বৈশাখ, ঝড়, রাত্রি … কিংবা আলামতবিহীন এককে ম্যাক

বৈশাখ, ঝড়, রাত্রি … কিংবা আলামতবিহীন এককে ম্যাক

কবে কোন বছরে এইটা আজ আর ইয়াদ নাই, নিশ্চয় নেটসার্ফিং করে এইসব তথ্য জোগাড় করে নেয়া যায়, কিন্তু অনুমান করি ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামটি রিলিজের বেশ কয়েক বছর পরে ম্যাকের একটা সোলো সংকলন বার হয়েছিল, ইয়াদ হয় অ্যালবামটির নাম ছিল ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’। এই একটাই এখন পর্যন্ত মাকসুদুল হকের একক গানের স্টুডিয়োসংকলন।  অবশ্য যদি আমরা ‘মাআরেফাতের পতাকা’ অ্যালবামটাকে ম্যাকের একক ধরি তাইলে আলাদা কথা। ‘মাআরেফাত…’ বোধহয় ম্যাকের সোলো বলা যাবে না, আবার ব্যান্ডের ব্যানারেও ‘…পতাকা’ বাইর হয় নাই, মাকসুদুল হক ‘গরিমা গানের দল’ নামে একটা আলাদা প্রোজেক্ট করেছিলেন, সেই ব্যানারেই ‘…পতাকা’ বাইর হয়েছিল, ওইটাও পরীক্ষামূলকভাবে একবার মাত্র। গরিমার বাংলা আবহমান লোকগানগুলো নিয়াই ছিল প্রোজেক্টটা। ক্যারেক্টারের দিক থেকে এইটা ম্যাকের অন্যান্য সংকলনগুলোর মতনই উল্লেখযোগ্য। মুর্শিদি আর ফকিরি ধারার আন্ডারকারেন্ট ‘ফোক’ গানগুলোই প্রোজেক্টেড হয়েছিল অ্যালবামে। একটু-দুটো স্থলে বৈষ্ণবধারা বাউলগানের ছোঁয়া থাকলেও সব মিলিয়ে এইটাকে যেন সুফি টিউনের দিকেই ঝোঁকানো মনে হয়েছিল। অ্যানিওয়ে।

এইখানে লক্ষ করবার মতো একটা ব্যাপার এ-ই যে, ম্যাকের এন্টায়ার ক্যারিয়ারে চর্বিতচর্বণ প্রায় নাই বললেই চলে। একই হিটের পুনরুৎপাদন বা পুনঃপুনরাবর্তনের ছিটগ্রস্ত বাংলা গানবাজারে ম্যাক এইদিক বিবেচনায় বিরল নিরীক্ষাব্রতী ছিলেন আগাগোড়া। আজও তা-ই, নিশ্চয়। কিন্তু সংগীতশিল্পী হিশেবে একটানা চারদশক পারায়ে আসার পরে এইভাবে একটু সমগ্রদর্শনের টোনে এই নিবন্ধে বাক্যালাপ চালানো যেতেই পারে বোধহয়। ম্যাকের সংগীতযাত্রা থামিয়া যায় নাই কিন্তু! নয়া অ্যালবামেরও মুক্তিধ্বনি কানে আসছে বেশ অনেকদিন হলো, সামনে আসে নাই এখনো, অচিরে নিশ্চয় নয়া স্টুডিয়োসংকলন পেতে চলেছি আমরা। তাছাড়া লাইভ কন্সার্টে, টেলিভিশনকামরায়, এবং ইউটিউবে ম্যাকের আওয়াজ হামেশা কানে আসে। অ্যাক্টিভ ম্যাক নিজের ধরনে। এনগেইজড, ইনভোল্ভড, মিউজিকেই।

ঠিক আছে। এইখানে শুধু ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ নিয়া আলাপ করা আমাদের ইচ্ছা। আলাপ মানে অ্যালবামরিভিয়্যু বলতে যা বোঝায় তা না; ক্যাসেটের ফিতায় অ্যালবামটা বার হবার পরে এই নিবন্ধকারের মতো অনেকেই কিনেছিল, শুনেছিল, হকের পয়লা ব্যক্তিক সংকলন। অভিজ্ঞতা আনন্দের হয় নাই।  কিছুদিন আগে এই ফিতার একটা কপি খুঁজিয়া পাওয়ায় এইখানে কেবল ফিতার ফ্ল্যাপ বা যাকে বলে ইনলে-কার্ড সংরক্ষণ করবার মানসে এই মুসাবিদা।

