বনজুঁই ঘুমিও না ৭ || নিবেদিতা আইচ

বনজুঁই ঘুমিও না ৭ || নিবেদিতা আইচ

মফস্বলে কাটানো শৈশবের বিকেলগুলো ছিল বুনোফুলের ঘ্রাণে সুবাসিত। বন্ধুদের নিয়ে কখনো কখনো কলোনির বাইরে অনেকটা পথ হেঁটে যেতাম। সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল সেই পথের ধারে হেলায় ফুটে থাকত। একটার সাথে আরেকটা লাগিয়ে নিলে তৈরি হয়ে যেত ফুলেল অঙ্গুরীয়, সেটা পরে মনে হতো বুঝি হয়ে গেলাম ফুলেশ্বরী! বাদলা দিনে যখন আকাশটা নিত আড়ি আর ছুটোছুটির মাঠটা কাদায় থিকথিক করত তখন বেশ প্রিয় একটা খেলা ছিল এটা।

বছর ছয়েক আগে চাকরিসূত্রে আবার মফস্বলে ফিরে এলাম। ভোরবেলা ডিউটি সেরে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছি। ভেজা ভেজা সকাল ছিল। একা একা হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ টের পেলাম সেই বুনো ঘ্রাণ! ইতিউতি তাকিয়ে অনেক খুঁজেও পাইনি তার হদিশ। তবে কি হ্যালুসিনেশন? জানি না। কিন্তু ঘ্রাণ বড় মাদকীয় ব্যাপার, স্মৃতিকোষগুলোকে মুহূর্তেই অনুরণিত করে। গ্যুগল করে ছবি মিলিয়ে সেই অঙ্গুরীয় ফুলের নাম জানা গেল — দণ্ডকলস। এমন খটোমটো নামের সাথে স্মৃতির মেদুরতা একেবারেই যায় না। বইতে যা-ই লেখা থাকুক আমি একে অঙ্গুরী ফুল বলেই ডাকব বলে ঠিক করলাম।

কত চেনা অচেনা ফুলের ঘ্রাণমাখা আমাদের শৈশব তা বলে শেষ করার মতো নয়। আর ফুল নিয়ে আমাদের ছিল হরেক রকম খেলা। নয়নতারা — যাকে আমরা তখন তারাফুল, কাঠমালতী বলেও ডাকতাম, — তার পাপড়ি আঙুলের ডগায় লাগালেই হয়ে যেত লম্বা নখ। সবকটা আঙুলে মিষ্টি গোলাপি রঙের নেইলপলিশপরা নখ! দারুণ লাগত দেখতে।

নাইন-ও’ক্লক বা টাইম ফুলের নামটা তখন না জানলেও ফুলটা নিয়ে হাতের তেলোয় ঘষলে আবির রঙের আলতা হয়ে যায় — এটা ঠিক জানতাম! জলে গুলিয়ে নিলে দারুণ রঙ তৈরি হয়ে যেত। পুতুলবিয়ের আয়োজনে এই ফুলের প্রয়োজন হতো আমাদের। পরে এর আরেক নাম পর্তুলিকা বলে জানতে পেরেছি।

পিটুনিয়া আর সন্ধ্যামালতীকে মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলতাম আমি। পরবর্তীতে যখন এদের আলাদা করতে শিখেছি তখন থেকে সন্ধ্যামালতীকে ডাকতে শুরু করেছি সাঁঝমালতী৷

আরেকটা ফুল সেই দিনগুলির স্মৃতিকে রঙ্গিন করে রাখে, মৃদু লাইলাক রঙ যার। ঢোলকলমি নামটা অবশ্য এর রঙের মতো মিষ্টি নয়। বরং এর ইংরেজি নাম মর্নিং গ্লোরি শুনতে মধুর। এই ফুলগাছ দিয়ে মাঠের চারপাশে বেষ্টনী দিতে দেখেছি। আমাদের হাড়িপাতিল খেলায় অহরহ এই ফুল দিয়ে ব্যঞ্জন রান্না হতো। চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই বেগুনি রঙের কলমি ফুলের পাঁচিল ঘেরা সবুজ রঙের মাঠ। এই মাঠে আমাদের প্রিয় খেলা ছিল কানামাছি, বৌছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বরফপানি। তারপর একসময় জানা গেল এই ফুল বিষাক্ত, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, ইত্যাদি। ব্যস, ধীরে ধীরে কোথায় হারিয়ে গেল সেই মৃদু লাইলাক রঙ ফুল।

মাইজদীর বাসায় ছাদে ছিল চমৎকার বাগান। সেখান থেকে কিছু ফুল নতুন করে চেনা হয়েছিল। দুপুরমণির লালচে কমলা রঙ দেখে ঘোর লাগতো চোখে। সেই চোখেই আবার আরাম পেতাম শ্বেত কাঞ্চন আর টগরের শুভ্রতায়। পাশের বাসার বাগানে ছিল হাস্নাহেনা আর গন্ধরাজ। সে কী তীব্র সুঘ্রাণ ওদের! হাস্নাহেনার সুঘ্রাণে বাগানে সাপ চলে আসে। সম্ভবত মায়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম এ-রকম কিছু৷ তবে হাস্নাহেনা ফুটলে আর চাঁদ উঠলে এখনো নজরুলের এই গানটির কথা মনে পড়ে আমার —

নাই চিনিলে আমায় তুমি,
রইবো আধেক চেনা।
চাঁদ কি জানে কোথায় ফোটে
চাঁদনী রাতে হেনা।

সেই ছাদবাগানে বিচিত্র রঙের জবা ফুল প্রথম দেখতে পাই। লাল আর সাদা জবা ছাড়াও যে হলদে, কমলা, অগুনতি পাপড়ি বা পাঁচ পাপড়ি এত রকম জবার বাহার আছে বলে জানা ছিল না। এরপর শহর বদলাবার সাথে সাথে আরো অনেক রকমের জবা দেখেছি। সম্ভবত হলুদ জবার মতো সুন্দর মনে হয়নি আর কোনোটিই।

তখন থেকে মায়ের বারান্দাবাগানেও নানা রঙের জবার আনাগোনা শুরু হলো। জবা ছাড়া বাকি সদস্যরা ছিল নয়নতারা, নীলকণ্ঠ, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা আর গোলাপ। এদের সঙ্গে পাতাবাহার, মানিপ্ল্যান্টরা তো বরাবরই ছিল। আলোর মেলায় গিয়ে বাসার সামনে যখন সত্যিকারের বাগান করার সুযোগ হলো তখন সেখানে গাঁদা, কসমস, ডালিয়ারাও যুক্ত হলো।

চাকরিসংক্রান্ত কারণে প্রায় একযুগ পর সরযুবালা স্কুলে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট তুলতে যাই। স্কুলের বাগানে সেবার কলাবতীদের দেখে আসি। লাল আর হলুদ শরীরে হলুদ আর লাল রঙের ছিটে। ফুল নয় যেন প্রজাপতির পাখা! স্কুলের বাগানে আরো দেখা হয় মোসেন্ডা, টগর আর কল্কে ফুলদের সাথে। কল্কেফুলের নাম ততদিনে জানা হয়ে গেছে। আগে জানতাম এর নাম মধুফুল বলে।

সেবার হাঁটতে হাঁটতে আলোর মেলায় বেড়াতে গেলাম। কেমন আছে জায়গাটা একবার দেখার খুব লোভ হয়েছিল। শাপলা ভবনের সামনে যে ছোট্ট লন ছিল তার বুকজুড়ে সবুজ ঘাসের সঙ্গী ছিল লজ্জাবতী লতা। দু-হাজার সালের কথা। তখন মাঠে দৌড়াবার বয়স মাত্র শেষ হয়েছে তাই মনখারাপের বিকেলে লজ্জাবতীর সাথে খুনসুটি করে সময় কেটে যেত। আমি বারবার ওদের ছুঁয়ে দিতাম আর ওরা নুয়ে যেত, বিব্রত হতো প্রতিবারই। প্রায় একযুগ পর সেদিন আরেকবার আলোর মেলায় গিয়ে দাঁড়াতেই এইসব স্মৃতি ফিরে এল।

মনে আছে হলুদ রঙের ছোট ছোট বনগাঁদা দেখা যেত এদিক-ওদিক, প্রায় সবখানেই। সব শহরেই এর দেখা পেয়েছি। পাতার ঘ্রাণটা ছিল বেশ তীব্র। বনগাঁদার চেয়েও আকারে ছোট আরেকটা ফুল হলো ফুলকুঁড়ি, বেগুনি রঙের। এরা হয়তো বন্ধু ছিল শুরু থেকেই। তাই বনগাঁদাকে দেখতে পেলে খানিক বাদেই ফুলকুঁড়িরও দেখা মিলত।

এবার বলি পূজার ঘ্রাণমাখা, ধুপধুনোর স্মৃতিমাখা ফুলটির কথা। আমরা তখন বাগিচাগাঁও থাকি, খুব ভোরে হাঁটতে বের হলে ফেরার পথে পূজার ফুল তুলে আনতাম। পেঁজা তুলো মেঘের দিনে শিশিরস্নাত মখমলী ঘাসের গালিচায় শিউলিফুলের আলপনা যেন আমাদের অপেক্ষায় থাকত। আমরা যখন সেখানে পৌঁছুতাম বাতাস তখন তার শরীরে ওর মৃদু ঘ্রাণ মেখে অপেক্ষা করছে। সেই দিনগুলিতে ফুলের ঝুড়ি থেকে উছলে-পড়া শারদ সুন্দরী আমাদের ঘরে ঠাঁই নিত রোজ৷

অ্যালামন্ডা আর মোসেন্ডা — এই দুটির কথা না বললে ফুলের গল্প আমার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বকশিবাজারের বাসায় আমাদের দেড়তলার ঝুলবারান্দাকে অ্যালামন্ডার ঝাড় আড়াল করে রাখত প্রায় সারাবছর। আমরা যাকে অ্যালামন্ডা বা ঘণ্টাফুল বলে জানতাম রবিঠাকুর তারই নাম দিয়েছিলেন — অলকানন্দা। হলুদ রঙটা বুকের কাছে এতটা প্রগাঢ় হয়ে উঠত যে আমি বোধ হয় এর ঘ্রাণও পেতাম।

এবার বলি মোসেন্ডার কথা যার বাংলা নাম মৌসন্ধ্যা। এমন কাব্যিক একটা নাম! আর ওর পাপড়ির গায়ে যে মখমলী আস্তর তার মাঝে রীতিমতো আভিজাত্য খুঁজে পেতাম আমি। এই ফুল আমার শৈশবের বাগানে প্রায়ই ফুটে থাকত। তবে তখন এই নামটি আমার জানা ছিল না।

একটা সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করি। তা হলো অনেক ফুলকেই ভুল নামে জেনে এসেছি বহুদিন ধরে। যেমন মাধবীলতা বলে যাকে জানতাম সে অন্য কেউ, সে আসলে মধুমঞ্জরী! কাঠগোলাপ বলে জানতাম নয়নতারাকে কিন্তু কাঠগোলাপ আসলে অন্য এক স্বর্গীয় ফুল। ওর সাদার মায়া, আবিরছোঁয়া হলদে আভা আমাকে এখনো সমানভাবে মুগ্ধ করে।

বোগেনভেলিয়া বা বাগানবিলাসকে যখন থেকে শুধুমাত্র কাগজফুল বলে জানি তখন থেকেই আমার মনে মনে একটা ছেলেমানুষি ইচ্ছের জন্ম। কখনো নিজের একটা ঘর হলে, হোক সে কুঁড়েঘর তার ছাদ জুড়ে থাকবে এমন শামিয়ানা। এই ফুল আমার সমস্ত শৈশবকৈশোর রাঙিয়ে রাখে সকল রোমন্থনে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে ওর শান্ত ছায়া মাথায় নিয়ে আমার দিনের শুরু হবে — এ ব্যাপারটা শুধু ভাবনায় এলেই কেমন প্রশান্তি জাগে!

ম্যাগনোলিয়া হলো সেই ফুল যার সঙ্গে আমার আলাপ হলো এই তো গত বছর, প্রবাসে। হিম হিম সকালের পাঁশুটে আলোয় দূর থেকে মিষ্টি রঙের ঝাড়টা দেখে দ্রুত পায়ে ছুটে গিয়েছিলাম। ওকে ছুঁয়ে দিয়ে বলেছিলাম —  এতদিন কোথায় ছিলে? তন্ময় হয়ে তার রূপ দেখছিলাম আমি। পরে জেনেছি হিমচাঁপা বা উদয়পদ্ম ওরই অন্য নাম। যেমন দেখতে তেমন নামকরণ বটে!

সবশেষে বলি ভাঁটফুলের কথা। একটু জংলা মতো জায়গায় পথের ধারে থোকায় থোকায় ফোটে সাদা রঙের ভাঁটফুল। এরই ভালো নাম যে বনজুঁই! আমার প্রিয়তম বনজুঁই। আমার গল্পে প্রিয়তম নারী চরিত্রগুলোর ডাকনাম বনজুঁই, যা শুধু আমার গল্পভাবনায় রয়ে যায়, প্রকাশ্যে আসে না কখনো। আজকাল ভাবি ‘মন কেমন’-এর বয়সে এই নাম জানা থাকলে কত গদ্য, কত কবিতা লেখা হতে পারত! সময়টা তো তখন একটা অন্যমনস্ক হাওয়ায় বনজুঁইদের মতোই নিভৃতে দুলছিল।

প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you