বনজুঁই ঘুমিও না ২ || নিবেদিতা আইচ

বনজুঁই ঘুমিও না ২ || নিবেদিতা আইচ

স্কুলবেলায় আমি রেডক্রিসেন্ট এর সদস্য ছিলাম। সম্ভবত ক্লাস সিক্স কি সেভেন থেকে। তবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি মাত্র দু-বছর। ক্লাস নাইনে জেলা পর্যায়ের সদস্য বাছাইয়ের কিছু-একটা লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল, এখন ঠিক মনে নেই, সেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েছিলাম বলে আমাকে স্কুলের প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়েছিল।

তারপর হলো একটা মজার ব্যাপার। তখন সামনে একগাদা পরীক্ষা। ওরকম ঘোরতর সময়ে স্কুলে নোটিশ এল দশম জাতীয় রেডক্রিসেন্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করার জন্য স্কুলের প্রতিনিধিদের যেতে হবে। ক্যাম্প হবে গাজীপুরে। এক-সপ্তাহের আয়োজন। জীববিজ্ঞানের পারুলআপা সব তদারকি করছেন। তাঁকে আমরা যমের মতো ভয় পেতাম। আপা খুব কড়া ছিলেন আর ভীষণ বকাবকি করতেন। মানুষটা ভেতরে ভেতরে কতটা নরম ছিলেন সেটা যখন বুঝেছি তখন আমার স্কুলজীবন শেষ। আর আমি ওই শহরটাও ছেড়ে এসেছি ততদিনে। শুনেছি আপার শরীর ভালো নেই। হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ভর্তি ছিলেন তিনি। ছেলেবেলার এমন তরতাজা, দাপুটে মানুষগুলি যখন সময়ের সাথে দুর্বল হয়ে পড়েন তখন ভালো লাগে না মোটেও।

সেদিন স্কুলে নোটিশটা যখন ক্লাসে পাঠানো হলো সেই দাপুটে পারুল আপার কাছে যেতে হয়েছিল। তাকে ভয়ে ভয়ে জানাতে হয়েছে বাসা থেকে আমাকে কিছুতেই গাজীপুর যেতে দিতে রাজি হবে না। এর আগে কত র‍্যালি, প্রতিযোগিতা, শিক্ষাসপ্তাহে অংশ নিয়েছি। সবই ছিল শহরের ভেতরের ব্যাপার। এবারের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। তাছাড়া সামনে টেস্ট পরীক্ষা তারপর এসএসসি। এসব মাথায় নিয়ে আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না বাবা-মা।

বাসায় এসে বোধ হয় কিছু বলিওনি এ ব্যাপারে। জানতাম স্রেফ নিষেধ করে দিবে বাবা-মা। তারপর হঠাৎ দেখি পারুলআপা আমাদের বাসায়। দরজা খুলে তাঁকে দেখে আমি পাথর, মানে সত্যিই পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। আপা বোধহয় ধমক দিয়েই আমাকে বলেছিলেন — তোমার বাবামায়ের পারমিশন নিতে এসেছি, ডাকো তাদের। এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায়। আপা আসলে মুখে মুখে এমন রাগ দেখাতেন। কতটা স্নেহ তিনি করতেন তা ক্যাম্পে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

হ্যাঁ, ক্যাম্পে যাবার অনুমতি পাওয়া গেল সেদিনই। মা মৃদু আপত্তি করেছিল যদিও। কিন্তু বাবা আমার শিক্ষকের উপর ভরসা করে অনুমতি দিয়ে দিলো। আমি যুগপৎ বিস্ময় আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রিহার্সাল চলল প্রায় দশদিনের মতো। আমাদের সরযুবালা স্কুলেই রিহার্সালটা হতো। অন্যান্য স্কুল আর কলেজের সিনিয়রদের নিয়ে বোধহয় মোট কুড়িজনের একটা টিম হয়েছিল। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিলাম আমরা ঐ ক-দিনে।

সময় ঘনালো। ক্যাম্পে অংশ নিতে প্রথমে আমরা ঢাকা গেলাম ট্রেনে চেপে। তারপর মাইক্রোবাসে গাজীপুরে। ঢাকায় কিছু কাগুজে ফর্মালিটি বাকি ছিল বোধহয় আমাদের। সেজন্য ওভাবে যাওয়া। আমার ট্রেনজার্নি বরাবরই খুব প্রিয়। তার উপর যাত্রার সময়টা ছিল ভোররাত। কু-ঝিকঝিক শুনতে শুনতে জানালার পাশে বসে ভোর হওয়াটা দেখব এই অপেক্ষায় ছিলাম।

বাবার সাথে স্টেশনে গেলাম। সম্ভবত এগারোসিন্দুর ছিল ট্রেনের নাম। আমাকে হতবাক করে দিয়ে অ্যাডভেঞ্চারটা শুরু হলো তখুনিই। কারণ যার কাছে আমাদের টিকেটগুলো ছিল তিনি সময়মতো এসে পৌঁছাতে পারেননি স্টেশনে। এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। কী উত্তেজনা! এতগুলো মানুষ আমরা টিকেট ছাড়াই উঠে পড়লাম ট্রেনে।

যাবার সময় বাবাকে দ্বিগুণ টেনশনে রেখে গেলাম সেজন্য একটু মনখারাপও লাগছিল আমার। যা হোক, ট্রেন ছাড়তেই ভুলে গেলাম সব। পুরোটা পথ ছিল অনেক আনন্দের, উত্তেজনার। অনেক চেঁচামেচি করেছে সবাই। যারা আমাকে গোমড়ামুখী ভাবত তারাও দেখল আমি গলা মিলিয়েছি, হাহাহিহি করছি। আর আমাদের কাজকর্ম দেখে পারুলআপা রেগে আগুন হয়ে ছিলেন সারাটা ক্ষণ।

ক্যাম্পে যাবার পর দারুণ একটা সারপ্রাইজ পেলাম। আমার এমন একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল যে শুধু সেটুকু কারণেই রাগী পারুলআপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু যেমন বড় বড় চোখে তিনি তাকাতেন, কাজটা যে আত্মঘাতী হবে বুঝতে পেরে আর করা হয়নি আমার।

ক্যাম্পে যার সাথে দেখা হয়েছিল তার গল্পটা তোলা রইল পরের পর্বের জন্য।

প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস

 

… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you