‘গরীবের সক্রেটিস’ অধ্যাপক শাহজাহান কবীর || নূরুল হক

‘গরীবের সক্রেটিস’ অধ্যাপক শাহজাহান কবীর || নূরুল হক

প্রফেসর কে এম শাহজাহান কবীর নেত্রকোণার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে শাহজাহানস্যার নামেই খ্যাত। নেত্রকোণার লৌকিক সংস্কৃতি, গান, নাট্যচর্চা, শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সাংগঠনিক ভিত্তি, নেত্রকোণার পৌষমেলা, কচিকাঁচার মেলা সহ মন ও মননের বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে একটা সমাজকে তিনি আলোকিত করে গেছেন। চারপাশকে আলোকিত করার ব্রত নিয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন — মানুষের জীবন একটা প্রদীপের মতো; নিজের সবটুকু দিয়ে দেয়াতেই এ-জীবনের সার্থকতা। মাটির সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং সারস্বত সাধনাই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা। অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই তিনি পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেছেন।

প্রতিবছর ১৫ নভেম্বর এই মহৎ শিক্ষকের জন্মদিন। নেত্রকোণার মানুষেরা এখনো এই গুণী শিক্ষক ও সংস্কৃতজনকে মনে রেখেছেন। কবি নূরুল হক তাঁর প্রিয় ছাত্র ও সহকর্মী। আমরা কবি নূরুল হকের গদ্যসংগ্রহ প্রকাশের চেষ্টা করছি। গদ্যসংগ্রহের লেখা অন্বেষণের যাত্রাপথে কবির খাতা থেকেই অসমাপ্ত এই লেখাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। শিরোনামটি নূরুল হকের লেখার ভেতরেই ছিল। সাবঅল্টার্নবাদীদের স্কুলিংয়ে প্রবেশ না করেও বলা যায়, ‘গরীবের সক্রেটিস’ কথাটিকে লেখক সম্ভবত প্রাচ্যজ্ঞানের ধারণা থেকেই উচ্চারণ করেছেন। ছোট্ট এবং অসমাপ্ত লেখা। কিন্তু এই ছোট্ট লেখার ভেতরেও স্পষ্ট হয়েছে প্রফেসর শাহজাহান কবীরের প্রতি ছাত্র ও সহকর্মী কবি নূরুল হকের দৃষ্টি ও অভিজ্ঞান।

লেখাটি পড়লে বোঝা যায়, কেন তিনি (নূরুল হক)  তাঁর শিক্ষক ও সহকর্মীকে মগড়াতীরের ‘সক্রেটিস’ বলেছেন। চিন্তায়, আয়োজনে সময় ও তারুণ্যকে সমৃদ্ধ করতে না পারলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন হয় না। লেখাটিতে তাঁর অকপট ব্যক্তিত্ব এবং তারুণিক দৃঢ়তা প্রকাশের জন্যই লেখক অধ্যাপক শাহজাহান কবীরের পারিবারিক প্রসঙ্গটি নিয়ে এসেছেন। — সরোজ মোস্তফা


‘গরীবের সক্রেটিস’ অধ্যাপক শাহজাহান কবীর :: নূরুল হক
সংগ্রহ ও গ্রন্থনা  : সরোজ মোস্তফা


অধ্যাপক শাহজাহান কবীর ছিলেন আমার শিক্ষক। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে নেত্রকোণা কলেজে আমি তাঁর সহকর্মী হয়েছিলাম। এটি একটি বিরল অভিজ্ঞতা। তার চেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন ‘গরীবের সক্রেটিস’ অর্থাৎ নেত্রকোণা কলেজের ছাত্রদের সক্রেটিস তথা নেত্রকোণা তরুণ সমাজের সক্রেটিস। গ্রীসের সক্রেটিস ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের তরুণ সমাজের পথপ্রদর্শক। তরুণদের সঙ্গে তিনি প্রায়শই আড্ডা দিতেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলতেন, প্রশ্ন করে করে নানা বিষয় জেনে নিতেন এবং পরিশেষে, প্রত্যুত্তরে তাঁদের ফিরিয়ে দিতেন অনেক অমূল্য নির্দেশনা ও চিন্তার অমর খোরাক। তিনি তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন — এমন একটা অভিযোগে অভিযুক্তও হয়েছিলেন। পরিণামে তাঁকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

অধ্যাপক শাহজাহান কবীরের মধ্যেও এই একটা প্রবণতা আমি লক্ষ করেছি। আত্মচরিত এবং সামাজিক পদচারণায় তাঁর ব্যক্তিত্বের ধরনও এমনই ছিলো। চিন্তায় ও তারুণ্যে তিনি তরুণদের সাথেই মিশতেন, আড্ডা দিতেন এবং তিনি যা জানতেন তাদেরও তা জানাতেন। তরুণসমাজ অধ্যাপক কবীরের খুব প্রিয় ছিল এবং তরুণসমাজেরও তিনি প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

তিনি বিয়েও করেছিলেন এমন একজনকে যিনি বয়সে তাঁর চেয়ে একেবারেই দূরতম প্রজন্মের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন তাঁর ছাত্রী। এক্ষেত্রেও তিনি তারুণিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দিয়েছেন। তরুণসমাজের ভেতরে থেকেছেন। তরুণসমাজের ভেতরে থাকার জন্য সক্রেটিসকে গ্রীসের অভিভাবকসমাজ অভিযুক্ত করেছিলো। তাঁরা সক্রেটিসকে হেমলক খাইয়েছিলো। নেত্রকোণার অভিভাবকসমাজ তাঁকে কিছু না বললেও তাঁর স্ত্রীর অভিভাবকপক্ষ অধ্যাপক কবীরকে অভিযুক্ত করেছিলো অর্থাৎ এই বিয়ে কখনোই তাঁরা মেনে নিতে পারেননি।

তাঁর জীবনকালীন সময়ে নেত্রকোণার সাংস্কৃতিক অঙ্গন তাঁর দ্বারাই পরিপুষ্ট হয়েছিল। নেত্রকোণা কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও তাঁর চারদিকেই আবর্তিত হতো। ছাত্রদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ছিল অসাধারণ। একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই লেখার ইতি টানব।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরিবারের সদস্য সহ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পরে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি প্রতিদিনই বদলাতে থাকে। বিশেষ করে ভেঙে যায় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড। জেলের ভেতরে জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের মাটিতে বয়ে যায় অপ্রাকৃত অস্থিরতা। সেই সময়ে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মানুষ কিছুটা স্বপ্ন ও স্বস্তির দিশা পেয়েছিল। খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকায় একটি মিছিলের আয়োজন করা হয় । ১৫ আগস্টের পর এটিই ছিল ঢাকার প্রথম মিছিল । মিছিলটি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফুল দেয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এই মিছিলে অনেকের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের মা এবং ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। এ-সম্পর্কে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, “৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানটি না ঘটলে, মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া কি সম্ভব হত? মনে হয় না।” নেত্রকোণাতেও এ-রকম একটি মিছিল হয়েছিল। ছোট শহরের সেই স্বাপ্নিক মিছিলে আমি অগ্রভাগেই ছিলাম। খালেদ মোশাররফকে হত্যার পরে নতুন সরকার গঠিত হলে আমাকে এই মিছিলে থাকার অপরাধে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে তাঁরা নিশ্চয়ই সামাজিক ভাষায় কথা বলে না। মেজর সাহেব ইতোমধ্যে শহরের গণ্যমান্য অনেক লোককে ‘বানিয়েছেন’। শব্দটা শোনার সাথে সাথে আমার গা শিউরে উঠল। শুনেছিলাম, মেজরের বাড়ি জামালপুর। পণ করেছিলাম তাকে যদি জীবনে কোনো-একবার পাই!

এ-সময়ে আমাকে রক্ষা করেছেন আমার শিক্ষক প্রফেসর শাহজাহান কবীর। সেই সময়ে শহরে খুব পরিচিত আশরাফ আলী আকন্দ সাহেবকে সাথে নিয়ে তিনি আমাকে মেজরের ডেরা থেকে উদ্ধার করেন। আশরাফ আলী আকন্দ সাহেবের ছেলে খায়রুল এবং সোহরাব আমার ছাত্র ছিল। সেই সুবাদে তিনি আমাকে জানতেন। মেজর সাহেবও তাঁকে জানতেন। আমাকে সহজে বের করে নিয়ে আসার স্বার্থেই শাহজাহান স্যার হয়তো আকন্দ সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রফেসর শাহজাহান কবীর স্যার নেত্রকোণার প্রকৃত অভিভাবক ছিলেন। মমতার অতুল্য আলো দিয়ে তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। মমতার ঢাল এমন অদৃশ্যে থাকে তা চর্মচক্ষে কেউ দেখতে না পেলেও সেই ঢালই শেষরক্ষা করে সমূহ বিপদ থেকে। তাঁর মমতার রক্ষাকবজ আমাকে বাঁচিয়ে এনেছিল।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
কবি নূরুল হক স্মরণ ও মূল্যায়ন সংকলন

COMMENTS

error: