আমাকে পাগলও বলা যেতে পারে …
কমলকুমার মজুমদার আমার এবং গৌরবে আমাদের কাছে কী, তা প্রকাশ করতে আর লজ্জা রাখা উচিত নয়। যদি বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ সহ বাদবাকি বাংলা সাহিত্য তাঁর গদ্যস্থাপত্যের একটি পাদটীকা মাত্র, তাও বেশি বলা হবে না। এভাবে তাঁকে বাংলার সর্বকালের সেরা নাট্যপ্রযোজক, সেরা চিত্রকর, শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক — সবই বলা যেতে পারে।
প্রকৃত প্রস্তাবে, যে-কোনো অতিশয়োক্তিই তাঁর সম্পর্কে নির্ভয়ে করা যায়। কেননা, যে-কোনো অতিকথাই তাঁর সম্পর্কে বলা যাক না কেন — কোটি কোটি কোষে দূর ও নিকট সম্পর্কে ছড়িয়ে-থাকা তাঁর কৃতকর্মের অন্তর্গত বাস্তবতা এসে তা সমর্থন করে যাবেই। কেননা, এইসব কোষ, ত্বকের মতো, বাংলার বাংলার বাতাস থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করতে পারে ও শরীরময় তা ছড়িয়ে দিতে পারে। এদের গতিবিধি ও সময়প্রণালি তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার।
“গ্রন্থসকল নীরবতার সন্তান” — কমলকুমার বলেছিলেন। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এমনই একটি গ্রন্থ। অন্তর্জলীটলি কিছু নয়, নাবিকের কাছে যেমন নৌকা, যাত্রাটুকুই এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ। যখন নদী অন্ধকার, দাঁড়ের ছপছপই তখন একাধারে দৃশ্য-ধ্বনি-স্পর্শ-আঘ্রাণ যা-কিছু।
প্রণাম যাত্রা। যাত্রাধিকারীকে প্রণাম।
গীতার বদলে …
সুশীল জানা থেকে সমরেশ বসু পর্যন্ত বেশ ছিল। তারপর … অগ্নিপরিধির মধ্যে গৌতম সহসা একদিন, কোনো-একদিন তাঁকে দেখতে পেল এবং উঠে পড়ে বলল, ‘আমি ওর মধ্যে যাব’।
আমরা বললাম, ‘গৌতম, করো কী, সাক্ষাৎ অগ্নিজ্ঞানে সত্যজিৎ যাকে স্পর্শ করেননি … গীতার বদলে যে-গ্রন্থ হতে পারে প্রত্যেক বাঙালি লেখকের শবযাত্রার সঙ্গী … এই নাও গ্যাসমুখোশ — এই নাও অ্যাজবেস্টস্ পোশাক …’
গৌতম বলল, ‘কিছু লাগবে না। আমি যাব আর একটা প্রণাম সেরে আসব।’
আমরা ভেবেছিলাম পারবে না। ছাই হয়ে যাবে পুড়ে। কিন্তু গৌতম সেই মহান, মহতোমহীয়ানের পা অন্তত একটিবার ছুঁয়ে আসতে পেরেছে।
নখ-চুল-লোম ইত্যাদি …
একমাত্র সত্যজিৎ রায় সার্থক ব্যতিক্রম। পৃথিবীর আধুনিক চলচ্চিত্রকাররা কেউ আর সাহিত্য নিয়ে ফিল্ম করেন না। কুরুজোয়া, ফেলিনি, গোদার, তারকোভোস্কি কেউ না। অন্তত, ক্ল্যাসিক নিয়ে তো নয়ই। ‘ফিল্ম হ্যাজ গট নাথিং টু ডু উইথ লিটারেচার’ — বার্গমান নিজেই একথা বলে গেছেন। ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কারণ, আমরা কাজ করি ভিশ্যুয়াল নিয়ে। আর যা-কিছু দৃশ্যমান তার শুধু চিন্তনীয়তার দিকগুলিই ওদের বিষয়। আমরা পরস্পরবিরোধী।
আমরা পরস্পরবিরোধী। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মগুলি নিয়ে তোলা প্রতিটি চলচ্চিত্র দেখে আমাদেরও বরাবর তা-ই মনে হয়েছে। হ্যামলেট বলুন, আনা কারেনিনা বলুন, অধুনাতম স্ট্রেঞ্জার বা আউটসাইডার বলুন — সেইসব মহান সাহিত্যকৃতির হাড়ের কাঠামো কোথাও আমরা পাইনি, কোনো চলচ্চিত্রে, পাইনি রক্তমাংস। কোথা শেক্সপিয়র, কোথা তলস্তই, কোথায় কামু! এখানে আমরা যা পাই তা এঁদের পরিত্যক্ত তথা পরিত্যাজ্য নাপিতে-কাটা নখ-চুল-লোম ইত্যাদি যা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা আমাদের বলে থাকেন, ‘এই তো পেলে। অস্বীকার করতে পারো, এই লোম-চুল-নখ এগুলো কামুর, এগুলো শেক্সপিয়রের এসব তলস্তইয়ের?’ না, হায় যে, আমরা তা পারি না।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অখণ্ড গ্রানাইট পাহাড় আমেরিকার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালায়। নাম আল কাপিনো। পৃথিবীর তিনভাগ জল ও একভাগ স্থল যে-উপন্যাসের আরাধ্য বিষয়, মেলভিলের ‘মবি ডিক’ উপন্যাসটিকে সেই আল কাপিনোর সঙ্গে তুলনা করা হয়। চলচ্চিত্রে একটি সরল পুঁটিকে দিয়ে সেই তোলপাড় তিমির চিৎকার শোনানো হলো। বলা হলো, এই অণ্ডই নাকি সে-ব্রহ্মাণ্ড। এই নাকি মবি ডিক!
পৃথিবীর বুদ্ধিমান চলচ্চিত্রকাররা তাই কেউ কখনো বিশেষত ক্লাসিক নিয়ে ফিল্ম করেন না। সত্যজিৎ রাক্য নিজে বলেছেন, খারাপ গল্প ছাড়া ভালো ফিল্ম হয় না। (ভাষা আমার)।
‘যে হাঁস শূন্যতা লইয়া খেলা করে’ …
গৌতমও যে পারবে না, পারা সম্ভব নয়, এটা জানা ছিল। কিন্তু, সে অন্তত একটিবার পা ছুঁয়ে প্রণাম জানাতে পেরেছে। এর বেশি পারবেই বা কী করে?
কমলকুমারের যে-কোনো রচনা থেকে যে-কোনো কটি পঙক্তি উদ্ধার করা যাক :
… ‘স্পোর্ট’ কথাটা বিলাসকে বড় খুশী করে, বড় সুন্দর করে, উহ্য যেন বাক্য নয়, তাহা যেন সত্যই নয়ন-অভিরাম সহজ, একটি ব্রাহ্মণী হংস, যে-হাঁস তুষার-অভিমানী, যৌবনশালিনী, এবং যে হাঁস শূন্যতা লইয়া খেলা করে।
আমি আগেই বলেছি, এগুলি কথার কথা নয়। এইসব অতিশয়োক্তির শতশৃঙ্খল মোচন করে এদের অন্তর্গত ক্রীতদাসবাস্তবতা উঠে এসে বারবার এদের যাথার্থ্য সমর্থন করে — এ-বেদনার ভার তারা চিরকালই বইবে।
টুটেনখামেনের সমাধিগৃহ যেন। ‘মৃত্যুর ডানা তাকেই স্পর্শ করবে যে নিদ্রাভঙ্গ করবে এই প্রবলপ্রতাপ ফারাওয়ের।’
নীল শ্রদ্ধার্ঘ্য …
গৌতমের ছবি নিয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। সমালোচকের পিঁচুটিচোখে আমি তো ছবিটি দেখিনি। শত্রুঘ্ন সিনহাকে দিয়ে বৈজু চণ্ডাল হয় না। উল্টোদিকে, প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আর কে-ইবা সীতারাম করতে পারত। অভিনেতার শায়িত মুখ তো এখানে শুধু মুখ নয় — সীতারামের সমগ্র জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবিই এখানে।
কিন্তু না, এ ছবির সমালোচনায় আমি যাব না। আমি সেভাবে ছবিটি দেখিওনি। আমি শুধু দেখেছি সতীদাহের কল্পদৃশ্যে লেলিহান আগুনের পিছন থেকে যার ক্রুদ্ধ নৌকাচক্ষু দুলতে দুলতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে পিছিয়ে বসেছি। তার আগে সারা ছবি জুড়ে কত-না-বার সেই সজল নৌকাচক্ষু — কখনো তেরছা, কখনো ঝিঁক, কখনো আয়ত, কভু-বা স্মিতচক্ষে কত-না-ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
সেই প্রবলপ্রতাপ ফারাওয়ের পায়ে সারা ছবি জুড়ে অসামান্য সব দৃশ্য — তুলনাহীন ফ্রেমের পর ফ্রেম সাজিয়ে মূলত নীল শ্রদ্ধার্ঘ্য — আমার কাছে এটাই গৌতমের অন্তর্জলী যাত্রা। এই। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু, এর চেয়ে কমও কিছু নয়।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র প্রথম পঙক্তি ‘আলো ক্রমে আসিতেছে।’ — গৌতম এটা পেরেছে। ওই প্যারাগ্রাফেরই শেষে কিন্তু ‘ক্রমে আলো আসিতেছে।’ — এটা পারা চলচ্চিত্রকারের পক্ষে সম্ভব নয়। গৌতমও পারেনি।
- রচনাটি লেখকের ‘চলচ্চিত্র চঞ্চরী’ শীর্ষক পুস্তিকা থেকে কালেক্ট করা হয়েছে। প্রকাশক প্রতিক্ষণ পাব্লিকেশন্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রকাশকাল জানুয়ারি ১৯৯৫।
… …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS