আত্মজা ও একটি বৃষ্টিবাইক || জাহেদ আহমদ

আত্মজা ও একটি বৃষ্টিবাইক || জাহেদ আহমদ

বাপের হাতের মাপে দেড়হাত প্লাস্ বিঘৎখানেক উঁচা। আন্দাজে মেপে দেখা, চোখের আন্দাজে, হাত দিয়া বা গজফিতায় মাপা না। বাচ্চাদের বাইসাইকেল যেমন হয়, কিউট দেখতে, একটা বেল্ আছে ডানপাশের হাতলমুঠির কব্জিতে বসানো; একজোড়া এক্সট্রা চাকা আছে পেছনের দিকটায়, প্রাথমিক প্রশিক্ষণদিনগুলো পেরোনোর পরে সেই চাকাদ্বয় পেছনচাকার সংলগ্ন গোটানোই থাকে, যেন উড়োজাহাজের অ্যারোড্রামে ল্যান্ডিঙের সময় ব্যবহারের গরজে সেই চাকাদুটো। অথবা আব্জানো অবস্থায় চাকাদুটো মূল চাকার সঙ্গে এমনভাবে লেগে থাকে, দেখে মনে হয় একটা মাছুয়া বক ঠ্যাং গুঁটিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জংলার কচুরিপানায়। বাইকটাকে হেলান দিয়া থাকতে দেখা যায় বারান্দার বা ডাইনিঙকোণের দেয়াল ঘেঁষে সাধারণত।

দুনিয়ায় পাখির সঙ্গে তুলনীয় উড়োজাহাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় দ্বিচক্রযান, বাংলায় বাইসাইকেল বলিয়া যারে একবাক্যে চেনে সবাই, তফাৎ এ-ই যে এই দ্বিচক্রযান অটোমোবিল্ বাহন নয়। এইটা আসলেই ওড়ে, যেন ন্যাচারাল্, যেন প্রাকৃতিকভাবে! এবং শুধু ওড়েই না, বাইসাইকেল বস্তুত সপ্রাণ ও সরস সুরস্ফূর্ত সরলযান। কিন্ডারগার্টেন্ শেষ বর্ষের ডিগ্রিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী ডিয়্যুড্রপ্ মেয়েটি যখন তার সাইকেলটা চালায় বারান্দার এপার-ওপার, তখন সত্যি সত্যি জিনিশটা প্রাণ পায় এবং উড়াল দেখায় ডানা ঝাপ্টায়ে দুইপাশে। এবং অবিরল সাইকেলচেন্-প্যাডেল্-চক্রঘূর্ণিপ্রসূত শব্দের সনে কেবল তুলনা করা যায় বৃষ্টিমিউজিকের।

সত্যি সত্যি বৃষ্টিতে ব্যাল্কোনির গ্রিলবেষ্টিত খোপটুকু যখন ঘোড়দৌড়ফিল্ডের আদল পায়, গ্যালারিভরা মানুষদর্শকের শো-শো শব্দের আবহ ক্রমশ ক্রিয়েট হয় বৃষ্টিস্পিড বাড়ার সঙ্গে, ঠিক এই-রকম টাইমে মেয়েটা প্রায়শ বাপের কানের চারিপাশে ঘ্যানরঘ্যানর করে আব্দার বাজিয়ে। বেদম বর্ষায় ভিজে ভিজে একটানা রাস্তায়, গাড়িঘোড়া চালানোর ‘সত্যিকারের’ সড়কে, সে চায় সাইকেল চালিয়ে যেতে অনেক অনেকটুকু দূরে। এ-ই তার সাধ, বহুদিনের, সদ্য সাড়েনয় বর্ষায় পড়েছে সে।

একটু বড় হয়ে নে আগে, এখন বৃষ্টিতে নির্ঘাৎ বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে, নিউমোনিয়া হবে, জ্বরজারি বাঁধিয়ে একমাস ভুগবার চেয়ে একদৌড়ে বেড়ে ওঠ আগে, আর তো বছর-দুই পরেই শক্তপোক্ত হবি, তখন বর্ষায় বৃষ্টিমিছিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়া হাঁকাবি বাইকপ্যাডেল্ — এইসব ভুজুংভাজুং বলে মেয়েকে নিবৃত্ত করে বাপ। হাঁসের ছানার ন্যায় প্যাঁকপ্যাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা আবার তার সাইকেলে চাপে।

এই ফাঁকে বাপ খাজুল হয়ে ভাবে মেয়ের সঙ্গে করা তার মিথ্যাচার নিয়ে। এমন দিন কি সত্যি আসবে যে মেয়েটা হাইওয়েতে বাইক হাঁকিয়ে ছুটবে দূরের পানে, পেছনে তার বৃষ্টি ব্যতীত অন্য কোনো বালামুসিবত থাকবে না, তেপান্তরের ঘাসের গন্ধ শরীরে নিয়ে সেই বৃষ্টিঝাঁক মেয়েটাকে একশবছর আগেকার কোলাহলকাহিনি শোনাবে কানে কানে? এমন দিন কি আসবে এই সভ্যতায় যেদিন এই মেয়েটির সঙ্গে তার বাপ অসহায় মিথ্যাচার করে যাবে না দিনের-পর-দিন?

যদি কিছুকাল আগে মেয়েটা আসত, জন্মিত যদি সে এই দশক-দুই আগেও, তবু না-হয় বাপদাদার ভিটেটুকু পেত, তখন ছড়ানোমেলানো উঠানে সে তার কাজিনদের সঙ্গে অ্যাট-লিস্ট এই বয়সের কিছু দস্যিপনা করে বেড়ানোর সুবর্ণ সুযোগটুকু পেত। এখন ভাড়াবাড়ির গ্যারেজের সামনে চিলতে সিমেন্টপাকা জায়গায় কিংবা ছাদের পিছল মেঝেতে বৃষ্টি ভিজলেও চারপাশের চোখগুলো তাকে দেখতে থাকে নৃশংস নজরে, এর মধ্যে একে একে চোখগুলো হাত হয়ে তাকে ঘিরে ধরতে উদ্যত হবে কখন বৃষ্টিঘোরে সে টেরও পাবে না। তারচেয়ে এ-ই ভালো, ঘরের ভেতরে আরও বছর-দুই বৃষ্টিকাল্পনিক সাইকেলচালনা, সময় মেয়েটাকে একসময় তার বাপের অসহায়তা নিশ্চয় বুঝিয়ে দেবে।

এদেশ ক্রমশ উন্নত হবে, এলআইসি থেকে এমআইসি হবে, রাজনৈতিক ও অন্যান্য বাস্তবতা বাপের অভিপ্রেত উপায়ে পরিবর্তিত হবে। এদেশের প্যুলিস্, এদেশের সেনাবাহিনী, এদেশের পারলৌকিক পরামর্শক হুজুরসংঘের লোকজন এবং সর্বোপরি এদেশের মানুষ একদিন নিশ্চয় আরেকটু মনুষ্যচরিত্রের রূপ পরিগ্রহ করবে। এদেশের সরকারপ্রধান একদিন উল্টাপাল্টা বাতচিত ভুলে মানুষকে সম্মান দিতে এবং সমীহ করতে শিখবে নিশ্চয়। কে জানে, ম্যে বি মিলতেও পারে সেইদিনে যেয়ে অ্যাট-লিস্ট বেডরুমে সেইফটি। কিন্তু ততদিনে মেয়েটা বাইক চালানো ছেড়ে লেলিহান সংসারের পাঁকে না-চাইলেও জড়িয়ে পড়বে।

একদিন বৃষ্টিসড়কে সে একটা চাকাপাখনাওয়ালা বাইক চালাতে চেয়েছিল, একদিন বাইসাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে বৃষ্টির শো-শো আওয়াজ তুলে সে তার বাপকে শোনাত রোজ ছুটিদিনে, বছর-দুইয়ের মধ্যে একটু শক্তপোক্ত হয়ে উঠলে তার বাপ তাকে মহাসড়কের বাইসাইকেলরেসে নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিল … ভুলে যাবে, এইসব, ভুলে যাবে সে বেঁচে থাকার বীভৎসতায়। সেদিনও বৃষ্টি থাকবে এদেশে। সেদিনও অঝোর বর্ষায় বাইসাইকেলের অজস্র চক্রঘূর্ণির শো-শো সংগীত উৎপন্ন হবে। একটি সাড়েনয়বর্ষা বয়সের বৃষ্টিরিমঝিম মেয়ের অপূর্ণ অচরিতার্থ সাধ বাংলার উন্নয়নশীল বা গায়েগতরে-উন্নত বর্ষার গায়ে গেঁথে রয় চিরতরে।

লেখাকাল ২০১৪

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you