গিটার, গুল্লি, মুরুব্বি অ্যান্ড বাংলা ঝাক্কি || মাহবুব শাহরিয়ার

গিটার, গুল্লি, মুরুব্বি অ্যান্ড বাংলা ঝাক্কি || মাহবুব শাহরিয়ার

ঝিকিমিকি শহরে
কত গল্প জ্বলে রে …

ডিস্টর্টেড গিটারগুলা ঘ্যা ঘ্যা ঘ্যা কইরা বাজা শুরু হইছে আমার জন্মের আগেই এই শহরে। যুদ্ধফেরত  এক সৈনিক যখন তার বাড়ির পাশের রেললাইনে দেখে ভাতের জন্য কোনো মা তার সন্তানরে বেচতেছে তখন ওই রকযুদ্ধের শুরু। মুরুব্বিদের সাথে বোঝাপড়ার বাহাস, যুবকের কান্ধে গিটার নিয়া যুদ্ধ আর রক নামক এক দৃশ্যরে  রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত এক দেশে ইস্টাবলিশ করার চেষ্টায় জারি রাখা অবিরত।

যার নাম গুরু, ওই-যে পাশের মহল্লার কিংবা পাশের বাড়ির বড়ভাই, চাচা কিংবা সবার ভাই টাইপের পরোপকারী এক সদয় ক্যারাক্টার আজম খান। অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট মানে তো যুদ্ধের পরের ক্ষতবিক্ষত এক মাঠ যেখানে বোমারু বিমানের গর্ত আর নির্দয় ট্যাঙ্কের চেইনের আঘাতের ঘায়ের মাঝে কাদার পুঁজ। সেই মাঠের ধার ধরে হেঁটে-যাওয়া রেললাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে-থাকা আজম খানের দিলও নীরব যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রেমিকার মতো কিংবা মায়ের মতো দেশকে এক অপমানিত নারীর বেশে দেখে। যেই দেশের খোয়াব স্টেনগান হাতে গেরিলা অ্যাকশনে দৌড়ানোর কালে দিলের পর্দায় প্রোজেকশন হইত সেই দেশের ক্ষতরে সারায়া তোলার সাধনায় শুরু হয় রকযুদ্ধ।

‘অস্ত্র জমা দিছি ট্রেনিং জমা দেই নাই’ — এমনই তো ভাব ব্যাজবিহীন আধাসামরিক সাজের সেনাপতির, আজম খান সেই নাম। সেনাপতির সহযোদ্ধা লাকি আখন্দ, হ্যাপি আখন্দ, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীররা। এক নতুন দিনের দিকে আগায়া যায় তারা মশাল হাতে আর পিছে পিছে রওনা দেয় মাকসুদুল হক, নিলয় দাস, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্, হামিন, শাফিন আর তাদের পরের  সৈনিকেরা কাতারে কাতারে।

রকফ্রন্টের বোমারু বিমান, অটোমেটিক মেশিনগান, গ্রেনেড কিংবা মাইনের আঘাত পেয়ে কেউ সরে যায় আর কেউ চলে যায়। ফ্রন্টে রয়ে যায় বীরের বেশে কিছু উদ্যম যৌবনের প্রতীক, বাধাবিপত্তির সমস্ত ব্যারিকেড আর বাঙ্কার গুঁড়িয়ে যারা বিজয়ের ঝান্ডা হাতে আগায়া আসে আশির দশকের স্বৈরাচার পার হয়ে নব্বইয়ের এক গণতান্ত্রিক দৃশ্যপটের দিকে।

আমার অল্প জ্ঞানের ভাণ্ডারে এইটুক রকসিনের ইন্ট্রো না দিলে লেখাটা হয় না বোধ করেই এই শুরুর বয়ানটুকু। পঁচাশি সালে জন্ম-নেয়া এই আমি নব্বইতে পাঁচ বছরে পা দিয়া স্কুলে ভর্তি হইতে হইতে বাংলা রকসিন এক টিনেজ বালক হয়া মোচ উঠা শুরু করল আর আউট-ল্যদের মতন মাথাচাড়া দিয়া উঠল সমস্ত ডাবল বেজ ড্রাম আর ইলেক্ট্রিক ইন্সট্রুমেন্টরা। চিনতে পারলাম রকস্ট্রাটা, ওয়ারফেজ, লিটল রিভার ব্যান্ড, ফিলিংস, ফিডব্যাক, নোভা, সোলস, সাডেন, চাইম, ইভস আর আমার মাথায় এখন যাদের নাম আসতেছে না তারা।

একটা লাল স্যানিও টেপ রেকর্ডার তার সাক্ষী আর পরবর্তীতে যোগ দেয় সনি কোম্পানির যুগান্তকারী এক আবিষ্কার ওয়াকম্যান আমার এই মিউজিক জার্নিতে। বাড়ির পশ্চিম পাশে ন্যাশনাল টিমের বাস্কেটবলপ্লেয়ার জায়েদী ভাইদের ডেকসেটের ফ্যুল সাউন্ড আর পুবদিকে একবাড়ি পরে মামাতো ভাইয়ের ডেকের ফাইন টিউনড ডেকসেটে বাইজা চলে যত মিক্সটেপ। আমার ভিতরে নড়েচড়ে এক রকমিউজিকের ভ্রুণ।

মর্নিং শিফটের ক্লাস শেষ কইরা সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরলে গোসলের পর এক ছাদ পার হয়া মামার বাড়িতে চইলা যাওয়া আর দুই মামাতো ভাইয়ের ঘরে থাকে-থাকে সাজায়া রাখা মিক্সটেপের গায়ে গানের নাম পইড়া মুখস্ত করা। ম্যাক্সেল, টিডিকে, সনি যখনই যেই টেপ ডেকে গতর এলায়া দিয়া গান বাজানো শুরু করত তার প্লেলিস্ট পইড়া মনে রাখার চেষ্টা করতাম কোনটা কোন গান। পাশাপাশি সাপোর্টিং-এ থাকে দুই ভাইয়ের ঘরে লাগানো সমস্ত বিশাল সাইজের পোস্টার। এসি ডিসি, মেটালিকা, গান্স এন রোজেস আর পিঙ্ক ফ্লয়েডের এত আকর্ষণীয় হাতছানির মাঝে বিরাজ করে এক মুকুটহীন রাজার পোস্টার, আমার সব কাইড়া নেয় আজম খান। অভিমানী এক রাজপুত্র, মাইক হাতে এক প্রোফাইল ছবি সাদাকালো নিরাড়ম্বর ডিজাইন। তবুও রাজার রোশনাই আমার ভিতরে সবাইরে সাইডে চাপায়া নিজের সিংহাসন পাইতা দিয়া বইসা যায়। অভিমানী আজম খান ইন হলিউড আর আশেপাশে যত রকসৈনিকের পোস্টারের দিকে তাকায়া দিনগুলা কী সুন্দর কাটত!

একটা গানের কথা এর মাঝে খুব মনে দাগ দিলো, আজম খানের ‘জীবনে মরণ কেন আসে রে?’ এই গানটা আমার ভিতর এক অন্যরকম বোঝাপড়া দিয়া রাইখা গেছে এখনো পর্যন্ত। এক সময় মামাতো ভাইরা না থাকলেও এই ক্যাসেটটা বাইর কইরা নিজেই চালায়া দিতাম কোনো কোনো নীরব দুপুরে কবুতরগুলারে খাওন দিতে দিতে। এই প্রথম আমার মিউজিকের নজরবন্দী হওয়া আজম খানের কাছেই।

এর পরের রকমিউজিকের শকটা আমার আসে জেমসের কাছ থেকা, নামে আর কামে দুইভাবেই যার ফিলিংস আলাদা। যার ব্যান্ডের নাম ‘ফিলিংস’ তার কাছে তো জীবনের মানে এক অনুভূতির স্রোতের মাঝে নিজেরে এলায়া দিয়া নৌকার পাল তুইলা এক পাহাড়ের পাদদেশে গিয়া কোনো বিশাল এক বোল্ডারের উপর শুইয়া রোদ পোহানো জীবন। এইখানেও তার সেনাপতি আজম খানের পিছু নেয়া অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে, ‘স্টেশন রোড’ গানের দিকে তাকাইলে তার উজ্জ্বল এক উদাহরণ পাওয়া যায়।

মিউজিকের পাশাপাশি পোস্টার কালচার এর মাঝে আরেক কাল্ট হাজিরা দেয় সেই শৈশবে, তখনো যা আমার কাছে বোধগম্য না। এক অর্ধনগ্ন নারীর চিত্রকর্ম, ১ ফুট বাই ৪ ফুট এক তেলরঙ ফ্রেমে বাঁধাই করা। ঘরের এক কোণায় কিঞ্চিৎ অন্ধকারে আব্রু ঢাকার চেষ্টারত সেই নারী। কোনো সাধারণ চিত্রকর্ম ছিল না সেইটা, শুধুমাত্র দুইটা শব্দের কারণে সেই পেইন্টিংস আমার কাছে এক রকমিউজিক ফ্যানের স্মৃতি। বাম কোণায় লেখা ছিলো ‘প্রিয় আকাশী’। সেইসব দুপুর আর আকাশী, কখন জানি কার কাছে সিস্টেইন চ্যাপেল পার হয়া সেইসব চিঠি পৌঁছায়া যাইত। এখনো খুঁজি, কার কাছে যাইত সেইসব ঠিকানাবিহীন চিঠি।

সময়টা ৯২ সাল সম্ভবত, মহল্লায় সাজ সাজ রব বলতে যা বোঝায় তাই-ই। মহল্লার সব উঠতি ভাইব্রাদার কেমন জানি হন্তদন্ত, হাবেভাবে খুব পেরেশান। সবাই দৌড়ের উপরে, কিছুই বোঝা যাইতাছে না। বিকালের দিকে বাসার থেকা একমিনিটের হাঁটা রাস্তায় লবণের গোডাউনের পাশে গিয়া দেখা গেল রাস্তা আটকায়া এক বিশাল স্টেজ বানায়া ফালাইছে আর বড় বড় স্পিকার লাগাইতাছে। প্রথমে খালি চায়া থাকা আর বোঝার চেষ্টা চালায়া যাওয়া এইটুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা লাগে বয়সের কারণে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা লাগে নাই সেদিন, সম্ভবত আসরের নামাযের পরেই কয়েকজন কালো গেঞ্জি পরা যুবক স্টেজে উইঠা যায় গিটার হাতে আর কেউ তার নিয়া নাড়াচাড়া করতে থাকে স্টেজের এইদিক থেকা ওইদিকে আর আমার কাছে ক্লিয়ার হয়া যায় যে মিক্সটেপে শোনা সেইসব ইলেক্ট্রিক মিউজিকের ফিজিক্যাল এক্সিবিশন আজকা আমার চোখের সামনে ডেকসেটের ইকুয়ালাইজিং ছাড়াই কানে ঢুকব, এর নামই কন্সার্ট।

এক বিশাল ব্যাপার! রাস্তা আটকায়া স্টেজ বানায়া প্রস্তুতি চলতাছে এক যজ্ঞের। কালো গেঞ্জি যেন এক রেভোলুশনের ইউনিফর্ম, এখনো সেই রেভোলুশনের ইউনিফর্মই দেখি আন্ডারগ্রাউন্ড কন্সার্টে গেলে।

এই সেই ব্যান্ড নোভা, আমার জীবনের প্রথম এক্সপেরিয়েন্স ‘পদ্মার পারে ঝিল শালুকের খেলায়, তোরা দেখবি কে কে আয়’ — এই এক গানের পরেই বাসা ফেরতের দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় মন আমার সেই সাত বছর বয়সের প্রথম রক কন্সার্ট দর্শনে।

কন্সার্ট দেইখাই আমার রকস্টার দেখা শেষ হয়া যায় নাই সেই সময়, সৌভাগ্যবশত নোভার চারু আর ফজল দুইজনই আমার এলাকার বড়ভাই হওয়ার সুবাদে এর পর থেকা আমি তাগো নজরে রাখি। আমার বাসার থেকা বেশি হইলে দেড়মিনিটের রাস্তা চারু আর ফজল ভাইয়ের বাড়ি, স্পষ্ট মনে আছে তাগো বাড়ির পাশে একটা বাকরখানি রুটির দোকান আছিলো আর আমি সেইখানেই প্রত্যেকদিন রুটি আনতে যাইতাম সকালে। চারু ভাইরে দেখতাম প্রায়ই ছোট মসজিদের কোণায় জিন্সের হাফপ্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পইরা দাড়ায়া থাকতে আর মাঝে মাঝে গিটার হাতে বাড়ির সামনে দিয়া যাইতে। এর মাঝে আরেকজন তখন মিউজিক নিয়া মাতামাতি করতাছে এলাকায়, চারু ভাইদের বন্ধু হওয়ার সুবাদে তারও হাতে গিটার নিয়া হাঁটাহাঁটি দেখি। উনার সামনের চুল কিঞ্চিৎ টাক তখনই, কিন্তু পিছে ঝুঁটি করত চুল বড় রাইখা। কোনো কোনোদিন বিকালে দেখতাম আমার বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বইসা গিটারও বাজাইতেন। এই চুল ঝুঁটিওলা ধোলাইখালের দুষ্টু বড়ভাই পরবর্তীতে হইলেন দুরে, ইসা খান দুরে অ্যান্ডারগ্রাউন্ডের এক মহারথীই যারে বলা যায়।

সেই নব্বই দশকের গোড়ার পুরান ঢাকার দুপুরগুলা তখন নীরব, আর্কিটেকচার আর কালার এক স্যুদিং অনুভূতি জাগায় মনে সবসময়। নীরব দুপুরগুলায় তখন ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা না আইলেও আইতো কটকটিআলা আর মাটির মটকায় বরফের পানিতে ডুবাইনা নারিকেল-দেয়া আইসক্রিম, অপেক্ষা করতাম এইসব মুখরোচক ‘আনহাইজেনিক’ জিনিসপাতি খাওয়ার জন্য। নীরব দুপুরের ক্রাইমপার্টনার স্যানিও টেপরেকর্ডার তখন কান্ধে উইঠা গেছে, স্যানিও ছাড়া আর কিছু নাই লাইফে।  দাদাভাইও তখন ক্যাসেট কিনা শুরু করছে, আমিও সেই ক্যাসেটের ভাণ্ডার হাতে নিয়া চালাইতাছি রকমিউজিকের ডিস্টর্শনের ওয়েভ। এর মধ্যে হাতে পাওয়া গেল ওয়ারফেজের অ্যালবাম ‘ওয়ারফেজ’। আমার সামনে চিচিং ফাক-এর মতন এক নতুন লিরিকাল ঝড় আইলো, আমি উড়তে থাকলাম।

‘একটি ছেলে হাঁটছে একা
ঝর্ণাধোয়া ছোট্ট পথে
বৃষ্টিভেজা হালকা রোদে
জানে না জীবন কাকে বলে’

এই লুপের মধ্যে আমি আমার প্রাচীন নগরের নীরব দুপুরে হারায়া যাইতে শুরু করলাম একা একা। নিজেরে নিজের ছায়ার সাথে একা একটি ছেলে হয়ে হাঁটা শুরু করলাম জীবনের অলিতে গলিতে।

আস্তে আস্তে ‘রকস্ট্রাটা’ শুনলাম। এরপর ‘চাইম’, ‘সাডেন’, ‘অবসকিউর’ আর কন্টেম্পোরারি যত ব্যান্ড আছে মোটামুটি বয়সের সাথে সাথে কানে আইতে থাকল আর যারা ভাল্লাগলো তারা কানেই বাইজা রয়া গেল।

লিটল রিভার ব্যান্ড এলআরবি ততক্ষণে আইয়ুব বাচ্চুর সুইং-এ উত্তাল ডবল অ্যালবামের ঝড়ো হাওয়ায়, চারিদিকে বাজে মাধবীর ইলেক্ট্রিক টিউন। ক্যাসেটের দোকানে দোকানে এলআরবি-র পোস্টার সাঁটানো এক সিনারিওর দিন গুজার হয়া যায় আর নগরের প্রেমিকরা প্রেমিকাগো দিকে স্কুলের সামনে, গল্লির মাথায়, ক্যাসেটের দোকানে চোখে গগলস লাগায়া তাকায়া থাকে আর দিল উজাড় করা গলায় গায় ‘সেই তুমি’ কিংবা ‘মাধবী’। কিন্তু কেউই খেয়াল করে না সেই রেললাইনের  বস্তিতে জন্মেছিল যে-ছেলে, তার গল্প আবারও ফিরা আইতেছে এলআরবি আর ফিলিংসের গানের লিরিকে। পোস্ট-ওয়ারের সেই হতাশার নতুন গণতান্ত্রিক রূপ এইবার জেমস্ আর আইয়ুব বাচ্চুর ভোকালে সোচ্চার। গণতান্ত্রিক দোলনায় দোলা দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে জন্ম নেয় অন্যায়ের বিপক্ষে বাজনাদার ব্লুজ, রক, মেলো-রকের মতো মিউজিক।

‘রাজাকারের তালিকা চাই’ — নোভার এই গান একদিন ইংরেজি হয়া ফিরা আইসা শক দেয় আমারে ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’ নামে। আমি অনেক কষ্ট পাই, আর এই কষ্টের মধ্যে দিয়া আমি চিনি ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ নামের ব্যান্ডটারে। এই বাংলা রক মিউজিকের সাথে বোঝাপড়ার মধ্যেই চিকনে বিদেশি রকের জীবাণুও ঢোকে আমার মাঝে কিন্তু বাংলা রক তার সলিড বোল্ডারগুলারে দাবায়া রাইখা দেয় আমার অন্তরায় চিরতরে।

রকমিউজিকের এই সংসারে বাংলা রকের আরেক খুঁটির নাম না লইলে বেঈমানি হয়, এই বেঈমানি রকমিউজিকের শ্রোতা হিসাবে করলে ইজ্জত থাকে না। ‘মাঝি তোর রেডিও নাই’ — এই কথা আর কেউ কয় নাই মনে হয়। এই ঝড়-জল আর বন্যার দেশে গভীর সমুদ্রের মাঝিগো কথা কেউ ভাবে নাই ‘ফিডব্যাক’ ছাড়া। বাংলা রকে র‍্যেগে ধারার ছন্দ নিয়া হাজির এই ব্যান্ড এক ভিন্ন ধাঁচের স্বাদ দিছে সবসময়ই। ‘ফিডব্যাক’ আমার সেন্ট ফ্রান্সিস কিংবা বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের প্রেমিকাগো চিঠি পাঠানোর ব্যান্ড। মেলায় দেখা সুন্দরী আর কুঞ্জবাবু লেনের গলির মোড়ে দাড়ায়া আমার বন্ধু সাকিলের পাশের বাড়ির সুন্দরী মৌসুমিরে দেইখা গাওয়া ‘মৌসুমি, কারে ভালোবাসো তুমি’। মৌসুমির হয়তো বিয়েশাদি হয়ে আজকে স্কুলে যায় কিন্তু ফিডব্যাকের সেই মৌসুমি এখনো সাকিলের গলায় শুনি আমি বাকরখানির দোকানে দাড়ায়া।

১৯৯৫ পর্যন্ত একই রুটিনে চলা সেইসব দুপুর কিংবা স্কুলপরবর্তী সময়গুলাতে শুধুই মিক্সটেপে আমার কানে বাজতে থাকে আজম খান,  এলআরবি, ফিডব্যাক আর ফিলিংস।

রক, হার্ড রক, মেলো রক, গ্ল্যাম রকের নব্বই দশকে প্রেম-অপ্রেম আর চাওয়া-পাওয়ার অপেরায় মশগুল থাকার মাঝখানে মাঝে মাঝে নরম এক দুখী বাউলের মতন শুনি ‘চাইম’-এর গান। ‘নাতি খাতি বেলা গেল’ থেকা শুরু হয়া ‘কোনো কারণেই’ যে প্রেমিকারে ফিরাইতে না পারার দুঃখ সেই দুঃখবিলাসী গান, হয়তো সেই মোবাইলবিহীন সময়ের যুবকের দুঃখের কান্ডারি হয়া রয়া যায় সেইসব গান।

এর মাঝে মাকসুদের ফিডব্যাকছাড়া হয়া যাওয়া আর ‘মাকসুদ ও ঢাকা’-র জন্ম নেয়া বাংলা রকের ইতিহাসে। ‘…নিষিদ্ধ’ নামের এক অ্যালবাম নিয়া নতুন এক রূপে মাকসুদরে পাওয়া যায় তার রাজনৈতিক ভাষায়। নতুন কিছু শুনি ‘গণতন্ত্র’ নামক গানে, যুদ্ধে যাওয়ার ডাক পাই, নিজের মৃত্যুদণ্ডের দাবি শুনি আর খোদার আরশে রাখি বিচার পাওয়ার আশা।

‘তোরা দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে দে
মোদের আবারো যুদ্ধে যেতে হবে’ —

এই দুই লাইন শুনলেই মনে হয় কবি হুমায়ুন কবির আর আহমদ ছফার ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে হেলাল হাফিজের কবিতার লাইন চিকা মারার কথা — “এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”। ১৯৯৫ সালে সেই হতাশা আর প্রেমের লিরিকাল জার্নির মাঝে ‘নিষিদ্ধ’ এক সোচ্চার পোস্টার কিংবা দেয়ালের চিকার মতো দলিল হয়া থাকে ‘নিষিদ্ধ’।

কন্সার্ট কন্সার্ট

প্রথম কন্সার্ট তো এক-লহমা কিছু কালা কালা গেঞ্জিপরা রকস্টাররে দূর থেকা এক শিশুর চোখে দেখা, এরপর অনেক বছরের না পাওয়া। ঈদের মৌসুমে ইত্তেফাকের টিভির অনুষ্ঠানসূচি থেকা খুইজা বাইর করা ব্যান্ড শোর সময়কাল আর সাদাকালো ফিলিপস টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা ব্যান্ড শোর প্রতীক্ষায়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সেটে ধারণ করা সেইসব লিপ সিঙ্করেই লাইভ মনে কইরা নেয়ার সময়গুলা অতি মধুর আর উত্তেজনাময়। মায়ের কাছে জিদ ধরা বড়ভাইয়ের সাথে কন্সার্টে যাওয়ার লেগা, তবুও দিনশেষে লাল স্যানিও টেপরেকর্ডারের ফিতা প্যাচায়া যাওয়ার পর ইকোনো ডিএক্স দিয়া ফিতা পুনরুদ্ধার আর রিওয়াইন্ড কইরা চালানো দুপুর।

কন্সার্টের টিকিট পাওয়া যাইত বেইলি রোডের সুইসে, ধানমন্ডির লা বাম্বায়, এলিফেন্ট রোডের বিগ বাইট আর মাঝে মাঝে লক্ষ্মীবাজারের আহমেদ জেনারেল স্টোরে। কন্সার্টের পোস্টার দেখলেই মনটা উড়ুউড়ু করত, কবে যামু কবে যামু। একে একে সেই হতাশার দিন যায় আর নতুন দিনগুলা সম্ভাবনা নিয়া আস্তে আস্তে আগায়া আসে। ১৯৯৯ কিংবা ২০০০ সালের কোনো-এক ডিসেম্বরে আমার প্রথম আনুষ্ঠানিক কন্সার্ট দেখতে যাওয়া আর্মি স্টেডিয়ামে। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হয় কন্সার্ট মিস না করার পণ। সেইসব কন্সার্টে কত মারামারি আর কত স্টান্টবাজি! পুরান ঢাকা থেকা দুপুর ২টার সময় বেবিট্যাক্সি কইরা রওনা দেয়া আর্মি স্টেডিয়ামের দিকে আর সেই ভরদুপুরের রোইদ্যে লাইনে দাড়ায়া থাকা সময়। কারো মোজায় সিগারেট, কারো ক্যাপের ভিতর, কারো হুডির মাঝে নিষিদ্ধ প্রেমফুলের একটু ছোঁয়া।

কন্সার্টে ঢোকার আগেই লাইনে দাড়ায়া কত মারামারি, কখনো পুলিশের লগে আবার কখনো লাইনে দাড়ানের সিরিয়াল নিয়া অন্য কোনো গ্রুপের লগে। কত কন্সার্টের উন্মাদনা, কত স্মৃতি সবই রয়া যায় এই নিউরনে। কিছু কিছু স্মৃতি ভোলার না, ভোলা যায় না। আর্মি স্টেডিয়ামে একবার এক কন্সার্টে জেমস্ উঠল স্টেজে, তখন বাজে বিকাল চারটা, সূর্য হেইলা যাইতাছে পশ্চিমে আর চারদিকে জ্বইলা উঠল সব নিষিদ্ধ প্রেমফুলের প্রদীপ। ধোঁয়া আর ধুলায় চারদিক পেরেশান। এর মধ্যে জেমস্ উঠল তার ‘দুখিনী দুঃখ কোরো না’ অ্যালবামের কভারের ছবির সেই ইউনিফর্মে। সাদা পাঞ্জাবি, জিন্স, আর বুট পায়ে সবার দিলের জিকির আর ফিকির-এ খালি জেমস্। ছোট তখনো আমি, হঠাৎ এক ফানাফিল্লা রকাররে দেখলাম একটা গিটার হাতে সামনের বাঁশের বেড়া বায়া উইঠা একহাতে এক গিটার নিয়া তাকায়া আছে স্টেজের দিকে। তার গিটারে লেখা ‘নওগাঁ থেকে মোসাদ্দেক’ আর তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, জিন্স আর বুট। এমনও তাইলে রকফ্যান হয়!

রকস্টারের ফ্যানশাসন এক মিরাকল, সবাই পারে না। সবার দ্বারা সম্ভব না এ কাজ। যেমন জেমস্ যখন “তোমরাই আমার জান তোমরাই আমার প্রাণ” বইলা নিজের দাবিটা আদায় কইরা নেয় তার ভক্তের কাছ থেকা, সেইটা আর কেউ পারে নাই কিংবা পারব না।

২০০২ সালে আর্মি স্টেডিয়ামে আরেক কন্সার্টে জেমস্ উঠার সাথে সাথে দর্শক সামনের দিকে এমন এক চাপ দিলো যে বাঁশের বেড়া মাটির সাথে কথা কওয়া শুরু কইরা দিলো। বাঁশের কোনো অস্তিত্ব নাই। সিকিউরিটি হিমশিম খাইতে খাইতে মাইক নিয়া জেমস্ তার মাতাল গলায় শাসনের সুরে ভক্তকুলরে কন্ট্রোল কইরা ফালাইলো। সব আবার আগের জায়গায়। বাঁশের বেড়াও আবার ফিরা আইলো। এমন মাতাল কন্সার্টে যখন জেমস্ জিকির গানটা শুরু করত, ‘ইয়া রব ইয়া রব বলে ইয়া রব ইয়া রব’ সে এক গগনবিদারী আহাজারি তার মওলার কাছে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে পুরা এক স্টেডিয়ামভরতি দর্শক যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেরে উৎসর্গ কইরা দিতেছে জেমসরে মিডিয়াম বানায়া। সে এক ফানাফিল্লা পরিস্থিতি!

