ঢাকাই ছবি : নিকট ও সাম্প্রতিক : জনরা ও বিবিধ আলাপ-১
গত কিস্তির সূত্র ধরে বলি, বলিসিনেমায় প্রকটিত সাম্প্রতিক লক্ষণের অনেককিছু ঢাকাই ছবির রমরমা দিনগুলায় কমবেশি আদিবীজ রূপে বিদ্যমান ছিল। রাজ্জাকের স্টারডম দ্রষ্টব্য ঘটনা হইলেও সমান্তরালে একাধিক তারকা ছিলেন যাঁরা নিজ স্বকীয়তায় ছবি টানতেন। রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁদের টক্কর থাকলেও মাত্রা সেখানে পৃথক ছিল। কাহিনিচিত্রের ধারা বুঝে পরিচালকরা কাকে প্রধান চরিত্রে বাছবেন ঠিক করতেন। রাগী, একরোখা ও সরল কিসিমের গ্রাম্য যুবকের চরিত্রে সচরাচর ফারুককে কাস্টিংয়ের ভাবনা পরিচালকের মাথায় খেলা করত। গ্রামীণ টাইপের মারকাটারি ছবিতে লাঠিয়াল রূপে ফারুকের পৃথক আবেদন ছিল। কেতাদুরস্ত ট্রাজিক হিরোর প্রয়োজন পড়লে জাফর ইকবাল অটোমেটিক চয়েস ছিলেন। বিপথগামী স্বামী ও নিয়তিদোষে গোল্লায় যাওয়া চরিত্রে আলমগীর প্রায়শ ফিট খাইতেন। অতিআবেগে নিজেকে শেষ করে দিতে পারবে এহেন দুখী চরিত্রে জসিমকে স্মরণ করা হইত। মারপিটে ভরপুর সিনেমায় সকলে কমবেশি বিবেচিত হইলেও রাজ্জাকের সঙ্গে সোহেল রানা, উজ্জ্বল ও জসিমের পৃথক কদর ছিল। অ্যাকশননির্ভর ছবিতে জসিমকে পথিকৃৎ গণ্য করা উচিত। ঢাকাই ছবির মারপিটের দৃশ্যায়নে স্টান্টম্যান ও ফাইট ডিরেক্টরের চাহিদা পূরণে তাঁর জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ-এর বিশেষ অবদান ছিল। এই ধারার সিনে লোকের জোগান দিতে পরিচালকরা তাঁকেই ভরসা মানতেন তখন।
ভিলেন হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরে নায়ক ও প্রতিনায়কের চরিত্রে জসিম নিজস্ব দর্শকচাহিদা তৈরি করে নিয়াছিলেন। চেহারা বা ফিগারে নায়কোচিত না হইলেও আটকায় নাই। শাবানার সঙ্গে তাঁর স্ক্রিনকেমিস্ট্রি বেশ জমাট ও দর্শক-পছন্দনীয় ঘটনা ছিল। জসিমকে এদিক থেকে ঢাকাই ছবির রজনীকান্ত বলা যাইতে পারে। নায়ক মানে হ্যান্ডসাম টাইপের কিছু হইতে হবে; — তামিল ছবিতে রজনীকান্ত এই ধারণায় প্রথম ভাঙন নিয়ে আসেন। থালাইভা খ্যাত জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখরের ঘটনাও অনুরূপ। বর্ণপ্রথার দাপটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেল একদশক ধরে দক্ষিণী সিনেমায় বিজয় নিজের অপরিহার্যতার প্রমাণ দিয়া চলেছেন। দক্ষিণ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে জাতপাতের সমস্যা মোটের ওপর প্রবল আকারে আজো বিদ্যমান। ভারতবর্ষের সিনেকারাখানায় একাধিক ছবিতে সমস্যাটি ফিরে-ফিরে প্রাসঙ্গিকতাও পায়। থ্রিলার আঙ্গিকে বানানো আর্টিকেল-15 কিংবা মালায়ালাম পরিচালক সানাল কুমার শশীধারণের নাম চট করে মনে আসে। বছর পাঁচ-ছয় আগে নির্মিত শশীধারণের এন অফ-ডে গেম বর্ণপ্রথার অন্তরালে বিরাজিত হরর টের পাইতে দর্শককে সাহায্য করেছিল। ছবির নির্মাণপ্রণালি সোজা কথায় ব্যতিক্রম বললেও হয়ত কম বলা হয়।
দক্ষিণের সিনেকারখানায় নাম লেখানোর পর হইতে বিজয়কে শশীধারণের ছবির গল্পে উঠে আসা হররের ভিতর দিয়া গমন করতে হয়েছিল। কালো ও নিচুজাতের খোঁটা তাঁর জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। জাতপাতের নিগড় অতিক্রম করে অ্যাকশন হিরো রূপে তাঁর উত্থানকে অগত্যা কুর্নিশ যাইতে হয়। ঢাকাই ছবিতে জসিমের আবির্ভাব খানিক সে-রকম ছিল। একঝাঁক সুদর্শন নায়কের ভিড় ঠেলে ভিলেন থেকে হিরোয় পরিণত জসিমের কামিয়াবি ঢাকাই চলচ্চিত্রের কথা চিন্তা করলে মন্দ ছিল না। শোলে-র রিমেক দোস্ত দুশমন ছবিতে ডাকু গব্বার সিংয়ের চরিত্রে তাঁর অভিনয় তখন দর্শকমন হরণ করে। সেকালের দর্শকরা রিমেক ব্যাপারখানা ঠিক বুঝতেন বলে মনে হয় না। গুরুজন বা বড়ভাইদের দেখেছি রিমেক বলতে তাঁরা সোজা নকলিই বুঝতেন! দেওয়ান নজরুলের দোস্ত দুশমনও শোলে-র নকলি রূপেই সেই সময় সমাদর লাভ করে। নকলি হইলেও গব্বার সিংয়ের চরিত্রে জসিমের অভিনয় সকলের মনে ধরেছিল। বালেগ হওয়ার পর ছবিখানা দেখতে গিয়ে মনে হইল হিন্দি গব্বারের চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয়ের জন্য কিংবদন্তির মহিমায় সিক্ত আমজাদ খানকে বাংলার গফফার ওরফে জসিম একাধিক জায়গায় ভালোই ওভারকাম করে গিয়াছেন। তাঁর অতিঅভিনয়ে যে-শক্তি বিরাজ করত সেটা এই জনরার ছবির ক্ষেত্রে মন্দ অভিজ্ঞতা নয়। সত্যমিথ্যা জানি না তবে সেই সময়কার সিনেকাগজ নাকি খবর ছাপে জসিমের অভিনয় খোদ আমজাদ খানের নজরে আসে এবং খানসাহেব প্রশংসায় কৃপণতা করেন নাই।
