সেদিন এক বন্ধুকে বলছিলাম যে মানুষ কি আর হাতে লিখবে? এখন পর্যন্ত পরীক্ষার খাতা ছাড়া আর কোথাও আমাদের হাতে লিখতে হচ্ছে না। সব ধরনের এন্ট্রি ডিজিটালি হচ্ছে। ফলে দেওয়ালে লেখা ‘সাত দিনে ইংরেজি শিখুন’, ‘মঘা ইউনানি এই পথে’, ‘মেসার্স অমুক ব্রাদার্স’, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে দশ টাকা জরিমানা’… এ-জাতীয় দেওয়াললিখনেই কেবল হাতের লেখা টিকে থাকবে। এরপরের বাস্তবতা অবশ্য অনুমান করতে পারছি না। যেমন সেদিন ক্রিশ্চিয়ান কবরস্থানে গিয়েছিলাম। সেখানে শতবর্ষী এপিটাফগুলো কী সুন্দর কতই-না কারুকার্যময়! সেখানে কতই-না দার্শনিকতাপূর্ণ কথা লেখা! সেসবের স্থলে লেমিনেটেড ফোরকালার ছবি সম্বলিত ‘সুতন্বী এম জে’ বা ‘হিন্দ শিলিগুড়ি’ ফন্টে মৃতের নাম লেখা।
হাতে-লেখা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে কেউ আর মনের গোপন কথাটি বন্ধুকে বলছে না। হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছে। ন্যুড থেকে নির্মল সকলকিছু। এটি সময়ের বৈশিষ্ট্য। ফলে হাতের লেখা এখন কবিতার মতোই এক মেমোরেবল স্পিচ। কেউ আর প্রিয় লেখকশিল্পীর কাছে অটোগ্রাফ চায় না সেল্ফি ছাড়া। টেক্সট নিরস ব্যাপার। তার দরকার ফোরকালার দগদগে ইমেজ। হাতের লেখার বিমুর্ততা তাকে আর স্পর্শ করছে না। সমস্ত হাতে-লেখা চিঠি, খাম, চিরকুট আজ মিউজিয়ামে। এসব শুনতে কবিতার মতো লাগলেও এটিই এই সময়ের বাস্তবতা। ‘হস্তাক্ষর সুন্দর হইলে পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়’ এই মেমোরেবল স্পিচটা কী নির্মমভাবে আজ কেবল পরীক্ষার খাতাতেই এসেই ঠেকেছে!
তখন আমি বুককাভার করতাম। মাঝে মাঝেই টাইপো লিখতাম। এই টাইপোটা মার্কার দিয়ে লিখেছিলাম। আমার ভালো লাগে রেডলিফ (ফ্ল্যাট নিব) মার্কার। এটা এখন অ্যাভেইলেবল না। কখনো কখনো বাঁশের ভাঙা চটা দিয়ে লিখতে ভালো লাগে। টাইপোর চ্যালেঞ্জ হলো পোস্ট প্রসেসিং। আইপ্যাড-এ আমি ভালো কোনো টাইপো লিখতে পারি নাই। মেকানিকাল লাগে। টাইপোর কথা বললে আমাদের কাইয়ুম চৌধুরীর নাম সর্বাগ্রে। তিনি বাংলা টাইপোর ঈশ্বর প্রায়। এখনো প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি মৃত্যুর পরেও কীভাবে হাজির আছেন তার অসামান্য টাইপোর জন্য। জ্যাকব নামে একজন সেই টাইপো দিয়ে কাইয়ুম ফন্ট বানিয়েছেন। কী যে দরকারি একটা কাজ করেছেন! আমাদের এখানকার বাহনলিপি আর পুরনো ঢাকার সাইনবোর্ডগুলোর টাইপো কিছুটা অবশিষ্ট আছে। সেসব নিয়ে কাজ হতে পারে। কিন্তু কে করবে কে জানে। হয়তো কোনো-এক জ্যাকব।
ছোটবেলায় মাকে দেখতাম রুমালে ফুল তুলছে। বালিশের কাভারে ফুল তুলছে। গ্রামে গেলেই দেখতাম সেখানে চৌকাঠের উপর বাঁধানো অ্যালবামে ট্যাপেস্ট্রি, তাতে কত কী লেখা, কত রকমের লেখা, ‘মায়ের মতো আপন কেহ নাই’, ‘ভুলো না আমায়’ ইত্যাদি। সেসব সুই-সুতোর গাথার ভেতর আমাদের আরেক লেখালেখির জগৎ আমরা ফেলে এসেছি। সেখানেও এক প্রকার সাহিত্য, গীতিকবিতা কান্নার মতো জমে আছে।
- ট্র্যান্সজেন্ডার ও সমানাধিকার || আফসানা কিশোয়ার - November 28, 2023
- একা || মূল :: পাওলো কোয়েলো, তর্জমা :: জাকির জাফরান - November 28, 2023
- গোলাপের নামঠিকানা || আল ইমরান সিদ্দিকী - November 28, 2023
COMMENTS