চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৬ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৬ || শেখ লুৎফর

প্রিয়তমার অদেখা মুখ


অন্ধকার আকাশটা তারায় তারায় ছেয়ে গেছে। খোয়া খোয়া কুয়াশা পথের দু-পাশের লতাপাতা, ঝাড়জংলার শরীর জড়িয়ে বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে। অহকালুও এমনিভাবে একটা নরম গতর চেপে ধরে ঘুমাতে চায়। আস্তা একটা বিছানায় একলা একলা ঘুমানোতে কোনো সুখ নাই। তাই যখন-তখন নিঁদ চটকে যায়। তখন নিশুতি রাতের দীর্ঘশ্বাসে অহাকালুর বুক জগতের মানুষের প্রতি অভিমানে ভার হয়ে আসে। তার আপন কেউ নাই। নিত নিত সে যাদেরকে তার চারপাশে দেখে তারা শুধু কতকগুলা মানুষ। এইযেন মানুষ তার গতরের আকার-প্রকার দেখে তার বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা পর্যন্ত পাল্টে দিলো! উপহাসের বিষাক্ত বাতাসে ভরে দিলো তার জিন্দিগি! মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে এইসব জটিলতা অহাকালুকে কিছু সময়ের জন্য ভাবুক করে ফেলে। রাগে-দুঃখে-অভিমানে কতক সময় সে বিমূঢ়ের মতো পড়ে থাকে। তাবাদে খেতার নিচের ওম-ওম গরমে নিচের অঙ্গটাও যদি খোমার ধরে জেগে থাকে তাতে অহার কসুর কতটুকু? আর মনের এইসব কষ্ট বাবদ তার কানা চোখটার গর্তে কত রাতের ঘুম বকেয়া পড়ে গেল?

বাজারফেরতা অহাকালুর এইসব ভাবনার মাঝে মালেক দুম করে জিসেজ্ঞস করে, — বিয়ার কী কল্লে?
অহাকালু কথাটা না-শোনার ভান করে নীরব থাকে। মাঝেমাঝে নিজের ওপর তার খুব রাগ লাগে। সবাই তাকে নিয়ে হাসে। টিটকারিভরা অহাকালু নামটা মুখভরে উচ্চারণ করে ছোট-বড় সবাই আমোদ পায়। তাই মালেকের প্রশ্নের জবাবে সে নিশ্চুপ থাকে। মালেক খেঁকিয়ে ওঠে, — এই একবেটারি, কথা কছস না ক্যা?

কিন্তু মালেকের জিজ্ঞাসায় তলে তলে তার বুকটা ধড়াস ধড়াস শুরু করে দিয়েছে। শুধু আবেগের তাড়না না, অহাকালুর বুকে কষ্টও লাগে।
একটু সুযোগ পেলেই সবাই তাকে খোঁচায়। চিটকিবিটকি পারে কিন্তু তার বিয়ে বাবদ একটা কথাও কেউ খরচ করে না। মানুষের এই ধারা। সে কাছের মানুষটার মনটা না দেখে, দেখে দূরের আসমানের তারাটাকে।

অহাকালু এখন প্রায় স্বচ্ছল মানুষের মতো। গত বছর নতুন করে ঘর তুলেছে। তালাপাতার ছানি দিয়ে ছোট একটা পাকঘরও দিয়েছে। গত চৈতের শেষে কলুপাড়ায় তেরো কুড়ি টাকাও সুদে লাগিয়েছে। বলতে গেলে এই টাকাটাই তার সারা জিন্দিগির সঞ্চয়। বছরে সাত-আট মাসের খোরাকিও হাতের হয়। মানু মিয়ার তালতলার পাঁচ কাঠা জমিন সে ভাগে করে। জমিটা কান্দা। মাটিও বিশেষ সুবিধার না। মানু ইচ্ছা করেই আজেবাজে জমিনগুলা তাদেরকে দিয়েছে। মানু মিয়া জানে তারা জান দিয়ে খেটে খেটে নিশফি জমিগুলাতেই দুনা ফসল ফলাবে।

এইবার মালেক ফিসফিস করে অহাকালুকে কয়, — কেতু মুন্সি তরে কৈছে দ্যাহা করতে।
অহাকালুর তাজা চোখটা দপ করে জ্বলে ওঠে, — অতকন কৈলে না? মুন্সির বাড়ি একমাইল পিছনে থুইয়া আইলাম! হালা সেভেন্টিস্কয়ারের পুত!
অহাকালু আক্ষেপ করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ে। মালেককে তার মারতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মালেক ক্ষ্যাপলে তার হাড় গুঁড়া করে দেবে। তাই শুধু সেভেন্টিস্কয়ারের পুত বলে গালি দেয়। মালেক কিছু বলে না। খালি ফিকফিক করে হাসে। অহাকালুকে বাড়ির পথে জোরে জোরে টানে আর বলে,  — ল অহন বাড়িত যাইগ্যা। আয়েকাইল দ্যাহা করবেনে।
অহাকালু শক্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আর ভটর ভটর করে বলে, — আমার বাল।

ভালো চোখটা চকচক করে জ্বলছেই কিন্তু নষ্টটার মাঝে শুধু থিকথিকা আন্ধকার। মালেক মনে মনে ডরায়। এই মুহূর্তে অহাকালুকে কুখাবনগরের রাক্ষসের মতো লাগছে। সে জানে, অহাকালু যতই কাঁদুক, তার কপালে বউ নাই। এই বিষয়টা মালেকের কাছে খুব আরামের। মালেক অহাকালুর একটা হাত ধরে জোরে টান দেয়, — দেরিং করিছ না, ল বাড়িত্ যাই।
অহাকালু মাথা ঝাকায়, — না, তুই যা আমি আইতাছি।

মালেক মনে মনে হাসে। আজকাল কেতু মুন্সির নাম শুনেই অহাকালুর খাওনপানির তিরাশ উপে যায়। খালি বলে, — সেভেন্টিস্কয়ারের পুত! এখন মালেকের মন বলে, সময়মতো কথাটা অহাকে না বলে সে ঠিকই করেছে। অহাকালুকে সে একদম সহ্য করতে পারে না বলে এখন মনে মনে একটা গালিও দেয়, — হালা খাচ্চর…। গত দশ বছর ধইর‌্যা একটা বেটিমানুষের জন্য চেট ধারাইতেছে আর ট্যাহা জমাইতাছে! কী টনটনা কৈর‌্যা ঘরটা দিছে! লগে একটা পাকঘর!

মালেক অন্ধকারে একলা একলা হাসে। মাঝে মাঝে মালেকের ইচ্ছা করে মাঝরাতে গিয়ে তালপাতায় ছাওয়া ঘরের চালে আগুন দিয়ে আসে। তাই সে ইচ্ছা করে কথাটা সময়মতো অহাকে বলেনি। সেই সন্ধ্যার আগে আগে শুঁটকি মাছের গলিতে কেতু মুন্সির সাথে তার দেখা হয়েছিল। যদি সে ঠিক টাইমে অহাকে খবরটা দিত তাহলে তো অহার ভোগান্তিটা কম হতো। এখন মালেক অহাকালুকে আর জোর করে না। এইবার যেতে চায় যাক। আসা-যাওয়া তিন মাইলের ঠেলা। তাবাদে সামনের গোটা পথটাই অহাকালু আজগুবি চিন্তায় ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটবে। আর একচোখের নিবু নিবু আলোতে বারবার অন্ধকার পথে উশ্টা খাবে।

অহাকালু সড়কের পাশের নাড়াক্ষেতে গিয়ে পেশাবের ছল করে কুঁথে কুঁথে পেশাব করে। পেশাব থেকে উঠে দেখে মালেক উত্তরে বাঁক নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এবার সে উল্টাদিকে হাঁটা দেয়। মনে পড়ে, জালু কলুর বউয়ের কোমরে ঢেউ দিয়ে ভেঙে ভেঙে হাঁটার কথা। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে। আর খালি সে মনে মনে আল্লা আল্লা জপে। কেতু মুন্সির হাতে নগদ দশটা টাকা ধরিয়ে দেওয়ার পর থেকে তাকে দেখলেই মুন্সির চোখ চকচক করে। সেই চকচকানি দেখেই অহাকালু বুঝেছে, খোদা চাইলে এবার তার একটাকিছু হবে। পরশু কেতু মুন্সি তাকে বলেছিল যে রাজৈ গ্রামে মুন্সির একটা ভাগ্নি আছে। একটু কালা কালা ভাব। কিন্তুক ডৌল-গড়ন নাকি খুব চনচনা। মুন্সি তাকে আশা দিয়ে বলেছে, — আমার ভাগ্নি ত, আমি কৈলে আমার বুইন ফালব ক্যামনে?
সেই থেকে গত দুই সপ্তাহ ধরে অহাকালুর চোখে নিদ নাই বললেই চলে। নজরে খালি জালু কলুর বউয়ের গতর ভাসে। বেটি মাইনশের গতর কতটা গরম আর লোতা?

এই ভাবতে ভাবতে অহাকালু কেতু মুন্সির দেউড়িতে এসে হাঁক দেয়ে, — মুন্সি সাব বাড়িত্ আছুন…, অ মুন্সি সাব!
মুন্সি ঘরের ভিতর থেকে জবাব দেয়, — ক্যাডা…কালু মিয়া না?
মুন্সির দরজার ফাঁক দিয়ে কুপিবাতির লাল আলো উঠানের অন্ধকারে পড়ে ল্যাংড়া-লোলার মতো খালি গড়াগড়ি দিচ্ছে। বাড়ির উত্তর দিক থেকে একটা খালপড়া কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসে। ভয়ে অহাকালুর বুকটা হিম হয়ে যায়। কুকুরও তাকে অপছন্দ করে! অহাকালুকে এই রাতের বেলায় দেখলে কুত্তাটাও ক্ষেপে যাবে। তাই সে চুপচাপ কলাপাতার দেউড়ির সাথে মিশে থাকে।

কুকুরটার ঘেউঘেউয়ানি আর শোনা যায় না। মাটির দেওয়ালের উপর খড়ে-ছাওয়া ছোট ছোট দুইটা ঘর। পরত পরত অন্ধকারের নিচে ঘরগুলাকে বড় বড় উঁইয়ের ঢিপি বলে অনুমান হয়। অহাকালু সেই দিকে তাকিয়ে কেতু মুন্সির ভাগ্নির মুখটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। কিন্তুক একটুও সুবিধা করতে পারে না। খালি জালু কলুর বউয়ের মুখ মনের মাঝে লাফালাফি করে। সেখানে মুন্সির ভাগ্নির মুখ রাখার কোনো ঠাঁই নাই। এই চেষ্টা এবং পারা না-পারার মাঝেই মুন্সি এসে পড়ে। কেতু মুন্সির একহাতে কুপিবাতি আরেক হাতে একটা পিঁড়ি। মুন্সির কিম্ভুত ছায়া লাফাতে লাফাতে গলা টানটান করে বিরাট একটা উটপাখির মতো অপেক্ষমান অহাকালুর সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতের বাতিটা উঁচু করে অহাকালুর মুখের সামনে ধরে মুন্সি হা-করে তাকিয়ে থাকে। বসন্তের দাগে ভরা খাউদা খাউদা মুখ। নষ্ট চোখটার থকথকে লাল গর্তের মাঝে একবিন্দু হলুদ কেতুর। ভয়ে মুন্সি আঁতকে ওঠে। কী জানি হাইল বিলের মেছো ভূতটাই বুঝি তার বাড়িতে উঠে এসেছে!
মুন্সি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হাসে, — কালু মিয়া ক্যামুন আছ?
মুন্সির সম্বোধনে অহাকালু মনে মনে সম্মান বোধ করে কিন্তু কোনো সাড়া দেয় না। সামনের তিনটা দাঁত না থাকায় মুন্সির হাসিটা যুইত ধরে না। আহাকালু লোকটার দাঁত ছাড়া খালি জায়গাটার ঘুটঘুটে আন্ধকারটা পরখ করে। খোড়লের মতো থকথকা আন্ধা। কথা বলার সময় সেই অন্ধকার গর্তটা থেকে মুন্সির থুতু ছিটকে আসে। থুতুর সাথে মুর্গির গুয়ের মতো বদ গন্ধও আসে। এখনও সেইরকম একটা কুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে মুন্সি বলে, — পিঁড়িডা নেও। বইয়া বইয়া আলাপ করি।

অহাকালু পিঁড়ি পেতে বসে। কেতু মুন্সিও বসে। তাদের মাঝে একটা কুপিবাতি ম্যাড়ম্যাড় করে জ্বলছে। বাতির শিষটা বাতাসে ফাৎ ফাৎ করে কাঁপে। অহাকালু বাতির লাল শিষটার দিকে নজর রেখে বলে, — মালেকে কৈল…
— হ।
— কি?
— সম্বাদ আছে। বিরাট সম্বাদ।
অহাকালুর বুক ধকধক করে। খুশিতে রক্তে ঢেউ ওঠে। মুখের চামড়ায় গরম আঁচ লাগে। ‘সম্বাদ আছে…’ বলতে বলতে কেতু মুন্সি নিজের পিঁড়িটা সামনের দিকে আরেকটু টেনে একেবারে অহাকালুর কাছে ঘন হয়ে বসে। আগের ভাঙা আলাপটা মুন্সি বুঝি তাদের দুইজনের মাঝে নাচতে-থাকা অন্ধকার থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে জবানে তুলে লয়, — আমার বুইনের কাছে পয়গাম লইয়া গেছিলাম। তোমার কথা সব খুইল্যা কৈছি। তোমার চৌখ্যের ব্যাপারে তাগর একটু ক্যাচরম্যাচর আছে। এছাড়া আর কোনোদিকে আপত্তি নাই।
কাছিমের গলার মতো অহাকালুর ঘাড়খানা আশায় উঁচু হয়ে ওঠে। কিন্তু মুন্সির ছোট বয়ানটা তার কাছে একেবারে অখাদ্য। সে আশা করেছিল মুন্সি একটু একটু করে সব খোলাসা করবে। নিজের বিয়েশাদির আলাপটা সে খুব মন দিয়ে শোনে। জগতে তার আপন কেউ নাই। নিজের ভবিষ্যতের কথা নিজে না শুনলে আর কে শুনবে?

তাবাদে মুন্সির কথা শুনে অহাকালু মনখারাপ করে বসে থাকে। মুন্সি চতুর নায়া। আট-দশজনের সংসারটা তাকে এই দিয়েই চালু রাখতে হয়। তাই কৌশলটা বদলায়। আলাপের মাঝ থেকে অহাকালুর চোখের ব্যাপারটা বাদ রাখতে চেষ্টা করে, — মনে কয় শক্ত কৈর‌্যা ধরলে কামডা অইব।
এই কথা শুনে অহাকালু লম্বা করে শ্বাস ছাড়ে। হতাশা! হতাশা! কাশিদ তুমি শত মাইল দৌড়ে এসে আমার জন্য বয়ে এনেছ একটুকরো আগুন!
মনে মনে এইসব ডায়ালগে তার মনটা নেতিয়ে পড়ে। গত দশ বছর ধরে সে বিয়ে আর মেয়েলোকের লোতা লোতা গতর এক করে দেখছে। কয় মাস ধরে ঘুমের যাতনাটা তাকে আরো বেশি কাবু করতেছে। ঘরটা দেওয়ার পর থেকে তার একটা দিনও কাটতে চাইছে না।
মনে কত হাউস ছিল। কাতি মাসের শেষেই সে দেওয়ালের মাটি ছানা করে রাখে। পয়লা অঘ্রানেই সে দেওয়ালের প্রথম তাক গেঁথে ফেলে। সারাদিন গিরস্তের বাড়ি কামের পর সন্ধ্যায় এসে মাঝরাত তক ছানা মাটি টিপে টিপে বসিয়েছে। তার বুড়ি মা কুপি হাতে পাশেই বসে থাকে। মা চোখের ঘুম তাড়াবার জন্য আলাপ জুড়ত। লম্বা লম্বা আলাপ। অহাকালু বিরক্ত হয়। তার মায়ের প্যাচালে বারবার চিন্তা কেটে যায়। তাই খেক্ করে ওঠে, — ফালাওছা তোমার আজাইরা প্যাচাল।
অহাকালুর মা মুখ চুন করে বসে থাকে। কাদামাটির মস্ত মস্ত দলা দুই হাতে বুক-সমান তুলে সে ছুটতে ছুটতে এসে দেওয়ালে থপাস করে বসায়। শুধু রাতে রাতে, একলা একলা এইভাবে সে তিনমাসে ঘরের দেওয়ালটা খাড়া করে ফেলে। ঘরের কড়িবর্গা রেডি করা আর ছাওয়ার জন্য একটা মানুষ রেখেছিল। কাদামাটির প্রতিটা দলার সাথে দমে দমে সে মিশিয়ে দিয়েছিল তার গতরের ঘাম আর মনের দুঃখগুলাকে।

অহাকালু বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ে। কেতু মুন্সি সেই নিশ্বাসকে ডরায়। হাদিস- কোরআন বলে, জোয়ান মর্দা কিংবা মেয়ের ঠিক টাইমে বিয়ে না হলে তার প্রতিটা নিঃশ্বাসে সাতটা দোজখের আগুন এক সাথে হাউত্ করে বেরিয়ে আসে। কেতু মুন্সি অহাকালুর নিশ্বাসের আগুন থেকে গা বাঁচানোর জন্য এখন বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়তে পড়তে বলে, — ত্যা তুমি চিন্তা কৈর না। বুইন আর বুইনের জামাইরে আমি শক্ত কৈর‌্যা ধরাম। এই বাবদ মনে কয় আরও তিন-চাইরবার যাইতে অইব রাজৈ গেরামে। বুইনের বাড়ি কি খালি হাতে কেউ যায়? যদি তুমি পারো তে আর কিছু…।
অহাকালু নিশ্চিত, কেতু মুন্সি তার বোনের বাড়ি খালি হাতেই যায়। আর যদি কিছু নেয় তবে তিনআনা দামের একপ্যাকেট গোলগোইল্যা বিস্কুট। মুন্সির চোখমুখে অনটনের আগুন সবসময় খাঁ খাঁ করে। একটু নজর করে দেখলেই ষোলোআনা ঠার পাওয়া যায়। কেতু মুন্সির তিন নম্বর মেয়েটাকে অহাকালুদের গ্রামেই বিয়ে দিয়েছে। মুন্সির মেয়ের জামাইটাও একনম্বর ফাজিল। আলাপে আলাপে কয়দিনই ফেকফেক করে তাদের সবার সামনে বলেছে, — আমার শশুর মুন্সি মানুষ। কোরান-কিতাব দৈইখ্যা আমার শউরির লগে ঘুমায় আর বছর বছর নয়া ফসল ঘরে তোলে। জনাবের একটা ফোডাও বিফল অয় না। সাত ছেইলা আর পাঁচ মাইয়ার মাঝে সবচে ছোট্টার বয়স অহন মাত্র তিন বছর।

এইতক বলেই কেতু মুন্সির মেয়ের জামাই লম্বা হাসিতে ভেঙে পড়ে। এখন অহাকালু মুন্সির ‘আর কিছু’ শব্দটার ওপর বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। যে-কোনো শর্তেই রাজি হওয়ার জন্য সে এখন একপায়ে খাড়া। মেয়েলোকের অভাবটা তার আর সয় না। তাবাদে সন্তানাদিরও ত একটা গুরুত্ব আছে। একদিন সে বুড়া হবে। মরবে। দশজনে মিলে বিলপারের কান্দায় কবর দিয়ে আসবে। তখন ঝি-পুত না থাকলে তার জন্য কে কাঁদব? আর সন্ধ্যা হলে কে তার ঘরে বাতি জ্বালাবে?

এইসব মর্মবেদনার কথা এক তিলেকের জন্যও গত পাঁচ-ছ বছর যাবৎ অহাকালুর মগজ থেকে নামছে না। তাই কেতু মুন্সির টোপটা আমূল গিলে ফেলার জন্য বকের মতো লম্বা গলাখানা সে আধহাত তক সামনের দিকে এগিয়ে দেয়, — আইয়ে কাইলই পাইবাইন। কিন্তু আমার একটা কতা…।
অহাকালু কেতু মুন্সির দু’হাত খাবলা দিয়ে ধরে ফেলে। মুন্সির মুখ থেকে ছিটকে আসা বদ গন্ধটাকে এখন সে একটুও আমল দেয় না। মুন্সির খসখসা হাত দুইটা নিজের হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে। অইদিকে কেতু মুন্সির অবস্থাও খুব নাজুক। সে সারাটা বিকাল, সন্ধ্যা বাজারের গলিতে গলিতে অহাকালুকে তালাশ করেছে। আগামীকাল তার ঘরে খারাকি শেষ হওয়ার কথা। ভাতের অভাবে এতগুলা শুকনা মুখ তার চৌপাশ থেকে খালি ‘আব্বাজি! আব্বাজি!’ ডাকবে। তাই মুন্সি তিন দিন আগেই মনস্থ করে রেখেছে, ভাগ্নির কথা বলে যদি আর দশটা টাকা অহাকালুর কাছ থেকে সে খসাতে পারে, তাহলে একমণ ধানের দাম হয়ে যায়। ঘরে ভাত আর নুন থাকলে আল্লাখোদার নামে মনটাও একটু থিতু হয়। মুন্সির ভাবনার মাঝেই অহাকালু অনুনয়ে ভেঙে পড়ে, — যে কৈর‌্যাই অয়োক, কামডা যেন অয়। আমার কেমুন জানি ডর ডর লাগে।

মুন্সি একটা বিড়ি ধরায়। পাতাকাগজের বিড়ি। অহাকালুর দিকেও একখানা বাড়িয়ে দিতে দিতে কাশি দিয়ে গলা সাফ করে, — তুমি একটা কাম কর। শহরে গিয়া নষ্ট চৌখটা বান্দায়া লও।
অহাকালু অবাক হয়, — চৌখ বান্দাইতাম মাইনে?
— মাইনে ডাক্তরে তোমার চৌখ্যের গাতাটাত একটা পাত্থরের চৌখ বসায়া দিব। দেখতে অবিকল ভালা চৌখটার মতন।
অহাকালু ফের বড় করে শ্বাস ছাড়ে, — হুনছি এইরহম আছে। কিন্তুক মেলা ট্যাহার ধাক্কা!
কেতু মুন্সি তাকে সাহস দেয়, — কত আর অইব, মনে কয় দুই কি আড়াই কুড়ি ট্যাহা।

অহাকালু একেবারে শামুকের মতো গুটিয়ে আসে। গত সাত-আট বছর ধরে তার মা শত চেষ্টা করেও তার জন্য একটা পাত্রী পায়নি। ভাইয়েরা তো সেই প্রথম দিকেই অহাকালুর বিয়ে বাবদ চিন্তাটা ছেঁটে ফেলেছে। সে যদি বিয়ে করতে না পারে, যদি নির্বংশা হয়ে কবরে যায় তবে তো তাদের পোষমাস। অহাকালুর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর…

তাবাদে যে বছর খুব আকাল হয়েছিল, ধানের দাম একলাফে উঠেছিল তেরো টাকা ছ আনা সেই বছরের কথা অহাকালুর খুব মনে পড়ে। সেইবার তারা বিরুনিয়া গেছিল একটা পাত্রী দেখতে। তাকে দেখে পাত্রীর বড়ভাই সামনাসামনি বলে ফেলেছিল, — নষ্ট চৌখটার দিকে চাইলে ক্যামুন রাক্ষস-রাক্ষস লাগে। ডর করে…।
এইসব ভেবে সে কেতু মুন্সির কোনো কথাতেই আর না বলতে পারে না। তবু সে কিন্তক…কিন্তুক করে। কেতু মুন্সি তাকে ফের বুদ্ধি জোগায়, — বাড়িত গ্যায়া আমার কতাডা ভাইববো।

অহাকালু রোদন দিয়ে উঠতে চায়। একবার ইচ্ছা করে এখান থেকে সে দৌড়ে পালায়। আড়াইকুড়ি টাকা! বড়সড় একটা বাছুরের দাম! তাবাদে সে এখন আর নিজের মন থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছে না। কালো কিন্তু ডৌল-গড়নে চনচনা একটা মেয়ের মুখ তাকে চুম্বকের মতো টেনে রাখে। এইভাবে বুঝি অহাকালুর পরানপাখিটা মুন্সির হাতে আটক হয়ে থাকতে চায়? তবু অহাকালু গতর ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে। মুন্সির কথায় আজ তার বুকটা খানখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। অভিমানে গলার স্বর বসে গেছে। অহাকালু বাসর রাতে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ দেখবে পাথরের চোখে? অহাকালু! অহাকালু! তোমার দুনিয়াটা ভৈর‌্যা গ্যাছে বিষের বাতাসে। চেয়ে দেখ, আলো নাই, বায়ু নাই, আসমানে পাখি নাই, তোমার দুঃখের দরিয়া খালি উথালপাথাল করে…।

বিড়বিড় করে দেওয়া ডায়ালগটা শুনে কেতু মুন্সিও বসা থেকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে অহার দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনের কঠিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারায় তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অহাকালু যেন এবার শেষ ডায়ালগ দেয়, — বান্দার গোস্তাকি মাপ হয় মুল্লুকে আজম, থাকুক থাকুক অধম গরিবের বুকে, তুচ্ছ অহাকালুর বুকে ঘুমিয়ে থাকুক তার অদেখা প্রিয়তমার মুখ।

এইবার অহাকালু তার ভালো চোখটার পানি মুছতে মুছতে জোর করে একটা গলা-খাকারি দিয়ে কঠিন গলায় বলে, — আর যাই কৈন মুন্সিসাব, পাত্থরের চৌখ দ্যায়া আমি বউয়ের মুখ দ্যাখতাম না।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you