ট্রাডিশন আকারে ব্যান্ড ষাটের দশকের ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুরু হয়ে গেছিল। তখন গান বলতে কলকাতাই আধুনিক (সিনেমার) গান প্রবল দাপটে বাংলা শাসন করছে। ঢাকাই আধুনিকও (সিনেমার) কলকাতার ট্রাডিশন ফলো করছে। পাশাপাশি ‘লোকসংগীত’ শিরোনামে নিম্নবর্গের গানের চর্চাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিসরে শনাক্ত করার চলও শুরু হয়ে গেছে। এরই মাঝে ব্যান্ড এল গুটি গুটি পায়ে। অ্যামেচার ভঙ্গি তার। ওয়েস্টার্ন পপ-রক থেকে তখন কেবল সে যন্ত্রানুষঙ্গ ধার নিতে শিখেছে। তাতেই বিরাট বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিলো। হারমোনিয়াম-তবলার যুগল দাপটের জায়গায় গিটার-ড্রামসেট বেশ আপসেটের মতো শোনালো রূচিশীল নাগরিক কর্ণকূহরে। কিন্তু এই গানকে সংগীতের মূলধারায় নোটিশ করবারই সুযোগ দিলেন না দাপুটে নাগরিক সম্প্রদায়। মহল্লার ছেলেমেয়েদের আনাড়িচর্চার মতোই হয়ে থাকল সেসব।
.
গানের জগতে তখন রাজনীতি বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। একদিকে, পাকিস্তানি শাসকদের দৌরাত্ম্যে রবীন্দ্রসংগীত রাষ্ট্রীয় পরিসরে কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। না-পাওয়ায় যে ঘটনাটি ঘটলো সেটি বেশ ইন্টারেস্টিং: রবীন্দ্রনাথের গান সংগীতের ট্রাডিশন হিসেবে দাপুটে এবং প্রাতিষ্ঠানিক। নতুন গানের বিকাশ মূলত এই ধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করবার মাধ্যমে বিকশিত হবার কথা। কিন্তু নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় রবীন্দ্রসংগীতের চর্চাই সামাজিকভাবে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠল। পূর্ববঙ্গে। সামাজিক প্রতিবাদের প্রয়োজনের কাছে নান্দনিক বদলের প্রয়োজনখানি গৌণ হয়ে রইল। দেশগঠনের রসদ আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে আহরণ করতে লাগলাম। সেটা জাতীয় সংগীত থেকে যাবতীয় দেশাত্মবোধক গানের চর্চা শুরু পর্যন্ত। এমনকি রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানও (‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’) আমাদের দেশাত্মবোধের হাতিয়ার হয়ে উঠল।
.
স্বাধীনতার পরপর অবস্থা রাতারাতি পাল্টে গেল। দু ধরনের গানের মাধ্যমে এক সাংগীতিক বিপ্লব সাধিত হলো। এক, প্রথাগত ফর্ম অনুসরণ করা দেশাত্মবোধক গানের চর্চা। দুই, প্রথাবিরোধী বাংলা রকের দ্ব্যর্থহীন আত্মপ্রকাশ। প্রথমটিতে নেতৃত্ব দিলেন আবদুল লতিফ, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা সহ মূলধারার একদল শিল্পী সুরকার গীতিকার। আর দ্বিতীয়টার পুরোভাগে দাঁড়ালেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ আর ফকির আলমগীর। তখনকার দেশগঠনে এই দুই ধরনের গানেরই দু-রকম ভূমিকা প্রামাণ্য হয়ে উঠল।
দেশাত্মবোধক গান রোমান্টিক। ব্যান্ডের গান প্রতিবাদী, সমসাময়িক। সত্তর দশকের দুর্ভিক্ষ, বন্যা, নিম্নবর্গ আর অনিশ্চিত দেশযাত্রার মূর্তিমান ডকুমেন্টেশন হয়ে উঠল ব্যান্ডগান। কোনো ধরনের প্রাক-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ছাড়া বাংলাদেশের পয়লা সেলিব্রিটি হয়ে উঠলেন আজম খান।
… …
- হালুমহুলুমভালুমবাসা, ব্রাত্য রাইসু! || সুমন রহমান - November 23, 2024
- শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান - August 23, 2024
- দেশান্তরী গরিবের কম্যুনিটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট || সুমন রহমান - July 11, 2024
COMMENTS