চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৫ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৫ || শেখ লুৎফর

আমি তো পিরিতি জানি না


খেলা একমনে পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছে। তার মাথার ওপর বাঁশঝাড়ের ফ্যাংলা ফ্যাংলা ছায়া। সে গুনগুন করে গাইছে, অরে বিধুমুখী দুঃখ-কষ্টে আছে রে তর শ্যাম…।

সত্যিই খেলা কষ্টে আছে। তার চওড়া কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঝিমধরা রোদের সাথে তাল দিয়ে দিনটা আজ সকালেই মেজাজ গরম করে ফেলেছে। কামে খেলার আপাতত এই নিবিষ্টতা দেখে একটুও ভাবা ঠিক হবে না যে, আজ তার মনটা চাষবাসে ফিরেছে। বরং জোর দিয়ে বলা যায়, ঝামেলাটা কত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় খেলা মনে মনে সেই পথ খুঁজছে। যে-খালটা বেনেভিটাকে দু’ফালা করে গাঙে পড়েছে তার চওড়া মুখের ঢাল-গড়ানে বসেছে খেলা। পেছনে একটা মস্ত বদ্যিরাজ গাছ। গাছটার ঘন ছায়া তার সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দু’ পাশের উঁচা পার জুড়ে ঘন বাঁশবন। নদীর এপারে পুব ওই পারে পশ্চিম। গাঙের পশ্চিমপারের দিঘলা চর জুড়ে সারি সারি মাথা। কামলা-কিষাণ সবাই পাট লওয়াতে মগ্ন। খেলা মাথা তুলে সেদিকে নজর দেয়। তেজি রোদে অল্পতেই চোখের নজর ভোঁতা হয়ে আসে। কিন্তু খেলার ভাবনাটা মন থেকে একটুও সরে না : নিশ্চয়ই তার বাপ তাকে জব্দ করার জন্যই তিনশ আঁটি পাটের আস্তা একটা জাগ নিতে কামলা রাখেনি। আর খেলা যাদেরকে আজ কামে আসতে বলেছিল সেই আজিজের দল, কী এক অসুবিধায় দুদিন পরে আসবে বলে খুব সকাল সকাল তার কাছে খবর পাঠিয়েছে।

গাঙের পশ্চিমপারে সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলে খেলা সেদিকে তাকায়। গাঙপারের চালাতে হাতদুয়েক লম্বা একটা বোয়াল মাছ ছিট পাড়ছে। এমনটা প্রায়ই হয়। পাট পচে গাঙের পানি গাব-ফলের কষের মতো কালো আর বিষাক্ত হয়ে গেছে। তাই ছোট-বড় অধিকাংশ মাছ একটু বাতাসের জন্য পানিপোকার মতো এলোপাথারি ছুটতে ছুটতে একসময় লাফ দিয়ে চাতালে উঠে পড়ে। তখন আশপাশে যারা থাকে তারা সবাই গলা ছেড়ে জোহার দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ ছুটে গিয়ে মাছটা ধরে ফেলে। এভাবেই খেলাও আজ সাত-আটটা গলদা চিংড়ি আর একটা মাঝারি চিতল মাছ ধরেছে।

পালাগানের বিখ্যাত একটা ডায়ালগে গাঙপারের বাতাস ছলকে ওঠে। সবাইকে চমকে দিয়ে পরী বলতে থাকে, বসন্তের ফুলে ফুলে সেজেছে কানন, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ভোমরার বিরহবিলাপ, বসরাই গোলাপের সুঘ্রাণে আনচান করছে আমার হৃদয় আর এমনই মধুলগ্নে আপনি কি না প্রজাসাধারণের কথাই শুধু ভাবছেন! চেয়ে দেখুন মহারাজ : উত্তরের হেমালী পর্বত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে টিয়ারা, গাইছে সারা মুল্লুকের পৌখ-পাখালী, ওই যে শুনুন — চেমন নগরের বনে বনে আজ ডাকছে কাতর হরিণীরা।

খেলা-পরী কিংবা তাদের ঘাটুদলের সবাই দিনমান একটা স্বপ্নের ঘোরে কাটায়। রাতের ঝলমলা মঞ্চের জগতটা তাদের মাথায় সবসময় টং হয়ে থাকে। তাই সংসারের কোনো জটিলতাই তাদের সেই হাউস-আবেগে নখ বসাতে পারে না। একটু ফাঁকমতো নিরালায় দলের দুই-তিনজন একসাথে হলেই নিজেদের আলাপের বিষয়টাকেও তারা রাতের রঙ্গমঞ্চের আদলে জবানে তুলে নেয়, ডায়ালগ চালাচালি করে। রাজা-উজির-রাজ্য, মহারাণী, ষড়যন্ত্র, গুপ্তচর, ধর অস্ত্র কর যুদ্ধ, এইসব শব্দের সাথে মিশ-খাইয়ে, নিজেদের বিষয়-আশয় জড়িয়ে, বিরাট বিরাট পাঠ বলে। এতেই তারা মহানন্দে থাকে। ক্ষেত-পুত, ঝি-জমিন, রোগ-শোক, দুঃখ-বেদনা কোনোকিছুতে পরোয়া নাই। আফশোস নাই। তাবাদে আশপাশের যে-কেউই শুনে খুশি হয়ে দুই-চারটা হাততালিও লাগায়। আর পরী ঠাহর করে দেখেছে, এতে তার নিজের অজান্তেই অভিনয়টাও হাড়ে-গোস্তে রপ্ত হয়ে আসছে। খেলাদের এইসব দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না যে জগতে আরো দশটা বিষয় আছে, বেঁচে থাকার নানান ঝক্কিঝামেলা আছে। যে দেখবে তারও মনে হবে, সত্যিই বেঁচে থাকাটা দারুণ একটা পালাগান!

পরীর মনের হাহাকারে খেলার কালো চকচকে গতরটা কেঁপে ওঠে। আবেগে আমুদে তার চোখদুইটা ঝলমল করছে। সে মনে মনে অবাক হয়। পরীর গলায় ডায়ালগটা কী আচান্নক ঠমক ধরেছে! কিন্তু খেলা জানে, এখন আর একমিনিট সময়ও নষ্ট করার মতো ক্ষমতা তার নাই। নদীর দুইপারে দলে দলে মানুষ পাট নিচ্ছে। পরীর গলা শুনে এতক্ষণে সবাই হাতের কাম ফেলে খেলার ফিরতি ডায়ালগের আশায় এইদিকেই কান পেতে আছে। এইতক ভাবতেই তার গলা রাজাধীরাজের মতোই গমগম করে ওঠে, — মহারানী কী সত্যিই নির্বোধ হয়ে গেলেন? এতদিনে আপনার জানা উচিত ছিল, শিকারের সময় সিংহ কখনও ঘুমায় না। আমি উদয়পুরের গুপ্তচরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। চেমন নগরের বাতাসে আজ রক্তের গন্ধ, ভয়-আতঙ্কে প্রজাদের চোখে নিদ নাই। রাজ্যের এই দুর্দিনে আমি তাদেরকে একলা ফেলে রঙ্গ-বিলাসে মত্ত হয়ে শিকারে বেরোতে পারি না। কোনো রাজা কখনও কী তাই পারে মহারানী?

পরী কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নত করে খেলার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ভাসা ভাসা চোখে কৌতুকপ্রিয় নারীর চোরা চাউনি, পিঠতক নেমে আসা ঢেউখেলানো চুলে রঙের বাহানা, — বান্দার গোস্তাকি মাফ করবেন জাহাঁপনা, এই অধম সত্যের কাছাকাছি কিছু জানে : প্রজারা চিরকাল ওলুখাগড়া। তাই তারা নিজের চেষ্টায় যুগ যুগ বাঁচে এবং নসিবের টানে দলে দলে কবরের অন্ধকারে নেমে যায়। অধমের কসুর নিবেন না খোদাবন্দ, এখন সব ফেলে এই অবলা দাসীর সাথে চলুন; নির্জন কাননের পথে আমরা পঙ্খিরাজ ঘোড়া ছোটাই।

পরীর ডায়ালগ শেষ হতেই কমপক্ষে দুইকুড়ি হাততালিতে গাঙপারের বাতাস চটাস-পটাস করে ওঠে। গাঙের পশ্চিমপার থেকে একজন জোশভরা গলায় চেঁচায়, — এই পরী, হাইঞ্জায় একসের মনাক্কা লইয়া আইতাছি কিন্তুক…।

এপার থেকে খেলাও ফিরতি খোঁচা মারে, — মনাক্কা খালি পরীর, আমারটা কই?

ওপারের জন পাল্টা জবাব দেয়, — পরীর অইলেই ত তর অয়।

লোকটার এই খোঁচামারা জবাবে চারপাশের সবাই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে। মানুষের বিটলা হাসিতে খেলা লজ্জা পায় না। এক-ধরনের বন্য আমোদে, বীরত্বে তার বুকটা ভরে ওঠে। সে জানে চারপাশের সবাই তাকে হিংসা করে। লোকে বলে, বউপালা আর ঘাটুপালা সমান কথা। খেলা বছরের পর বছর পরীর মতো ঘাটুছেরা রাখছে। আর ঘাটুটাও পাঞ্জার কৈতরের মতো তার ছায়ায় ছায়ায় হাঁটে, খায়দায়, একবিছানায় ঘুমায়। বিষয়টা লজ্জার হলেও শুধু খেলা না সবাই জানে, সামর্থ্যবান পুরুষের জন্য এটাতে খালি অহঙ্কার না পৌরুষের আভিজাত্যও আছে।

হ্যাজাকবাতির নিচে ঝলমলা মঞ্চের জীবনটা দিনেও পরীকে ছাড়তে চায় না। তাই সুর করে বিচ্ছেদ গাইতে মনটা খালি পলকে পলকে খোমার ধরে। বারবার দুইচোখে ঝলক দিয়ে ওঠে : উজ্জ্বল আলোর নিচে, মঞ্চের চারপাশে হাজার হাজার নিশ্চুপ মানুষ তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। একটা বিচ্ছেদ পরী একবার গাইলে তিন-চার দিনেই সাতগ্রামের মানুষের গলায় গলায় ঘুরতে থাকে। শিল্পী, অভিনয়, গানের কথা আর ডায়ালগ এইসব শব্দ তার জীবনটাকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে। খেলারা কেন দিনেও একটু সুযোগ পেলে পালাগানের সংলাপ বলে এখন সে এর মাহাত্ম্য বোঝে। আজকাল পরীর কাছে টাকা, জমি, কব্জির শক্তি ঘাটুগান আর পালাগানের সামনে কফ-থুতুর মতো লাগে।

খেলা পরীর দিকে তাকায়। পরীর চিকন ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের রেখা, খাড়া নাকের সাথে দুইটা টলটলা চোখ, ডিমের মতো ভরাট মুখাবয়বের ফর্সা পরীকে নজর করে দেখলে কেমন একটা মায়া লাগে। কিন্তু এখন খেলার হিসাব অন্যখানে। সে নিশ্চিত, বড়জোর আর দুই সিজন পরীকে দিয়ে বানেছাপরীর রোলটা করানো যাবে। তাবাদে পরী আবার হয়ে যাবে বছরবন্দী কামলা। মউতের মতো পরীও দিনমজুর কামলা হয়ে হারিয়ে যাবে!

খেলার মনটা ভার হয়ে আসে। পরী আবার ফজলু হয়ে যাবে? কামের তালাশে ঘুরবে গিরস্তের বাড়ি বাড়ি। মাসের পর মাস পেট ভরাবে লতিফ শাইলের মোটা ভাত, খেসারির ডাল, আলুভর্তা আর বালিঝুরি মরিচের লাল চাটনি দিয়ে?

খেলার চিন্তাটাকে একফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে পরী আবার ফিসফিস করে ওঠে, — জাহাঁপনা কী আজ অন্ন-জল স্পর্শ করবেন না?

খেলা হাতের পাটগুলাকে সামনের স্তূপে ছুঁড়ে দিয়ে নতুন আরেকটা আঁটি টেনে নেয়, — আপনি মিথ্যা ভয় পাচ্ছেন মহারানী, আমি অবশ্যই আপনার হাতে ফলার গ্রহণ করব, কিন্তু তার আগে দখল করে নেব উদয়পুরের অর্ধেকখানা রাজ্য।

মনে মনে পরী অবাক হয়। গাঙের ডহরে খেলার বাপের তিনশ আঁটি পাটের জাগ পচে জো হয়ে আছে কিন্তু খেলা বলছে পাট লওয়া শেষ করে নাস্তা খেতে যাবে!

চার-পাঁচমাস আগেও পরী এই বিষয়গুলা ধরতে পারত না। এখন পারে। একটুও না ভেবে সে-ও খেলাদের সাথে তাল মিলিয়ে ডায়ালগের জবাব ডায়ালগে দিতে পারে। ভাষাটাও অনেকটা রপ্ত হয়ে এসেছে। ওই যে খেলা মাঝে মাঝে বলে, ‘ঘাডুর খরচের ট্যাহা ভূতে জোগায়।’ এখন তার জবানেও যেন ভূতে ডায়ালগের উত্তর জোগায়। বাছা বাছা শব্দ আপনাতেই মনে ঘাই দিয়ে জেগে ওঠে। শাঁ শাঁ করে তৈরি হয়ে যায় মজার মজার ডায়ালগ। মনের গহনে বুঝি মাকড়ের মতন সব বড় বড় ওস্তাদ আছে, সেই মহা মহা ওস্তাদরাই বুঝি তার কলবে বসে কলকাঠি নেড়ে নেড়ে সব বুনন করে দেয়!

খেলা পরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে, মহারানী, এই যে দেখছেন আমাদের সামনে দিয়ে বয়ে চলা নদী, এটি কিন্তু স্বর্গপুরের সামসাদ নদী। এই নদী উদয়পুরের রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। হেরাতপুরের গুহার পাশে গিয়ে যেখান থেকে নদীটা বাঁক নিয়েছে, সেখান থেকে উদয়পুর পর্যন্ত এ-নদীর সবটাই সোনাজল। বিশ্বাস না হয় আপনি নদী থেকে এক বদনা পানি নিয়ে ঘণ্টাখানেক জ্বাল করুন। দেখবেন পানি উড়ে যাবার পর বাকিটুকু সোনা! এই সংবাদ পাওয়ার পর থেকে আমার নিদ হারাম হয়ে গেছে মহারানী। আমি হেরাতপুর থেকে উদয়পুর পর্যন্ত সবটা চোখের পলকে দখল করে নেব। তারপর সমস্ত সোনা দিয়ে বানাবো মহারানীর আসমান-উঁচা এক মূর্তি। চেমন নগরের মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখবে, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসার অমর কীর্তি।

পরী ফিরতি ডায়ালগ দেবার আগেই উত্তরের জংলার দিক থেকে মাগীকুদ্দুর গলা ভেসে আসে, — না না মহারাজ, অধম বান্দার কসুর নিবেন না, যে-কোনো মুহূর্তে দাবার চাল উল্টে যেতে পারে, আপনার স্বপ্ন চেমন নগরের ওপর দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসতে পারে। জগৎ-সংসারের ইতিহাস কী তাই বলে না জাহাঁপনা?

মাগীকুদ্দু আসাতে খেলা এবং পরী দু’জনেরই চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খেলা মাগীকুদ্দুর দিকে নজর ফেরায় : পাতলা গড়নের ছোটখাটো মানুষটার ঘন কুঁকড়া চুলগুলা কাঁধ ছাড়িয়ে গেছে। তার বুকের উপর লাল-ডোরার বড় গামছাটা শাড়ির আঁচলের মতো আড়াআড়ি করে ফেলা। রোদ-বৃষ্টি খেয়ে খেয়ে গতরটা কটকটা ঝামা। বিড়ির কষে পোড়া-চিকন ঠোঁট দুইটাতে আগ্রহ ও উপেক্ষার ঝাঁঝ। তার চলন-বলন, হাসি আর শাড়ির আঁচলের মতো বুকের গামছাখানা ঘনঘন ঠিকঠাক করা সহ সব ঠমক-ঠামক অবিকল মেয়েদের মতো। মেকাপের পর মাগীকুদ্দুর কাজলটানা চোখ আর লম্বা ধাঁচের মুখটায় সত্যিকারের রানীর মতো আচান্নক এক আভিজাত্য আসে। খেলা এইসব ঠাহর করে দেখতে দেখতে দরাজ গলায় মাগীকুদ্দুকে সম্ভাষণ জানায়, — আসুন, আসুন উজিরে আজম, আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম। তিনশ আঁটি পাটের জাগ সামসাদ দরিয়ার গভীর জলে। আহত রণহস্তীর মতো বন্দরে আমি একা। উদয়পুরের আজিজ মুনিসকে দূত মারফত জানিয়েছিলাম, সীমান্ত রক্ষায় তার সাহায্য আমার একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আজিজ শত্রুপক্ষ নজিরউদ্দীনের সেনাছাউনিতে নাম লিখিয়েছে।

মাগীকুদ্দু পলকে আসল জিনিস সমঝে ফেলে। সে আর কালু দু-জনেই আজ বেকার। কোনো কাম জোটেনি। তাই সে খেলার বাড়ির দিকেই আসছিল। মনে একটা গোপন আশাও ছিল, খেলার বাপ মাঝারি চাষা; তাই সারা বছরই কাম পাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা থাকেই। আর কাম না পেলেই কী? খেলার মায়ের কাছে বসে একটা লম্বা কিচ্ছা জুড়ে দিলে আর ফাঁকে ফাঁকে এটা-সেটা এগিয়ে দিলে, দুপুরে খাওয়ার সময় খেলার মা নিজের সাথে মাগীকেও বসিয়ে দিবে। শুধু খেলার মা কেন? চারপাশের গোটা-তিনেক গ্রামের সব স্বচ্ছল চাষাদের গিরস্তানরাই মাগীকুদ্দুর জন্য অন্তত এটা করবে। কারণ গিন্নীরা সব মাগীকুদ্দুকে পুরুষ না ভেবে তাদের স্বজাতি ভাবতেই ভালোবাসে। মাগীকুদ্দু কথায় কথায় মুখ ঝামটা দেয়, পিরিতির ডায়ালগ কয়, মাঝে মাঝে গুনগুন করে বিচ্ছেদ শোনায় আর কাম করে বাতাসের বেগে।

মাগীকুদ্দু তার বুকের গামছাখানা ফের টেনেটুনে ঠিক করে। তারপর কুর্নিশের ভঙ্গিতে ডানহাত বার-কয় কপালে ঠেকিয়ে মনের আদত কথাটা খেলাকে জানায়, — আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক মহারাজ আর আমাদের শত্রুপক্ষ উদয়পুরের ছোটরানী আপনাকে ভালোবেসে তাঁর ঢলঢল যৌবন মহারাজের পায়ে সঁপে দিক। আমার পেছনে বীরশ্রেষ্ঠ দানবকালুও আছে। আমরা সামসাদ নদীর গর্ভ থেকে তিনশ আঁটি পাট উদ্ধার করে চেমন নগরের খাজাঞ্চিখানায় জমা করে দেবো জাহাঁপনা।

মাগীকুদ্দুর সাথে দানবকালুও আছে এই খবর শুনে খেলা ছোট একটা লাফ দিয়ে ওঠে, — আল্লার কসম আমি মনে মনে ঠিক করছিলাম একআঁটি পাট লইয়াম, আরেক আঁটি গাঙ্গের পানিতে ভাসায়া দ্যায়াম। কামলা নাই কিছু নাই আমি একলা এই তিনশ আঁটি পাট লইতে লইতে গাঙপাড়েই পইচ্চ্যা মরাম।

খেলার কথায় মাগীকুদ্দ কিংবা পরী কেউই অবাক হয় না। কারণ তারা খুব ভালো করেই জানে, এইটাই আসল খেলা। সে তার বাপের চাপে গাঙপারে পাট লইতে এসেছে সত্য। কিন্তু সেটা কতক্ষণ? আছরের আজানের আগেই সে চকচকে বাবরি দুলিয়ে পরীকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চক্কর দেবে, ফাঁকমতো পালাগানের বিখ্যাত ডায়ালগ বলবে কিংবা পরীর বিচ্ছেদে মন উদাস করবে।

মাগীকুদ্দু পাতাকাগজের একটা বিড়ি ধরিয়ে, নেংটি কষে গাঙের কুটকুটা কালো পানিতে নেমে পড়ে। পরপর পাঁচআঁটি পাট চাতালে তুলে এনে সামনে নিয়ে বসে। নরম-সরম সকালটা ঝিমধরা রোদের কামড়ে খুব তাড়াতাড়িই মরে যায়। মেয়েদের নাকের নথ দুলানোর মতো করে উলুঝুলু বাতাস ডালপালায় দুই-একটা দুলুনি দিয়ে মাঝপথেই মারা পড়ে। খেলার গতর ঘামে চকচকা। এখন মাগীকুদ্দুরও ঘামঝরা শুরু হয়েছে। ছায়ার দিকে একটু শুকনা-মতো জাগায় ভাঁটপাতা ভাঁজ করে পরী বসে আছে। ঠিক তখন দানবকালুর হেঁড়ে গলার ডায়ালগে গাঙপারটা থরথর করে কেঁপে ওঠে, — বিধাতা নিশ্চয়ই চায় না দৈত্যরাজ দানুকার্তিক আজ বিনা যুদ্ধে হেরে যাক। তাই তিনি আমাকে এক পয়গাম দিয়ে চেমন নগরের মহারাজের কাছে পাঠিয়েছেন।

খেলা তার হাতের পাট ফেলে শাঁ করে উঠে দাঁড়ায়। এরই মাঝে পরীও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিরাট চেহারা-গতর আর বিড়ালের লেজের মতো বাঁক-খাওয়া চওড়া গোঁফের দানবকালু সত্যিই দানবের মতো থপথপ পায়ে খেলাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

সকাল থেকেই দানবকালুর মনটা মরে আছে। সারাটা গ্রাম ঘুরে সে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছিল আজ তার বরাত মন্দ। ঘরেও দারুণ টানাটানি। দানবকালুর মনে কয় এইবার বুঝি তার হাঁড়িতে আকালটা একটু আগেভাগেই এসে আসন নিয়েছে। একসের চালের দাম এখনই দশআনা ছাড়িয়ে গেছে! একটা দিন কাম না পাওয়া মানে একটাকার ঘাটতি। এই ঘাটতি দৈত্যরাজ কী দিয়ে পোষাবে?

খেলা বীরের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, — আসুন, আসুন, আসন গ্রহণ করুন দৈত্যরাজ। কাল ছিল পূর্ণিমা তিথি। রাতের প্রথম প্রহরে আজিজ সামন্তর কাছে দূত পাঠিয়েছিলাম এই বলে যে আমার সেনাসাহায্য প্রয়োজন। তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি জানি, আপনি শুধু আমার আত্মীয় নন, পরম বন্ধুও। তাই তো আপনি আমার দুর্দিনে ছুটে এসেছেন আমার ধন-প্রাণ রক্ষায়। আপনার এই বদান্যতার কথা আমার হৃদয়ে চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে দৈত্যরাজ।

পরী, মাগীকুদ্দু দু’জনেই আস্তে আস্তে বার-কয় হাততালি দেয়। দানবকালু পরীর গাল টিপে দেয়। চোখের ইশারায় জানতে চায়, সে কেমন আছে? তাবাদে তামাকপাতা গুঁড়ো করে কাটা কাগজ পাকিয়ে বিড়ি বানায়। খেলাকে একবার জিজ্ঞেস করে তার জন্যও বিড়ি বানাবে কী না? খেলা তার ভেজা হাত দুইটা পাছায় মুছতে মুছতে দানবকালুর দিকে এগিয়ে আসে। কালুর কানের ফাঁকে গুঁজে রাখা এইমাত্র বানানো বিড়িটা তুলে নেয়। তারপর পরীর দিকে ফিরে বলে, — তুই বাড়িত যা। মায়রে কৈছ, মানুষ আছে দুইজন।

পরী একবার সুরুজ দেখে, একবার খেলাকে দেখে। তার মনের ভাব দেখেই খেলা বোঝে পরী জানতে চাইছে, তারা এখনও কী সকালের নাস্তা খাবে না? তাই খেলা আবার বলে, — এই মাছগুলান লইয়া বাড়িত যা। মায়রে কৈছ চিড়া-মুড়ি আর কলাটলা থাকলে পাডায়া দিতে।

একটু পরে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ভেসে আসে পরীর গলা, —

আমি তো পিরিতি জানি না,
পাড়ার লোকেরা ছাড়ে না।
জোর করিয়া দেয় পিরিতির বায়না
হাঁইটা যাইতে কত লোকে
আমার দিকে চেয়ে থাকে।
আমি তো পিরিতি জানি না…

দানবকালু, খেলা কাজের মাঝেই কান পেতে রাখে; কিন্তু মাগীকুদ্দু হাতের পাট-সোলা সব ফেলে শরীরে মিনতির ভঙ্গি তুলে গায় :

ও কি চ্যাংড়া বন্ধুয়া রে,
আমি তো পিরিতি জানি না

খেলা এবার মাগীকুদ্দুর দিকে তাকায়।

মাগীকুদ্দু একটা আজব মানুষ। সংসারের কোনো হিসাবের সাথেই তাকে যেন মিলানো কঠিন। চৌদ্দ-পনেরো বছর আগে তার মা তাকে বিয়ে করিয়েছিল। বউয়ের সাথে ঘরও করেছে মাস-তিনেক। কিন্তু মাগীকুদ্দু নতুন বউয়ের সাথে ঘুমানোর চে বেশি করেছে ঝগড়া-ফ্যাসাদ।

মাগীকুদ্দুর বউ চাইত গতরখাটা কামের পাই পাই হিসাব। চাইত ভবিষ্যতের জন্য একটু একটু মজুদ করতে। ইশারা-ইঙ্গিতে ছেলেপুলের কথা কৈত। কৈত, একটা পৈসা জমানো মানে একটা সুখ জমানো। মাগীকুদ্দুও অরাজি ছিল না। কিন্তু সবকিছুতে বউয়ের খবরদারি মাগীকুদ্দুর একটুও ভালো লাগেনি। সে পালাগানে রানীর পাঠ করে আজ ত্রিশ বছর। তার কথা স্বয়ং মাহারাজাও চুপ করে শোনেন, যুক্তিমতো সায় দেন। আর কোনখানের একটা ঢ্যামনি, তিনদিন হইছে না তার ঘরে আইছে, কথায় কথায় তর্ক করে!

মাগীকুদ্দু ভাবে, তার জিন্দিগি শেষ। ব্যস, আর যায় কৈ? সে বুকের গামছাখানা আঁটো করে পেঁচিয়ে, চিকন ঠোঁট দু-খানা বাঁকিয়ে সতীনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। ঝগড়াটা যখন জমে উঠত তখন পড়শীরা দেখত মাগীকুদ্দুরা স্বামী-স্ত্রীতে নয় যেন সতীনে সতীনে ঝগড়ার বাইচ দিচ্ছে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you