জীবনে শীতকাল || আনম্য ফারহান

জীবনে শীতকাল || আনম্য ফারহান

আমাদের শীতকাল সমাসন্ন। জীবনে শীতকাল আসার ঘটনাটি ঘটবেই। রঙিন শীতপোশাক কিছুটা ডাকবে চনমন করা উজ্জ্বলতার দিকে। শীতকে ভালবেসে যেদিকে যাওয়ার কথা ছিল ওইদিকে একটা হালকা হলুদ কালারের ঘড়ি আছে। সেইন্টমার্টিনে কার্গো বার্জ এসে ভিড়ল অনেকদিন। সামনে শীতকাল বলেই অধিকতর গরম কোনো সমুদ্র হতে এসে থেমেছে। কালো পাথরে নীলাকাশের নিচে একটা বুক পেয়েছে এই ভুত। ভুতের সৌন্দর্য এই জাহাজ না দেখলে বোঝা একটু কঠিন। যেমন সেইন্টমার্টিন একটা আশ্চর্য মা। মায়েদের কাছে ভুত আসে। আসে শীতকাল।

শীতে যারা জ্যোৎস্না সইতে পারে না, তারা এত ব্যাকুল একেকটা প্রাণী, তারা এত মধুর সব স্বাভাবিক উভচর; তাদের কথা ভাবলে, তাদের সঙ্গ লাভ করলে, তাদেরকে জানতে জানতে জানা হয় ভালোবাসা। ভালোবাসা অনেক বড় একটা ব্যাকুল জাহাজ। যাদের ঘিরে উড়তে থাকে সী-গাল। সী-গাল এর মায়ের প্রয়োজন হয়, ভুত মা; একটা জাহাজ — সচল অথবা বিকল। এরও আগে ভালোবাসা যদি জানা হয়ে থাকে, তবে তা টাইগ্রিস ইউফ্রেটস থেকে ঘুরে আসা নয়, তা ভুতগ্রস্ততা নয়, তা এপিসোড, তা একটা প্রাথমিক বুদ্ধি। ভালোবাসা হচ্ছে প্রদক্ষিণমুখী প্রাণ, সী-গাল। জাহাজ দেখলে ছুটে আসে। জাহাজ এসে যেভাবে আটকে থাকে কিছুদিন। সেইন্টমার্টিনের মতো ভুতের কাছে যার দম প্রলম্বিত হয়। শীতকালের মতো স্থির বন্দুকে বারুদ যখন আর দিতে হয় না।

নিকটবর্তী হতে থাকলে কান্না পায়। মানুষের দুঃখ-ব্যথা এতই সরল যে সে কেঁদে দিয়ে দ্বারস্থ হয় নাশের। শুরুরও। জীবনের মতোই অনিবার্য। তখন ঝাউগাছ থেকে পবন নেমে এসে যেন বুকে ঢুকে যাচ্ছে। সাগর থেকে লোনা বরফ, চনমন নীল; চোখে গেঁথে যাচ্ছে। আর প্রাণ, অবতরণের অনুকূল ছুটি পেয়ে দেয় কেঁদে। নাচে, বুকে বুক মিলিয়ে ভালোবাসা। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটাই শীত চলছে বলে রঙিন শীতপোশাক ফুটে আছে।

ব্যক্তিগত শীতকাল আবুল হাসানের কথা মনে করিয়ে দেয়। কার্ডিগানের কথা বলত হাসান। আর বলত লালঝুঁটো পাখিকে চিনতে চাওয়ার বাসনার কথা। সূর্যোদয়ের কাছে শান্তি চাওয়ার ব্যাকুলতায় ডানা ঝাপ্টাত হাসান। খারাপ লাগে। সূর্যোদয় এত দীর্ঘ, এত বিশাল হয়ে জেগে ওঠে যে, রাতের তারা দেখার আনন্দ তখন বহুগুণ বিশ্লেষিত হয়। হাসান তাই শীতের রাতের মধ্যে একা ঢুকতে চাইত না। সূর্যোদয়ের সাথে কনকের উষ্ণ ঠোঁট চাইত। ভালবাসত। কবেকার কোনটা, তাও বলে বলে যেত। ওই-ই ছিল সূর্যোদয়ের খোঁজ।

আমরা যে জাহাজের কথা ভুলতে পারি না তা প্রদক্ষিণমুখী একটা আশ্চর্য ভুত যে, সেইজন্য। একটা অভ্যুদয়ের কথা জাহাজ সবসময় বলে। উপকূলে ভিড়লেও সে সূর্যোদয়ের মতো সবসময় প্রলম্বিত বিস্তারে রাতের সাথে যুক্ত। শীতের সাথে যুক্ত। মানুষের সকল দুঃখযাতনার সাথে প্রোথিত। সেইন্টমার্টিনের মতো সমুদ্রে বাসা বাঁধা। রাতের তারা দেখা আলোতে মানুষের মুখ যে-রকমই হোক না কেন, সঙ্গ দেয়া উচিত। যতই কান্না পাক না কেন, ঢোক গিলে ফেলতে হয় না; কাঁদাই উচিত।

শীতের সঙ্গে মরমী বা মর্মের যোগ আছে। মিস্টিসিজমের অতটা না। বরং রহস্য উদ্ঘাটনের। বরং আধ্যাত্মিকতাবাহিত অসীমের হাতছানির। জীবনকে নির্দিষ্ট করে দেয় এমন যে-কোনোকিছু ভয়ংকর। শীতের সেই ভয় ছড়ায় তাদের মধ্যে, যাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু অবস্থার মধ্যে হিসেবনিকেশ করে সম্ভাবনা সেরে ফেলতে হয়। অতি দুঃখের বিষয় তা। প্রতিটা শীত এসে এসে তাদেরকে ভীতির মধ্যে ফেলে। মোহর মেরে দেয়া হৃদয়ও বিপদ অনুভব করে। সেক্ষেত্রে অমীমাংসিত কোনোকিছুর বিস্তারে মনোযোগ দেয়া একটা কাজ। আর মীমাংসিত কোনোকিছু হলে আরও ভালো এইজন্য যে, শীত স্বাভাবিকভাবে যা আনয়ন করবে তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কাজ। দুই ক্ষেত্রেই শীতের মরমী আহ্বান খুবই কাজে লাগার ব্যাপার।

ছয় ঋতুর মধ্যে শীতকালের দেহই একমাত্র না-মরবিড না-চিয়ারিং একটা এক্সপ্লানেশন। হেমন্ত তার আভা। টোটাল ঋতুপরিক্রমার সুপ্তি।

আমাদের শীত খুব কাছেই আর আমরা শীতের মধ্যে জাহাজ নিয়ে ঢুকব। আমাদের ভর করবে সী-গাল। আমরা সমুদ্রে গিয়ে আটকে যাব কিছুদিন। সেইন্টমার্টিনে দেখব ঝাউগাছ থেকে নেমে আসছে বাতাস। একটানা আরামের ও ক্ষুধার মন্ত্র। ভুত আমাদের মনে করিয়ে দিবে পৌঁছানোর সাথে সাথে কান্না পেয়েছিল, বৃহৎ পৃথিবীর সামনে এ-রকম জেগেছিলাম একদমই একাকিত্বহীন; তাই একাকিত্বের স্মৃতি অসীমের মাঝে বুক খুলে দিয়েছিল।

রচনাকাল  ১৪/১১/২০২২


আনম্য ফারহান রচনারাশি

COMMENTS

error: