মর্মমুরাকাবা : বাবা বুল্লেহ শাহ : সুফি কবিতা ও গান || মঈনুস সুলতান  

মর্মমুরাকাবা : বাবা বুল্লেহ শাহ : সুফি কবিতা ও গান || মঈনুস সুলতান  

কবিপরিচিতি : সুফি কবি বুল্লেহ শাহ-এর জন্ম পঞ্জাবের বাওয়ালপুর জেলার উচ নামক গ্রামে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, তাঁর জন্ম ১৬৮০ সালের দিকে। তাঁর পূর্বপুরুষরা অভিবাসী হয়ে উজবেকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে এসে পঞ্জাবে থিতু হন তাঁর জন্মের অনেক আগে। সামাজিকভাবে বাবা বুল্লেহ শাহ হিসাবে পরিচিত হলেও আদিতে তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল আব্দুল্লাহ শাহ কাদরী। তাঁর পিতা মোহাম্মদ দারউইশ ছিলেন ইসলামের অত্যন্ত পাবন্দ পুরুষ। তিনি মসজিদে মসজিদে ওয়াজ-নসিয়ত করে ঘুরে বেড়াতেন। পাঞ্জাবের এ লোকনন্দিত চারণ-কবি ছিলেন সুফি মার্গের মোর্শেদ হিসাবে খ্যাত শাহ ইনায়েত কাদরীর ভাবশিষ্য। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিরা হচ্ছেন — পাঞ্জাবের ওয়ারিশ শাহ (১৭২২- ১৭৯৮), সিন্ধের সুফি কবি আব্দুলওয়াহাব (১৭৩৯-১৮২৯), আগ্রার মশহুর উর্দু কবি মীর তকি মীর (১৭২৩ -১৮১০) প্রমুখ।

বাবা বুল্লেহ শাহ-এর কবিতার প্রকরণ‘কাফি’নামে পরিচিত, যা সে-জামানায় পঞ্জাবি ও সিন্ধি সাহিত্যে প্রচলিত ছিল। কাফি শৈলীতে রচিত কবিতা সচরাচর সংগীত হিসাবে গীত হয়ে থাকে। তাঁর কবিতাকে সাম্প্রতিক যারা সংগীত হিসাবে উপস্থাপন করেছেন — তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন — নসরত ফতে আলী খান, আবিদা পারভীন, ওয়াদ্দালী ব্রাদার্স ও ইউকেভিত্তিক পাকিস্তানি রকব্যান্ড জনুন।

লালন শাহ-এর মতো কবি বাবা বুল্লেহ শাহ ধর্মের ভিত্তিতে জাতিভেদপ্রথা মানতেন না। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান তরুণরা একজন শিখকে হত্যা করলে বাবা বুল্লেহ শাহ তার তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তাঁর আমলে কবি কিছু সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের অহিংস প্রক্রিয়ায় মীমাংসার উদ্যোগ নেন। তাঁর এ ভূমিকা অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখিত হয়ে থাকে।

এখানে বাবা বুল্লেহ শাহ-এর দুটি কবিতার ভাবতর্জমা উপস্থাপন করা হচ্ছে। কবিতাগুলো পঞ্জাবি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কারতার সিং ডুগাল। এগুলোর সূত্র হচ্ছে ইন্টারন্যাটভিত্তিক ওয়েবসাইট।

।।এক।।
তুমি হয়তো আমাকে কখনো করোনি খেয়াল
কিন্তু করজোড়ে যাঞ্চা করি তোমাকে হে দয়াল।

তোমাতে আমার সত্তা উৎসর্গীত
এসো আমার হৃদয়ে — দীনজনে হও প্রীত,

প্রান্তর ও বনভূমিতে খুঁজি তোমাকে
তোমার মতো হৃদয়বান আর পাবো কাকে,
পড়ে আছি বহুকাল জাগতিক পাঁকে
ডাকি তোমাকে বারবার হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে,
এসো প্রেমাষ্পদ — এসো আমার কাছে।

রাখালের কাছে তুমি গবাদি পশু — চারণভূমির
কিন্তু আমার কাছে তুমি তো নিখাদ বিশ্বাস,
তৃষিত আত্মায় সরোবরের সুপেয় নীর
প্রেমাষ্পদ — আমার কাছে আসো,
গোছাও অনিশ্চয়তার ত্রাস।

ছেড়েছি সংসার তোমার জন্য
হে শাহ ইনায়েত — তুমিই একমাত্র শিক্ষক,
তোমার ভাবনায় আমার আবেগ হয়েছে বন্য
তোমার ধ্যানে জলাশয়ের কিনারে হয়েছি বক।

প্রবেশ করে বুল্লাল জমকালো এক প্রাসাদে
তার জন্য অপেক্ষা করছে বিরাট পুরষ্কার,
সংসারে কী পেয়েছি আমরা — বাদ-বিসংবাদে
অধিক কথায় ক্ষয়ে গেছে সংলাপের ধার।

।।দুই।।
পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে থেকো না হে প্রিয়
বহুকাল ধরে চাক্ষুষ করার জন্য তৃষিত হয়ে আছি
আমাকে শুধু এক-পলকের দেখা দিও।

ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে মনে হয় ছন্নছাড়া উন্মাদ
চারপাশে লোকজন বিদ্রুপে হাসে — হায়,
এসে সে উজ্জীবিত করবে — দেবে প্রেম নিখাদ
শুধু এ প্রার্থনা কুরে কুরে আমাকে করে অসহায়।

তৈরি করা হচ্ছে তোমার ক্রীতদাসকে
উঠানো হবে তাকে নিলামে,
হে প্রেমাষ্পদ — এসো — উদ্ধার করো আমাকে
না-পাওয়ার আতঙ্কে আমি কাঁপি — নেয়ে উঠি ঘামে।

তোমার বৃক্ষের আমি এক বুলবুল
অন্য কোথাও উড়ে যাওয়ার সামর্থ নেই আমার,
আমার ভেতরে প্রেম ঘুরে ফেরে দুর্বার
হে প্রিয় — আমাকে করো না উন্মুল।

লুকিয়ে থেকো না হে প্রেমাষ্পদ পর্দার অন্তরালে
তোমার দর্শনপ্রয়াসে আমার তৃষ্ণা-যে অন্তহীন,
শুধু প্রতীক্ষা লেখো না আমার দুর্ভাগ্যদীর্ণ ভালে।

বুল্লেহ — বলো কে সে
বিচিত্র কোনো বান্ধব?
একহাতে তার পবিত্র কোরান
অন্য হাতে উপবীত,
তারপরও মশগুল হয়ে করো তুমি তাঁর স্তব।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you