সেইদিনই বাংলা রকের ঈশ্বর আজম খান সবার শেষে স্টেজ মাতাইতে উঠল তার সাথে আট/দশ জন বডিবিল্ডার নিয়া, সে-দৃশ্য ভোলার মতো না। গুরু আজম খান একেক গানে একেক রঙের শার্ট আর পিছে তার দেহরক্ষীর মতন বডিবিল্ডারদের শোডাউন। কে পারে এমন শোডাউন করতে, শোডাউন দিতেও গুর্দা লাগে — যে-গুর্দা একমাত্র গুরুরই ছিল। প্রণাম গুরুর চরণে, শত সহস্র প্রণাম রইল।

২০০০ সালে বাংলা রকের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের শুরু। বাংলা রকের প্রথম ট্যালেন্ট হান্ট বেনসন এন হেজেস স্টার সার্চ। স্টার সার্চ থেকাই বাংলা রক স্টিলার, বাংলা, কমল, সাবকনশাস, ওয়াটসন ব্রাদার্স-এর মতন সম্ভাবনাময় ব্যান্ড পাইলো যারা এই বাংলার রকমিউজিকের মশাল আরেকবার ফু দিয়া জ্বালায়া দিলো।

বাংলা নিয়া আইলো ফোক ফিউশনের মতন নতুন টেস্ট, মরমি ধারার ফোকের সাথে রকমিউজিকের এক ব্লেন্ড আর সাবকনশাস দিলো ফাংকি এক রকের স্বাদ। অ্যাম্পফেস্ট নামে শুরু হইল নতুন এক রক ইভেন্ট, সারা দেশের নানান জায়গায় রকমিউজিকের জয়জয়কার-এর ব্যানার নিয়া হইতে থাকল একের পর এক কন্সার্ট। সাউথ এশিয়ার নানান রকব্যান্ড এই ইভেন্টে অংশ নিয়া আরো জমায়া তুললো পুরা রক ঘরানা।

নিজের দেখা রক মিউজিশিয়ানদের মাঝে যেমন সেই নব্বই দশকের গোড়ায় ছিল চারু, ফজল, দুরেদের মতন মিউজিশিয়ান তেমনি আমার কাছ থেকে দেখা কয়েকজন মিউজিশিয়ানের বাইড়া-ওঠাও দেখলাম নিজের চোখে। যেহেতু ঢাকার রকমিউজিকের আঁতুড় ঘর আমার স্কুল মানে সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল সেহেতু আমার মিউজিকের সাথে বাইড়া ওঠার ধরন আলাদা। এই স্কুলের ছাত্ররাই ষাটের দশকে ‘উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার’-এর মতন ধ্রুপদী রকমিউজিক কইরা গেছে এই রকের ইতিহাসে। আমার দেখা এইসব মিউজিশিয়ানদের মধ্যে তিনজন আমার স্কুলের জন বড়ভাই এনায়েত, রনি আর মল্লিকভাই।

মল্লিকভাই আগাগোড়া রকের এক জিন্দা মূর্তি। উনারে প্রথম পাইলাম স্কুলের অ্যাক্টিভ স্কাউটলিডার হিসেবে, স্কুলের স্কাউটদের পদচারণা মানেই ড্রামসের শিক্ষায় মল্লিকভাই স্কিন প্যান্টপরা বড় বড় চুল আর পায়ে লেদারের চোখা বুট আর কোনো হেভি মেটাল ব্যান্ডের টিশার্ট গায়ে, ঠিক যেন লক্ষ্মীবাজার দিয়া হাইটা যাইতাছে পুরান ঢাকার স্ল্যাশ (গানস অ্যান্ড রোজেস)। খুব ভাল্লাগতো এই রকাহোলিক বড়ভাইরে দেখতে। আরেক শান্তশিষ্ট মিউজিশিয়ান দেখতাম তানভির দাউদ রনি ভাইরে, মল্লিকভাই আর রনিভাই একই ব্যাচে পাশ করছিল স্কুল থেকা। এই দুই ক্লাসমেট দুইরকম কিন্তু দুইজনই মিউজিশিয়ান। রনিভাই স্কুলের অনুষ্ঠানে দীলিপ স্যারের সাথে গানও করত, কিবোর্ড বাজাইত। আর এদের পরে আরো কাছ থেকে দেখা এনায়েত। এনায়েতভাই ফুটবল খেলতে নামত — সাদা টিশার্টের পিছে লেখা AXL ROSE, আরেক শান্তশিষ্ট বড়ভাই। উনার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার কারণে উনার পাতলা খান লেনের বাসায় যাওয়া-আসা হইত তখন। ঠান্ডা প্রকৃতির এক বেইজিস্ট। উনাদের প্র্যাক্টিস চলত মল্লিকভাইদের বাসায়, সেটাও পাতলা খান লেনেই।

এনায়েত ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমার সাথে (সব বলা সম্ভব না)। একটা স্মৃতি মনে পড়ে, প্রায়ই দুপুর বারোটার দিকে উনি ঘুম থেকা উইঠা একটা জিন্সের হাফপ্যান্ট (ফুলপ্যান্ট কাটা) আর টিশার্ট পইরা বাকরখানির দোকানে আইসা দোকান থেকা চা আনায়া বাকরখানি চুবায়া খায়া নাস্তা করতেন। এই এনায়েত ভাইই পরবর্তীতে ২০০৩ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেস স্টার স্টার্চে বেস্ট বেইজিস্টের পুরস্কার ছিনায়া আনলেন।

দূর থেকা দেখা রকস্টার তো অনেকেই আছেন, সবার কথা লেখুম না শুধু একজন বাদে। সেই একজন গুরু আজম খান, বাংলা রকের হুজুরে আলা। উনারে কাছ থেকা দেখা দুইটা স্মৃতির প্রথমটা গুলশান ইউথ ক্লাবে। কন্সার্টের আগে গ্রিনরুমে চইলা আইলেন গুরু বিকাল তিনটার দিকে, সাথে দুই শিষ্য। আমি দূর থেকা চায়া চায়া দেখি একটা হ্যাংলাপাতলা লোকের আগমন। এক কোণায় চেয়ার নিয়া বইসা জুতা মোজা খুইলা রিলাক্স হইতেছে গুরু আর চারদিকে সমস্ত ছোটবড় মিউজিশিয়ানরা। এক পর্যায়ে আইয়ুব বাচ্চু আইসা গ্রিনরুমে ঢুইকাই গুরুরে পায়ে ধইরা সালাম করা শুরু করলেন আর গুরু তারে বুকে জড়ায়া ধইরা তার চিরাচরিত ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে একটা চুমা দিয়া কইলেন, ‘বাচ্চু আজক আমার লগে বাজাবি।’ আইয়ুব বাচ্চু এক মুহূর্ত ভনিতা না কইরা সাথে সাথে রাজি হয়া গুরুর সাথে বইসা আড্ডা দেয়া শুরু করল।

সেইদিন সন্ধার পর যখন গুরু স্টেজে উঠেন তখন প্রয়াত বাউল আব্দুর রব ফকির আমার সাথে গ্রিনরুমেই বসা, গুরু স্টেজে উঠার সাথে সাথেই তিনি পাশে বসা আনু শাহ (আনু ফকির)-রে বইলা উঠলেন, ‘চলো দিকি গুরু উঠিছে স্টেজে, দেখি আসি।’ এইটা আমার কাছে এক বিস্ময় এখনো, আব্দুর রব ফকির আর আনু শাহ-এর সাথে সাথে আমিও স্টেজের সামনে গিয়া দাড়ায়া কাছ থেকা গুরুর পার্ফোর্মেন্স দেখলাম আর দেখলাম আব্দুর রব ফকিরও তার ‘বাংলাদেশ’ গানের মিউজিকে নাচতেছে। এখনো কানে বাজে গানের মাঝখানে এক চিল্লান, “বাজা বাচ্চু।”

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এই পাগল লোকটা, এই সাদা দিলের লোকটার আরেক রূপ দেখি আমি পরবর্তীতে। অর্ধেক গান শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে যাওয়া এক আজম খান। ইভেন্টের সবাই আজম খানের পিছে দৌড়াইতাছে আর গুরু কইতেছে, ‘আজক আমি স্টেজে গান গামু না, আজকা আমি তগোরে নিয়া গান গামু।’ ওদিকে স্টেজে মিউজিক চলতেছে, গুরুরে বুঝায়া গানটা শেষ করার জন্য স্টেজে উঠানো হইল। সেদিন গুরু গানটা শেষ কইরা নাইমা গেল, আর গান গাইল না স্টেজে। এরপর দেখলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের মধ্যে পাগল লোকটা শুইয়া শুইয়া গান গাইতাছে গলা ছাইড়া। এ কোন গুরু, এ কোন আজম খান! তার কোন না-বলা দুঃখ সেই সবুজ ঘাসের কাছে শুনাইতাছে গানে গানে! এ কোন যোদ্ধা!

এরপর আমার কাছে মনে হয় না বাংলা রকের আর কোনো মিউজিশিয়ানরে নিয়া লেখা আমার আর প্রয়োজন আছে, গুরুর স্মৃতিটুকুই থাক-না …

পুরান ঢাকার  রেকর্ডিং সেন্টার

এই পুরান ঢাকার  রেকর্ডিং সেন্টারের কাহিনি না লেখলে আমার মিউজিক এক্সপেরিয়েন্স সম্পূর্ণ হয় না। আমার এলাকার দুই ক্লাসিক মিউজিক রেকর্ডিং সেন্টার এসআর আর গীতাঙ্গনের আড্ডার জম্পেশ মুড়িভর্তার ঘ্রাণ এখনো পাই। ষাট মিনিটের একটা ক্যাসেটের দুই সাইডে ছয়টা কইরা বারোটা আর নব্বই মিনিট হইলে নয়টা কইরা আঠারোটা গানের মিক্সটেপের গরম গরম মিউজিক যেন সোনার খনি। তরুণেরা অপেক্ষা করত কবে ভালো ভালো গান জমব ইন্ডাস্ট্রিতে আর কবে তারা কয়েকটা অ্যালবাম বাইছা একটা মিক্সটেপ বানাইবো যার সব গানই তুখোড়। আবার অনেকে আর্টিস্ট হিসাবে মিক্সটেপ রেকর্ডিং করাইত, কেউ আজম খানের বেস্ট অফ আর কেউ-বা এলআরবি, ফিলিংস, আর্ক কিংবা ফিডব্যাকের বেস্ট অফ-এর লিস্ট নিয়া ধর্না দিত এইসব রেকর্ডিং সেন্টারে। যার মাথার ক্যাটালগে যত গানের লিস্ট, সে-ই এই লাইনের ওস্তাদ। এসআর রেকর্ডিং সেন্টারের আশরাফভাই কিংবা গীতাঙ্গন-এর খোকন। এইসব লোকজন একটা ইনফ্লুয়েন্স হিসাবেও কাজ করত পোলাপানের মধ্যে, ওস্তাদ কিংবা বস ডাইকা পেরেশান হয়া যাইত পোলাপান এইসব ক্যারাক্টাররে। আর তরুণীরা আইতো যে-রেকর্ডিং সেন্টারের মিক্সটেপে গানের লিস্টের হাতের লেখা যত সুন্দর সেইখানে। এইদিক দিয়া আমি মনে করি গীতাঙ্গনই আগায়া থাকার কথা খোকন ভাইয়ের মুক্তার মতন হাতের লেখার জন্য। ঈদের আগে পোলাপান লিস্ট নিয়া ভিড় জমাইত এইসব জায়গায়, শুধুমাত্র ঈদের দিন রাস্তায় ডেকসেটে বাজাইবো যেইসব গান ওইসব গানের লিস্ট নিয়া। তীর্থের কাকের মতন একেকজন লিস্ট নিয়া হাজির হইত ঈদের দশ দিন আগ থেকা।

এইসব রক শক-এর উন্মাদনা, রাজনৈতিক গীতিকবিতা, ব্যর্থ প্রেমের আহাজারি আর নতুন দিনের কথাবার্তার মধ্যে দিয়া অলিগলির স্কিনটাইট জিন্স আর ওড়না-উড়ানো তরুণতরুণীর যাপিত জীবনে রেকর্ডিং সেন্টাররে অস্বীকার করা যায় না কিংবা আমি অস্বীকার করি না। মিউজিকের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়া রয়া যায় এইসব রেকর্ডিং-এর দোকান।

এর মাঝে এক পাগলের গল্প দিয়া আমি এই স্মৃতিময় আলাপের শেষ বন্দরে পৌঁছাইতে চাই, সে-পাগল আমার ভাই। আমার খালাতো ভাইয়ের মিউজিক শোনার গল্পটা ছিল এমন, যে নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির মোড়ে দাড়ায়া পোলাপান যদি গানের আওয়াজ পাইত তাইলে মনে করত ভাই বাসায় আছে। সেই ভিসিয়ারের আমলে তার ঘরে আমি বব মার্লের কন্সার্ট দেখতাম ভিএইচএস ক্যাসেটে কিংবা অর্ডার দিয়া সেই লোক মাইকেল জ্যাকসনের মতো স্টিল-লাগানো ড্রেস বানাইতো আর রাখত বড় বড় চুল। যেহেতু রকমিউজিক নিয়া আলাপ তাই মাইকেল জ্যাকসন থেকা আমি দেশি রক মিউজিকে যাই। এই বিদগ্ধ আত্মার গল্পের শেষ নাই জীবনে। যার ঘরে বিশাল রেফ্রিজারেটরের সমান স্পিকার আর সাত-আটটা ডেক পার্ট-এর সাউন্ড সিস্টেম তার মিউজিক নিয়া আহ্লাদি তো থাকবই। এই ব্যক্তির বদৌলতেই যত কন্সার্ট দেখা শুরু টিনেজ বয়সে, এমন ভাই কে পায় যে কিনা অনেকগুলা কন্সার্টের টিকেট দিয়া কয় যা দেইখা আয়গা। এমনই কপাল ছিল আমার, আর সেইসব কন্সার্টে গিয়া দেখা যাইত সে-ও তার বিশাল বহর সহ সস্ত্রীক হাজির। এই লোক যেখানে, সেখানে আমাগো কোনো চিন্তা নাই এইটা ছোটবেলা থেকা জানা ছিল। সে যখন ঘরে থাকত না তার সমস্ত সিডি আর ডেকসেট আমাগো দখলে, যা ইচ্ছা শুনো কেউ না করব না। এই লাই-দেয়া লোকটার কাহিনি দিয়া শেষ করার কারণ একটাই, এই লোকের জন্যেই আমার অনেক কাছ থেকে আইয়ুব বাচ্চুরে দেখা। বাচ্চু ভাইয়ের সাথে বইসা ঝুনুর বিরানি খাওয়ার স্মৃতি এই লোকের জন্যেই আছে আমার। উনার ইচ্ছা হইল একবার উনি একটা মিউজিক লেবেল দিবেন, যেই ভাবা সেই কাজ শুরু। নারিন্দায় তার বিশাল এক ক্যাসেটের দোকান চালু হইল আর সেই দোকানের ফিতা কাটতে আসলেন স্বয়ং আইয়ুব বাচ্চু। পুরা নারিন্দা শরৎ গুপ্ত রোড সেদিন জাম, আইয়ুব বাচ্চু আইছে (ভাগ্য ভালো তখন সেলফির যুগ না)। দোকানের ফিতা কাটার পর বাচ্চু ভাইরে নিয়া বাসায় যাওয়া হইল আর বাচ্চুভাই দোকান থেকা বাইর হওয়ার পরই বাচ্চু ভাইয়ের গাওয়া গান ‘বাংলাদেশ’-এর “তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু, তোমার মাঝেই শেষ” বাইজা উঠল। পারলে কোলে কইরা নিয়া যাওয়া হইতেছে বাচ্চু ভাইরে বাসায়। বাসায় ঢুকার পর একতলা থেকা শুরু কইরা দুই তলার ঘর পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য, কেউরে ঢুকতে দিতাছে না। আমি এক ফাঁক দিয়া যাওয়ার পর আমারে দেখতে পায়া কে জানি টান দিয়া বাচ্চু ভাই যে রুমে বসা সেই রুমে ঢুকায়া দিলো, আমি বাচ্চু ভাইরে সেদিন না ছুঁইলেও ছুঁইয়া দেখতে পারতাম ঐ অনুভূতি হইল। আমি বাচ্চু ভাইরে দেখলাম।

এই লেখা শুরু করছিলাম বাচ্চু ভাইরে শহিদ মিনারে শেষদেখা দেইখা আসার পর এক ভারাক্রান্ত মন নিয়া, আজকে আমি এই লেখার শেষপ্রান্তে দাড়ায়া বাংলা রকের রথী-মহারথীদের নাম লেখতেছি আমার লেখায়। এইসব স্মৃতি আছে, রয়া গেছে আমার শহরের গলিতে গলিতে আমার মতন কত কিশোর, তরুণ, কিংবা যুবকের কল্বে। কেউ লেখে, কেউ লেখে না। তাই যদ্দুর পারি লেইখা যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুর উছিলায় কিংবা স্মৃতিতে।

উৎসর্গ : গুরু-শিষ্য আজম খান ও আইয়ুব বাচ্চুকে।

সেলাম রক!

… …

মাহবুব শাহরিয়ার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you