শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সঙ্গে তাঁর মিনারায় || শেখ লুৎফর

শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সঙ্গে তাঁর মিনারায় || শেখ লুৎফর

কোনো ভূমিকার দরকার নাই। কারণ গড়পরতা বাঙালি শুধু দেহ-গতরেই খর্ব না, আজ তারা মনন-মগজেও আচানক রকম খাটো হয়ে গেছে। শুনেছি বিখ্যাত মরমি কবি উকিল মুনশি পেশায় মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর যাপিত জীবন, ব্যক্তিত্ব, মানবপ্রেম ও স্রষ্টাকে পাওয়ার সাধনায় তিনি এমন এক উচ্চতায় উঠেছিলেন যে, তাঁর মহল্লার নামাজিরা এই বাউলের হাতের দোতারা এবং কণ্ঠের কালামকেও (গান) সমানভাবে ভালোবাসতেন।

উকিল মুন্সীর সেই গল্পটাই কিছু বাঁক-মোচড় ও সময়দোষে অনেকটা তেঁতো স্বাদ নিয়ে বাস্তব হয়ে উঠল যখন সাধক শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীকে কাছ থেকে দেখতে পেলাম। তিনিও একটা মসজিদের ইমাম। তাঁর বর্তমান কর্মস্থল জগন্নাথপুরের আছিম শাহ-র মাজারের মসজিদ। মসজিদের পরেই পশ্চিম-উত্তর জুড়ে বিশাল হাওর। হাওরে ঘুরে বেড়ানো আমার পুরনো বাতিক। সাথে থাকে ছোট একটা হাতব্যাগ। তাতে থাকে পানির বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট, নোটখাতা, বুকপকেটে কলম আর প্যান্টপকেটে স্মার্টফোন। এই ভাটির দেশ শুধু ধান আর গানের দেশ না সাধকেরও দেশ। এখানে হাওরের শাপলা ও কলমি ফুলের পাশে ফুটে আছে অসংখ্য নাম-না-জানা ছোট ছোট ফুল। যদি তাদের কারো দেখা পাই! জানি, আমাদের সামনে শুধু অন্ধকার। তবু আশায় বাঁচি। মনে মনে খুঁজি ঘন পাতার আড়ালে মৌ মৌ করতে থাকা চালতা ফুলের ঘ্রাণ।

একদিন শেষবিকালে আমি আর বাউলশিল্পী রিপন উদাসী মেঘাখালীর হাওর থেকে উঠে এসেছিলাম আছিম শাহ-র মাজারে। প্রায় আড়াইশ বছর আগে হযরত আছিম শাহ এখানে আসন গেড়েছিলেন। পুরনো একটা বটগাছের ছায়ার নিচে তাঁর মাজার। আমরা খালিপায়ে এসে মাজারের চওড়া বারান্দায় বসি। আমাদের চারপাশে বটের শান্তি-শান্তি ছায়া।  সেখানেই দেখা হলো শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সাথে। তিনি বিশ্বনাথ উপজেলার দিদারপুর গ্রামে ১৯৭৫ সালে জন্মেছেন। বাবা শাহ মোহাম্মদ তৈয়ব আলীও গানপাগল মানুষ ছিলেন। মায়ের নাম মোছা. সেলিনা খাতুন। শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বিশ্বনাথ ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন। শিক্ষক হুজুররা যখন দরজার সামনে জুতা খুলে ক্লাসে ঢুকতেন তিনি তখন ওস্তাদের পায়ের জুতাদুটো নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ভরে রাখতেন। হুজুর ক্লাস শেষে দেখতেন জুতা নাই তখন তিনি পকেট থেকে জুতা বের করে দিতেন। এইভাবে তিনি তাঁর ওস্তাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। ওয়াজের মৌসুমে হুজুররা মাহফিলে বয়ান করতে যাবার সময় সহবত হিসাবে তাঁকে সাথে নিতেন। হুজুর ভাড়া-করা কারে উঠে ড্রাইভারকে বলতেন, গাড়ির জানালার কাচ তুলে দাও। তারপর তাঁকে বলতেন, অ-রে পুত, এইবার তর মারফতি গান চালু কর।

শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ছাত্রবয়েসেই আসরে গাইতে শুরু করেছিলেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও আলেম সমাজে তিনি চরমভাবে কোণঠাসা। সমাজের বাঁকা নজর, মানসিক নির্যাতন ও অর্থকষ্ট কোনোটাই তার সাধনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মাথায় কিস্তি টুপি, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল এবং একহারা গড়নের প্রায় ছ-ফুট লম্বা ছিমছাম মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। তাঁর চোখেমুখে জ্বলতে-থাকা প্রজ্ঞার আগুন আমাকে সালাম দিতে বাধ্য করে। রিপন উদাসী পরিচয় করিয়ে দিতেই আমি তাঁর হাতে হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করি, — আপনি মসজিদের ইমাম?
ইউসুফ আলী : ঠিক আছে, আমি ইমাম।

আমরা গোল হয়ে বসি। আমি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে একঢোক খাই। সিগারেট ধরাই। একটা শাহ ইউসুফ আলীর দিকে বাড়িয়ে ধরি —
ইউসুফ আলী : না।
শেখ লুৎফর : সিগারেট টানেন না?
ইউসুফ আলী : না।

ঈগলের মতো লম্বা গলায় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পানের রসে ভেজা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। হাওর থেকে উঠে আসতে থাকা সন্ধ্যার অন্ধকারের মাঝে আমি তাঁর বিনয়ী চোখ দুটোতে অনেক অনেক আলো দেখে ফেলি।
শেখ লুৎফর : আপনি কী আমাকে একটা সাক্ষাৎকার দেবেন?
ইউসুফ আলী : মাগরেবের আজানের আর মাত্র সাত মিনিট আছে।
শেখ লুৎফর : আপনার মিনারায় (মসজিদের সাথে ইমাম-মোয়াজ্জিন থাকার ছোট্ট রুম) কী আসা যাবে?
ইউসুফ আলী : অবশ্যই।

তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে পুকুরপাড় ধরে মসজিদের দিকে চলে যান। একটু পরেই উত্তরদিকের গাছ-বৃক্ষ ও কলাবাগানের আড়াল থেকে মাইকের আওয়াজ কানে আসে, — আল্লাহু আকবার

তিনদিকে তিন পুকুরের বুকে রাত নামছে। আমি আর রিপন মসজিদের মিনারা ঘরে গিয়ে বসি। আতর ও আগরবাতির সুঘ্রাণে ঘরটা চনমন করছে। শাহ ইউসুফ আলী মসজিদে নামাজ পড়ছেন। পেছনে হাতে গোনা কয়জন মুসল্লি। অর্থাৎ সাধারণ নামাজিদের উনিশআনাই এই মসজিদে আসেন না।

বিশাল বিশাল তিনটা পুকুরের চারপাশে, আম-জাম-কলা গাছের ভিড়ে, ঝিঁঝি ও জোনাকিরা সন্ধ্যার উৎসবে মেতে উঠেছে। মুসল্লিরা চলে যেতেই অথৈ নির্জনতা আমার মনে ভাবের দুয়ার খুলে দেয়। আর যখন শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মসজিদ থেকে এসে পানসুপারির বাটা সামনে নিয়ে বসেন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, — গানকে আপনারা কালাম বলেন কেন?
ইউসুফ আলী : এইটা তো আল্লাহ বলেছেন, ‘সোয়ালিহিন, মুত্তাকিন’ যে মুমিন ব্যক্তিরা…, উনাদের গুণগান আল্লাহ নিজে করেছেন। উনাদের অনেক মর্যাদার কথা আল্লাহ কোরআনের মধ্যে বলেছেন। এমনকি তার প্রিয় বান্দাদের, ইনসানদের গুণগান করার জন্য আল্লাহ কোরআনে তাগিদ দিয়েছেন।

আমি স্মার্টফোনের রেকর্ডার চালু করে আয়েশে সিগারেটে টান দিয়ে বলি, — আশা করি আপনি সংগীত বিষয়ে কথা বলবেন।
ইউসুফ আলী : রসুল পাক (সা.) যখন মক্কা ছেড়ে মদিনাতে হিজরত করতে আসেন তখন মদিনাবাসী খবর পেয়ে নবিজিকে স্বাগত জানানোর জন্য ঢোল, ঢপ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহ নৃত্য করতে করতে অনেকটা পথ এগিয়ে এসে নবিজি ও তাঁর সাহাবিদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন।  মক্কা থেকে আগত সাহাবিরাও অই নৃত্যগীতে অংশ নিয়েছিলেন। সেই আনন্দঘন উৎসব, মিলনের উৎসবে সবাই ফানাফিল্লাহ হয়ে গেছিলেন। তখন নবিজির গায়ের চাদর জমিনে পড়ে গিয়ে এগারো টুকরা হয়ে গেছিল। সাহাবিরা সেই টুকরাগুলো তাঁদের বুকে তুলে নিয়েছিলেন। এই কথা বোখারি শরিফে আছে। তখন কিন্তু নবিজি সেই নৃত্যগীত ও ঢোল-ঢপ ও শিঙা বাজানোকে নিষেধ করেন নাই। কিংবা বলেন নাই যে তোমরা গানবাজনা বন্ধ করো। বলেন নাই এইটা হারাম।
শেখ লুৎফর : আরো কিছু উদাহরণ দেন।
ইউসুফ আলী : সাহাবি আনাস বিন মালিক ইসলাম গ্রহণের পর বারো বছর নবিজির খেদমত করেছিলেন। উনার বরাত দিয়ে হাদিসে আছে, মক্কার এক সাহাবি একদিন নবিজিকে দাওয়াত দিলেন। নবিজি আনাস বিন মালিককে সাথে নিয়ে দাওয়াত রাখতে গিয়ে দেখেন, অই সাহাবি রাসুল পাক (সা.)-এর সম্মানে বিরাট এক মজমার আয়োজন করেছেন। উনারা বাদ্যযন্ত্র সহ গান ও গজল পরিবেশন করলেন। আল্লাহর রসুল তখনো অইসব গানবাজনা বন্ধ করার নির্দেশ দেন নাই। আরেক রেওয়ায়েতে আছে, নবিজির ওফাতের পর হযরত আবুবকর (রা.) তখন খলিফা। হযরত আলি (রা.) রসুলের স্মরণে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে বাদ্যযন্ত্র সহ নাত ও গজল গাওয়া হয়েছিল। সংগীত পরিবেশন করা হয়েছিল।

শেখ লুৎফর : তাহলে আলেম সমাজ কেন গানকে হারাম বলেন?
ইউসুফ আলী : গান আর সংগীতের মাঝে কিন্তু বিস্তর ফারাক আছে। না-বুঝে সাধারণ মানুষ দুইটাকে এক করে ফেলে। আর আজকের দিনের অধিকাংশ বাদ্যযন্ত্র ও গানের ভাব-ভাষাকে কোনো দলিল দিয়ে, হাদিস দিয়ে সার্পোট করা সম্ভব না। বর্তমানে যে-বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে বা মহিলাদেরকে নিয়া, তাদের আনন্দফুর্তি… এইটা তো তাদের খায়েশ মিটানো। এই অবস্থায় কেউ যদি গানকে হালাল ঘোষণা করে…(ইউসুফ আলী হেসে ফেলেন। তাঁর সাথে আমিও হাসতে থাকি।)

শেখ লুৎফর : আপনার মুর্শিদ কে?
ইউসুফ আলী : আমার মুর্শিদের বাড়ি জিনারপুর পরগনা। হবিগঞ্জ থানা। রুকনপুর গ্রাম। জায়গাটার নাম জবান শাহ-র হাওলি। আর আমার মুর্শিদের নাম শাহ মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। শাহ মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের মুর্শিদ জবান শাহ। জবান শাহ অনেক বড় মাপের ওলি ছিলেন। তিনি কোরআন-হাদিস, ইজমাভিত্তিক অসংখ্য কালাম (গান) রচনা করে গিয়েছেন। আমার পিরবাবা আমাদেরকে অর্ডার দিয়েছেন, আমরা যেন জবান শাহ-এর লেখা কালামগুলি বেশি বেশি গাই।

শেখ লুৎফর : আপনি কালাম লিখেন?
ইউসুফ আলী : অবশ্যই।
শেখ লুৎফর : আপনার নিজের লেখা কালামের কোনো বই আছে?
ইউসুফ আলী : না।
শেখ লুৎফর :  কেন?
ইউসুফ আলী : আমার মৃত্যুর আগে কোনো বই প্রকাশ হবে না।
শেখ লুৎফর : কেন?
ইউসুফ আলী : মুর্শিদের নিষেধ আছে। নিজেকে জাহির করা ঠিক না।

শেখ লুৎফর : এখন মনে পড়ছে, গত মাসে জগন্নাথপুর হাসপাতাল পয়েন্টের ভিড়ের মাঝে আপনাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। তখন আপনার মাথার চুল কাঁধ ছাড়িয়ে গেছিল। এখন স্বাভাবিক সুন্নত বাবরির মতো কেন?
ইউসুফ আলী : আমার মুর্শিদ তো সুন্নতি চুল রাখার অর্ডার দিয়েছেন। কিন্তু চুল কাটার নির্দেশ না পেলে লম্বা তো হবেই। বোখারি শরিফে চুল বিষয়ে তিনটা দলিল আছে —

. রিম্মা। অর্থাৎ চুল কানের লতি পর্যন্ত লম্বা রাখা যাবে।
. জিম্মা। অর্থাৎ গর্দনা পর্যন্ত। আমাদের ঘাড়ের হাড়ের পাশে যে শাহ রগ আছে সেই পর্যন্ত লম্বা চুল রাখা যাবে।
. ওয়ারেফা। মানে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল রাখা যাবে।

তো মুর্শিদ আমাকে সুন্নতি চুল রাখার আদেশ দিছেন। কাটার হুকুম না পেয়ে কাটতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে চুল কাঁধ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তো দেখা গেছে যে, দুনিয়ার মানুষ আমার লম্বা চুল নিয়ে নানাভাবে আমাকে নাজেহাল করতে থাকে। অনেক লাঞ্ছনার শিকার হইছি। অনেক ধরনের হুমকির সম্মুখীন হইছি।
শেখ লুৎফর : কেন?
ইউসুফ আলী : শরিয়তপন্থীরা তো সবাই কানের লতি পর্যন্ত লম্বা চুলকে সুন্নত জানে। তাই তাদের নজরে এইটা নিষিদ্ধ।

শেখ লুৎফর : পেশায় আপনি ইমাম। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, আপনার প্রথম মসজিদ সিলেটের ওসমানীনগর থানায়। দ্বিতীয় মসজিদ জগন্নাথপুর থানার উত্তর ভবানীপুরে এবং তৃতীয়টাও জগন্নাথপুরের বিখ্যাত ওলি হযরত আছিম শাহ (রা.)-এর মাজার-মসজিদ। সর্বমোট পনেরো বছর ধরে আপনি ইমামতি করছেন। এই-যে বাউলগান কিংবা সংগীত ও ইমামতি, দুই জগতের দুই জীবন, আপনার ব্যক্তিজীবন, সাধনা — এইসবের মাঝে নিশ্চয়ই অনেক গোপন কষ্ট ও তিক্ত অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে। কিছু বলবেন কী?
ইউসুফ আলী : উত্তর ভবানীপুর থাকতে অই জাগায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়া আমার নামে বিচার পর্যন্ত হইছে। তারা প্রথমে আমাকে আশিক অবস্থাতেই তাদের মসজিদে চাকরি দিছিল। তবে সংগীতের মাধ্যমে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের গুণগান করতে গিয়ে দেখা গেছে যে তিরিশঘর মুসুল্লির মধ্যে পঁচিশঘর আমার পক্ষে, পাঁচঘর আমার বিপক্ষে।

শেখ লুৎফর : আপনি দিনে পাঁচবার মসজিদে আজান দিছেন, জামাতে ইমামতি করেছেন কিন্তু রাতে যখন গানে টান দিছেন সেইটা কোনখানে?
ইউসুফ আলী : আমার মহল্লার মাঝেই অনেক বাড়িতে অনুষ্ঠান হইছে, সেখানে গাইছি।
শেখ লুৎফর : যন্ত্র ছিল?

ইউসুফ আলী : অবশ্যই। ঢোল, ডপকি, দোতারা। কোনো-কোনো সময় যন্ত্র ছাড়াই গাইছি। কিন্তু আমার একটা অভ্যাস আছে। শরীরের এশকিতে আমি সিলভারের কলসি, থালা-বাটি কিংবা একটুকরা কাঠ হলেও বাজাতে পারি। সেই তালে তালে গাইতে পারি। কৌটা, চামচ, মন্দিরার পরিবর্তে এইগুলা ব্যবহার করছি।
শেখ লুৎফর : শ্রোতা কারা ছিলেন?
ইউসুফ আলী : আমার মহল্লার মানুষরাই। যারা আমার পিছনে নামাজ পড়েন সেইরকম বয়স্ক মানুষজন ছিল। তারা আমার কালামের ভাব-ভাষা ও সুরের মাঝে খারাপ কিছু পাইছে না। বরং আমার অই কালাম শুনে আমার প্রতি তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেছিল।

শেখ লুৎফর : আপনি তো গান লিখেন?
ইউসুফ আলী : অবশ্যই।
শেখ লুৎফর : নিজের লেখা কালামের বই হবে না?
ইউসুফ আলী : না। কারণ আমার মুর্শিদ বলেছেন, মারফতের জগতে জাহিরি ভালো না। তাই আমার ইচ্ছা, আমার মৃত্যর পর কেউ যদি আমার কালাম দিয়ে বই করে তাতে কোনো বাধা নাই।

শেখ লুৎফর : আপনি কোন মহাজনের লেখা কালাম গাইতে পছন্দ করেন?
ইউসুফ আলী : অনেকের কালামই গাই। তবে আমার মুর্শিদের মুর্শিদ জবান শাহ-এর লেখা কালামই বেশি গাওয়া হয়।
শেখ লুৎফর : জবান শাহ বিষয়ে কিছু বলবেন?
ইউসুফ আলী : উনি বহুত বড় মাপের আলেম ছিলেন। মুনশি (ফার্সি ভাষায় দক্ষ) ছিলেন। ওলি ছিলেন। উনার বাড়ি এই জগন্নাথপুরেই। জীবনে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। মা-বাবা জোর করে উনাকে বিয়ে করালেন। বাসররাতে নতুন বউকে উনি কী বোঝালেন কে জানে। শেষরাতে বউয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন। ফজরের আজানের সময় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির। শ্বশুরের ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে, শ্বশুরের নাম ধরে ডাকতে থাকেন, অমুক ভাই বাড়ি আছেন? ডাক শুনে তাঁর শ্বশুর বেরিয়ে এলে জবান শাহ বললেন, — এই নেন আপনার মেয়ে। সেই রাতেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বারো বছর কোনো খোঁজ নাই। বারো বছর পর হবিগঞ্জের জিনারপুরে বিশাল এক জঙ্গলের মাঝে উনাকে পাওয়া গেল। গভীর জঙ্গলের আস্তানায় ধ্যানে বসে আছেন।
শেখ লুৎফর : এবার হযরত জবান শাহ-এর লেখা একটা কালাম শোনাবেন কী?
ইউসুফ আলী : অবশ্যই —

আমার দেহের ভাণ্ডে মক্কার ঘর,
তোমার দেহের ভাণ্ডে মক্কার ঘর,
কে বিরাজে দেহের মাঝে, (২)
আগে তাঁরে তালাশ কর,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

পিরের বিধি পাইছে যারা,
নামের বৈরাগী তারা,
দৌড়ায় তারা নামের ঘোড়া, (২)
আসে-যায় মক্কার শহর,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

পিরের মুখের পদবাক্য,
হৃদয়ে রাখিয়া ঐক্য,
ধ্যানের ঘরে করো লক্ষ, (২)
জাগা চিনে নামাজ পড়,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

আপন ঘরে মানিক জ্বলে,
অন্ধ লোক মক্কাতে চলে,
ফকির-সাধুর দিদার মিলে, (২)
যে গেছে দিল্লীর শহর,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

দিল্লীর শহরের মাঝে,
কুতুব মিনারা আছে,
সেই মিনারায় উঠলে পরে,(২)
দেখতে পাও মক্কার শহর,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

মুর্শিদ জবান শাহ পির কাবা,
ঘরে দরগা-উস-মাওলা,
সেই চরণে বাইন্ধ্যা মন রে, (২)
সদায় জপ আল্লাহু আকবার,
দ্যাখ চায়া মন সাধুভাই।

শেখ লুৎফর : কে বিরাজে দেহের মাঝে কিংবা আপন ঘরে মানিক জ্বলে এবং মক্কা, দিল্লীর শহর ইত্যাদি শব্দগুলো নিশ্চয়ই এই গানের চাবি। এই সংকেতগুলো কী একটু খোলাসা করবেন?
ইউসুফ আলী : কোরআনে আছে, আল্লাহ বলছেন, আমি তোমাদের শাহ রগের (আমাদের ঘাড়ের হাড্ডির মাঝে যে প্রধান রগ আছে) চাইতে নিকটে। এই কালামের অই শব্দগুলা দিয়ে জবান শাহ বলতেছেন, এই দেহভাণ্ডের মাঝে আল্লাহকে রেখে হাজিসাহেব মক্কাতে যাচ্ছেন তাঁর তালাশে। অই-যে দিল্লীর কথা বলা হলো অইটাই ‘কুলুবুল মুমিনিনা আরশুল্লাহ’। মুমিনের কলব আল্লাহর আরশ। অর্থাৎ আমাদের আত্মাই কাবাঘর। অষ্টপ্রহর একই ঘরে বসত, আসা-যাওয়া, সঙ্গ-সাধন। এই সঙ্গ থেকেই সংগীত। মারফতের ভাষা হলো সংগীত, যা বিশ্বাসীর কলব থেকে সুর হয়ে ভেসে আসে।


রাত গভীর। শাহ ইউসুফ আলীর লজিং (পিরবাড়ি) থেকে টিফিনক্যারিয়ারে করে আসা রাতের খাবার অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি ফোনের রেকর্ডার অফ করে সেইভ করি। শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর হাতে হাত মিলাই, আবার আমাদের দেখা হবে। তখন আমরা কথা বলব নারী, রাজনীতি ও মারফত নিয়ে। আসসালামু আলাইকুম।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও কথা ধারণ / ১০ অক্টোবর ২০২২


শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you