সুরের বিকৃতি, সুকৃতি ও সংস্কৃতি : বিতর্ক, প্রতিবাদ ও অন্যান্য || আল ইমরান সিদ্দিকী, নাজনীন সীমন

সুরের বিকৃতি, সুকৃতি ও সংস্কৃতি : বিতর্ক, প্রতিবাদ ও অন্যান্য || আল ইমরান সিদ্দিকী, নাজনীন সীমন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ইন্ডিয়ায় বানানো ‘পিপ্পা’ সিনেমায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানটি এআর রহমানের নতুন কম্পোজিশনে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিনেমাটি রিসেন্টলি রিলিজের অব্যবহিত আগে ইউটিউবে এর গান আপ্লোড করার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয় সর্বত্র। প্রসঙ্গ নজরুলের সুরের বিকৃতি ইত্যাদি। প্রতিবাদ হয় বাংলাদেশে এবং ইন্ডিয়ার বাংলা ভাষাভাষী প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গে। ফেইসবুক ইত্যাদি ছাড়াও বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় এই বিষয়টা কাভার করে লেখাপত্র হয়েছে বেশ।

গত ১৪ নভেম্বর (২০২৩) কবি আল ইমরান সিদ্দিকী তাঁর ফেইসবুকপাতায় এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ (খুদেনিবন্ধ/স্ট্যাটাস) প্রকাশ করেন এবং এর সূত্র ধরে সেখানে একটা আলাপ হয় আরও কয়েকজন সহ কমেন্ট সেকশনে। সেই আলাপের একটি নির্বাচিত অংশ নিয়ে এই ফিচার। এখানে সিদ্দিকীর সঙ্গে আলাপে যোগ দিয়েছেন নাজনীন সীমন। আলাপটা আমাদেরকে আরও আলাপ জুড়তে ইন্সপায়ার করতে পারে।

উল্লেখ্য, সিদ্দিকী ও সীমন উভয়েই ফিচার প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন বলে অশেষ কৃতজ্ঞতা। — গানপার

আল ইমরান সিদ্দিকী : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে যে স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম বহুদিন আগে। কার লেখা, তা মনে নাই। রবীন্দ্রনাথ পারতপক্ষে তাঁর গান ব্যবহার করার অনুমতি দিতেন না সিনেমাওয়ালাদের। নজরুল শান্তিনিকেতনে গিয়ে আবদার করার পর রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁর গান সিনেমায় ব্যবহার করার। সিনেমা মুক্তি পাবার পর সেই সিনেমার সংগীতপরিচালক নজরুলের ওপর তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু, কোনো প্রতিবাদ করেননি। সংগীতপরিচালক সিনেমার প্রয়োজনের সুরের এদিক-ওদিক করেন।

এ. আর. রহমান ‘কারার ওই লৌহকপাট’ নিয়ে যা করেছেন, তা নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা অনেকের মতো আমারও নাই। কিন্তু শ্রোতা হিসেবে বলতে পারি, তাঁর এক্সপেরিমেন্ট হৃদয়গ্রাহী হয় নাই। সবসময় হতেই হবে, এমনও না। তবে বাঙালি সংস্কৃতি অর্থাৎ ‘গেল গেল, সব গেল সংস্কৃতি’-র কারার লৌহকপাট ভেঙে তিনি নজরুলকে উদ্ধারের একটা চেষ্টা করেছেন, সেজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

নাজনীন সীমন : অনেকেই মনে করেন, নজরুলের গান মনের মাধুরী মিশিয়ে যেভাবে ইচ্ছা গাওয়া যায়। নজরুল নিজেই নাকি এই স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন! এ ব্যাপারে সত্যি কি কবি এতটা উদাসীন ও উদার ছিলেন? উত্তর হচ্ছে : ‘না’।

এখনকার অস্কার বিজয়ীদের আবির্ভাবের বহু আগে গত শতকের বিশের দশকেই আকাশবাণীতে নজরুলের গানে বিকৃতি ঘটতে শুরু করে। এই বিকৃতিতে নজরুল নীরব থাকেননি। প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯২৯ সালের ২৩ আগস্ট তারিখে ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় স্পষ্ট ভাষায় চিঠি লেখেন। আগ্রহীদের জন্য কবির সেই চিঠির চুম্বক অংশ তুলে দিলাম :

শ্রদ্ধাস্পদ
শ্রীযুক্ত নবশক্তি সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু
…আমার গান প্রায় প্রত্যহই কোনো-না-কোনো আর্টিস্ট রেডিওতে গেয়ে থাকেন। এবং আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি। এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং ক্কচিৎ দুয়েকজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে (বা একা পেয়ে) তার পিণ্ডি এমনি করেই চটকান যে মনে হয়, ওর গয়ালাভ ঐখানেই হয়ে গেল। সে একটা রীতিমতো সুরাসুরের যুদ্ধ।

একদিন শুনলাম, কোন এক ভদ্রলোক আমার ঠুমরি-চালের ‘দূর্গা’ সুরের ‘নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখিজল’ গানটিকে ধ্রুপদের ইমন কল্যাণ সুরে গাচ্ছেন। এবং তা শুনে গানের ‘আঁখিজল’ আমার চোখে এসে দেখা দিলো। অবশ্য অনুরাগে নয়, রাগে এবং দুঃখে। ভাগ্যিস গান এবং গাইয়ে দুই-ই ছিল নাগালের বাইরে, নইলে সেদিন ভালো করেই সুরাসুরের যুদ্ধ বেঁধে যেত!

আরেকদিন একজন ‘রেডিও-স্টার’ মহিলা আমার ‘আমারে চোখ ইশারায়’ গানটার ন্যাজমুড়ো হাত পা নিয়ে এমন করে তাল পাকিয়ে দিলেন যে, তা দেখে মনে হলো, বুঝিবা গানটার ওপরে একটা মোটর-লরী চলে গেছে। মোটর অ্যাকসিডেন্ট না হলে ওরকম কন্ধ-কাটা নুলো খোঁড়া ক্ষতবিক্ষত অবস্থা কারোর হয় না।

এরকম প্রায় প্রত্যহই হয় এবং বেতারের গাইয়ে-গুণীজন যাঁরা আমার গান দয়া করে গেয়ে থাকেন, তাঁরা আর-একটু দয়া করে গানগুলোর মোটামুটি সুর ও গানের কথা জানবার কষ্ট স্বীকার করেন না।…

আর একটি কথা, বেতার-বার্ত্তার বাঙালী কর্ত্তা মহাশয় প্রায় ভুলে যান গীত-রচয়িতার নাম ঘোষণা করতে। তাতে করে নবীন অনুকারকের প্রাপ্য প্রশংসা হয়তো আমাদের ওপরে এসে পড়ে। গালই খেতে হয় বেশিরভাগ। গালই হোক, আর প্রশংসাই হোক, যার যেটা প্রাপ্য তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা মস্ত বড় অন্যায়। তার চেয়েও বড় অন্যায় — সেই গালি বা প্রশংসা যখন কোনো নির্দোষী বেচারার কাঁধে এসে পড়ে।

আমাদের গান বেতারে গীত হওয়ার বদলে কিছুই পাইনে, কাজেই বেতার-কর্ত্তৃপক্ষের কাছে এটুকু সৌজন্য হয়তো প্রত্যাশা করতে পারি যে, তিনি অন্তত যাঁর রচনা — তাঁর নামটা উল্লেখ করেন। এতে তাঁদের ব্যবসার কিছু ক্ষতি হবে না। আমাদের ক্ষতি যা হবার, তা ত হচ্ছেই।

বিনীত
নজরুল ইসলাম

আল ইমরান সিদ্দিকী : (বইয়ের পাতা থেকে একটি স্ক্রিনশট উদ্ধৃতি, ইমেইজ থেকে দেখে দেখে অবিকল নিচে মুদ্রিত হচ্ছে—)

এরপর দেবদত্ত ফিল্মস ‘গোরা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব নিল। সংগীত পরিচালনায় নজরুল ইসলাম। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীতগুলি তোলাবার এবং আয়োজনের দায়িত্বে বাংলার আরেক বিখ্যাত কবি। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যাকে বলে মাহেন্দ্রক্ষণ।

মহানন্দে গান তোলালেন নজরুল। নিজের ছাপও বুনে দিলেন সেইসব রবীন্দ্রসংগীতে। তখন রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করতে গেলে বা কোনো ফিল্মে ব্যবহার করতে গেলে আগে বিশ্বভারতীর সংগীত বিভাগীয় বোর্ড থেকে অনুমতি নিতে হত। কিন্তু গোরার গানগুলি রেকর্ডের সময় নজরুল কোনো অনুমতি নেননি। তাঁর সহজ বিশ্বাস ছিল যেখানে তিনি স্বয়ং সংগীত পরিচালক সেখানে বিশ্বভারতী নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি করবে না। অতএব, হইহই করেই গান তোলার কাজ শেষ হল। ফিল্মের জন্য গান রেকর্ডও হল।

বিপত্তি ঘটল ছবিমুক্তির দিন দুয়েক আগে। সেদিন ছবির ‘ট্রেড শো’। বিশ্বভারতী থেকেও পর্যবেক্ষক হাজির সেখানে। নজরুলের পরিচালনায় গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতগুলিতে নানা খুঁত খুঁজে পেলেন তিনি। ব্যাস, অনুমতি মিলল না। ছবির মুক্তিও বন্ধ হয়ে গেল। প্রযোজক পড়লেন ভীষণ বিপদে। নজরুল ইসলামের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কিংবা খামখেয়ালিপনার জন্য তাঁর না টাকা ডুবে যায়। অনেকটা বিনিয়োগ হয়েছে এই ফিল্মে।

নাজনীন সীমন : তো? এর জন্য কি বাঙালির সত্তার সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত গানটিকে মর্গে নিয়ে কাটাছেঁড়া বৈধ হয়ে যায়? বরং এটা কি প্রমাণিত হয় না যে এহেন কাজ করা উচিত নয়? সাধুবাদ কিসের জন্য? অন্যের সম্তানকে নিয়ে ইচ্ছেমতো পোশাকে, সাজে খোলনলচে পাল্টে দেয়া সাধুবাদ দেয়া সংগত? শিল্পকে সম্মান করতে হয়, ভালোবাসতে হয় তার স্রষ্টাকে। গোয়ের্নিকায় চাইলেই আমি রঙের ঝলক লাগাতে পারি, তাই কি?

আল ইমরান সিদ্দিকী : বাঙালি সত্তার জন্য তো মূল গান রইলই, হাজার জন গেয়েছেন। যেমন থাকল সাদাকালো ‘পথের পাঁচালী’। রঙিন গোয়ার্নিকা  হতেই পারে। তবে মূল ছবিতে রঙ না মাখালেই হলো। শিল্প বিকৃত হলেও, মূল শিল্প রক্ষা করা যায়। ইতিহাস কতভাবে বিকৃত হয়, আওয়ামীলীগ করে, বিএনপি করে, সেই ক্ষতি নিয়ে বরং ভাবা যেতে পারে। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি বলে কিছু নাই। সংস্কৃতি প্রবাহমান। আরবের হামদ-নাত আজ আমাদের সংস্কৃতির অংশ।

নাজনীন সীমন : জানা হলো। আশা রাখি অন্তত গোটাকয়েক চিরচেনা রবীন্দ্রসংগীতে তিনি নতুন করে কাজ করবেন।

ভুল মনে হলো ব্যাখ্যা। ব্যাপারটা সাদাকে রঙিন করার নয়, ধীর বা দ্রুত লয়ে গাওয়ারও নয়। রক্ষার কথা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে বিকৃতি নিয়ে। বক্তব্য, পটভূমি — কোনটার সাথে মিলের কারণে সাধুবাদ দিতে হবে, আমার অবোধ্য। তবে সাধুবাদ ঝুলিতে প্রচুর থাকলে দেয়াই যায়। অনেক সময় স্রোতের বিপরীতে থাকতে হবে বলেও আমরা দেই। সবই ব্যক্তিগত অভিরুচি। তবে দয়া করে সবকিছুকে একপাল্লায় না মাপলে বোধ করি ভালো হয়।

আর এটা মূল ছবিতেই রঙটা লাগানো হয়েছে যদিও কল্যাণী কাজী অনুমতি দিয়ে গিয়েছেন, পিপ্পা টিমের কথা অনুযায়ী।

আল ইমরান সিদ্দিকী : অজয় চক্রবর্তী ‘অজানা খনির নতুন মণি’ নামে একটা রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করেছিলেন। সেটা নিয়ে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে। আপনি যেমন নজরুলের বক্তব্য তুলে ধরলেন, সেভাবে অনেকে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যও তুলে ধরেছিলেন। পরে কবীর সুমন প্রতিষ্ঠিত গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন, তার নানা নমুনা তুলে ধরেছিলেন। খুঁজলে নজরুলেরও পাওয়া যাবে আশা করি। স্রোতের বিপরীতে থাকতে চাওয়াটা যদি অভ্যাস হয়, তবে সেটা খারাপ, যেমন খারাপ কোনো গান বা কবিকে ধর্ম বানিয়ে ফেলা। নজরুলের গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাতে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো আঘাত লাগে জাতির, তাহলে অবশ্যই আঘাত করাই কর্তব্য। তাতে সেই কবি রক্ষা পাবে। পুরনো গানে নতুন চিন্তা যোগ হবে এটাই তো উচিৎ। ওইখানে যাওয়া উচিত, “যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি।” পুরনো গানে নতুন বিচার-বিবেচনা যুক্ত হোক। ‘ওই রমজানের রোজার শেষে’ গানটা আব্বাস উদ্দীন গেয়েছেন উৎযাপনের ভঙ্গিতে। এখন নানা বাদ্য ও টেকনোলজি এসে তাতে উৎসবের আমেজ যুক্ত করেছে। মন্দ নয়। যার যেটা ভালো লাগে।

নাজনীন সীমন : ধর্ম ব্যাপারটা টেনে আনলে কি কথায় জোর আসে, না শব্দের নতুন অর্থ তৈরি হয়? অতটা পরীক্ষা আমার অন্তত সইবে না। আর কবিকে এভাবে রক্ষার দায়িত্ব কে যে কবে কাকে দিয়ে গেল, জানা নেই। না রবীন্দ্রনাথ, না নজরুল তাঁদের গান বিকৃত করার অনুমতি দিয়ে গেছেন। চাইলেই আমি আপনার কবিতার ছন্দ বদলে নতুন কবিতা করে নতুন কিছু তৈরি করেছি বলতে পারি না। অন্তত আমার নীতি ও রুচিবোধ তাতে বাধা দেবে।

আল ইমরান সিদ্দিকী : ‘বাঙালী সত্তা’ টেনে আনলে যতটা জোর আসে অতটাই আসে মনে হয় ধর্ম টেনে আনলে। দায়িত্ব দেয়ার কথা বলছেন? সেই অথরিটি নিয়েই তো এক ক্যাঁচাল। আমি কোনো অথিরিটি মানবো কেন? রবীন্দ্র-নজরুল কী বলে গেছেন, সেটা তো দেখছি রীতিমতো বি কী বলে গেছেন-এর মতো হয়ে গেছে। কপিরাইট যদি উঠে যায়, তো ‘বাঙালী সত্তা’-র নামে অথরিটি লাভ করতে চাওয়া অন্যায়।


আল ইমরান সিদ্দিকী রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you