মাকসুদুল হক ‘ফিডব্যাক’-এ যে-ধারায় কাজ করছিলেন, ‘মাকসুদ ও ঢাকা’-য় এসে সেই ধারার অভিপ্রেত অংশটুকু গুছিয়ে এনে এবং দেশদুনিয়ার রাজনীতিবিজড়িত রোজকার বিবৃতিবাচকতাটাকেও নতুন দিনের সংগীতের নন্দনশর্ত ক্ষুণ্ণ না করে একটা আলাদা আদল দিতে পেরেছিলেন। ওই অবদানটুকু যুগান্তকারী বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? এবং আরেকটা কথা এ-ই যে, ম্যাকের মিউজিশিয়্যান সত্তাটা আদৌ গজদন্তমিনারবাসী ছিল না কোনোদিনই, মিউজিক করতে এসে মার্কেটের খোরাক তিনি নিজেকে হতে দেন নাই, আবার বাজার অস্বীকারও করেন নাই। নিছক গানের জন্য গান করেন নাই তিনি, লিপ্ত ও তৎপর ছিলেন সবসময় মিউজিকের বিপণন ও মিউজিশিয়্যানের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মেধাস্বত্বের হিস্যা আদায়ের আন্দোলনে। এতকিছু তৎপরতার পরেও ম্যাক গানসৃজনে হেলাফেলা করেন নাই, মিউজিক এবং লিরিক দিয়াই বিশেষত নব্বইয়ের তারুণ্যঝঙ্কৃত বদ্বীপের মন জয় করেছিলেন। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত ‘ফিডব্যাক’ ছিল বাংলাদেশের সেরা ব্যান্ড, ম্যাক আর ফিডব্যাক মিলে স্টেজথ্রব একটা কালের সাক্ষী তিরিশ-পার-করা আজকের মধ্যবয়সী লিস্নাররা।

“মাকসুদুল হক নামটি শোনা মাত্রই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে অদম্য এক প্রতিভাবান শিল্পীর মুখাবয়ব। বাংলাদেশে ব্যান্ডমিউজিকের জনপ্রিয়তার পেছনে যে-কয়জন তরুণ অসাধারণ অবদান রেখেছেন মাকসুদুল হক তাদের অন্যতম। বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীত নিয়ে যারা নানা মৌলিক ও নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন, মাকসুদ তাদের পথিকৃৎ। তার গানে সময়ের বাস্তবতার উপস্থিতি অত্যন্ত সরব লক্ষ করা যায়। এজন্য বহুবার তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বিতর্কের। ‘ফিডব্যাক’ ও ‘ঢাকা’ ব্যান্ডের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মাকসুদের নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা এখনো থেমে নেই। মূলত ব্যান্ডমিউজিক নিয়ে এসব সৃজনশীল পরীক্ষানিরীক্ষার কারণেই তাকে বারবার সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা বৈরী পরিস্থিতির।

অসম্ভব জনপ্রিয় এই শিল্পীর স্বপ্ন ও ভরসা এদেশের তরুণ প্রজন্ম। তাই সবসময়ই তিনি তরুণ সহযাত্রীদের নিয়ে এসেছেন পাদপ্রদীপের সামনে। তার এই প্রথম একক অ্যালবাম ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’-ও তরুণ লেখকদের গান তিনি কণ্ঠে নিয়েছেন, বাণী ও সুরের ব্যঞ্জনায় যা অবশ্যই আগের মাকসুদকে ছাড়িয়ে নতুন এক মাকসুদকে তুলে ধরবে শ্রোতাদের সামনে।”

উদ্ধৃত কথাগুলো ‘বৈশাখী’-র ব্লার্ব থেকে নেয়া হয়েছে। এই কথা-কয়টি লিপিবদ্ধ রয়েছে অ্যালবামপ্রযোজকের জবানিতে। সেলিম খান প্রেজেন্টস্ ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ লেখার নিচে একজোড়া প্যারাগ্র্যাফে এই শিল্পীপরিচিতি ছিল। তবে যে-দাবিটা বিজ্ঞাপিত হয়েছে এইখানে, সেইটা আখেরে এস্ট্যাব্লিশ হয় নাই। মাকসুদকে নতুন চেহারায় এইখানে পাওয়া যায় নাই যে এইটা তো বলা বাহুল্য, সন্দেহও হয়েছিল অনেকেরই যে ম্যাক কি সত্যিই এই অ্যালবাম করেছেন? ফ্লপ যদি কিছু থেকে থাকে ম্যাকের ক্যারিয়ারে, এই একটাই।

কিন্তু দুইটা গান তারপরও মন্দ হয় নাই, ম্যাকের নাম সেই দুই গানের সঙ্গে না-থাকলেও মনে হয় না আসত-যেত কিছু, মনে আছে এখনও সুরটুকু ওই দুই গানের, অন্য আটটা গানের একটারও সুর/কথা হারাম মনে নাই। টাইট্যল  গানটা, আর ‘ফিরে পেতে চাই’ ছিল আরেকটা। আরও বলা যায়, ‘বিষের ঊর্মিমালা’ গানটায় ‘ওগো ভালোবাসা’ টাইমের লিরিকের ছোঁয়া পাওয়া যায়। যা-হোক, মোটমাট দশটা গানের তালিকা আমরা ফ্ল্যাপ থেকে এইখানে টুকিয়া রাখি :

বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত : টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
কিভাবে বোঝাবো ।। কথা : মাকসুদুল হক ।। মূল সুর : বিদেশী গান ।। সংগীত : রুবাইয়াৎ ।। রিদম : ফান্টি
বাস্তবতা ।। কথা : স্বপন ।। সুর : চঞ্চল ।। সংগীত : তন্ময় ।। রিদম : ফান্টি ।। গিটার : সোহেল
গ্রীস্মের রোদেলা দুপুর ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত : টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
ফিরে পেতে চাই ।। কথা : দিদার ও মাকসুদ ।। মূল সুর : বিদেশী গান ।। সংগীত : রুবাইয়াৎ ।। রিদম : ফান্টি
সুজনা ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত : টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
বিষের ঊর্মিমালা ।। কথা : দিদার ও মাকসুদ ।। সুর : মাকসুদুল হক ।। সংগীত : তন্ময় ।। রিদম : ফান্টি ।। গিটার : সোহেল
কত সহজেই ।। কথা : সকাল ।। সুর ও সংগীত : বাসুদেব ঘোষ ।। কিবোর্ড : বাপ্পা মজুমদার ।। রিদম : লিটন ।। গিটার : সোহেল
অচিরেই ।। কথা : রনিম ।। সুর : তন্ময় ও মাকসুদ ।। রিদম : লিটন ।। গিটার : সোহেল
কোথায় হারালে ।। কথা : দিদার ।। সুর : মাকসুদুল হক ।। সংগীত : ঢাকা

অ্যালবামের কাভার ডিজাইন করেছেন সজল সমদ্দার, কম্পিউটার গ্র্যাফিক্স সম্পাদন করেছেন জুয়েল। আরও কতিপয় ইনফো রয়েছে, সেগুলো সবই ইংরেজি ভাষায় এবং হরফে, যেমন অ্যালবামনাম বাংলার পাশাপাশি ইংলিশেও রয়েছে, এমনকি শিল্পীনাম ছাড়াও ‘ইটস্ ব্রিলিয়্যান্ট’ কথাটাও লেখা আছে দেখব প্রচ্ছদে, এখন তো কৌতুক লাগে এই জিনিশ দেখতে, লেগেছিল তখনও, ম্যাকের আগের অ্যালবামগুলোর একটাতেও এই জিনিশ দেখি নাই, সম্ভবত এই অ্যালবামের নকশা বাজারসর্দারের হাতেই হয়েছিল। অনুমান মিথ্যা হবার চান্স অল্পই। যাকগে, যে-বাড়তি ইনফোগুলো ছিল বিলো-অ্যালাইনমেন্টে, সেগুলো হচ্ছে :

রেকর্ডেড অ্যাট সাউন্ড গার্ডেন স্টুডিয়ো ইন ডিজিটাল সিস্টেম। সাউন্ড : আসাদ অ্যান্ড দূরে। মিক্সিং : মবিন। দ্য স্যং ‘কত সহজেই’ ইজ্ রেকর্ডেড অ্যান্ড মিক্সড অ্যাট ডিজিটোন স্টুডিয়ো। হার্ড ডিস্ক মাস্টারিং : ডি.কে.এম. শান্ত। ফোটো : বিপ্লব, ইকবাল। অ্যালবামটা প্রযোজনা করেছে সংগীতা, বাজারজাতও করেছে তারাই। ঠিকানা আছে : সংগীতা কমপ্লেক্স, ৩৭ পাটুয়াটুলী, ঢাকা; সংগীতা প্লাস, ১৬০ নবাবপুর রোড, ঢাকা।

মাকসুদুল হকের একক নিয়া আগ্রহ ছিল অনেকেরই, কিন্তু মুক্তির পরে আগ্রহের বাতি নিভিয়া যায় দপ করে। ম্যাকের এই একটা অ্যালবাম ছাড়া আর কোনো অ্যালবামের ক্ষেত্রে এমন কথা বলা যাবে না। এমনকি মিক্সড নামে যে-মচ্ছবগুলো ওই-সময় ছিল এবং সেগুলোর যে-কয়টাতে ম্যাক পার্টিসিপেইট করেছেন কোথাও অবনমিত মানের ম্যাককে দেখানো যাবে না। কাজেই, ইন ওয়ান সেন্স ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ ম্যাকের আলাদাভাবে মেনশন করার জোখা অ্যালবাম। বৈশাখ, ঝড়, রাত্রি … শিরোনামে আছে শুধু, শরীরে গরহাজির।

লেখা : জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you