অতিঅভিনয় মানে খারাপ এমন না-ও হইতে পারে। জসিম সচরাচর যে-ধাঁচের চরিত্রে অভিনয় করতেন সেখানে যাত্রা-ঢংয়ের অতিঅভিনয়ের প্রয়োজনীয়তা গল্প বা চিত্রনাট্যের কল্যাণে অমোঘ মনে হইতে থাকে। সিনেপর্দায় গল্প বলার ধরনটাই এমন যে ন্যাচারাল অ্যাক্টিংকে সেখানে উদ্ভট মানতে হয়। ষাটের দশকে বানানো খান আতার ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে কিংবদন্তির মর্যাদা দিয়াছিল। যতদূর মনে পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিলেকোঠার সেপাই-এ আনোয়ার হোসেনের নাম নিয়াছিলেন। ছবিতে তাঁর সংলাপ ও অভিব্যক্তির প্রতি পরতে যে-আবেগ উপচায় অভিনয়ের ধারা বিচারে তাকে অতিঅভিনয় মনে হয়। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে কি? পলাশীর প্রান্তরে বাংলার ভাগ্যবদলের ইতিহাসগাথা চিরকাল যাত্রাপালার ভিতর দিয়া আমজনতার হৃদয়ে মর্মরিত হয়েছে। খান আতা ধুরন্ধর মেধাবী লোক ছিলেন এবং সে-কারণে সিরাজউদ্দৌল্লার সিনেভাষ্য নির্মাণে যাত্রার ব্যাপারটা ভোলেন নাই। চিত্রনাট্যে লিপিবদ্ধ সংলাপে অতিআবেগকে সযতনে জায়গা দিয়াছিলেন, যেন বাংলার আমজনতা ছবি দেখার ক্ষণে অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে নিজেকে একাকার করতে বাধ্য হয়। পরিচালকের মনের ভাষা বুঝতে আনোয়ার হোসেনের অসুবিধা হয়নি। সেই সিরাজউদ্দৌল্লাকে তিনি সিনেপর্দায় মূর্ত করেন যাকে পর্দায় দেখার প্রতি অনুপলে দর্শক নিজের ভিতর পলাশীটা টের পায় ও সেখানে নিজেকে শামিল হইতে দেখে।
বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে। এমন কেউ কি আছে, যে বলবে আশা নয় দূর আশা। — সংলাপখানা আওড়ানোর ক্ষণে আনোয়ার হোসেন অতিঅভিনয়ের সেই শক্তিকে কামে লাগান যাকে সিরাজউদ্দৌলার নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে জুড়ে নিলে অতিঅভিনয় বলার সুযোগ থাকে না, বরং অভিব্যক্তি ও সংলাপ বিক্ষেপের এই পদ্ধতিকে ন্যাচারাল অ্যাক্টিং স্বীকার যাইতে হয়। ছবিতে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় নিছক অভিনয়ে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে আবেগের বিস্ফারে অনন্য রূপ ধারণ করেছিল এবং সেখানেই খান আতার সার্থকতা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার অতিনাটকীয় আবেগ কোনো সমস্যা নয় বরং ওটাই ছবির প্রাণভোমরা ছিল। খান আতার ছবিকে সাবলাইম স্বীকার যাইতে দর্শক তাই দ্বিধায় ভোগেনি।
সেলিম আল দীন নাটকে যাত্রাপালার যেসব ভাবরসকে অভিনয়শিল্পে সঞ্চালনে মরিয়া ছিলেন ঢাকাই ছবির জগতে সেটা গোড়া হইতে কমবেশি চালু বা সময় বিশেষে অতুল ঘটনার জন্মও দিয়াছে। অতিনাটকীয়, অতিআবেগ, অতিঅভিনয় ইত্যাদি বাংলা তথা উপমহাদেশের সিনেধারায় সহজাত এবং সকল সময় নেতিবাচক এমন নয়। মাত্রাজ্ঞান বুঝে তার প্রয়োগ ঘটানো গেলে খুঁত ধরার কিছু থাকে না। পৃথক অভিসন্দর্ভ রূপে তাকে পাঠ যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা সেই সময়ের সিনে-আলোচকরা ভাবেন নাই। নগরজীবী শিক্ষিত দর্শকশ্রেণি ও সিনে-আলোচকদের নাকউঁচু মনোভাবের কারণে যাত্রাপালার সিনেভাষায় সংযুক্তি ও নতুন অঙ্গে তার প্রয়োগ-সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনার সুযোগ ডালপালা ছড়াতে পারে নাই। নির্মাতাগণও যারপরনাই মাত্রাজ্ঞান বুঝে এর প্রয়োগ সম্পর্কে অসেচতন ও পরে তাললয়মাত্রা ছাড়া কাণ্ডকারখানার জন্ম দিতে থাকেন। নব্বইয়ের কালপর্বে অতিঅভিনয় সমৃদ্ধ চিত্রনাট্যে নতুনত্বের অভাব বোধহয় সে-কারণে প্রকট হয়েছিল।
যা-ই হোক, জনরার প্রসঙ্গে আবার ফেরত যাই। অ্যাকশন ধাঁচের ছবিতে জসিম যেমন স্বতন্ত্র ঘটনা ছিলেন, ওদিকে গল্প-উপন্যাস থেকে বানানো ছবি বুলবুল আহমেদের কাস্টিং ছাড়া জমাট মনে হইত না। নায়িকাদের মাঝেও চরিত্রভাগের ব্যাপারস্যাপার ছিল। খানিক রাশভারী প্রেমিকার চরিত্রে শবনম, পতিপরায়ণ স্ত্রী ও প্রেমিকার ভূমিকায় শাবানা, চঞ্চল সুহাসিনী মেয়ের চরিত্রে কবরী, জেদি, দস্যি ও অভিমানী বা দুখী প্রেমিকার রোলে ববিতাকে ট্রেন্ডসেটার মানতে হয়। এছাড়াও দর্শকমনে সুচরিতা, রোজিনা বা অলিভিয়ার পৃথক আবেদন ছিল তখন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, নায়করাজ রাজ্জাকের স্টারডম অমিতাভের মতো ওয়ান ম্যান আর্মির ঘটনায় মোড় নেওয়ার সুযোগ পায় নাই। সকল চরিত্রে অভিনয়কুশল হইলেও নাগরিক যুবার রোলে তিনি অধিক আবেদন বহাইতেন। রংবাজ ছবি দিয়া রাজ্জাক বোধহয় অমিতাভের আগেই প্রতিনায়কের (Anti-Hero) ভূমিকায় পর্দায় হাজিরা দিয়াছিলেন। গুণী শিল্পী বশির আহমদের কণ্ঠে হৈ হৈ হৈ রঙ্গিলা রে গানটির সঙ্গে ছবিখানাও দর্শকের আদর কুড়ায়। সত্তর থেকে পরবর্তী একদশক শোলে, ডন, শক্তি, মুকাদ্দর কা সিকান্দার, অমর-আকবর-এ্যান্টনি, লাওয়ারিশ ইত্যাদি দিয়া প্রতিনায়ক চরিত্রে অমিতাভ ব্যাপক ব্র্যান্ডিং পাইতে শুরু করেন। তাঁর এই কামিয়াবির তুলনায় রংবাজ পরবর্তী রাজ্জাককে সেভাবে প্রতিনায়কে অমোঘ করার কথা পরিচালকরা ভাবেন নাই। ঢাকাই ছবির কাহিনি বৈচিত্র্যহীন আবর্তে ঘুরলেও নায়ক-নায়িকার স্টারডম নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ডিংয়ের শাসনে দাঁড়ায়া থাকেনি। শহুরে যুবার চরিত্রে রাজ্জাকের সংযুক্তি অবধারিত হইলেও ফারুক সহ অন্যরা যেসব ধারায় পছন্দের গণ্য ছিলেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে সেই রোলগুলা তাঁকে কমবেশি করতে হয়েছিল। কখনো সফল হয়েছেন আবার মারও খেয়েছেন।
বাংলাদেশের সিনেভাষায় বিচিত্র প্রকৃতির ছবির জন্ম বলিউডের বহু আগে অর্থাৎ ষাট থেকে আশির কালপর্বে ঘটার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়াছিল। গল্পভাবনা, আবহসংগীত, নৃত্যগীত, অভিনয় আর দৃশ্যায়নের কারিগরি ভাবনায় নতুনত্ব ও সৃজনশীল হওয়ার ক্ষুধা পরিচালকদের মাঝে প্রবল না হওয়ার দোষে বিপ্লবটা ঘটে নাই। জহির রায়হান বেঁচে থাকলে ঢাকাই সিনেমার গল্পভাবনা হয়ত নয়া মোড় নিতেও পারত। সিনেভাষার প্রচলিত ধারাকে ভেঙেচুরে নতুন ট্রেন্ড তৈরির জন্য মাঝেমধ্যে দুই-একটা এমন ছবি বা পরিচালকের দরকার হয় যিনি কাহিনিচিত্র ও দৃশ্যায়নে অভিনব তরঙ্গ আনার হিম্মত রাখেন। তার ছবি হয়ত হলে কাটবে না কিন্তু সময়ের সঙ্গে কাল্ট হয়ে ওঠার কারণে বাকি পরিচালককে সাহসী ও নতুন ভাবনায় গমনে প্রেরণা দিয়া যাবে। জাপানি পরিচালক সেইজুন সুজুকির কথা এইবেলা স্মরণ হয়। ফরাসি চলচ্চিত্রে দেখা দেওয়া নবতরঙ্গ আন্দোলনে প্রভাবিত সুজুকি সামুরাই আর গ্যাংস্টা মুভিপ্রিয় জাপানি দর্শকের রুচিবদলে ভূমিকা রেখেছিলেন।
পর্দায় অপরাধজগতকে ভাষা দেওয়ার ধারায় তাঁর সিনেভাষার উপস্থাপন ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল। ষাটের দশকে বানানো ব্র্যান্ডেড টু কিল ও টোকিও ড্রিফটার-এর মতো ছবির মাজেজা লগ্নিকারের মগজে তাৎক্ষণিক ঢোকে নাই। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বটে, যে-কোম্পানির হয়ে ইয়াকুজা টাইপের ছবি বানাতে তিনি চুক্তি সই করেন তাদের চাহিদা মেনে হলে ছবি রিলিজের ঘটনা তাঁর কাছে পীড়াদায়ক ঘটনায় রূপ নিয়াছিল। কোম্পানির প্রবল আপত্তি আর লগ্নির বারোটা বাজায়ে অগত্যা ব্র্যান্ডেড টু কিল ও টোকিও ড্রিফটার-এর জন্ম হয়। ছবি দুটি তখন হলে কাটে নাই। সুজুকিও প্রায় দশ বছর জাপানের সিনেপাড়ায় একপ্রকার নিষিদ্ধ ও পরিত্যক্ত ছিলেন। সরকারি আর্কাইভে সংরক্ষিত ব্র্যান্ডেড টু কিল চলচ্চিত্র উৎসবে (*সম্ভবত আশির দশকের গোড়ায়) ভিনদেশি পরিচালক-সমালোচকদের চোখে পড়ে। পরের ঘটনা সহজে অনুমেয়।
সুজুকি হলিউডে প্রভাববিস্তারী ঘটনায় পরিণত হওয়ার কারণে জাপানে ইয়াকুজা ছবির চিত্রায়ন ও তার আন্তঃনিহিত ভাবনায় পালাবদল অমোঘ হইতে শুরু করে। অন্ধকার জগতের কাজকারবারে জড়িত চরিত্রের মনোজগতে আলো ফেলার বাসনায় সুজুকির গল্প-বয়নের ধাঁচ, মারপিটের সিনারিতে বন্দুকবাজির ধরন, যৌনতার উপস্থাপনায় নতুনত্ব, অর্থাৎ পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবিতে ক্যামেরার উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার অতুল শিল্পশৈলীর জন্ম দিয়াছিল। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ছবির ভাষা হজমের শক্তি সংগতকারণে জাপানি লগ্নিকার ও দর্শকের ছিল না। কিন্তু কাহিনিচিত্রের প্রাগ্রসর ধাঁচটাই পরে ইয়াকুজা ধারায় নির্মিত ছবির ভাষায় নতুন প্রাণশক্তি বহায় ও পালাবদল অনিবার্য করে তোলে।
যা-ই হোক, সুজুকির মাহাত্ম্য দু-চার কথায় বলে বোঝানো কঠিন। সিনেভাষা নিয়ে সাতকাহনের কোনো এক পর্বে সে-আলাপ সম্ভব হইতেও পারে। তাঁর উল্লেখ কেবল এই আফসোসের সহগ যে, বাংলা ছবি তৈরির কারখানায় নতুন জনরা সৃষ্টির মতো কাল্ট ছবির ঘটনা সুবর্ণযুগে যেহেতু ঘটে নাই বর্তমানের মুমূর্ষু দশায় এই কর্মে গমন দুঃসাধ্য! নব্বই বা অনতি-পরবর্তী দশকে পরিচালকরা অবিরত বম্বে ধাঁচের (*যেহেতু তামিল, তেলুগু, কন্নড় বা মালায়ালাম আজকের মতো সুলভ ছিল না) কাহিনি, দৃশ্যায়ন ও অভিনয়ে ফেরত গিয়াছেন। হলিউড বা বিশ্বের অন্যত্র ছবির চিত্রনাট্য ও দৃশ্যায়নকে কেন্দ্র করে বিচিত্র আঙ্গিকে পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়া সিনেভাষার স্বরূপ পাল্টানোর ঘটনাগুলা তাঁদেরকে ভাবিয়ে তোলেনি। গল্পের ধরনে যৎসামান্য পালাবদল ছাড়া সিনেভাষা সৃজনের কারিগরি কুশলতায় গতি আনার প্রশ্নে ঢাকার সিনেমা ষাট বা সত্তরের ছকেই বহাল ছিল।
আবারো রিপিট করি কথাটা, — অভিনয়শিল্পীর স্টারডমকে ভেঙেচুরে নতুন অঙ্গে হাজিরের জোয়ার সৃষ্টির সুযোগ তখন ছিল; জনরুচি বিরূপ হইতে পারে এই ভয়ে গল্প বা স্টারডমের বহমান ধারাকে বিশেষ নড়াচড়া না করে ছবি পয়দায় ঢাকাই ছবির নির্মাতারা মগ্ন ছিলেন। চিত্রনাট্যে ফতেহ লোহানী, আহমেদ জামান চৌধুরী বা সৈয়দ হকের মতো লোকজন সক্রিয় ছিলেন। ক্যামেরায় দৃশ্যধারণে বেবি ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন ঢাকাই ছবিতে বিচরণ করেছেন। সংগীত-আয়োজনে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, আজাদ রহমান, সুবল দাস, সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজ সহ গীতিকার-সুরকারে ছবিপাড়া ভরভরন্ত ছিল। প্লেব্যাকে সাবিনা-রুনা-শাহনাজ রহমতুল্লার সঙ্গে বশির আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রফিকুল আলম, সুবীর নন্দী, খুরশিদ আলম, এন্ড্রু কিশোর বাদেও বহু শিল্পী সিনেগানে কণ্ঠ দেওয়ার লাইনে ছিলেন। একঝাঁক অভিনয়শিল্পী, ফাইট ডিরেক্টর, কোরিওগ্রাফার আর নেপথ্য-কুশীলব হাজির থাকলেও কালের ধারায় সৃষ্ট বলয় ছেড়ে নতুন ভাবনা ও বক্তব্যে সবাক হইতে পরিচালকরা দ্বিধা, অনীহা আর উদাসীনতার বৃত্ত ছেড়ে বাহির হইতে পারেননি। আশির অন্তে এসে ঢাকাই সিনেভাষার প্রতি দর্শক-আগ্রহের পারদ নিম্নগামী হওয়ার পেছনে এইসব দ্বিধাভয় যুগান্তকারী প্রভাব রেখেছিল।
উত্তম-সুচিত্রার যুগ অস্ত যাওয়ার পরে কলকাতার বাংলা ছবি সংকটের অমানিশায় পতিত হয়। রমরম করে চলা তারকাবহুল ঢাকাই সিনেকারখানাও তিন দশকে সৃষ্ট প্রাক্তনদের যুগ শেষ হইতে মলিন চেহারা ধারণ করে। উত্তমের লিগ্যাসি টানার ভার কলকাতায় তাপস পাল ও প্রসেনজিতের ঘাড়ে চাপে। ঢাকার ছবিতে দিতি, চম্পা, দোয়েল ও অঞ্জু ঘোষকে সঙ্গী করে ইলিয়াস কাঞ্চন ও রুবেল সেই দায়িত্ব কান্ধে নিতে বাধ্য হন। দুই বাংলার কারখানায় যবে উল্টোযাত্রার স্রোত চলে তখন বলিপাড়ায় নতুন আঙ্গিকে সিনেভাষা সৃষ্টির তরঙ্গ বেগ পাইতে শুরু করেছে। গেল দেড় দশকের পথযাত্রায় দক্ষিণী ছবির প্রচণ্ড দাপট সহ্য করেও ধারাটি দুর্বার রূপ নিতে যাচ্ছে বলে একিন হয়।
স্টারডমে একের জায়গায় তিন হইতে বহুর দিকে যাত্রা বলিউডে নতুন জনরার ছবি বানানোর রেওয়াজকে ব্যাপক হইতে সাহায্য করেছে। নব্বইয়ে পা রাখা ঢাকাই সিনেমায় নির্মাতাগণের সৃজনদৈন্যের কারণে বিচিত্র আঙ্গিকে ছবি নির্মাণের চল নিম্নগামী ছিল। গৎবাঁধা কাহিনি ও মহাতারকার বৃত্ত ছেড়ে বাহির হওয়ার সাহস তার ছিল না। ইলিয়াস কাঞ্চন, সালমান শাহ, রিয়াজ, ফেরদৌস, মান্নার যুগ পার হয়ে ঢাকাই ছবি এখন শাকিব খানের ঘাড়ে চেপেছে। কলকাতায় তাও প্রসেনজিতের সহযোগী একঝাঁক নায়কের দেখা মিলেছে, ওদিকে ঢাকায় শাকিব খান এখন অবধি একলা স্টারডমের ভার কান্ধে নিয়া ঘোরেন-ফিরেন। তেলুগু-তামিল-মালায়ালামের কপিক্যাট ছাড়া বাংলার সুপারস্টার শাকিবের পাতে তুলে দেওয়ার মতো মেনু দৃশ্যত সেখানে গরহাজির।
