বান্নাভাই

বান্নাভাই

জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, অতীতগর্ভে বিলীন এক শহরের শিল্পী’ শীর্ষক মনোজ্ঞ রচনাটায় আহমদ মিনহাজ যেই শহর ও সময়ের গল্প করতেসেন সেই শহরের নাম সিলেট ও সময়টা লাস্ট সেঞ্চুরির গোটা নাইন্টিস্। যদিও বান্না নামের ঘটনাটার শুরু নব্বইয়ে নয়, আরও আগে থেকে, এবং সেইটা কবেকার তা-ও সবিশদ এসেছে লেখাটায়। নাইন্টিস্/নব্বই বিশেষ কারণে এবং সংগত কন্সিডারেশনে একটা মাইলস্টোন নবোদিত গণতন্ত্রের বাংলাদেশে, লেখকের আর্লি দিনগুলার চেতনায়, এবং বর্তমান বাংলাদেশের বহুকিসুই ইগ্নাইট করে সেই নাইন্টিননাইন্টি-অনোয়ার্ডস্ টাইমটায়। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থ-ও-আর্থ-নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বহুকিসুরই বিকাশ ও বিনাশ উভয়টাই দৃষ্ট হয় এই টাইমটায়, নাইন্টিসে, লাস্ট সেঞ্চুরি ভিস্-অ্যা-ভিস্ সহস্রাব্দ গোড়া থেকে শুরু করে এখনও চলতেসে এর নেতি-ইতি দুনো প্রভাবই। মিনহাজ সেই বিজুলি-উজল সময়টা ক্যাপ্চার করসেন আলোচ্য রচনায়।

কেবল শহরটাই তো নয়, দেখতে দেখতে দেশটাই বিলীন হয়ে গেল অতীতগর্ভ অব্লিভিয়নে। সেই সিলেট কেমন ছিল, বর্তমানে এই সিটি কর্পোরেশনের হার্মাদি আগ্রাসনে সে কেমন আছে, এইসব নিয়া আমাদের আর ভ্যাজরভ্যাজর করবার দরকার নাই। নিস্তেজ নিরাশায় ব্যাৎলা মুড়ির মতো বসে থাকি, চিটাগং বন্দর প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্যারের নজর এড়িয়ে রামাদানের রোজা রাখি, পিএমরে থ্যাঙ্কস জানাই। বেঁচে আছি, তাই। কিন্তু মনে পড়ে কতকিসু, মুম্বাই টু মুগাদিসু, মরার মনেপড়াপড়ি ছাড়া আর কিই-বা আছে শেখ হাসিনার দেশে মেনশন বাহুল্য করবার?

মনে পড়ে, ইয়াদ হয়, বাপচাচারা বাসায় ফিরে উৎফুল্ল গলায় বলতেন, টেলিভিশনে আইজ বান্নাভাই গাইবা! আরে, টেলিভিশন তো এই সেদিনের ঘটনা, আমাদের লাইফের উন্মেষকালে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে রেডিয়ো এবং তা ঘিরিয়া ফ্যামিলির সবাই মিলিয়া মুহররমের সময় জারি শোনা আর হাফতা-হাফতায় অনুরোধের আসর ও ছোট পরিবার সুখী পরিবার ইত্যাদি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আর বান্নাভাই লাভলী দেব ইয়ারুন্নেছা প্রমুখের গান শোনা। লাইফ অনেক ইজি ছিল তখনও।

গত সেঞ্চুরির নাইন্টিসের মেমোয়ার। ইশকুলের অনুষ্ঠানের বছরান্তের মঞ্চে, মহল্লার মাঠের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মজমায়, জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার পানখাওয়া লাল গলার রসোচ্ছ্বাস আর ক্লিনশেইভড অবয়বে স্টেজে উঠে গানগাওয়া  আমাদের শহরের বয়সনির্বিশেষ সকলের কাছেই ছিল প্রিয় ও প্রশংসনীয়। যদিও আমরা, যারা আর্বান পেরিফেরির স্কুলকিড, তারা তখন বড়েগোলাম বলেন বা বান্না কাউরেই ঠিকঠাক বেইল দিতাম না। আমাদের প্লেলিস্ট ছিল থোড়াসা আলগ কিসিমের। ফলে, টেলিভিশনে বান্নার গান এলে একটু জরুরি প্রয়োজনে প্রকৃতির ডাক শুনতে টেলিভিশনসেটের স্ক্রিন ছেড়ে উঠানে দৌড়ঝাঁপ সেরে বিজ্ঞাপনী জিঙ্গেলের সাউন্ড কানে পশিবামাত্র হুড়মুড় স্ক্রিনে ফিরতাম। আমাদের চউখ খুঁজত ব্যান্ডসংগীতের অনুষ্ঠান। সোলস, মাইলস, ফিডব্যাক, ফিলিংস, ওয়ারফেজ, রেনেসাঁ … আরও কতশত নাম! তবে এসবের তলায়, পানির তলদেশে ভেসে বেড়ানো মাছের কায়দায়, ছিলেন আমাদের রিয়্যাল লাইফ লোক্যাল হিরোরা। জামাল উদ্দিন হাসান বান্না আমাদের সেইসব অবন্দিত আনসাং লোক্যাল হিরোদের মধ্যেও কোথায় পৃথক ও প্রণিধানযোগ্য ইত্যাদি নিয়া আহমদ মিনহাজ নিম্নলিঙ্কিত গদ্যটি লিখসেন, পড়ে শেখ হাসিনা রেজিমের ড্রাইভিং ফোর্স অ্যাডমিনকর্তাদের আড়ালে এই নিদাঘ রামাদানের রোজায় পেট ভরে গেল। সুবহানাল্লা! জাযাকাল্লা খায়ের!

যা বলতে চাইতেসিলাম তা এখনও বলি নাই, বিদায় নিব বলা সাঙ্গ হলে; তা এ-ই যে, কেবল বান্না নয়, এই গদ্য পড়তে পড়তে এমন আরও অনেক যুগসন্ধিক্ষণের কণ্ঠশিল্পীদের নাম মনে পড়তেসিলো। ধরা যাক ক্যাসেটপ্লেয়ারযুগে সেলিম চৌধুরী যেভাবে ফোক গেয়ে দেশজোড়া আর্টিস্টের পরিচয় লাভ করসিলেন, এর পেছনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও বিটিভির সংগীতানুষ্ঠান ছাড়াও অডিয়ো কোম্প্যানির এবং দৈনিকীর মিডিয়াক্যাম্পেইন যুক্ত ছিল। ওই সময়েই, সেলিম চৌধুরীর অব্যবহিত আগে-পরে, সিলেটের অনেক কণ্ঠশিল্পী অ্যালবাম রিলিজ করে গেসেন একের পরে এক এবং লোক্যাল লেভেলে ম্যাসিভ হিট হলেও কথিত ন্যাশন্যাল লেভেলে সেভাবে কেউ প্রচার করে নাই। দুইয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে, যেমন ‘রূপের মাইয়া’-খ্যাত মামুন ন্যাশন্যালি রিচ করসেন সেইসময়, কেউই ঠিক প্রচারটা পান নাই। আর যারা প্রচার পাইসেন তাদের ফিচার্স ঠিকঠাক ডিটেক্টেড হয় নাই। আজও হয় নাই। জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার ফিচার্স কথাসাহিত্যিক আহমদ মিনহাজের এই গদ্যে যেভাবে ক্যাপ্চার্ড তা বাক্য-সংকোচনে এক্সট্রাঅর্ডিন্যারিলি ইম্প্রেসিভ বললেও কম বলা হয়।

ক্যাসেটযুগের লোক্যালি ব্রিলিয়্যান্ট শিল্পীদের ভিতর থেকে চটজলদি তিনচাইরজনের নাম নিতে চাই এইখানে, যাদেরে কেন্দ্রে রেখে এ্যাসে লেখা হলে সেই বিপুল নব্বইয়ের লুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক সড়কটা আরেকটু ফর্শা ঠার করা যাবে। ব্যান্ডসংগীতে ‘টাফ বয়েজ’ সেইসময় অ্যালবাম বাইর করে এবং টেলিভিশনে ব্যান্ডপ্রোগ্র্যামে অ্যাপিয়ার করে একটা আলোড়ন তুলসিলো লোক্যাল অ্যারিনায়। কিসুদিন আগে এক্সপায়ার করসেন এককালে-অ্যাক্টিভ অথচ বহুদিন গানবাজনাহীন সেই ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান সন্দীপ, কোথাও কোনো লেখাজোখা নজরে পড়ে নাই বিছড়ানো সত্ত্বেও। ঝলক নামের আরেকজন ভোয়েসআর্টিস্ট, সোলো, আইয়ুব বাচ্চু কম্পোজিশনে একাধিক অ্যালবাম করেন এবং মিক্সডঅ্যালবাম পিরিয়ডে প্রেজেন্স ছিল এই শিল্পীর উল্লেখযোগ্য অডিয়োসংকলনে। তেমনি ছিলেন কতশত কণ্ঠশিল্পী, যারা বাউল/বাউলা গায়ক নন, লোক্যাল ফাংশানগুলা যাদের হাজিরা ছাড়া ভাবাই যেত না। পারেছ চৌধুরী নামে এক শিল্পীর নাম পড়তেসে এছাড়া।

তারা আজ কই সব, আমাদের ইউনিয়নে ইউনিয়নে উপজেলায় উপজেলায় জেলায় জেলায় বিভাগে বিভাগে অ্যাডমিনিস্ট্রেইটিভ আইডিয়ায় আয়োজিত আওয়ামী লীগের সাহিত্যমেলায়? নাকি এইসব বিষয় তালাশ করা সাহিত্য পদবাচ্য নয় অ্যাডমিনতোষণকারী ‘লিখক’-কবিদিগের বিবেচনায়? এই সওয়ালের জওয়াব না দিয়ে, এই রিসার্চ না-সেরে ইউনিয়নে ইউনিয়নে উপজেলায় উপজেলায় জেলায় জেলায় বিভাগে বিভাগে মেলামোচ্ছব করে যে-‘জাতীয় সাহিত্য’ হইবার বিস্কুটদৌড়ে নেইম রেজিস্ট্রেশন করাইলেন তৃণমূলের লেখক, কবি ও মঞ্চামোদী সাহিত্যকরিয়েরা, তাদের নিয়া আমরা আমড়াবাগানে নাগরিক সংবর্ধনা আয়োজন করব? আওয়ামী লীগের ভিশন-টোয়েন্টিফোর্টি হাসিল করার কাজটা তো এই চিহ্নিত ‘কবিসাইত্যিক’ লোকগুলাই করতেসে দেশগ্রামে। যেমন করত তারা কালে-কালান্তরে, দেশে-দেশান্তরে, লেজেহুমু-মুসোলিনি কি হিটলারের টাইমে। ট্যালেন্ট হান্ট টাইপের এইসব জাতীয়-সম্পদ-খর্চায়-আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলায় স্টেজে উঠে কেবল নিজের ভোটার আইডি ডিসক্লোজ করা ছাড়া আর কোনো দায় আছে বলে স্বীকার করতে চান না রাইটারেরা। পাপের বেতন পরমায়ু, বোধয় শ্যামল গাঙ্গুলির কোনো বইয়ের নাম, কথাটা মাথায় এলো দুইহাজারতেইশে এসে দেশের তৃণমূলের লেখকদের বেতনবৃদ্ধির জন্য তদবির-তালাবি দেখে। কে বেহুদা আর্বান সেমিআর্বান সাবার্বান গায়কদের ইউনিক ফিচার হাজির করবে জনসমক্ষে? এরা আবদুল করিম আর হাসন রাজায় বিমুগ্ধ প্রোমোশন্যাল বই লিখেই দিনাতিপাত করে হ্যাপি। ইয়া রাব্বুলালামিন, ইহাদেরে পরমায়ু নসিব করিয়ো দয়াল!

কথাসাহিত্যিক আহমদ মিনহাজের প্রোক্ত রচনাটা রিভিশন দিতে যেয়ে এমন অনেক কণ্ঠশিল্পীর গলা ইয়াদ হচ্ছিল যারা স্ট্যাটাস-ক্যু বজায় রাখবার কোলাবোরেটার ‘বাউল মহাজন’ নয়, যারা গানটাই গিয়েছিল গেয়ে ক্যাসেটে-ক্যাসেটে রেডিয়োয় বা পাড়ার ফাংশানের পর ফাংশানে, এদের দুইয়েকজন ছাড়া কাউরেই ইউটিউবে অ্যাভেইল করা যায় না। সাজ্জাদ নুর, ফর ইন্সট্যান্স, এমনই এক কণ্ঠশিল্পী যারে অ্যাভেইল করা যায় ইউটিউবে। এমন গায়কদের কণ্ঠবৈশিষ্ট্য ও তৎকালীন বঙ্গসমাজের কোন লেয়ারে এদের অভিঘাতে ঢেউ উঠসিলো ইত্যাদি নিয়া বাংলায় কেউ লিখলে জাতীয় উপকার হয়। কে লিখবে? সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের লোক্যাল পাণ্ডা? নাট্য পরিষদের ন্যাকাবোকা? নাকি তৃণমূল লেখক পর্ষদের মঞ্চাসীন নিভৃত নন-এক্সপ্রেসিভ উদাসগম্ভীর কোনো দুঃখাক্রান্ত কবি? নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত সবাই, মেয়রাল ইলেকশন মাত্র শেষ হলো সাক্সেসফ্যুলি, ন্যাশন্যালে কামিয়াবি নিশ্চিত করতে অনেক মেহনত করতে হবে লেখক-কবি-শিল্পী নির্বাচনকর্মীদেরে। একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, নচির গানের মতো, এরপরে লেখার কথা ভাবা যাবে না-হয়।

জাহেদ আহমদ / জুন ২০২৩


রিলেটেড রচনা
জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, অতীতগর্ভে বিলীন এক শহরের শিল্পী

COMMENTS

error: