এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া || সুমনকুমার দাশ

এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া || সুমনকুমার দাশ

ছোটোবেলায় বন্ধুরা দল বেঁধে গাইতাম — ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া / এত যত্নে গড়িয়াছে সাঁই’। এর পরের লাইনগুলো আমাদের জানা ছিল না। এই দুই পঙক্তিই আমাদের কাছে ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ গান। হাওরের বনে-বাদড়ে টু টু করে ঘুরে বেড়ানোর সময় কিংবা ভর বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা ঢেউয়ে নৌকা ভাসিয়ে বন্ধুরা কত কত গান গাইতাম! তবে প্রত্যেকটি গানের প্রথম দুটি চরণই আমরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার গাইতাম। পূর্ণাঙ্গ গান রপ্ত করার কোনও ইচ্ছেও আমাদের যে ছিল তাও নয়। শখের বশে মনের আনন্দে গাইতাম।

শখের বশে গাওয়া এসব গানের মধ্যে — ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’ গানটি মনে বেশ ধরে। বয়স আরেকটু বাড়ে, তখন হাইস্কুলে পড়ি। ঠিক এমন এক সময় একটি ক্যাসেটপ্লেয়ারে আবদুল আলীমের কণ্ঠে ওই গানটি শুনি। মুহূর্তেই পুরনো দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মনে আবারও গুঞ্জরণ তোলে সেই গান। গুনগুন করে গানের পঙক্তিগুলো আওড়াই।

পরে, আরও অনেক পরে জানতে পারি —  এই গানটি রশিদ উদ্দিনের লেখা। নেত্রকোণার বাহিরচাপড়া গ্রামের প্রখ্যাত বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন। যিনি নিজে তো বিখ্যাত ছিলেনই, এমনকি তাঁর শিষ্য জালাল উদ্দীন খাঁ, শাহ আবদুল করিম, মজিদ তালুকদার, তৈয়ব আলী, ইদ্রিস মিয়া, জমশেদ উদ্দিন সহ অনেকেই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন নিজেদের সৃজনপ্রতিভায়। যে গানটির কথা এতক্ষণ বলছিলাম সেটি বরং এখানে উদ্ধৃত করা যায় :

এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়িয়াছ সাঁই।।

কার সঙ্গে যুক্তি করে গড়িলে সংসার
বেদেরগঞ্জ গিয়া আমি পাইলাম না কিনার
তুমি সাকার, তুমি নিরাকার
তুমি বিনে আর কেহ নাই।।

ছায়াবাজি কইরে বানাইয়া মানুষ
যেমনি চালাও তেমনি চলে
পুতুলের কী দোষ
তোমার হাত ছেড়ে দিলে থামিয়া যাই।।

তুমি ধর্ম, তুমি কর্ম, তুমি কর্ণধার
তোমার কর্ম তুমি করো, কেন আমরা গোনাগার
তোমার ইচ্ছায় চলিছে সংসার
তুমি খাওয়াইলে, আমরা খাই।।

তুমি বেহেস্তী, তুমি দোজকী, তুমি ভালো-মন্দ
তুমি ফুল, তুমি ভ্রমর
তুমি তাতে গন্ধ
তোমার আমার এই সম্বন্ধ দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াই।।

তুমি কখন সিংহাসনে ধরি রাজবেশ
কখন ভিখারি সেজে ভ্রমো নানা দেশ
তোমার রূপের পাইলাম না শেষ
জায়গা কইরাছ কোন ঠাঁই।।

রশিদ উদ্দিন বলে, তোমার পাপপুণ্যের ভার
তোমার কর্মের তুমি আবার করিবে বিচার
তোমার বেহেস্ত চাই না, দোজখ ডরাই না
কেবল আমি তোমারে চাই।।

কিন্তু শিল্পী আবদুল আলীম এই গানটি গাওয়ার সময় বোধহয় কিছু পঙক্তির ঈষৎ পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন। তারচেয়েও বড় কথা, তিনি এই গানের গীতিকার রশিদ উদ্দিনের নাম ব্যবহার না করে ‘সংগ্রহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এবং এই গানটি গেয়েই কিন্তু আবদুল আলীম ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলেন। উকিল মুনশি, জালাল উদ্দীন খাঁ, শাহ আবদুল করিম থেকে শুরু করে আবদুস সাত্তার সহ নেত্রকোণা ও সিলেট অঞ্চলের তৎকালীন অনেক বাউল গায়ক এই গানটি গেয়েছেন। এবং এঁদের সবাই এটি রশিদ উদ্দিনের লেখা বলেই দাবি করেছেন।

আমাকে ভাবিয়ে তোলে এই গানের কয়েকটি পঙক্তি। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কী সাহসী উচ্চারণ —  ‘তোমার কর্ম তুমি করো, কেন আমরা গোনাগার’ কিংবা ‘তোমার কর্মের তুমি আবার করিবে বিচার / তোমার বেহেস্ত চাই না, দোজখ ডরাই না / কেবলমাত্র আমি তোমারে চাই।’ তবে কী মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে একটা মিলনসূত্র তৈরি করতে চাইছিলেন গীতিকার? এক অজপাড়া গাঁয়ে বসবাস করেও কী নিরেট বস্তুবাদী উচ্চারণ আর প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা! তাঁর বিভিন্ন গানের পঙক্তি থেকে আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে :

১।।

পুতুল বানাইল কি নিজেই পুতুল বনিল
কোনটা করি ধারণা।।

২।।

কেবা আছে সৃষ্টিমূলে
দৃষ্টি খুলে পাওয়া তো যায় না।।

৩।।

বাউল কবি রশিদ বলে
তোমার কথা মনে হইলে
পড়ে যাই গণ্ডগোলে
কোথায় আছে সূক্ষ-স্থূল।।

৪।।

ওগো স্রষ্টা, জাতিভ্রষ্টা, তুমি হইলা নষ্টের মূল
নাহি তোমার জাতি-ধর্ম, নাহি তোমার কুলাকুল।।

৫।।

সে যে অস্থিত্ববিহীন, কয় রশিদ উদ্দিন
আকাশ-বাতাস গেছে ভেদ করিয়া।।

সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে গানে গানে বিদ্রোহ দেখালেও মানুষের জয়গান গেয়েছেন আজীবন। তিনি আত্মবিশ্বাস থেকেই উচ্চারণ করেন —  ‘মানুষ ধরো, মানুষ ভজো / শুন বলি রে পাগল মন / মানুষের ভিতরে মানুষ / করিতেছে বিরাজন।।’  এ গান ছাড়াও তাঁর প্রায় গানে মানবতাবাদী চেতনাই ফুটে উঠেছে। লেখক গোলাম এরশাদুর রহমান রশিদ উদ্দিনের গান সম্পর্কে লিখেছিলেন :

“সুকৌশলে মানুষে মানুষে সৃষ্ট ভেদাভেদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের সুর তুলে ধরেছেন মাত্র। যে-বিদ্রোহের ভিত্তিমূলে মানবতার চেতনা জীবন্ত সত্তারূপে বিরাজমান। তৎকালীন সমাজচিত্রের বাস্তবতায় এ সাহিত্যকর্ম কোনও আত্মভোলা কবির কাজ নয়। এটা সমাজের সকল মানুষের প্রতি আত্মজিজ্ঞাসার নীরব নির্দেশ। এ আত্মজিজ্ঞাসার বলয়ে গড়তে চেয়েছেন মানবপ্রেমের এক নতুন জগৎ।”

শুধু গান লিখে কিংবা গেয়েই শেষ নয়। মানবপ্রেমের মহিমায় সব শ্রেণিপেশার মানুষকে একাট্টা করতে রশিদ উদ্দিন সহ অনেকে মিলে ১৯৪৫ সালের ৯ এপ্রিল নেত্রকোণায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন করেছিলেন। সব ধরনের সা¤প্রদায়িকতা ও হানাহানির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়েছিল সম্মেলনে। আগতদের সবাই শপথ নিয়েছিলেন —  ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাতির ভিত্তিতে নয়, মানুষের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই সমাজ গঠন করলে মানবমুক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্ভব।

কৃষক সম্মেলন শেষে রশিদ উদ্দিন মানবতার জয়গান গেয়ে অসংখ্য গান লিখেছিলেন। এ-রকম একটা গান উল্লেখ করার প্রয়োজনবোধ করছি :

মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, শুন বলি রে পাগল মন
মানুষের ভিতর মানুষ করিতেছে বিরাজন।।

মানুষ কি আর এমনি বটে, যার কারণে জগৎ রটে
ওই যে পঞ্চভূতের ঘাটে, খেলিতেছে নিরাঞ্জন।
চৌদ্দতালার উপরে দালান তার ভিতর ফুলের বাগান
লাইলী আর মজনু দেওয়ান, বর্জকে করছে শাসন।।

তালাশে খালাস মিলে, তালাশ করো রঙমহলে
উঠিয়া হাবলঙ্গের পুলে চেয়ে থাকো সর্বক্ষণ।
উঠিয়া দেখিবে পুলে দুই দিকেতে অগ্নি জ্বলে
ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে, চমকিছে স্বর্ণের মতন।।

দুইধারে দুই কটরা, হায়াত মউত মাইঝখানে ভরা
সময় থাকতে খোঁজগে তোরা, নিকটেতে কাল শমন।
সোনাপুরী আঁধার করে, যেদিন পাখি যাবে উড়ে
শূন্য খাঁচা থাকবে পড়ে, কে করবে আর তার যতন।।

তিনি তাঁর গানে মানুষবন্দনার পাশাপাশি নিগূঢ়তত্ত্ব, আত্মা-পরমাত্মা বিষয়ক গান, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী সহ অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন। সাম্প্রতিককালে একটি গান তো হালআমলের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফিরছে :

আমার সোয়া চান পাখি
আমি ডাকছি তোরে, ঘুমাইছ নাকি।।

তুমি আমি জনমভরা ছিলাম মাখামাখি
আজ কেন তুমি হইলে নীরব, মেলো দুইটি আঁখি।।

বুলবুলি আর তোতা ময়না, কত নাম তোর রাখি
শিকল কেটে চলে গেলে, কারে লইয়া থাকি।।

তোমার আমার মধুর পিরিত, চন্দ্র সূর্য সাক্ষী
এক সাইথে কেন ভেঙে দিলে, বুঝলাম না চালাকি।।

বিশ্বজোড়া এই পিরিতি, সবই দেখছি ফাঁকি
বাউল কবি রশিদ বলে, ডাকলেই-বা আর হবে কি।।

শিল্পী বারী সিদ্দিকী এই দেহতত্ত্ব পর্যায়ভুক্ত গানটি খুব দরদ গিয়ে গেয়ে থাকেন। তিনি ছাড়াও একাধিক শিল্পীর কণ্ঠে এই গানটি শুনেছি। প্রত্যেক গায়কই ‘তুমি আমি জনমভরা ছিলাম মাখামাখি / আজ কেন তুমি হইলে নীরব, মেলো দুইটি আঁখি’ —  চরণদুটিতে এসে সামান্য সময়ের জন্য থেমে যান, শিল্পীদের কণ্ঠ যেন চাপা কান্নায় অনেকটা রুদ্ধ হয়ে আসে। এ-রকম তীব্র স্পর্শকাতর আবেগী পঙক্তি রশিদ উদ্দিনের গানে ভুঁরি ভুঁরি উদাহরণ রয়েছে।

লেখক গোলাম এরশাদুর রহমান তাঁর এক লেখায় জানিয়েছিলেন, রশিদ উদ্দিন বাউলগানকে আরও প্রসারিত করতে নিজের বাড়িতে বাউলতত্ত্ব প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করেছিলেন। নেত্রকোণা ও সিলেট অঞ্চলের সেরা বাউলেরা সেখানে গিয়ে ভিড় জমাতেন। ওই লেখক তাঁর লেখায় বলেছিলেন :

“১৯৩৩ সনের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোনা শহরের গরহাট্টায় সর্বপ্রথম তত্ত্বভিত্তিক বিতর্কমূলক এক বিরাট বাউলগানের আসর হয়। এ বিতর্কে রশিদ, জালাল খাঁ ও চান খাঁ অংশ নেয় এবং বিচারক হিসেবে মঞ্চে বসা ছিলেন সাধক আসমত ফকির। এ স্মরণীয় আসরে বিজয় নারায়ণ আচার্য সহ অত্রাঞ্চলের বহু খ্যাতিমান কবিয়াল ও দর্শক হিসেবে বা অতিথির মর্যাদায় মঞ্চে ছিলেন।

উক্ত আসরে তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, ইদ্রিছ মিয়া ও চান মিয়া সহ বহুসংখ্যক বাউলসাধক উপস্থিত ছিলেন। তখন থেকেই নেত্রকোনা জেলা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে সুললিত সুরে ত্রিপদিতে তত্ত্বভিত্তিক তর্কের বাউলগানের আসর ছড়িয়ে পড়ে। এ সব বাউলগানের আসর অতি সহজেই কবিগান ও জারিগানের চেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ফলে ৩০-এর দশক থেকে শুরু করে ৮০ দশক পর্যন্ত অত্রাঞ্চলের লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে বাউল সঙ্গীত সাধনা ছিল শীর্ষে। তখন উল্লেখিত বাউলসাধকগণের দখলে ছিল লোকসংস্কৃতির মাঠ। কৃষকের ঘরে আমন ধান উঠার পর পরই সর্বত্র ব্যাপকভাবে জমে উঠত বাউলগানের আসর। সুফি সাধকদের গৃহকোণে বসে আধ্যাত্মিকতা চর্চা এবং কবিয়ালদের কবিগান ও বয়াতিদের জারিগানের মাধ্যমে ধর্মশাস্ত্র চর্চার ডামাডোলের মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, লোকতত্ত্বভিত্তিক বাউলগানে লোকসংস্কৃতির এক নতুন জগত গড়ে ওঠে। আর মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের জন্য এ নতুন বাউল জগতের জনক ছিলেন বাউলসাধক রশিদউদ্দিন।”

গোলাম এরশাদুর রহমানের লেখায় তৎকালীন নেত্রকোণা অঞ্চলের রশিদ উদ্দিন কেন্দ্রিক বাউলগানের চর্চার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই লেখকের লেখার এক জায়গায় মালজোড়া গানের আসরে রশিদ উদ্দিনের তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতা সম্পর্কেও জানতে পারি। সেটা হচ্ছে : ১৯৫৯ সালে বারহাট্টা উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক প্রতিযোগিতামূলক মালজোড়া গানের আসরে উকিল মুনশি ও রশিদ উদ্দিন গান গাইতে একসঙ্গে মঞ্চে ওঠেন। প্রতিযোগিতামূলক মালজোড়া গান মানেই একে অপরকে কটাক্ষ করে কথা ও গানের ম্যারপ্যাঁচে আটকিয়ে দর্শকদের সুস্থ বিনোদন দেওয়া। ওই দিনের ঘটনাটা ছিল ঠিক এ-রকম :

উকিল মুনশি : দাড়ি রাখা রসুলের সুন্নত। রশিদ উদ্দিন জেনে শুনে এ সুন্নত আদায় করছেন না। তাই রশিদকে আমি ঘৃণা করি, তার সঙ্গে মালজোড়া গান করা যায় না।

রশিদ উদ্দিন : আমি জানি দাড়ি রাখা রসুলের সুন্নত। কিন্তু আমার বিবি দাড়ি রাখা পছন্দ করেন না। যদি দাড়ি রাখি তবে বিবি আমার সঙ্গে ঘুমাবে না বলে অঙ্গীকার করেছে। তাই বিবির মন রক্ষার্থে আমি দাড়ি রাখা পরিহার করেছি। আর বিবির মন রক্ষা করে চলা ফরজ। তাই আমি ফরজ রক্ষার্থে সুন্নত বাদ দিয়েছি।

যে মালজোড়া গানের কথা বলা হলো, সেটা কিন্তু রশিদ উদ্দিনের হাত ধরেই চালু হয়েছে। এই গানের উৎপত্তি প্রসঙ্গে প্রয়াত সংগীতগুণী রামকানাই দাশ তাঁর ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ বইয়ে লিখেছেন :

“একজন অসাধারণ তাত্ত্বিক বাউলের নাম রশিদ উদ্দিন। যুগের এবং সমাজ জীবনের পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে কবিগানের সঙ্গীতাংশের বেশিরভাগ পর্যায়গুলোকে বাদ দিয়ে কেবল দুই কবিয়ালের তর্কাতর্কি অংশটিকে বাউল নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে প্রাতিষ্ঠানিক বাউল শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছিলেন তিনি। এ তর্কাতর্কির অংশটিকে কাজে লাগিয়েই মালজোড়া তৈরি হয় এবং বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনই এর প্রধান প্রবর্তক বলে আমার বিশ্বাস। বাউলসাধক জালাল উদ্দীন, শরৎ বাউল প্রমুখও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মালজোড়া গানের উন্মেষলগ্নেই এটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কবির সরকারগণ রাধাকৃষ্ণ-হরগৌরি প্রভৃতি প্রসঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন সীমাবদ্ধ রাখত কিন্তু মালজোড়ায় মহানবির জীবন, হাশরের মাঠ প্রভৃতি বিষয় যোগ করে গায়কগণ আরও ব্যাপক করে তোলেন এর পরিধি। রশিদ উদ্দিনের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে শিক্ষা গ্রহণকারী খ্যাতিমান বাউলদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জালাল উদ্দীন, মিরাজ আলী, তৈয়ব আলী এবং পূর্বধলার ইদ্রিস মিয়া।”

নেত্রকোণা অঞ্চলে তখন বাউল আর মালজোড়ার একটা রমরমা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। উকিল মুনশি (বিরহী), শরৎ বাউল, চান মিয়া, জমশেদ উদ্দিন, ধেনু মিয়া, আলী হোসেন, আলী নেওয়াজ প্রমুখ কীর্তিমান বাউলেরা অঞ্চলের গণমানুষকে সুরের মুর্চ্ছনায় মাতিয়ে রেখেছেন বহুদিন। সবার মূলে ছিল মহান বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন। রশিদ উদ্দিনের বহু গান আজো মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হয়।

রশিদ উদ্দিনের বয়স যখন ১৫ কি ১৬ বছর তখন পাশের পুখুরিয়া গ্রামের টকনা মিস্ত্রীর সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর সান্নিধ্যেই একতারা বাজিয়ে বাউলগানের চর্চা শুরু হয়। ঠিক এমনি সময় রশিদ উদ্দিনের নিজ গ্রামে কৃষ্ণলীলা গানের প্রচলন হয়। সেখানে তিনি কৃষ্ণের নামভূমিকায় অভিনয় করে গ্রামবাসীর বাহবা অর্জন করেন। একই সময়ে নেত্রকোণা অঞ্চলে কবিগানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে কবিগান গীত হতো। রশিদ উদ্দিন সেসব অনুষ্ঠানে মনের আনন্দে অংশ নিতেন। পরে ১৯০৯ সালে কিশোরগঞ্জের কঠিয়াদী গ্রামের বাসিন্দা লেংটা পির রশিদ উদ্দিনের নিজগ্রাম বাহিরচাপড়াতে আসেন। তাঁর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজ বাড়িতে বাউলগানের জলসায় মেতে ওঠেন। এভাবেই শুরু, এরপর বাকিটুকু শুধুই ইতিহাস। দিকে দিকে রশিদ উদ্দিনের গানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এখন তিনি বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য বাউলসাধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।

… …

COMMENTS