ছবির-পর-ছবিতে সফল শাকিব কার্যত এক অচিহ্নিত মহাতারকা। নায়কোচিত চেহারার অধিকারী এবং হয়ত-বা রমণীমোহন। মারপিটে পারদর্শী। নায়িকার সঙ্গে প্রেমপিরিতির খেলায় গতানুগতিক। কৌতুক অভিনয়ে কলকাতার নায়কদের সহগামী। সহজ-সরল ও বোকাসোকা টাইপের চরিত্রে জাড্য-আক্রান্ত বা প্যাসিভ। প্রতিনায়কের ভূমিকায় সাবলীল মনে হইলেও কেমন যেন ভাবলেশহীন। ডায়ালগ থ্রোয়িং বা সংলাপ দিয়া বাজিমাত ঘটানোয় দুর্ভাগা, যেহেতু তাঁর উত্থানপর্বের দিনকাল হইতে ঢাকাই ছবির চিত্রনাট্যে সেইসব সংলাপ নিখোঁজ হইতে থাকে যার মধ্যে রক্তমাংসের বাংলাদেশকে টের পাওয়ার আবহ একসময় বজায় ছিল। দুই বাংলা জুড়ে জনপ্রিয়তা প্রীতিকর হইলেও শাকিবযুগে নির্মিত যৌথ-প্রযোজনার ছবিগুলা মোটের ওপর কলকাতার সিনেভাষায় ঠেকনা দিয়া দাঁড়ানো এবং সে-কারণে নিষ্প্রাণ।
হিরো ও ভিলেনগিরি, ট্রাজেডি বা কমেডি, থ্রিল আর সাসপেন্স, নাচাগানা থেকে নায়িকার সঙ্গে ফিচলামি বা মাখামাখির প্রতি অঙ্গে যে-বাংলাদেশকে দর্শক দেখতে পায় সেটা শাকিবের মতোই অচিহ্নিত প্রশ্নবোধক! কাজী হায়াৎ, সোহানুর রহমান সোহান, জাকির হোসেন রাজু, মালেক আফসারী কিংবা মোহাম্মদ হোসেন জেমী … কারো সাধ্য নাই কপিক্যাটে ইস্মার্ট যৌথ-প্রযোজনার এইসব ছবির গহ্বরে নিখোঁজ হওয়ার গাড্ডা থেকে শাকিব খান ও বাংলাদেশকে টেনে তোলে! শাকিবের হলকাটতি প্রমাণ করে তাঁর ভক্তকুল যথাবিহিত ঢাকাই সিনেমার রিমেকযাত্রা দর্শনে পরিতৃপ্ত। তারা হয়ত ভাবেন, — শাকিব খানের হাত ধরে ঢাকাই সিনেমা দক্ষিণী ছবির তুরন্ত সিনেভাষায় প্রবেশিয়াছে! যদিও ঢাকা বা যৌথ-প্রযোজনার গল্পের চিত্রনাট্যে অভিনব সেই ডিনামিকস-এর পাত্তা মিলে না যার জোরে তামিল-মালায়ালাম-তেলুগু ছবি দুনিয়া কাঁপায়।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে ক্রিস্টোফার নোলানের ভুবনবিখ্যাত থ্রিলার মেমেন্টো-র প্রেরণায় মেন্টাল নামে একখান ছবি ঢাকার সিনেকারখানায় ভূমিষ্ট হয়। বম্বে বা দক্ষিণ ছেড়ে ঢাকাই ছবির হলিউড গমনের ভাবনা ইতিবাচক ছিল সন্দেহ নাই। ছবির গল্প অবশ্য মেমেন্টো-র পরিবর্তে ঢাকাই সিনেমার পরিচিত ধাঁচেই বোনা হয়েছিল। শাকিব, তিশা আর মিশা সওদাগর মিলেঝুলে কেমিস্ট্রি মন্দ ছিল না। থ্রিলার অঙ্গে যেসব উপকরণ থাকলে ছবি জমে ক্ষীর হয় তরুণ নির্মাতা শামীম আহমেদ রনি সেগুলার আঞ্জামে আটঘাট বেঁধে নেমেছিলেন। এত দৌড়ঝাঁপ সত্ত্বেও সঠিক মাত্রাজ্ঞানের অভাবে ছবিখানা হলে তোলপাড় কাণ্ড ঘটাইতে বিফল হয়। পরিচালক বোধহয় ভুলে গিয়াছিলেন মেমেন্টো-র প্রেরণায় নির্মিত থ্রিলার ধাঁচের চিত্রনাট্যে গল্পে নতুনত্ব থাকা চাই, সেইসঙ্গে অতিঅভিনয়ের প্রবণতা এই টাইপের ছবির বেলায় হারাম। অভিনয়শিল্পীদের সেই কামে লাগানোয় ছবির সুরতাল কিছু আর বজায় থাকেনি।
ছবির টিজার বা প্রাক-প্রচারণায় শাকিব সচরাচর যেসব লুক দিতে অভ্যস্ত মেন্টাল-এ সেগুলা পরিহার করা জরুরি ছিল। হায়! শুরু হইতে শেষতক ঘটনাটা ঘটে নাই। প্রেমিকার অকাল বিয়োগের শোকে মেন্টাল কেস শাকিব তাঁর চিরাচরিত অঙ্গভঙ্গি সহকারে লুক-এর কাম সারেন। হাল জামানায় প্রচারণার অংশ হিসেবে ছবি রিলিজের আগে লুক বাজারে আসে এবং দর্শককে ছবিটা কেমন হইতে পারে তার আভাস দিয়া যায়। মেন্টাল-এর সিনগুলা আঁতিপাঁতি খুঁজে একটা লুক বাহির করা কঠিন হয় যেটা ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামে ছাড়ার পর ভক্তরা ভাবতে বাধ্য, — যাক, মেমেন্টোর ঢাকাই ভার্শনে শাকিব খান লা-জবাব লুক দিয়াছে … ছবিখানা দেখা জরুর!
থ্রিলার অঙ্গের উপযোগী সংলাপ কেমন হইতে পারে সেটা মেমেন্টো দেখার পরেও যেহেতু পরিচালকের মাথায় ঢোকে না গল্পের গরু সেই-যে গাছে ওঠে তারপর তারে আর নামানো সম্ভব হয় নাই। ছবির গল্পে রোমাঞ্চকর গতি ও জটিল চোরাটান না-থাকলে থ্রিলার জমে না। দর্শকমনে রোমাঞ্চের আবেশ তৈরিতে গল্পের সুতাকে নানা দিকে ছড়ানোর পরে পুনরায় গুটায়া নিয়ে আসতে হয়। চরিত্ররা যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে সেজন্য সাসপেন্স ও ক্লাইমেক্সে ঠাসা দৃশ্যগুলার ফাঁকে খানিক জায়গা খালি করা প্রয়োজন। কমেডি সিন, নায়িকার সঙ্গে খুনসুটি ও নাচাগানার বাহানায় চুমাচাট্টি বা বেডসিন আর আইটেম গান দিয়া জায়গাটা তৈরি করা কঠিন। গল্পের ভাবরস যেন দর্শকের মগজে ঢোকে সেই তরিকায় জায়গা খালি করতে হয় সেখানে। খালি এই জায়গায় বিচরণের সুবাদে চরিত্ররা দম নেওয়ার সুযোগ পায়। নিজের জখমের স্থানে তারা তখন হাতটা বোলায়। সিনেপর্দায় চরিত্রকে অবকাশটা তৈরি করে দেওয়া কাহিনির ভাবরসকে ঘনীভূত হইতে সাহায্য করে। মেন্টাল-এ হায় পাগলা শাকিবের ভোজালির কোপ থেকে জান বাঁচাইতে চরিত্ররা সারাক্ষণ দৌড়ের উপরেই থাকে!
হলিউডের থ্রিলার বা হরর অঙ্গে বোনা ছবিগুলা গল্পের নেতিবাচক চরিত্র অর্থাৎ ভিলেনকে আত্মপক্ষ সমর্থন ও সমালোচনার সুযোগ দিয়া থাকে। ইতিবাচক চরিত্র তথা হিরো-হিরোইন নিজের জখম হওয়ার কারণ তালাশ করতে নেমে জীবনের গতি ও হালচাল নিয়ে দু-চার ছত্র ফিলসফি আওড়ায়। ভাবুকতার ভিয়েনে মাখানো ডায়ালগের সাহায্যে খালি জায়গা ভরাটের সঙ্গে ছবির আন্তঃনিহিত ভাবরসকে নির্মাতা সেখানে তুলে ধরেন। ছবির মধ্য ও অন্তভাগে জায়গাটা এমনভাবে তৈরি হইতে থাকে দর্শকের এই সিনগুলায় ব্যবহৃত সংলাপে কান খাড়া না করে উপায় থাকে না। ফিলারের আঙ্গিকে ব্যবহৃত সংলাপগুলা তাকে রিলিফ দানের সঙ্গে ক্লাইমেক্স বা চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হইতে বলে। প্রতি দশকে এরকম তিন-চারখান ছবি হলিউডে জন্ম নিয়ে থাকে। উদাহরণ সহ আলোচনা করলে বোধহয় ভালো হইত কিন্তু বক্ষ্যমাণ রচনা সে-আলোচনার জন্য উপযুক্ত নয়। স্মৃতি হাতড়ে দু-চারখানা ছবির নাম শুধু এই ফাঁকে স্মরণ করে যাই :—
হিচককের সাইকো, ভার্টিগো বা দ্য বার্ডস-এর নাম এখন আর না নিলেও চলে। ওই ছবিগুলা রোমাঞ্চক জনরার ছবির শুরুয়াত ছিল এবং প্রবল আলোচিত হয়েছে এক সময়। জোনাথন ডেমির দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস-এর নাম বরং সকলের আগে নেওয়া উচিত হয়। রোমাঞ্চক ও ভৌতিক উপাদানের সংমিশ্রণে নির্মিত ছবিখানা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস বিবেচনায় আজো সমান প্রাসঙ্গিক। পেশাদার খুনির কায়দায় যুবতী রমণীদের অপহরণ, গুম ও তাদের ত্বক উপড়ে নিতে অভ্যস্ত ড. হ্যানিবাল লেক্টার আর বাফেলো বিলের প্রবৃত্তি মাঝারে সঞ্চিত নারীত্বকমোহ-বিবমিষা এবং তারো গভীরতলে জমাট নরভূকবাসনার জটিল ছকে বোনা ছবিখানা মনোদার্শনিক সমস্যার ভরে আপনা থেকে দ্রষ্টব্য সিনেভাষায় দর্শককে জব্দ করে রাখে। সিনথেটিক আর্টিফ্যাক্ট তথা কৃত্রিম তন্তু সহযোগে বোনা সভ্যতার মসৃণ ত্বকে আদিম প্রবৃত্তির আপাত অনিঃশেষ আনাগোনা ও আচমকা উত্থানের ভৌতিক আবেশ এখনো কেন ঘটে তার সদুত্তর হাজার কিতাব লিখেও মানুষ খুঁজে পায় নাই। গল্প বলার ধারা ও দৃশ্যায়নের কারণে ডেমির এই ছবি মনে আবেদন জাগায়। সিনেভাষার সাতকাহন-এ সময়-সুযোগ বুঝে সে-আলাপ ফাঁদা যাবে খন্।
চকিত স্মরণের মুহূর্তে মার্টিন স্কোরসেজির ট্যাক্সি ড্রাইভার ও শাটার আইল্যান্ড আর ওদিকে ডেভিড লিঞ্চের ব্লু ভ্যালভেট বা মুলহোল্যান্ড ড্রাইভ দেখার স্মৃতি মনে হানা দিয়া যায়। গুস ভ্যান সান্তের প্যারানয়েড পার্ক বা টু ডাই ফর থ্রিলার অঙ্গের ছবিতে ভিন্ন স্বাদ সঞ্চারিত করার গুণে স্মৃতিতে আজো অমলিন। সাদামাটা গল্প ধরে আগানো এই নির্মাতার স্বভাব হইলেও গল্পের গাঁথুনি এমন যে অপরাধপ্রবণ মনের গহিন কোটরে সক্রিয় বাসনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার জায়গায় সে হাত দিয়া বসে, যারপরনাই ছবি শেষ হওয়ার পরেও তাকে ভোলার উপায় থাকে না। টড ফিলিপস-এর জোকার তো একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা। গুরুতর সামাজিক বার্তা আর জোয়াকিন ফিনিক্সের দানবীয় অভিনয়শক্তির সম্মোহনগুণে ছবিখানা নিজ হইতে মনে জায়গা করে নেয়। টোটাল রিকল খ্যাত পল ভেরহোভেনের বেসিক ইন্সটিঙ্কট ও ব্ল্যাক বুক ভোলা কঠিন! ড্যারেন অ্যারনোফস্কির ব্ল্যাক সোয়ান অথবা ডেভিড ফিঞ্চারের জোডাইক দেখার স্মৃতি দেখি মনে আজো তরতাজাই আছে!
