চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর

তুমি রাবণ হলে আমি হব রাম


যারা আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসে তারা নিশ্চিত দুঃসাহসী ও দুষ্কর্মপ্রিয়। তারা মাকড়সার মতো পদে পদে কুটিলতার জাল বিস্তার করে এবং নানান রকম খোলসের মাঝে নিজের বদখত চেহারাটা লুকিয়ে রাখার জন্য বারে বারে রঙ বদলায়। তাই মানু মিয়া দিলখোলা মানুষের মতো ভরাট পরানে বলে, — ঠিক আছে। ল দ্যাহি কী করা যায়। কিন্তুক পরী কৈ?
— হেরে নাস্তা খাওয়া, ঘুমাইতে কইয়া আইছি। সাবধান কইরা আইছি, হে যেন একলা একলা ঘরের বাইরে পাও না বাড়ায়।
— হুঁ।

হুঁ বলে মানু মিয়া চলতে শুরু করে।

খেলার মেজাজটা তেতে ওঠে। তালুকদারদের কাছ থেকে মানু মিয়ার ধার-করা বড়লোকি ঠমক আর হুঁ বলার ভঙ্গিটা সে একদম সহ্য করতে পারে না।

মানু মিয়া বিলপারের কড়ইতলায় এসে দাঁড়ায়। পাশে খেলা। পুবপাড়ের কান্দায় কাদু-কালুদের বসতি। ওদের শৈল-গতর দেওদানবের মতো কালো কুতকুতে আর বিরাট বিরাট, এজন্য লোকে ওদের বাড়িকে বলে দেওবাড়ি অর্থাৎ দানবদের বাড়ি। মানু মিয়া খেলার দিকে চোখ ফেরায়, — দানবকালুগরে ডাক দে।
খেলা গামছায় ঘাড় মুছতে মুছতে হাঁক দেয়, — কালু … কালু রে…।

কয়েকটা ডাক দিতেই বিশাল গতরের দানবকালু মাটির দেওয়ালের উপর তালপাতায় ছাওয়া ছোট্ট একটা ঘর থেকে উবু হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়, — কী অইছে?
— কতা আছে এই দিকে আয়।

আশিন-কার্তিক মাসে গ্রামের ঘরে ঘরে থাকে নীরব দুর্ভিক্ষ। মাঠে মাঠে ধানের সবুজ শীষ খয়েরি রঙ ধরতে শুরু করে। তাই কাজকাম বলতে কিচ্ছু না থাকায় গরিব চাষা আর কামলারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। কেউ কেউ উপাস পেটে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকে। দানবকালুও হয়ত তা-ই ছিল। সেই কারণেই দানবকালুর কানে খেলার কথাটা ভিন্ন অর্থে বাজে। তাই দানবকালু আচান্নক গলায় জানতে চায়, — কোনো অসুবিধা অইছে নাহি?
খেলা দানবকালুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জোরে হাঁক মেরে বলে, — জলদি কর।

এই তাগদায় দানবকালুর গরম চান্দিতে ঘূর্ণি ওঠে। খেলা যখন তাড়াতাড়ি আসার কথা বলছে তার মানে মসিবত আছে। সে বিলের পুব-উত্তর কান্দার অন্য বসতিদের উদ্দেশ্য করে জানপ্রাণ দিয়ে একটা হাঁক মারে। সেই বাঘা গর্জন বিলপারের কান্দায় কান্দায় আছাড় খেয়ে কাঁপতে শুরু করে। তার ফলাফল হয় আচান্নক। খেলা মানু মিয়ার দিকে তাকায়। মানু মিয়া নীরবে তার খাটো, মোটা আঙুল দিয়ে চিকন গোঁফে তা দিয়েই চলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিলপারটা ডাকাডাকিতে, ছোটাছুটিতে গরম হয়ে ওঠে। দুই মিনিটের মাঝে মানুর গোটা দলটা বিলপারের কড়ইতলায় জংবাজ মূর্তিতে ছুটে এসে হাজির হয়। উত্তেজিত মানুষগুলার হাতে কোনো-না-কোনো অস্ত্র। ওরা ভেবেছে ফন্দিবাজ আমজদ ঢালীর পক্ষ থেকে পরীকে হরণ করে নেবার জন্য হামলা হয়েছে। মণ্ডলপাড়া আর কলুপড়ার মানুষগুলা ততক্ষণে একটা জবরজং তামশা দেখতে যার যার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গাছপালার আবডালে বৌ-ঝিরাও চকচকা চোখে তাকিয়ে দেখছে। ঘাটুদলের এই মানুষগুলার প্রতি তাদের আগ্রহের অন্ত নাই। কম-বেশি সকলেই মানে, এই মানুষগুলা ঘাটুছেরা নিয়ে ঘুমায়। তাই সকলের মনে একটা নাক-সিঁটকানো ভাব আছে, আবার গোপন আসক্তিও আছে। ভয় এবং হিংসাও আছে এই গোঁয়ার-গোবিন্দ মানুষগুলার প্রতি। গড়পড়তা জীবনের পাঙসা খোলস ভেঙে ওরা কেমন রাজা-উজির সেজে মঞ্চ কাঁপায়, মক্ষিরাণীর মতো ঘাটুছেরাকে ঘিরে জোটবদ্ধ হয়ে চলাচল করে, সংসারের পঞ্চ-তরফের দায়দুক্কু দু-পায়ে ঠেলে কেমন ফকফক করে হাসে, যখনতখন মাথার বাবরি ঝাঁকি দিয়ে গানে টান মারে, গামছা-লুঙ্গির আড়ালে চকচকা অস্ত্র নিয়ে বীরের মতো হাঁটে, তাই খেলাদের দিকে মানুষের আগ্রহের শেষ নাই।

দানবকালুর বিশাল বাবরিখানা এলোমেলো, যেন অড়ং জংলা অর্থাৎ বিরাট একটা জংলার রূপ নিয়েছে। কাঁধে তার পরম বন্ধু সাড়ে-তিনহাত লম্বা রামদাটা। রোদের জেল্লায় সেটা ঝিকঝিক করছে। দলের দ্বিতীয় কালু অর্থাৎ অহাকালু লগির মতো লিকলিকে আর লম্বা। শিশুকালে গুটিবসন্ত থেকে দৈবক্রমে বেঁচে গেলেও একটা চোখ তার নিয়ে গেছে। গলে-যাওয়া চোখের মণির জায়গাটা এখন ঘায়ের মতো থিকথিকা। সেটা থেকে সারাবছর আঠালো রস ঝরে। সেই থেকে গ্রামের পাঁচজনে তাকে নাম দিয়েছে একব্যাটারি। আর লগির মতো লম্বা বলে ঘাটুদলে তার নাম পড়েছে অহাকালু। একটা চোখ সম্বল করেই দলের মধ্যে সে নিখুঁত তিরন্দাজদের একজন। তাই দলে তার কদর আছে। সে তার তির-ধনুক নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছে।

কার্তিক মাসে কাম নাই। গরিবদের ঘরে ভাতের খুব অভাব। কিষাণ-কামলারা তাই এই মাসটাকে বলে মরাকার্তিক। সেই সুবাদে মাগীকুদ্দু বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। তার ঝাড়া হাত-পা। সংসারে তার বুড়ি মা ছিল। তিন বছর আগে সে-ও মরে গেছে। তার বিচারে বউ মানে বেড়ি। সোনার হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি। তাবাদে ঘরে বউ থাকা মানে কুকুরির মতো বছর বছর ছানাপোনা আসতেই থাকবে। বিছানায় বাড়তে থাকবে বালিশের সংখ্যা। তখন এক ভাতের চিন্তা তোমার সকল সুখ-শান্তি হরণ করে নেবে। তারচে রাতের রঙ্গমঞ্চে রানির পাঠ বলা আর আমুদেসামুদে জীবন কাটানোতে কত সুবিধা! তাই বিয়ের তিনমাসের মাথায় মাগীকুদ্দু বউকে ঝাড়ু মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

ক্ষেত-খলায় যখন কোনো কাম থাকে না, তখন মাগীকুদ্দু তার বুকের গামছাখানা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে একটা বিচ্ছেদগান গাইতে গাইতে গিরস্তের অন্দরবাড়িতে হাজির হয়। গিরস্তের বাড়িতে মাগীকুদ্দুর কদর আছে। এইসব কারণে মাগীকুদ্দুর আয়-রোজগারের পথটা সারাবছর খোলা থাকে। গরিবের মেয়ে মাগীকুদ্দুর ঘরে পা দিয়েই এই জিনিস টের পেয়েছিল। যাবার সময় বউটার বিলাপ দেখে মাগীকুদ্দুর বুড়ি মা ছেলেকে সুপারিশ করতে গেলে মাগীকুদ্দু ‘ওয়াক থু’ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে মাকে জানায়, — বছর বছর আমি এগারোহাত শাড়ি কিনতাম ক্যা?

এই প্রশ্নে বুড়ি হা-করে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরুষের মুখে এমন কথা সে বাপের জন্মে শুনেনি!

দানবকালুর হেড়ে গলার ডাক শুনে মাগীকুদ্দু একলাফে ঘুম থেকে ওঠে। তাবাদে মনের মধ্যে ভাল্লুকের মতো জেগে ওঠে পরীকে হরণ করে নেবার তালে খাপ্পেতে থাকা আমজাদ ঢালীর মুখ। আমজাদ ঢালীর কুমতলবের কথা মনে হতেই মন-গতরে রানির মতো ভাব-ভাষা ফিরে আসে। দৌড়ের মাঝেই জোরে জোরে বলতে থাকে, — খালি হাতে রণাঙ্গনে!  বিপর্যয় অনিবার্য মহারাজ।

মাগীকুদ্দু ছুটতে ছুটতেই খাবলা দিয়ে একটাকিছু তুলে নেয়। সেই একটাকিছু যে ঝাড়ুখানা হবে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। কড়ইতলায় এসে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই তার হুঁশ ফিরে আসে। আর তখন উপস্থিত সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলে সে নিজেকে নিজেই একটা মুখ-ঝামটা দিয়ে হাতের জিনিসটা বিলের পানিতে ছুঁড়ে মারে। রাজারূপী কাদু তার তলোয়ারের মতো ছুরিখানা গামছার আড়ালে লুকাতে লুকাতে মেজাজ চাগিয়ে তোলে — হে বীরবাহু, বীরকূলচূড়ামণি, শত্রুহননে আর দ্বিধা কেন?

কাদুর পাশে মাগীকুদ্দু পরিষ্কার গামছাখানা দিয়ে বুক ঢাকতে ঢাকতে আর্তনাদের সুরে মহারাজকে জিজ্ঞেস করে, — বীরকেশরি রণাঙ্গনে যুদ্ধাহত, সেই দুঃসংবাদ মহারাজ কী অবগত নন?

কুটিল এবং অভিজ্ঞ মানু মিয়া মুহূর্তে বিষয়টা সমঝে ফেলে। সে মাঝে মাঝে দরকারমতো ঘাটুদলটাকে দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। ভাগ্যগুণে আজ তেমনি একটা মওকা মিলেছে। তাই তার চিরশত্রু মড়লদেরকে একটা খেইল দেখিয়ে দিলো। লাঠির জোর ছাড়া কর্তার কর্তিত্ব না-মরদের অট্টহাসি।

আজকের এই ঘটনা দিয়ে মানু মিয়া আবার তার হিম্মতের নজির রাখছে। দিনকয় আগে রাজারূপী কাদু শেষরাতে সড়কের জামতলায় দাঁড়িয়ে যে গরম গরম বক্তৃতা দিয়েছিল তাতেই দলের সবকয়টা আবং এখনো চেতে আছে! এই আবিষ্কারে মানু মিয়া খুশি হয়। সে একটা কাশি দিলেও তার জনমশত্রু আমজাদ ঢালী কিংবা মড়লরা খবর রাখে। সেই বিবেচনায় আজকের এই তুলকালাম কাণ্ডটা তার শক্তিমত্তার বিরাট একটা প্রর্দশন। এবং তা ঘটে গেল আঁতেল মড়লদের চোখের সামনেই।

মানু মিয়া খেলার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়। এই লঙ্কাকাণ্ডে খেলা বোবা-ভ্যাবলার মতো ত্যাব্দা মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্তার ইশারা পেয়ে তিলেকে তৈরি হয়ে ওঠে। সে রাজারূপী কাদুকে কুর্নিশ করতে করতে দেড়-কদম পিছিয়ে বাঁ-পাশে সরে দাঁড়ায়, — জাহাঁপনা, বান্দার গোস্তাকি মাপ হয়। গুরুতর কিছু না, গরিবের বাগুনখেত সুলা চাইতেছে। কিন্তু বান্দার পিতৃদেব হীনবল বৃদ্ধ। সেহেতু মহামান্য দলপতি আমাদের সকলকে তলব করেছেন। তাই আজ আমি আমার বাগুনক্ষেতে সুলা দেওয়ার জন্য চেমননগরের মহারাজের হুকুমে সকলের কাছে সাহয্য প্রার্থী। দ্বিপ্রহরে এই অধম বান্দা সাধ্যমতো ভোজনের ব্যবস্থাও করবে।

ভোজন! ভোজন! শব্দটা যাদুর মতো কাজ করে। কাদু-কালুর মারমুখো গতরের পেশী এই শব্দটার মায়াবলে শিথিল হয়ে আসে। প্রতিশোধ-নেশায় লাল হয়ে ওঠা চোখের নজর মুহূর্তে থিতিয়ে যায়। রক্তলাল উগ্রতার বদলে ভালো ভালো ছালুন দিয়ে গলাতক ঠেসে খাওয়ার লোভে তাদের চোখগুলা চকচক করতে থাকে। অহাকালুর লম্বা গলাখানা আধহাত সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে সারাজীবনে খুব কমদিনই ভোজন শব্দটার মর্মার্থ তার উপাসি পেট দিয়ে অনুভব করতে পেরেছে!

খেলার বাপ মাঝারি চাষী। প্রায়ই তারা খেলাদের জমিতে দল বেঁধে খাটতে যায়। বেতনভোগী কামলা হিসাবে দুইবেলা খাবারের জন্য যা পায় তা তাদের কাছে বেহেস্তি চিজ। খেলার মায়ের হাতের শুঁটকিভর্তাও অন্য বাড়ির গোশ-ভাতকে মিছে করে দেয়। সেই বাড়িতেই আজ দাওয়াত এসেছে মাগনি কামলার! অর্থাৎ বিনা বেতনে কাজ। মাগনি কামলার নিয়ম হলো : প্রতিবেশী কৃষককে সাহায্য করার জন্য এই কাজে ধনী-গরিব সকলেই অংশ নেয়। এতে লজ্জার কিছু নাই। বহু মানুষ একসাথে হাসিঠাট্টা আর আমোদসামুদে বিরাট কঠিন কাজটা কয়েক ঘণ্টায় শেষ করে ফেলে। কাজ শেষে জমির মালিক খুশি হয়ে সবাইকে ভালো ভালো খাবার দিয়ে সম্মানিত করে।

এই খবরে দলের সবাই নিজেদের মধ্যে কাউমাউ করে আলোচনা জুড়ে দেয়। এইসব কবজব আলাপে অহাকালুর রাগ হয়। রামছাগলগুলার বকবকানিতে সে ভোজন শব্দটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছে না। বিরক্ত অহাকালুর একটুও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে খেলার দিকে কান পেতে অপেক্ষা করছে। এই মুহূর্তে খেলাকে তার নিজের ভাইয়ের মতো লাগছে। খেলা যদি আরো কিছু বলে? তাদেরকে ভোজন করানোর জন্য খেলা যদি তার ছাগলটা জবাই করার কথা ঘোষণা করে? দলের মানুষের জন্য খেলার দ্বারা সব সম্ভব। সে উদার। সাথি-সহবতদেরকে ভালোবাসায় সে অদ্বিতীয়। বিপদে-আপদে সবার আগে সে এসে দলের মানুষের পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। চৈত-কার্তিকের অভাবে নিজের ঘরের ধান-চাল তার মায়ের হাতে-পায়ে ধরে হলেও দিয়ে দেয়। মা রাজি না হলে গোলা থেকে চুরি করে দিয়ে দেয়। সেই দলের মানুষকেই আজ খেলা মাগনি কামলার দাওয়াত দিয়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতে অহাকালুর বসন্তে-গলে-যাওয়া চোখের গর্তে লেগে থাকা হলুদ কেতুরটা কাঁপে। আর তার ভালো চোখটা আগ্রহ ও উত্তেজনায় দপদপ করে জ্বলে।

রাজারুপী কাদু এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মারদাঙ্গায় সে-ই সবচে তুখোড়। চোখের পলকে চার-পাঁচটা মাথা বেলের মতো ঠুকে দেয়। কিংবা দেড়হাতি ছুরিখানা দিয়ে প্রতিপক্ষের উরু, কোমর, পিঠ, বাজুতে টপাটপ ঘা মারতে থাকে। খেলার ওই গুমর-ফাঁক-করা আর্জিতে নিমেষে তার চোখ-মুখে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। সে হাতের ছুরিখানা দু-পায়ের ফাঁকে মাটিতে গেঁথে, পরনের খাটো লুঙ্গিটা যুত করে পরে, চুল-গোঁফ হাতড়ে ঠিকঠাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, — চেমননগরের দুর্ধর্ষ সেনানায়কের (খেলার) মুখে আজ ফুলচন্দন বর্ষিত হউক! শুভকাজে বিলম্ব নাস্তি, উজির, উজির-এ-আলা…, কোথায় গেল আমার সামন্তবর্গ, কোথায় আমার নাজিরগণ?

দীর্ঘদেহী তরুণ ঘোড়ামোবারক কখনও কখনও উজিরের পাঠ নেয়; সে তড়িতে হাতের ভীমা লাঠিখানা ফেলে দিয়ে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে রাজাকে কুর্নিশ করতে করতে এগিয়ে আসে, — বান্দা হাজির। আদেশ করুন জাহাঁপনা!
— যথাশীঘ্র আমার রাজ্যের এই তরুণ প্রজার আর্জি মঞ্জুর করা হউক।

ঘোড়ামোবারক রাজাকে কুর্নিশ করতে করতে পিছিয়ে আসে, — আলামপনার হুকুম শিরোধার্য। কে আছ কোথায়? পরগনায় পরগনায় মহারাজের আদেশ জারি করে দাও, চেমননগরের পথে পথে জ্বালিয়ে দাও রঙিন ঝাড়বাতি। আজ সারাদিন কাটিবে উৎসবে, বহিবে হাসির লহর। চেমননগরের বাতাস আজ আমোদিত হবে মৃগনাভির সুবাসে।

কার্তিকের বেলা দশটা। কড়া রোদ আর ভ্যাপসা গুমোটের মাঝে বিলপারের একমাত্র তালগাছটার পাতাগুলা খেলাদের হাততালিতে কেঁপে ওঠে। বাসা বানানোতে ব্যস্ত একপাল বাবুইপাখি তালগাছের মাথা থেকে দিকবিদিক উড়ে যায়। দলের কর্তা মানু মিয়া খেলার বান্ডিল থেকে দুখানা বিড়ি তুলে নিয়ে একখানা কানে গুঁজে আরেকখানায় আগুন দিতে দিতে বলে — অস্ত্রশস্ত্র যা আছে মন্দ না। কিন্তুক অহন একটুক সামলায় রাহা দরকার। পাবলিকরে ডর দ্যাহায়া ফয়দা কী?

কর্তার হুকুমে কাদু-কালুরা অস্ত্রপাতি শরীরের ঘুপেঘাপে, গামছা-লুঙ্গির আড়ালে লুকায়। বিড়ির কড়া গন্ধে বিলপারটা তেতে উঠেছে। দাড়িগোঁফ কামানো মাগীকুদ্দু দাঁতের ফাঁক দিয়ে চ্যারত্ করে থুতু ফেলে। তার দেরি সইছে না। সে বিড়বিড় করে বলে, — এই মানুষগুলান খালি হুদাহুদি ভগর ভগর করে।

দলের কর্তা মানু মিয়া তার চিকন গোঁফে তা দিচ্ছিল। মাগীকুদ্দুর কথায় সে বিরক্ত হয়। হিজড়া জাতীয় এই জীবটাকে সে মনেপ্রাণে ঘিন্না করে। মানু মিয়ার বিচারে মাগীকুদ্দুর মাথাটা জটিল মেয়েলোকের মতো কুবুদ্ধিতে ঠাঁসা। সে দাঁতে দাঁত ঘষে বিড়বিড় করে মাগীকুদ্দুকে একটা গালি দেয়, — এই চুতমারানি হইল হেই-ই চুতমারানি যে একদিন-না-একদিন খেলার ঘুম ভাঙায়া দিব। খেলারে দলের কর্তা অইবার জন্য উসকায়া দিব।

মানু মিয়া জবান খোলে না। বাইরে থেকে তার মনের ভাব ধরার কোনো জো নাই। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দিনের আন্দাজ করে, আবহাওয়ার মক্কর বোঝে। বীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দীনদুক্কী মানুষগুলাকে পরখ করে। তার বশে বিশ-কুড়িটা তাগড়া জোয়ান। এই তল্লাটে তার মতো আর ক্যাডা? নেওকার আমজদ ঢালী! ছ্যাঁ…!

সে থুতু মেরে বিড়ির ধোঁয়ায় কটু হয়ে আসা মুখের লালা ফেলে দেয়। আমজদ ঢালী তার তুল্যে একটা ইঁদুর। অন্যদের কথা বিলকুল বাদ; কাদু-কালু, ঘোড়ামোবারক, খেলা — এই চারজন চাইলে বিষবাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে গোটা তল্লাটটা চোখের পলকে মিসমার করে দিতে পারে। নিজের হিম্মতে মুগ্ধ মানু মিয়া চারপাশে নজর বোলায়। তিনপাড়ার মানুষ দেখছে, এতগুলা বীর রামের হনুমানের মতো তার হুকুমের অপেক্ষায়! জীবনে এরচে বেশি কী আর সে পেতে পারে?

আত্মগৌরবে তুষ্ট হয়ে মানু মিয়া খেলার দিকে মন দেয়, — তর বাগুনক্ষেত কয় কাডার?
— আজ্ঞে সাত কাডা।
— মাত্র সাত কাডা? এই কুদ্দু, মাথা গুনত্তি দে।

ত্যক্ত-বিরক্ত মাগীকুদ্দু তার গামছাখানা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। জিনিসটা টেনে টেনে বুকে আনে ফের গামছাটা নটি মাগীর মতো বুক থেকে ফসকে যায়। তাবাদে মানু মিয়ার প্রতি গোপন অবজ্ঞায় সে দাঁতের ফাঁক দিয়ে চ্যারত্ করে থুতু ফেলে বলে, — মহারাজের জ্ঞাতার্থে বিনীত নিবেদন, আমি আগেই গণনা করেছি। বীরকূলমণি দানবকালু আর আমাকে নিয়ে একুইশজন।

মানুর চাটকির মতো ছোট কপালে ভাঁজ পড়ে, — বেজোড় ভালা না। গফুর বাদশারে দ্যাখতাছি না ক্যা?

দাঙ্গাবাজ মানুষের মতো চোখের কোনাকানা সবসময় লাল হয়ে থাকা ঘোড়ামোবারকের কাছে থাকে গফুর বাদশা। ঘোড়ামোবারক কোমরে কষে বাঁধা গামছা খুলতে খুলতে মানু মিয়ার দিকে এগিয়ে আসে, — বাদশা ঘুমাইতাছে। হেরে আর হাঙ্গামায় ডাকছি না।

মানু মিয়া চলতে শুরু করেও ঘুরে দাঁড়ায়, ঘোড়ামোবারকের দিকে তাকিয়ে বলে, — তুই বাদশারে লইয়া আয়। আমরা যাইতাছি।

খেলা জানে, মানু মিয়া ইচ্ছা করেই আঙ্কুরের কথাটা বলেনি। আঙ্কুর শুধু খেলার বন্ধু না, বুদ্ধি-বিবেক ভালোবাসায় আঙ্কুর খেলার আরেকটা ভাই। দলের সবাই জানে, নানা কারণে আঙ্কুর মানু মিয়ার দুই চোখের বিষ। যেহেতু আজ তার বাড়িতেই আয়োজন। তাই সে শুধু আঙ্কুর না ইচ্ছা করলে আরো অনেককেই দাওয়াত করতে পারে। তাছাড়া সব বিষয়েই মানু মিয়া আগে নিজের হিসাবটা ঠিক রেখে পা বাড়ায়। মুখে মুখে মানু যা-ই বলুক দিনে দিনে খেলার কাছে পস্ট হয়ে উঠছে আরো অনেককিছুই। তাই মানু যেমন নিজের কথা আগে ভাবে, এখন থেকে খেলাও তার কথা ভাববে। মানু মিয়া যদি হয় লঙ্কার রাবণ তবে খেলাকে হতে হবে অযোধ্যার রাম। এইসব ভাবতে ভাবতেই খেলা মাগীকুদ্দুকে বলে, — এই কুদ্দু তুই কর্তারে লইয়া যা। আমি আঙ্কুররে লইয়া আইতাছি।

এই কথার পরে কর্তাকে বলতেই হয়, — এই ঘোড়া, তুই বাদশারে লইয়া আইবার সময় আঙ্কুররেও লইয়া আইছ।

এবার খেলা বিকাশবাবুর কথা তুলতেই ধূর্ত মানু মিয়া খেলাকে আরেক নজর দেখে নিয়ে অহাকালুর দিকে তাকায়, — এই অহা, তুই বিকাশরে লইয়া আয়।

মানু মিয়া খেলার দিকে তাকায়। খেলা মানুর মনের আদত কথাটা বুঝে ফেলেছে কী? মানুর মনে সন্দেহ জাগে। কিন্তু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেলার চোখে-মুখে শিশুর সারল্য, দপদপ করে জ্বলতে থাকা তারুণ্যের বেহিসাবী আবেগ। এই দেখে মানু মিয়া আপাতত তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে একটা ডায়ালগ দিয়ে ফেলে, — জ্বালাও, বাপের রজন যত ইচ্ছা জ্বালাও হে অর্বাচীন বালক। যত জ্বলিবে তত হইবে ছাই, আমি পদে পদে মানিক কুড়াই।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you