সব-পেয়েছির দেশে : বুদ্ধদেবের চোখে ঠাকুরের শেষ ক’দিন ও শান্তিনিকেতন || জয়দেব কর

সব-পেয়েছির দেশে : বুদ্ধদেবের চোখে ঠাকুরের শেষ ক’দিন ও শান্তিনিকেতন || জয়দেব কর

শেয়ার করুন:

 

‘শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা’-র ভূমিকার একাংশে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, “একজন কবির বিষয়ে অন্য এক কবির মন্তব্য, অত্যুক্তি হ’লেও, ভ্রান্ত হ’লেও, মূল্যবান (কেননা কেবল কবিরাই পারেন সংক্রামকভাবে সাড়া দিতে)”। আমার ক্ষুদ্র পাঠাভিজ্ঞতায় আমি এই উদ্ধৃতিটির যথার্থতা পেয়েছি বারবার। আমার পাঠাভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে এমন অনুভব জাগল স্বয়ং তাঁরই লেখা আরেকটি বই থেকে। বইটির নাম ‘সব-পেয়েছির দেশে’। বইটি ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে দুখণ্ডে বিভক্ত।

রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন ও বুদ্ধদেব বসু — এ তিনের ছোঁয়া নিঃসন্দেহে মনোস্বাস্থ্য উন্নতির এক চমৎকার ভাব-অনুষঙ্গ। দেখার ও বলার সৌন্দর্য সৃষ্টিতে বুদ্ধদেব বসুর জুড়ি নেই । তাঁর গদ্যে বলা আর দেখার মধ্যে যে ঐক্য অনুভব করা যায়, সে-ঐক্য যে একজন নিখাদ কবির হৃদয়জাত সুন্দরের, তা বলতে আমার দ্বিধা নেই। আর যখন তিনি লিখেন কোনও কবিকে নিয়ে, তখন তো তা স্নিগ্ধ ও শান্ত এক সরোবর, অনায়াসে প্রতিফলিত করে জোছনার পূর্ণচাঁদ।

পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির মধ্যে পারস্পরিক ভিন্নতা বজায় থাকার পরও প্রজ্ঞাদীপ্ত আভায় হার্দিক সংযোগও যে সাহিত্যাকাশে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে তার প্রমাণ বুদ্ধদেবের এই ‘সব-পেয়েছির দেশে’। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষের দিকের দিনগুলোর সাথে আমাদের পরিচয়ের সাথে সাথে তাঁর বিস্তীর্ণ জীবনের সংযোগ যেমন ঘটে, তেমনই তাঁর প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার চাদরে বিস্তৃত শান্তিনিকেতনে বেড়ে ও গড়ে ওঠা আশ্রমিকদের সজীব সান্নিধ্যও যেন পাই এতে। কবির মহৎ ও বৃহৎ কল্পনার বাস্তবিক রূপ শান্তিনিকেতন আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়।


বসু এক জায়গায় লিখেছেন,

“এখানে দেখলুম কাজ যা হওয়া উচিত তা-ই, অর্থাৎ সমগ্র জীবনযাপনের ছন্দের একটা অংশ। এখানকার কাজে আছে খেলার আনন্দ, আছে ব্রতপালনের আন্তরিকতা। বিনম্র বাধ্যতা আছে, রক্তচক্ষু বাধকতা নেই। কেউ অলস নয়, আবার কাজের চাপে কেউ হাঁপিয়ে উঠছে এমনও মনে হয় না। জীবন সহজ ও স্বচ্ছন্দ। কাপড়চোপড়ের হাঙ্গামা নেই — যা খুশি পরলেই হ’লো, যেমন খুশি বেরিয়ে পড়া যায় যে-কোনো মুহূর্তে। বেরোবার জন্য যে সাজতে হয় না এটা আমি বলবোই মস্ত বাঁচোয়া। শাস্তিনিকেতনে অনুষ্ঠান আছে, কায়দাকানুনের কড়াকড় নেই। কারো সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছে হ’লে এগিয়ে গিয়ে কথা চললেই হ’লো — দূরে প’ড়ে রইলো ইনট্রোডাকশন। সব মানুষই আত্মসম্মানিত, মনুষ্যত্বই পরস্পরের মিলনক্ষেত্র, মেলামেশা তাই অত্যন্ত সহজ ও সুন্দর। মানুষের প্রাণ এখানে বিকশিত; স্বাভাবিক মনুষ্যধর্মে জ্ঞানী কর্মী ছাত্র-ছাত্রী সকলেই এখানে ধনী, তার কাছে। ফ্যাকাশে ঠেকে কলকাতার ইস্ত্রি করা নিখুঁত নির্ভুল ভদ্রতা।”

কী জীবনে, কী শিল্পে — সবখানেই ঠাকুরের বিশুদ্ধ বিস্তার। তাঁর স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা, আতিথেয়তা সবখানেই তিনি অনন্য। বুদ্ধদেব লিখেছেন,

“তাঁর চোখের আড়ালে কারুরই যে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে এটা তাঁকে বিশ্বাস করানোই শক্ত। তাঁর নানা কর্মের ভার নিয়ে তাঁর সঙ্গে যাঁরা থাকেন কি ভ্রমণ করেন, পাছে কোনো সময়ে তাঁদের খাওয়ার কোনোরকম অসুবিধে হয়, এ-দুশ্চিন্তা তাঁর কায়েমি। শুনলুম বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই রথীন্দ্রনাথের মা-র কথা তাঁর মনে প’ড়ে যায় — তাঁরও অতিথিবৎসলতা ছিলো অসামান্য।

আতিথেয়তার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত খুঁতখুঁতে, কিছুতেই ঠিক তাঁর মনের মতোটি হয় না; নিয়তকুশলকারী তাঁর পরিজনবর্গ, কিংবা অতিথিরা স্বয়ং, অনেক ক’রে বললেও তাঁর মনে এ-সন্দেহ থেকেই যায় যে অতিথির যত্নে বুঝি কোনো ত্রুটি হচ্ছে। আমরা ঠিক সময়ে চা পাচ্ছি কি না, রাত্রে আলো পাচ্ছি কি না, পাখার অভাবে হয়তো কষ্ট হচ্ছে — এ-সব বিষয়ে প্রায়ই খোঁজ নিতেন, আর আমাদের উত্তরগুলো যে নেহাৎ ভদ্রতাপ্রসূত নয়, সত্যি যে আমরা খুব সুখে আছি এ-বিষয়ে কখনোই তাঁকে তৃপ্ত করতে পেরেছি ব’লে মনে হয় না। একদিন সকালে উত্তরায়ণে চা খাচ্ছি, একটু পরেই কবির কাছে যাবো, সুধাকান্তবাবু আমাদের বললেন, শুধু খেলে হবে না, ‘কী-কী খেলেন তা তাঁকে গিয়ে বলতে হবে — বুঝলেন?’ আমরাও কবির কাছে গিয়ে এক এক ক’রে সবগুলো জিনিশের নাম আউড়িয়ে গেলুম — খেয়ে খুশি হয়েছি এ-কথা শুনে তিনি কত খুশি। রতন কুঠিতে সাপের রব যখন উঠলো তিনি ভাবলেন আমরা খুবই ভয় পেয়েছি। বিকেলের দিকে সুধাকান্তবাবুকে ডেকে বললেন, ‘উদীচীর উপর-তলাটা পরিষ্কার ক’রে দিতে বলো — ওদের সেখানে নিয়ে এসো।’ সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘এখন সব লোকজন চ’লে গিয়েছে, ও বড্ড অসুবিধে।’ কবি একটু চুপ ক’রে থেকে বললেন, ‘সে তো ঠিকই। লোকজন ডাকবে, ঘর সাফ করবে, জিনিসপত্র সরাবে — সে তো খুবই অসুবিধে। এদিকে ওরা হয়তো সারারাত জেগে ব’সে থাকবে — সেটাও অসুবিধে। কোনটা বড়ো অসুবিধে ভেবে দেখো।’

এ-কথা সুধাকান্তবাবুর মুখেই পরের দিন শুনেছিলুম। কথাটা শুনে যেমন লজ্জিত হয়েছিলুম, তেমনি রোমাঞ্চিতও হয়েছিলুম কবির স্নেহমাধুর্যে। আমরা প্রথম যেদিন চ’লে যাওয়ার প্রস্তাব করলাম কবি বললেন, ‘না, যেয়ো না। কলকাতায় এখন বড্ড গরম, ছুটি তো আছে, এখানে উপভোগ করো।’ আমরা আসাতে তিনি যে সত্যি খুশি হয়েছেন সেটা বারেবারেই ফুটেছে এমনি নানা ছোটো-ছোটো কথায় ও ঘটনায়।”

জরাগ্রস্ত শরীরের ক্লান্তি নিয়েও শান্ত ও সমাহিত চিত্তে সৃষ্টিশীলতায় তৎপর কবি কেবলই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত তাঁর বোধ ও চিন্তার তীক্ষ্ণতায়। বুদ্ধদেব লিখেছেন,

“সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে তাঁর রচনায় বিশ্ববিধাতার চাইতে নরদেবতারই প্রাধান্য। ‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো তুমি কি বেসেছো ভালো?’ এ-প্রশ্ন তাঁর মনে জেগেছে। বিদায় নেবার আগে ডাক দিতেন তাদেরই যারা দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য ঘরে-ঘরে প্রস্তুত হচ্ছে। তাঁর মুখে আজ মহামানবের জয়গান, কোনো আনুমানিক সত্য শিব সুন্দরের নয়। সত্যকে তিনি দেখেছেন জীবনে, সুন্দরকে এই জগতে, আর অশুভবিনাশের জাগতিক সাধনাতেই দেখেছেন শিবের বিস্ফুরণ। ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার হারিয়ে অতীন্দ্রিয়কে বেশি ক’রে আঁকড়ে ধরাই হয়তো স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু হয়েছে উল্টো। প্রত্যক্ষবোধের আনন্দে তিনি আজ মগ্ন। বার্ধক্যের বিজ্ঞতা তাঁকে ছুঁলো না। বেঁচে থাকবার, ভালোবাসবার অবোধ আনন্দ তাঁর চিরকালের। কখনো তিনি লুব্ধ হলেন না ঐশ্বরিকতায় কি পারলৌকিক গাম্ভীর্যে, আজ তিনি অর্জন করেছেন শুধু আন্তরিক গভীর বিনয়ের প্রজ্ঞা।”

আরেক জায়গায় লিখেছেন,

“রবীন্দ্রনাথের বইয়ের সমালোচনায় একটা সুর আজকাল প্রায়ই ধরা পড়ে — ‘বুড়ো হয়েছেন, শরীর ভালো নেই, কী আর লিখবেন — যা লিখছেন এই ঢের।’ এই পিঠ চাপড়ানো ভাবটায় তাঁর রচনার প্রতি শুধু নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতিও ঘোর অবিচার করা হয়। আজকাল কোনো লেখাই বোধ হয় তাঁকে সম্পূর্ণ তৃপ্তি দেয় না, সমালোচকদের কথা তাই অগ্রাহ্য করেন না, বরং শুনতে চান। শুনতে চান কিন্তু খাতির চান না, আধ-মনা আন্দাজি প্রশংসা চান না, তিনি জানতে চান রচনাটি হয়েছে কি না। এখানেই তাঁর বিনয়। তিনি তো মনে করতে পারতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যা লিখবে দেশের লোক তা-ই নেবে, কাজ কী আমার অন্যের কথায় কান দিয়ে।’ কিন্তু আজকের দিনেও নিজের প্রতিষ্ঠাকে তিনি গৃহীত ও অনস্বর সত্য ব’লে ধরেন না, প্রতিটি নতুন রচনার পিছনে থাকে নতুন লেখকের উৎসাহ, প্রতি বারেই তাঁর নতুন জন্ম ব’লে প্রতি বারেই তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠার দাবি। ‘হে নুতন, দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ — তাঁর এই নবতম বাণী শুধু কথার কথা নয়, ওতে আছে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সত্য।

সব চেয়ে আশ্চর্য লাগে এই যে ‘আমার যা হবার হ’য়ে গেছে’ এ ভাবটি কখনো তাঁর মনে এলো না। এ-জন্যেই এত লিখেও তিনি পুরোনো হলেন না, এত দিনেও তিনি ফুরিয়ে গেলেন না। তাঁর লেখা — রবীন্দ্রনাথের লেখা ব’লে নয় — যে-কোনো লোকের লেখা হিশেবেই দেশের লোকের মনে লেগেছে কিনা সে-বিষয়ে এখনো তিনি অনুসন্ধানী। পাঠকদের তিনি বলেন — আর কিছু দেখো না, কে লিখেছে, তার বয়েস কত, উপজীবিকা কী, সে কোন সমাজের লোক ও-সব ভুলে যাও, লেখাটা দ্যাখো। ও-সব দেখে লেখাটা যদি ভালো লাগে সে ভালো লাগাটাই খাঁটি। কোনো লেখা কারো ভালো লেগেছে শুনলে তিনি খুশিও হন, যদি সে-ভালো বলা নেহাৎই খুশি করবার জন্যে না হয়।”

বুদ্ধদেব যখন রবীন্দ্রনাথের রোগশয্যার বর্ণনা দেন, তখনও তাঁর আড়ালে থাকে প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষণ ও দর্শন। তা হৃদয়ের দরোজায় নাড়া দেয়, উপনীত করে এক অনিবার্য বাস্তবতায়। তিনি লিখেছেন,

“ফিরতি গাড়িতে ব’সে থেকে-থেকে মনে পড়লো ঐ দৃশ্য, অন্ধকার ঘরে কবির রোগশয্যা। চিরজীবী কবিকে তো দেখেছি, জরাজীর্ণ প্রাণীকেও দেখে গেলুম। অফুরান প্রাণ কী নির্মম দেহবন্ধনে আজ বন্দী। কবির চিরযৌবনের সঙ্গে জরার এ কী অসম্ভব অসঙ্গতি। সমস্ত পথ মনটা যেন স্তম্ভিত হ’য়ে রইলো — কী ভাববো ভেবে পাই না।”

সুখপাঠ্য এই বইটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আক্ষেপটাও বড়োই হৃদয়গ্রাহী। মুখবন্ধে তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, —

“এবারে শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতেই এ-বইটির কল্পনা আমার মনে আসে, এবং কলকাতায় ফেরবার অল্প ক’দিন পরেই এটি লিখতে আরম্ভ করি। এর শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের যে চিঠিটি আছে সেটি এ-বইয়ের অন্তর্গত করবার অনুমতি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম।

বইটি রবীন্দ্রনাথের হাতে দিতে পারলে ধন্য হতাম, আমার এ-সামান্য উপহার তিনি হয়তো খুশি হ’য়েই গ্রহণ করতেন। কিন্তু তা আর হ’লো না। এবারের শ্রাবণ-পূর্ণিমা এল আমাদের সর্বনাশ নিয়ে। এ-বইয়ের উন্মেষ যতো বড়ো আনন্দে, তার চেয়েও বড়ো দুঃখের দিনে এর জন্ম হ’লো। শান্তিনিকেতন যাঁদের প্রিয়, রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য রইলো আমার আনন্দ-বেদনা-মেশা এই রচনা। বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদপদটি এঁকে দিয়েছেন শ্রীযুক্ত রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানাই।
শ্রাবণ, ১৩৪৮
বু.ব।”


জয়দেব কর রচনারাশি
গানপারে বুদ্ধদেব বসু
গানপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you