ব্র্যাড অ্যান্ডারসনের দ্য মেশিনিস্ট নিয়ে সিনে-আলোচক রজার ইবার্ট তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লিখেছিলেন; যদিও এই ছবির আলোচনায় তাঁর ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের কথাবার্তা ছবিখানার ওপর সুবিচার করে না। Near the end of the movie, we understand him when he simply says, ‘I just want to sleep.’ — আলোচনায় দর্শককে ছবির মূল সুর ধরায়া দেওয়ার জন্য ইবার্টকে সেলাম। কিন্তু দিনের-পর-দিন ঘুমাইতে না পারার সমস্যায় জেরবার ক্রিশ্চিয়ান বেল যবে বলে, ‘ভাইডি, আমি খালি ঘুমাইতে চাই।’;— লোকটার মুখ দিয়া এই ডায়ালগ বাহির করার আগে অবধি নির্মাতা যে-অঙ্গে যন্ত্রছকে বাঁধা বেলের ডেলি কাজকারবারকে ক্যামেরাবন্দি করেন সেটা নিজগুণে আরেকখানা গল্প হয়ে ওঠে। ইবার্টের আলোচনা সেদিকপানে তাকানো বিশেষ প্রয়োজন ভাবে নাই। থ্রিলার অঙ্গের ছবির তুলনায় ধীরগতির কারণেও বোধহয় মেশিনিস্ট দর্শক-সমালোচকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হইতে বিফল হয়; যদিও ‘আমি খালি ঘুমাইতে চাই’ সংলাপে ভর দিয়া দাঁড়ানো ছবির বুনোট কামু-কাফকার সাহিত্যছকে বোনা চরিত্রগুলার জাড্যকবলিত অবস্থায় মানবসমাজে বিচরণ বা সেখান থেকে ছিটকে পড়ার কাহিনির চেয়ে কোনো অংশে কম মর্মান্তিক ছিল না।
বাংলা সাহিত্য ও সিনেভাষায় ঘুমাইতে না পারার সমস্যা নিয়ে গল্প কি লেখা হয়েছে? অধমের স্মরণে আসে না! তবে হ্যাঁ, কথাকার মানব চক্রবর্তী প্রণীত স্যালাম্যান্ডার আখ্যানটির কথা মনে পড়ে। কামু-কাফকার ধাঁচে বাঁধাই হইলেও বয়ানটা মর্মস্পর্শী ছিল! সে যা হোক, নোলানের মেমেন্টো আর ইনসেপশন স্মৃতিমধ্যে সঞ্চিত ছবির কাতারেই পড়ে। জনপ্রিয় হওয়ার কারণে বিস্তারে না গেলে বোধহয় গোনাহ হবে না। ছবিতে গল্প বয়নের কথা ভাবতে বসলে এইসব ছবি আপনা থেকে মনে টোকা দিয়া যায়। এ-রকম আরো আছে নিশ্চয়। সব দেখাও কঠিন। কাজেই কথা আর না বাড়িয়ে ঢাকাই সিনেকারখানায় তৈরি মেন্টাল-এ ফেরত যাই।
থ্রিলার অঙ্গে নির্মিত সিনেভাষায় দৃশ্যায়নে বিবিধ চোরাটান গরহাজির থাকায় শাকিব খানের গৎবাঁধা ছবিগুলা থেকে মেন্টালকে পৃথক ভাবার কারণ থাকে না। মারপিটের সিনগুলা সম্ভবত এই ছবির সবচেয়ে বাজে দিক। পরিচালক সোজা তামিলে গমন করেন এবং এক-দেড় দশক ধরে চাল্লু সিন রিপিট করান। ছবি মার খাওয়ার জন্য অগত্যা ওটাকে কাফি মনে হইতে থাকে। মেমেন্টোকে যে-লোক একবার মাথায় নিয়াছে তার ভাবা উচিত ছিল ছবিতে শাকিবকে কোপা শামসুর ভূমিকায় হাজির করা বদখত দেখায়। দেশে মারকাটারি ছবির কালচার বিবেচনায় ছুরি-চাকু, ড্যাগার কিংবা ভোজালি সহযোগে কোপাকুপিতে দোষ ধরার কিছু নাই, তবে কোপা শামসু যত্রতত্র প্রয়োগ হইতে থাকলে ছবির মান আর বজায় থাকে না। ভাবনাটা মেমেন্টো থেকে মেন্টাল-এ যাত্রার ক্ষণে নির্মাতাকে কেন খোঁচা দিয়া গেল না সে এক রহস্য বটে!
মারপিটের প্রসঙ্গে মনে পড়ে জসিমের যুগে বন্দুক, তলোয়ার আর বিচিত্র উপায়ে লম্পজম্প বা ডিগবাজি দিয়া শত্রুকে ঘায়েল করার রীতি ছিল। রুবেলের জামানায় কুংফু-ক্যারাটের সঙ্গে নানচাকু ও হকি স্টিকের চল বৃদ্ধি পায়। মান্না ও ডিপজলে ড্যাগার-চাপাতি-ভোজালি এবং রাম দা ট্রেডমার্কের মহিমায় উন্নীত হয়েছিল। শাকিবের যুগে মারপিটের সিনে কী যন্তরমন্তর ও টেকনিক কামে দিবে সেটা ঢাকাই ছবির পরিচালক ও ফাইট ডিরেক্টররা বোধহয় আজো ভেবে বের করতে পারেন নাই! মেন্টাল-এ ভোজালিকাণ্ড যারপরনাই বেহুদা ভায়োলেন্স ছাড়া দ্বিতীয় আবেদন ছবিতে বহায় না। বন্দুকবাজির অভিনব ব্যবহার এই ছবির জন্য জরুরি ছিল। খালি হাতে শত্রুদের ঘায়েল করার তরিকায় নতুন কৌশল আমদানি করা যাইত। মারপিটে নতুনত্ব আনার খাতিরে তামিল ও হলিউডকে একসঙ্গে টুইস্ট করার উপায় নিয়েও ডিরেক্টর ভাবতে পারতেন। এসবের কোনোকিছু না ঘটায় ছবিখানার সম্ভাবনাকে তিনি নিজহস্তে গলাটিপে হত্যা করেন।
তামিল নির্মাতা পুরি জগন্নাথের আইস্মার্ট শঙ্কর-এর (iSmart Shankar) কথা অগত্যা মনে পড়ে। কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে থ্রিলার মিশায়ে বানানো ছবিখান গেল বছর রিলিজ করেছিল। করোনা মারির মধ্যে রিলিজ করলেও বক্স অফিসে ঝড় তুলতে অসুবিধা হয় নাই। ছবির ভাববীজ মিশেল গোন্ড্রির স্মরণীয় ছবি ইটার্নাল সানশাইন অফ দ্য স্পটলেস মাইন্ড থেকে পরিচালক নিয়াছিলেন বলে কলকাতার সিনেকাগজে খবর ছাপতে দেখেছি। মেন্টাল-এর মতো আইস্মার্ট শঙ্কর-এর গল্প ভারতীয় আমজনতার কথা মাথায় রেখে বোনা হয়েছিল। তফাৎ এটুকুই যে, তালজ্ঞান বজায় রাখায় দেখতে মন্দ লাগে না। ভারতীয় কাহানির চিরাচরিত ছকে থ্রিলার ও কল্পবিজ্ঞানের অনুষঙ্গ মিশানোর ক্ষণে তার দেহকে নতুন আঙ্গিকে সেলাই করা, সংলাপ ও অ্যাকশন সিনের শক্তি বাড়ায়া নিতে মশলা ছবির প্রচলিত উপাদানকে পৃথক মাত্রায় ব্যবহারের কারণে জগন্নাথের সিনেভাষ্য দর্শককে মোটের ওপর বসিয়ে রাখে।
আইস্মার্ট শঙ্কর-এর অ্যাকশন সিনগুলা নতুন বা বিশেষ বৈচিত্র্যপূর্ণ না হইলেও সিনেমাটোগ্রাফির চাতুরীর কারণে বৈচিত্র্যহীনতা চোখে সয়ে যায়। অতিমানবীয় টাইপের মারপিটকে উদ্ভট ভাবার অবকাশ ছবির তুরন্ত গতির কারণে মনে চাপ দিয়া বসার চান্স পায় না। সিনেপর্দায় গতিশীল দৃশ্যাবেশ তৈরিতে দক্ষিণী নির্মাতাদের সহজাত পটুত্বের কারণে উপমহাদেশের চিরায়ত হিরোইজমে সচল ফ্যান্টাসি বাস্তবাতীত বাস্তব রূপে দর্শকচেতনায় বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করে। দৃশ্যগুলা বাস্তবিক নয় তবু দেখার সময় সে আর মনে কাজ করে না! অতিমানবীয় ফ্যান্টাসির মাদকতা ভালোই লাগে দেখতে। কারিগরি সক্ষমতা, কম্পিউটার গ্রাফিক্স আর দারুণ সব অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা খাটিয়ে যে-দৃশ্যাবেশ সেখানে পয়দা হয় তার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার কথা দর্শক তাই ভাবে না। অ্যাকশন সিনারির এই জায়গায় দক্ষিণী ছবি মারপিটে দুরন্ত সেকালের হংকং অথবা হলিউড ঘরানার ছবিকে ক্রমশ পেছনে ফেলতে শুরু করেছে। হলিউড থেকে ভাববীজ আহরণের ক্ষণে তামিল-তেলুগু-মালায়ালাম ছবি কোন ডিনামিকস-এর জোরে দুনিয়া কাঁপায় সেটা আইস্মার্ট শঙ্কর দেখতে বসে পুনরায় বোধে ধরা দিয়া যায়।
অ্যাকশন সিনারিতে ঢাকাই সিনেভাষা দৃশ্যাবেশ জাগানোর কামে পিছিয়ে থাকায় শাকিব খানের ভোজালিকাণ্ড বা সুপারম্যানের ভঙ্গিতে উড়ন্ত মারপিটকে বাস্তবাতীত বাস্তব ভাবার ঘোর মনে তৈরি হয় না। কম্পিউটার এডিটিংয়ের সাহায্যে দৃশ্যাবেশ তৈরি ও ক্যামেরায় অ্যাকশন সিনারি শুট করার কায়দাবাজিতে ঢাকাই ছবি অধিক অগ্রসর হইতে পারে নাই। সেইসঙ্গে মারপিটের বাংলা ভার্সন যেগুলা বাংলার জনগণ যুগ-যুগ ধরে বাস্তবজীবনে এস্তেমাল করে এসেছে সেগুলাকে নবায়নের ভাবনা পরিচালকদের ভাবিত করে বলেও একিন হয় না। চরদখলের ঘটনায় লাঠিযুদ্ধ এক সময় ঢাকাই ছবির ট্রেডমার্ক ছিল। এখনকার মারপিটের ধারায় লাঠিযুদ্ধের সংযোজন বা সেরকম ফিউশন নিয়ে ভাবার দায় নির্মাতার মনে জাগেনি। ব্রতচারী গুরুসদয় দত্ত আংরেজ খেদাও আন্দোলনের সময় প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে রায়বেঁশে নৃত্যে ব্যবহৃত শারীরিক কসরতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এর আধুনিক ব্যবহার সিনেভাষায় ঘটানো যায় কিন্তু ভাবার লোক নাই। বাংলার প্রচলিত মল্লযুদ্ধে কিংবা জব্বারের বলিখেলায় ব্যবহৃত টেকনিকের নতুন ধাঁচে ফিউশন মারপিটে অভিনবত্ব আনার হিম্মত রাখে। বাংলা সিনেকারখানায় এসবের চল চোখে পড়ে না।
দক্ষিণের ছবি এইসব দিক দিয়াও দড়। জাপান, হংকং, কোরিয়া বা হলিউডের মারপিটের সঙ্গে তামিল বা মালায়ালাম ধাঁচের সংকর কীভাবে ঘটানো যায় এই থিসিসটা তারা করে এবং কামিয়াব হয়। আবার মারপিটে বহুল ব্যবহৃত উপকরণের পরোয়া না করে হাতের কাছে যা পায় সেগুলাও অনেকসময় কামে লাগায়। কাবালি-তে রজনীকান্ত ছাতা দিয়া সিনারি গরম করে তোলে। আইস্মার্ট শঙ্কর-এ হাসপাতালে মারপিটের সিনে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জকে দারুণ কামে লাগায়। মশলা ছবির বেলায় মারপিট এক ভয়ঙ্কর শৈল্পিকতা এবং সেখানে অবিরত নতুন আইডিয়া দরকারি হয়ে ওঠে। হিন্দিতে টাইগার শ্রফের সাম্প্রতিক উত্থানের নেপথ্যে কুংফু-কারাতের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত আত্মরক্ষা পদ্ধতির টুইস্ট বড় কারণ।
নব্বইয়ের পুরা দশক জুড়ে ডিপজল-মান্না মিলে বাংলা মারপিটের ঢাকাই সংস্করণ জন্ম দিতে প্রয়াস নিয়াছিলেন। ডিপজলের ভোজালি ও রামদা-র পর্দা-সহিংসতায় রুখু তেজি জৈবভাব ছিল। দৃশ্যাবেশ সৃষ্টিতে তাঁর এই জৈবসহিংসতা বেশ কামে দিত। শাকিব আর সিক্স প্যাক অনন্ত জলিলের জামানায় অ্যাকশনগুলাকে প্লাস্টিক ফুলের মতো দেখায়। ঢাকা এ্যাটাককে ব্যতিক্রম ধরে নিলে ছবির গল্পের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অ্যাকশনদৃশ্য ঢাকাই সিনেমায় আজো সুলভ নয়। দীপংকর দীপনের ছবির দৃশ্যায়ন মূল গল্পের সঙ্গে সুসমঞ্জস এবং অ্যাকশন সিনে পেশাদারিত্ব চোখে পড়ে। বম্ব ব্লাস্টার তাসকিন রহমানকে ট্রেইল করার সিনগুলা হলিউড অঙ্গের ছবির মতো বেশ নজরকাড়া। বড় কথা, এই অঙ্গের ছবিতে জায়গা বুঝে যেখানে যতটুকু থ্রিল ও সাসপেন্স দরকার পরিচালক সেভাবে শুট করেছেন। শাকিব খানের হাউজফুল ছবিগুলায় এহেন পরিমিতি অধিক চোখে পড়ে না। তাঁর দুর্ভাগ্য বাতেধরা একখান ঘোড়াকে তিনি ও মিশা সওদাগর মিলেঝুলে গেল দেড় দশক ধরে টানছেন! ঘোড়াটানার এই কামে তাঁদের দুজনকে সঙ্গ দেওয়ার মতো পরিচালক, ফাইট ডিরেক্টর, কোরিওগ্রাফার, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট এবং অপু বিশ্বাসের পরে দ্বিতীয় কোনো নায়িকা সেখানে দৃশ্যত অনুপস্থিত!
সিনেভাষার সাতকাহন আগের পর্ব
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি ২
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS