১৯৮১-র জুনের এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় আমার জন্ম হয়েছিল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, মা প্রায়ই বলে এমন ফুটফুটে হয়েছিলাম যে নার্সরা আমাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু করেছিল! আমি এখনো বিশ্বাস করি তারা এক দেবদূতের জন্ম দেখে এমন নৃত্যপর হয়ে উঠেছিল! যে দেবদূতরূপ ধ্বংস করার জন্য আমি আজীবন কঠোর সাধনা করে গেছি ও যাচ্ছি! যদিও আমি এখনো নিজেকে দেবদূতই ভাবি, তবে আপনাদের ওসব স্বর্গীয় দেবদূত-টূত না; ভাবি নরকের দানবীয় বীভৎস দেবদূত! যার কাজ নকল স্বর্গে পবিত্র নরকের আগুন গেয়ে সবার মুখোশের অস্বস্তি বাড়ানো, এবং নিষ্ঠার সাথে বিনা পারিশ্রমিকে আমি সে-কাজ করে যাচ্ছি!
যা-ই হোক আমি বেড়ে উঠেছি ঝিনাইদহের মধুপুর নামক এক বেহেশতের খামারের মতো অজপাড়া গ্রামে, যদিও সম্পূর্ণ গেঁয়ো ছেলে হবার দারুণ সুযোগটা আমার বাবা, মা, ভাই হতে দেয়নি! তারা আমাকে সবসময় নাগরিক কোনো ছেলের মতো বড় করতে চেয়েছে! আমিই মনে হয় আমার গেঁয়ো বন্ধুদের ভেতর সবার শেষে সাঁতার শিখেছি, সবার শেষে শিখেছি গাছে চড়া, সাইকেল চালানো, কাবাডি খেলা, অন্যের গাছের ফল চুরি করা, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি স্বর্গীয় পবিত্র কাজ! বরং আমি সবার আগে শিখেছি সংবাদপত্র পড়া, টেলিভিশন আর রেডিওর মাধ্যমে সবকিছু জেনে বাকি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া, তখন এসব নিয়ে একটা জ্ঞানী-জ্ঞানী ভাব ছিল, কিন্তু এখন বুঝি কী বিরক্তিকর কাজ ছিল সেসব! যা নিয়ে আমি পরবর্তীতে একটা গান লিখেছিলাম যার নাম ‘সুদর্শন রোবট’। আমি জানি এসবের চেয়ে বন্ধুদের সাথে ভরা কুমারনদে সাঁতরে কেটে সবার আগে নদের ওপারে ওঠার আনন্দ গ্যুগলের বড়বাবু হবার চেয়েও কত আনন্দের!
আমাদের বাড়িতে বাবা, মা, ভাই সবাই প্রচুর গান শুনত; ভোরে ঘুম ভাঙত ন্যাশনাল ক্যাসেটপ্লেয়ারে সাগর সেনের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ শুনে। অনেকেই বলে আমার কবিতা, গানে এত বিষাক্ত বস্তুর উপস্থিতি কেন, আমি তাদের বলি — ছেলেবেলায় শোনা এই গানই মনে হয় আমাকে এমন বানিয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যাকে আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত মহামানব বলা হয় সে-ই আমাকে প্রথম চিনিয়েছিল বিষ; জীবনানন্দ, র্যাবো বা কাফকা, নীৎশে বা ডিলান নয়। কাকতালীয়ভাবে আমার পিতার শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি ছিল কীটনাশকের ব্যবসা এবং সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকায় আমার বেড়ে ওঠা — যা নিয়েও আমি পরে একটা গান লিখেছিলাম ‘আমার নাম অসুখ’। মা ছিল অনেক ধার্মিক , যদিও তার বড়ভাই মানে আমার বড়মামা ছিল বাউল, তবে সংসারযজ্ঞবিচ্যুত নয়, বিরাট সংসার ছিল তার। নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলে দেখতাম তার বিশাল বাগানবাড়িতে মামা গভীর রাতে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বব মার্লীয় বস্তুযোগে বাউল গানের আসর বসাত। মামার একপাল ভেড়া ছিল, সে যখন মাঠে তাদের চরাতে নিয়ে যেত আমিও তার সাথে যেতাম, তারপর সে কোনো গাছের ছায়ায় বসে বড় বড় ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে বাউল গান গাওয়া শুরু করত, আর আমি ভেড়াদের চরিয়ে নিয়ে বেড়াতাম মাঠে, বাউল গান প্রচ্ছন্নভাবে আমার ভেতর মনে হয় তখনই ঢুকেছিল।
আমার বড়ভাই সবসময় সারা দুনিয়াকে জানতে চাইত, কোনোভাবেই গ্রামীণ না হবার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল তার, ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য নরক ঢাকা শহরের বন্ধুদের সাথে মেশার ফলেই মনে হয় তার এমন হয়েছিল, এবং আমাকেও সে এমনভাবেই বড় করতে চেয়েছিল। ভাইয়ের জানাশোনা ছিল অনেক ভালো — তার গান, সাহিত্যের রুচি ছিল খুব ভালো। নানা ধরনের গান সে শুনত এবং আমি ছিলাম ভাই-অন্তপ্রাণ, সে যা-ই করত আমি তা অন্ধের মতো করতে চাইতাম; সে কিশোর কুমার শুনলে আমি মুখস্থ করে ফেলি কিশোর কুমার, রবীন্দ্রনাথ শুনলে আমি ঠোঁটস্থ করি রবীন্দ্রনাথ, হেমন্ত শুনলে আমি পাড়ি দিই হেমন্তের ফসলভরা মাঠের মতো উদাত্ত কণ্ঠ, মাইলস শুনলে মাইলসের সাথে পার হই মাইলের পর মাইল, ফিডব্যাক শুনলে আমিও ব্যাক করতে চাই মাকসুদের কণ্ঠে, ফিলিংস শুনলে আমিও বুঁদ হয়ে থাকি তেজোদ্দীপ্ত ঘোড়ার অনুভূতিশীল আগুনে খুরে, এলআরবি শুনলে ভেসে যাই ছোট নদীর মতো!
আমি জানি না এটা কীভাবে হয়েছে — ছোটবেলা থেকেই কোনো গান শুনলে সেটা অনুকরণ না করা পর্যন্ত আমার ঘুম আসত না, হোক তা মুজিব পরদেশী বা জেমস্ অথবা এন্ড্রু কিশোর! আমার মনে হয় প্রথাগতভাবে কোনোদিন গান না শিখেও এখনো যে গান গেয়ে যাচ্ছি সেটা আমার এই অনুকরণ-আসক্তির ফলেই, আর আমার সংগীতশিক্ষক সেই ছোট্ট ন্যাশনাল ক্যাসেটপ্লেয়ার, রেডিও আর টেলিভিশন।
বড়ভাই পড়াশোনা করতে চলে যায় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে, একবার ফেরার সময় সে আমাকে তখনকার সুমন চট্টোপ্যাধায়, অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতার এইচএমভি থেকে বের হওয়া ক্যাসেট এনে দেয়। আমাকে আর পায় কে! সারাদিন শুনি সেইসব গান। বিশেষ করে সুমন আমাকে পাগল করে দেয়, যতসময় পারি তার গান শুনতে থাকি, এত আপ্লুত কখনো হইনি! খুবই মিনিমাল অ্যারেঞ্জমেন্ট আর দারুণ ভরাট অনুভূতিশীল কণ্ঠ আমাকে বিমোহিত করে ফেলে, সামান্য একটা গিটার দিয়ে কী দারুণভাবে গেয়ে চলেছে গান! গ্রামীণ পরিবেশে নগরজীবনের এসব গানের কথা আমি বুঝতে না পারলেও টের পাই এটা আমারই গান, আর সুমন আর-কারো মতো নয়। এর আগে সব ধরনের গান আমার ভালো লাগত, কিন্তু সুমনের ‘আমার প্রেমের গান’-এর ঐ একটা লাইন “আমিও ফেঁদেছি আমার প্রেমের গান” আমাকে পুরো অন্যরকম শ্রোতা বানিয়ে তোলে, মনে হতে থাকে চারপাশের সমস্ত প্রেমের গান নকল, মানুষ শুনতে চায় আর বাজারকাটতি বেশি বলে সবাই তা গেয়ে যাচ্ছে। আমি ভয়ঙ্করভাবে সুমনকেন্দ্রিক হয়ে উঠি, অন্য গান আমাকে আর টানে না, আমার গেঁয়ো বন্ধুদের শোনাই, তারা তেমন মুগ্ধ হতে পারে না। পারবে কীভাবে ! ঐতিহ্যের চরমশীতল আনুগত্যের ভেতর এমন প্রথাহীন গায়ককে সবাই নেবে কীভাবে! এমন নতুন গায়ককে বরণ করে নেবার জন্য এই প্রাগৈতিহাসিক চরাচর কবে প্রস্তুত ছিল! মনে আছে সুমনের ‘স্তব্ধতার গান’ টানা ছত্রিশ দিন ক্যাসেটপ্লেয়ার রিওয়াইন্ড করে করে শুনেছিলাম, অনেক পরে এসে চিনেছি সাইমন অ্যান্ড গার্ফাঙ্কেলকে, যদিও এখনও আমার ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’-এর চেয়ে ধ্বনিব্যাঞ্জনাগত কারণে ‘স্তব্ধতার গান’ বেশি ভালো লাগে।
একদিন শুনলাম আমাদের গ্রামের এক বড়ভাই কোথা থেকে একটা গিটার কিনে এনেছে, আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম তার বাড়ি, গিয়ে দেখি সেটা একটা হাইওয়ান গিটার, সেটা আমার প্রথম গিটার দর্শন। ছুঁয়ে দেখিনি, কেননা সেই ভাই যে নিজে গিটারের গ-ও বাজাতে পারে না, কিন্তু কাউকে ছুঁতে দিচ্ছে না, এমনভাবে আগলে রেখেছে যেমন পিরামিড আগলে রাখে ফেরাউনের ম্যমি!
এরপর গ্রাম থেকে আমরা পাশের মফস্বল শহর ঝিনাইদহে চলে যাই, যেখানে অডিওভিশন নামে একটা ক্যাসেটের দোকান ছিল, গানখোর হিসেবে তার কর্ণধারের সাথে আমার অসম বয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, কলকাতায় তার প্রচুর যাতায়াত ছিল, সে আমাকে সুমন-অঞ্জনের সব ক্যাসেট বের হবার কয়েকদিনের ভেতর এনে দিত। আমার অনেকে গর্ব ছিল যে আমাদের পুরো জেলায় আমার সংগীতরুচি সবচেয়ে ভালো (হা হা হা), কেননা আমার কাছে সুমনের সব ক্যাসেট আছে! আমার স্কুল-কলেজজীবন পুরোটাই সুমনময়; মহীনের ঘোড়াগুলির নাম তখনও শুনিনি, তবে এটাও ঠিক বাংলা ব্যান্ডের কখন কি অ্যালবাম বের হচ্ছে সবই আমার কাছে থাকত এবং শুনতাম, কিন্তু তুলনামূলকভাবে সুমনের গান অনেক বেশি শুনতাম, জানি না সুমনের লিরিকই মনে হয়ে এর কারণ, কেননা অন্যদের লিরিক এত আলাদা করা যেত না যেভাবে সুমনকে যেত, যে-গানের কথা আমার দেখা চারপাশের পৃথিবীর মতোই, কোনো ভণিতা নেই, নেই শব্দের অহেতু কারসাজি! আর তার গলার ঐ অদ্ভুত হাই-লো-মিড ব্যালেন্স আমাকে পাগল করে রাখত।
লাজুক হবার কারণে কারো সাথে প্রেম করতে না পারলেও সুমনের গানের সব প্রেমিকা যেন আমার প্রেমিকা ছিল, আমার তখনকার কিশোরসুলভ ভাবগাম্ভীর্যহীন গলায় সেসব গান গুনগুন করে গেতে গেতে আমার না-হওয়া প্রেমিকাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম। মনে আছে একটা মেয়ের খুব প্রেমে পড়েছিলাম, যদিও তার সাথে কখনোই আমার একটা কথাও বলা হয়নি, ভেবেছিলাম তাকে নিজের মতো একটা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের বেস্ট অব প্রেমের গান উপহার দেবো, সাহসে আর কুলায়নি, কেননা তার পিতা ছিল শহরের বিখ্যাত মাতাল!
ডিলান বা লেনন বা পিট সিগার — এদের প্রথম নাম শুনেছিলাম সুমন-অঞ্জনের গান থেকে, ভাবতাম এরা অন্য কোনো গ্রহের কিছু গায়ক জন্তু; যারা খেয়ে ফেলেছে সুমন-অঞ্জনের ভারতীয় আত্মা, আর সেই খেয়ে-ফেলা আত্মা ফেরত পেতে সুমন-অঞ্জন গেয়ে যাচ্ছে গান, তবে তখনো আমি ডিলান, লেনন , সিগারের একলাইন গানও শুনিনি!
এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হতে ঢাকায় চলে আসি, কী বিস্ময়কর শহর রে ভাই! যেন মৃত জন্তুর মতো এক শহর; — যে ইনসোমনিয়া রোগে ঘুমাতে না পেরে, কোনো বিশ্বস্ত ফ্রয়েড বা ইয়ুং না পেয়ে, নিজেই নিজের জন্য ওষুধ লিখেছে — “যতদিন বেঁচে থাকবি ততদিন ঘুমাতে পারবি না, কেননা ঘুম শহরের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।“ আমি এসে উঠি আমার ভাইয়ের কাছে গ্রিন রোডের আইবিএ হোস্টেলে, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার অজপাড়াগাঁয়ের এক ছেলে কিনা এসে উঠল দেশের বাণিজ্যচক্রান্তের অংশ হবার ইঁদুরদৌড়ে বিজয়ী হতে চাওয়া একভিড় মানুষের কেন্দ্রস্থলে! গভীর নিষ্ঠার সাথে যারা ফিলিপ কটলার পড়ে। আমার অবস্থা হলো যেন টমের জন্মদিনের চিজকেকের ভেতর পড়া জেরির মতো! সারাদিন ঐসব ক্যারিয়ারিস্টিক বড় বড় মানুষের ভেতর আমি ঘুরে বেড়াই, হয়তো দুনিয়ার খেলাধুলা, সাধারণ জ্ঞান এসব নিয়ে কথা বলি, ছাদে ক্রিকেট খেলি আর বাকি সময় একা বসে থাকি ছাদের কোনায়!
একদিন আকাশে চাঁদ উঠেছে দেখে সন্ধ্যায় ছাদে যাই, গিয়ে দেখি একভিড় ছাত্রদের মাঝে একটা লোক ক্যাপ পরে গিটার বাজিয়ে গান গাচ্ছে, আমি স্তম্ভিত, দূরে গিয়ে বসি, আমার স্তম্ভিত হবার কারণ জীবনে প্রথম কাউকে সামনাসামনি গিটার বাজাতে দেখলাম, এত অসম্ভব সুন্দর সাউন্ড এমনকি এখনও হেন্ড্রিক্স, গিলমোর , ম্যাকলফলিন, পাকো ডি লুসিয়া শুনলেও মনে হয় না (এর কারণ হয়তো জীবনে প্রথম সামনাসামনি গিটার শোনা)। পরে জানতে পেরেছিলাম ছাদে যে গিটার বাজাচ্ছিল সে এদেশের গিটারনক্ষত্র নীলয় দাশ আর গাচ্ছিল ডন ম্যাকলিনের ‘ভিন্সেন্ট’। কী যে মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই সন্ধ্যায়, নীলয়দা সরোদের মতো করে গিটার বাজিয়েছিল, আর অনেক সময় দূরাগত ধূমকেতুর মতো বাজিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল গিটার, সবাই তার আঙুল দেখছিল রক্ত জমে লাল হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য নীলয়দার সাথে আমার কিছুদিনের জন্য অন্তরঙ্গতা হয়েছিল, যদিও সেটা খুব গভীর কিছু না, আপনি যদি কারো প্রতি অতি মুগ্ধ হয়ে থাকেন তার সাথে কীভাবে হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠবে!
এভাবেই কাটছিল আমার ঢাকা নরকের আধানির্বাসিত জীবন, মন বেশি খারাপ হলে ভাই আমকে বাড়ি পাঠাত দুই-একদিনের জন্য। একবার তো বাড়ি থেকে ফেরার পথে ঐ অঞ্চলে প্রথম-চালু-হওয়া এসি বাসের ভেতর সুপারভাইজারকে অনেক অনুরোধ করে সুমনের ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবাম চালাতে বললাম; দুইটা গান শেষ হওয়া মাত্র বাসের অন্য যাত্রীরা এমনভাবে চিল্লানো শুরু করল — “এসব কোনো গান হলো, এসব কি চালাও, বাংলা গান তো শেষ হয়ে গেল, কিশোর চালাও, শানু চালাও, থামাও এই লোকের গান।“ বাসের সব যাত্রীরে আমার এতটা গণ্ডমূর্খ মনে হয়েছিল যে ট্রাম্পকেও আমার এতটা গর্দভ মনে হয় না এখন!
ভাই একদিন বলল, “মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব? বাড়ি যাবি?”
আমি চুপ করে বসে আছি।
“নাকি যাদুঘরে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের শো হচ্ছে ওখানে যাবি?”
আমি তো কি করব বুঝে উঠতে পারছি না! এত দারুণ সংবাদ এর আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না, লাফিয়ে বললাম, “সুমনের শোতে যাব!” তখনকার বাস্তবতায় একটা কলেজপড়ুয়া ছাত্রের জন্য টিকেটমূল্য ছিল অনেক। ভাই বলল, “ঠিক আছে আমি টাকা দেবো তুই যা!” এত দারুণ উপহার এর আগে আমি কখনো পাইনি!
যাদুঘরে সদ্য-গোঁফগজানো আমি তখনকার আমার ঈশ্বর সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনতে গেলাম। কী অদ্ভুত তার পার্ফোর্ম্যান্স, গানের ফাঁকে ফাঁকে যেসব কথা বলে তাও যেন এক মহাকালমর্মরিত সোনাটা! আমি জানি না গান কতটুকু শুনেছিলাম, শুধু তার দিকে তাকিয়েছিলাম আফিম-আসক্ত কোনো প্রভুভক্ত কুকুরের মতো। সুমনকে সামনাসামনি দেখছি এটাই ছিল আমার মহাবিশ্ব হাতে পাওয়া, গান যেখানে সামান্য নভোযান বিশেষ! কন্সার্ট শেষ হলো, আমার মনে হচ্ছিল এত দ্রুত কেন শেষ হলো! সবাই হাততালি দিয়ে ফেটে পড়ছিল, আর আমি ভিড়ের ভেতর কেঁদে চলেছিলাম (এখন মনে হয় বুদ্ধ, ডিলান, ভ্যান গগ, নীৎশে, তারকোভস্কি, র্যাবো, জীবনানন্দ, হেন্ড্রিক্সকে দেখলেও এমন হবে বলে মনে হয় না)।
কন্সার্ট শেষ হলো, সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে, আকারে ছোট হওয়ায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পর্দার আড়ালে লুকোচুরি খেলে আমি গ্রিনরুমে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার আগেই কিছু মধ্যবয়স্ক আর তরুণীবয়স্কা সুমনের সাথে কথা বলার জন্য তাকে ঘিরে ধরেছে। কাউকে সে হতাশ করছে না, হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে। আকারে ছোট হওয়ায় আমার দিকে তার চোখ পড়ছে না, তাকিয়ে দেখি তার নাইলনস্ট্রিং গিটারটা তার হার্ডশেল গিটারের ভেতর কর্মক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। সুমনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললাম, “আপনার গিটারটা কি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?“ সে বলল, “হ্যাঁ বাবা দেখো না।” — বলেই সে তার অন্য ভক্তদের সাথে কথা বলতে লাগল। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি গিটারের দিকে নিজেকে বাড়িয়ে দিলাম, জীবনে প্রথমবারের মতো আমি কোনো গিটার ছুঁয়ে দেখলাম!
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে হার্ডশেল কাভারের ভেতর ৬ নম্বর তার থেকে যখন ১ নম্বর তারের দিকে আঙুল বুলালাম, তাতে এত সুন্দর শব্দ ঝঙ্কৃত হলো, এত দারুণ সংগীত আমি কখনো আর শুনিনি, এমনকি আন্দ্রে সেগোভিয়াও মনে হয় এত সুন্দর শব্দ বের করতে পারেনি তার গিটারে! ঠিক সে-মুহূর্তে যে আমি কখনো জানতাম না গায়ক হব, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই গিটার বাজিয়ে আজীবন আমি গান গাইব, এই কাজ করার জন্য আমার জন্ম হয়েছে আর এটা করতে করতেই আমি মরব।
তারপর এই তো গান গেয়ে যাচ্ছি, তেমন উৎকর্ষমণ্ডিত বাংলা গান নয়, নিজের গান একদম নিজের মতো আগন্তুক, সুমনের গানের ধারাবাহিকতা আমার গানে নেই, আমি এমন গান গাইতে চেয়েছি যে-গানকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের গান বলা যায় না! এবং গিটারিস্ট হিসেবে আমি জঘন্য, কোনো রকম ঝ্যাঙ্গরঝ্যাঙ্গর করে রিদম বাজিয়ে গেয়ে যাচ্ছি আমার ছন্দবিবর্জিত কবিতা!
সুমনের সেই যাদুঘরের কন্সার্টের পর আইবিএ হোস্টেলে তখনকার সময়ের জেমস্ বা নগরবাউল-এর গীতিকার আসাদ দেহলভীর সাথে আমার দেখা হয় এবং সে তার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করে। তার বন্ধু আমাকে তার পরিচয় জানিয়ে দেয়, আমি এতই অপমানিত হই যে দেহলভীকে চ্যালেঞ্জ জানাই — “আপনি বিখ্যাত বলে আমাকে অবজ্ঞা করলেন, আমিও দেখিয়ে দিব যে আমিও লিখতে পারি!“ সেই চ্যালেঞ্জে আমি জীবনে প্রথম কোনো কবিতা লিখে ফেলি আর তারপর থেকে এখনো লিখে যাচ্ছি, আর লিখতে লিখতে সুমনের গিটার আমাকে গায়ক বানিয়ে তোলে! এবং গেয়ে যাচ্ছি নরকের আগুনের গান। আস্তে আস্তে খুঁজে খুঁজে বের করি মহীনের ঘোড়াগুলি ও গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বব ডিলান, এলভিস প্রিসলি, ন্যাট কিং কোল, ডোরস ও জিম মরিসন, পিংক ফ্লয়েড, লেড জেপলিন, কুইন, কোহেন, পিট সিগার, উডি গাথরি, ক্যামেল, নির্ভানা ইত্যাদি এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি সাদা চামড়াদের গানে আর এখন এসে আটকে আছি সব কালোদের ব্লুজে!
কবীর সুমনের সাথে সেই একবারই কাছ থেকে আমার দেখা, পরে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে তার একটা শো দেখেছিলাম! এই সেদিন প্রথম কলকাতা গেলাম, একজনের কাছ থেকে তার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম, একবার ঘোরের বশে ফোন দিতে গিয়ে নিজেকে নিষ্ক্রান্ত করলাম, শেষে না মুগ্ধতা কমে যায় সামনাসামনি সাক্ষাতে। পছন্দের লোকদের সাথে দেখা করার ব্যাপারে আমার ভয় কাজ করে, যদি তারা কতৃত্ববাদী হয়ে ওঠে! এই কারণে একই শহরে থেকেও ব্যক্তিগতভাবে আমার কখনো দেখা হয়নি আজম খান, জেমস্ বা আইয়ুব বাচ্চুর সাথে, তবে এটা ঠিক হ্যাপি আখান্দ বেঁচে থাকলে কোনো কানাগলির অন্ধকারে নভোযানে ওঠার জন্য আমাদের দেখা হয়ে যেত, যেভাবে দেখা হয় কফিল আহমেদ-এর সাথে।
প্রথমবারের মতো যখন কলকাতা গেলাম — আমার একদম অপরিচিত মনে হয়নি, সেটা মনে হয় জীবনানন্দ দাশ, কবীর সুমন, মহীনের ঘোড়াগুলি আর অঞ্জন দত্তের জন্য। তাদের সব কবিতা গানে এই কলকাতা যেন আমার অনেকদিনের চেনা, সব আমি চিনি এবং গান-কবিতায় কলকাতার এসব জায়গা রাস্তা যেমন মোহময় স্বপ্নগ্রস্ত জায়গা মনে হতো, মমতা ব্যানার্জীর এই কলকাতা তার কাছে যেন কিছুই নয় একটা স্যাঁতসেঁতে বাজার ছাড়া!
আমি এখনও যখন বাংলা গান শুনি তখন কবীর সুমনের গানই শুনি, এই শহরে তার অনেক ভক্ত গায়ক আছে, অথচ আমি সবচেয় কম শুনেছি তার গান অন্যকে গাইতে, এমন একজন গায়কের গান কেউ গাচ্ছে না এটা বিভীষীকাময়, জানি তার গান গাইতে নিজের গায়কীর একটা দৃঢ় সক্ষমতা লাগে, তবু কেউ গাচ্ছে না! তার নিজের মতো করে সুমনের গান গাচ্ছে না! তুমি যদি কোনো গায়কের গান নিজের মতো করে না-ই গাইতে পারো তবে তার পূজা করে কী লাভ, জন্মদিনে অর্ঘ্য ঢেলে দিয়ে তার বিরাট ভক্ত বনে গিয়ে নিজে অনেক রুচিশীল প্রমাণ করার কী দরকার! আর এমন একজন গায়কের গান না-গাইলে একজন অনতিতরুণ গায়ক গান গাওয়া শিখবে কিভাবে!? যেভাবে উডি গাথরির গান গেয়ে বব ডিলান ডিলান হয়ে উঠেছিল তার কৈশোরে! সুমন যখন থাকবে না, শুধু তার ইউটিউব এমপিথ্রিই কি গেয়ে যাবে তার গান? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের ক্ষেত্রে এমন হলে কেমন হতো!!
অনেকদিন ভেবেছি এমন একটা লেখা লিখব, কিন্তু বাঙালি এমন প্রতিক্রিয়াশীল জাতি যে বারবার পিছিয়ে গিয়েছি এই ভেবে যে, সবাই ট্যাগ লাগাবে প্রবর রিপন হলো বাংলাদেশের কবীর সুমন (হা হা হা), যেভাবে কবীর সুমনকে অনেকে বলে বাংলার ডিলান! এ জাতি ট্যাগ লাগাতে ওস্তাদ! জিম মরিসন আমার প্রিয় গায়ক এই কথা বলেছি বলে অনেকেই বলেছে আমি বাংলাদেশের মরিসন, পিঙ্ক ফ্লয়েড প্রিয় ব্যান্ড এটা বলে শুনেছি সোনার বাংলা সার্কাস দেশি পিঙ্ক ফ্লয়েড!! বিস্ময়কর যে প্রভাব আর অনুকরণের ফারাক এই জাতির জনতা ও সমালোচকরা কখনো বুঝবে না!!!
সোনার বাংলা সার্কাস-এর ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ অ্যালবামটা আমাদের ব্যান্ডের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, এখানে সবার যার যার নিজের অভিব্যক্তি আছে, নিজস্ব অনুপ্রেরণার গল্প আছে, নিজস্ব উৎসর্গের বোধ আছে। কিন্তু যেহেতু আমি এই অ্যালবামের সব-ক’টা গানের লিরিক লিখেছি, তাই শুধু লিরিক্যাল জায়গা থেকে এই অ্যালবামটা আমি কবীর সুমনের জন্মদিনে তাকে উৎসর্গ করলাম।
যেহেতু আমাকে জন্ম দিয়েছিলো সুমনের ক্যাসেট ও গিটার, জানি সে শুনবে না তবু জীবনানন্দের মতো বলছি —
সুমন না জানুক আমার সকল গান তবু তাকেই লক্ষ্য করে …
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS