ঢাকা লিট ফেস্টের শূন্য-গোয়াল ও নাই-মামা || মৃদুল মাহবুব

ঢাকা লিট ফেস্টের শূন্য-গোয়াল ও নাই-মামা || মৃদুল মাহবুব

যারা প্রতি বছর আমার মতো ঢাকা লিট ফেস্টে যান, তারা জানেন আয়োজক, দর্শক সবাইকে দেখে মনে হবে আসলেই একটা উৎসব চলিছে দেশে। সাহিত্য নিয়ে এমন ব্যাপক উৎসব, উৎসাহ, উদ্দীপনা তো বাংলাদেশ নাই-ই। যারা এই লিট ফেস্টের বিরোধিতা করেছেন, সচেতনভাবে বর্জন করেছেন তারাও এটা নিয়ে কথা বলেছেন। ফলে, লিট ফেস্ট ঢাকা সাহিত্যবাস্তবতায় একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বটে। মানে ঢাকার সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার প্লাটফর্ম তৈরি শেষ আপাতত, রেললাইনও বসে গিয়েছে, মাত্র ট্রেন আসা বাকি, আসলেই আমরা উঠে পড়ব, বিশ্বসাহিত্যের সাথে মিলে যাব আমরা। আমরা শুধু ট্রেনটির অপেক্ষায়। উঠব উঠব একটা বাতাস লেগেছে। মানে এই দেশে সাহিত্য-ট্রেনযোগাযোগ ব্যবস্থা, কলকব্জাসকল প্রতিবেশি দেশ ও সদূর পশ্চিম থেকে আমদানিকৃত। দারুণ দারুণ সব মেশিন, মানুষ ও প্রযুক্তি। আমরা শুধু চড়ে বসলেই পৌঁছে যাবে আন্তমহাদেশীয় সাহিত্যচ্যানেলে। এগুলো তো বাংলা সাহিত্যের জন্য ঘটনা বটে। আয়োজকদের ভূমিকায় মনে হয়, আমরা বিশ্বসাহিত্যের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগে সক্ষম হয়েছি। ট্রেনের হুইসেল বাজছে, আসিতেছে বিশ্বসাহিত্যের ট্রেন। সাহিত্যে এই নয়ারূপ আগে ছিল না। সাহিত্য উৎসবমুখরিত কোন ব্যাপর ছিল না এই অঞ্চলে। তাহলে সাহিত্যকে উৎসবের আলোকে আমরা দেখতে চাই কোন সামাজিক পরিবর্তনের কারণে?

আমরা কুয়োর ব্যাঙ ভালোবাসি। এর জন্য আমাদের দেখাটাকে ছোট করলে চলবে না। কুয়োর বাইরে নিজের চেষ্টায় লাফ দিয়ে বের হতে না পারলে, অপরের সাহায্য নিয়ে আমরা বের হতে পারি এবং উদ্ধারকারীর মতো দুনিয়া দেখতে পারি। এটা তো বদলই হবে। মানুষের দেহ ও মন উভয়ই বদলায় সময়ে। এই মনোদেহ রূপান্তরিতও হয়। আপনার মগজ সময়পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেলে সেটাই স্বাভাবিকতা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরাট এক রাজনৈতিক অর্জন হয়। এই অর্জনের ভেতর দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক গতি সচল হয়। সমাজ ও মানবিক পরিবর্তনে রাজনীতি ও অর্থনীতির ভূমিকা ব্যাপক। মানুষের বাহ্যিক পরিবর্তন অর্থনীতির সাথে বেশি জড়িত আর ভেতরের পরির্তনের সাথে রাজনীতি সম্পর্কিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য যতটা বেগবান হয়েছে স্বাধীনতাপরবর্তীতে রাজনৈতিক অর্জন ম্লান থেকে ম্লানতর হয়েছে। ফলে আমাদের পোশাক বদলে গেছে, ভেতরের মানুষটা বৃদ্ধ, রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে। ফলে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যে বিশেষত্ব আমাদের লাভ করার দরকার ছিল তা আমরা পাইনি।  ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, রুচিটা বিস্তৃত হয়নি। আত্মোপলব্ধি বাড়েনি। নিজেকে দেখার অভ্যাসটা হয়নি। আমরা টাকার বিনিময়ে অপরের জীবনযাপন করতে চাই, দেখতেও চাই। প্রভুর মতো হয়ে উঠতে চাই। ফলে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের কারেণ আমরা অনেককিছু ক্রয় করতে পারি। কিন্তু নিজেদের মতো কিছু করতে পারি না। এইজন্য সেল্ফ-নারিশমেন্ট আছে সমাজে রাষ্ট্রে, কিন্তু  সোশ্যাল-নার্সিং নাই। একটা জমকালো অনুষ্ঠান করতে পারা, লোক-দেখানোর মধ্যে আমাদের যত সাফল্য। সমাজকে আমরা ফেস্টিভ করে তুলেছি। সেই ফেস্ট আমাদের মতো হয়ে উঠল কি না তা আমরা জানি না। উদ্দেশ্যহীন বিলাসবহুল জাহাজের ডেকে আনন্দ চলছে, চলছে হুল্লোড়। চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন আমাদের নাই। বিগত দিনে আমরা যে দেখেছি শুনেছি তাই চলছে নান। খরচটা বেড়েছে। তার প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর মতো কেরানিটা আমাদের নাই।

কয়েক বছরে আমাদের শহরে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক উৎসব এসছে। নভেম্বর, ডিসেম্বরে ক্ল্যাসিক ফেস্ট, ফোক ফেস্ট, সুফি ফেস্ট ইত্যাদি লেগেই থাকে। ক্ল্যাসিক ফেস্টে তো বিরাট ব্যাপার আমাদের এখানে। ধ্রুপদী সংগীত এই দেশে খুব কমই চর্চা হয়। তা শোনার দর্শকও বিরল ছিল। আমি খুব কম লোককেই ব্যক্তিগত জীবনে ক্ল্যাসিক চর্চা করতে ও শুনতে দেখেছি। কিন্তু ঢাকা ক্ল্যাসিক ফেস্টে এত লোক আসে কোথা থেকে গান শুনতে? যারা আসে তারা সারাবছর ক্ল্যাসিক শোনে কতটা? বিশ ত্রিশ হাজার লোক রাত জেগে ধ্রুপদী শোনে এটা দেখাই এক বিরল দৃশ্য সমগ্র দুনিয়ায়। এই সমস্ত অনুষ্ঠান চলছে বছরের পর বছর ঢাকায়। হঠাৎ এগুলো বন্ধও হয়ে যায় সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে। এই দেশে সাহিত্য পড়ে ও লেখে কম লোক। তারপরও দেশে লিট ফেস্ট হয়। ষোলো কোটির দেশে দক্ষ পেশাজীবী  শ্রেণি যেমন কম, আমাদের কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গদ্যকারও কম। কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা কম হলে সামাজকে ভেল্যুর ভাঙন থেকে কারা রক্ষা করবে, কারা পথ দেখাবে! নগরের ইন্টেলেকচ্যুয়াল কলুষ কারা পরিচ্ছন্ন করবে? তারপরও লিটারেচার ফেস্ট হচ্ছে বছর বছর। ফি বছর এগুলোর আলো ও শব্দ বাড়ছেই। এগুলো খুব গুরুত্ব সহকারে মার্ক করা দরকার। ভাবাও দরকার।

আমার ভালোই লাগে এই সমস্ত উৎসব। আমি নিজেও যতবার গিয়েছি, ততবারই ভালো লেগেছে। তরুণতরুণীদের উচ্ছল মুখ ভালো লেগেছে। আমাদের মতো গরিবি, আনন্দহীন সাহিত্যসমাজের লেখকেরা যখন পরদেশি লেখকদের সঙ্গে উজ্জ্বল লাল হয়ে ওঠে স্টেজে দেখতে খারাপ লাগার কোনো কারণ দেখি না। ভালো লাগে। পাশে যারা পরস্পর বসে আছেন তারা কেউ কারো লেখাই কোনোদিন পড়েনি বা অনুষ্ঠান শেষে পড়বেও না। এই বসাবসির মানে কী! যারা এখানে বক্তব্য দিতে আসে তাদের যে খুব লোক পড়ে তাও না। জগদ্বিখ্যাত লেখকটির সাথে আমাদের লেখকরা ছবি তুলে তাদের ফেসবুকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্রাকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে একটু। এই দুই এনজিওর যে অবদান আমাদের গরিব সমাজে, লিট ফেস্টের ভূমিকা ততটাই এলিট-হতে-চাওয়া শিল্পীসাহিত্যিকদের জীবনে। আত্মঅহম অর্জনের জন্য লিট ফেস্টের বিকল্প কই! সারাসারি শিল্পসাহিত্যের সাথে সংযুক্ত না এমন অধিকাংশ এলিট শিল্পপ্রেমিদের দেখা মিলবে এখানে। কার্ল মার্ক্সকে বিশ্বসাহিত্যের বড় লেখক ভাবে এমন ব্যক্তির  দেখা মিলবে এখানে। তাদেরকেও পাবেন কফি হাতে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেশিবিদেশি বড় বড় কবিসাহিত্যিকের মাঝে সেলফি তুলছেন। এলিটরা খুব হিসেবি। বললেই সে মাথা দুলিয়ে গান শুনবে, সাহিত্য-আলোচনা শুনবে না। এলিটদের আনন্দ লাভের উপায় বিচিত্র। কেন লিট ফেস্টে যায় তারা? এলিটের মন বোঝা দরকার। তারা দেশিবিদেশি যাদের কথা শুনতে আসেন তাদের উপর ন্যূনতম পাঠও কারো কারো নাই। যেখানে অংশগ্রহণকারী লেখকদের পাঠ নাই সেখানে পাঠকের কাছে তা আমি প্রত্যাশা করি না। এমন অপাঠকের দেশে তবে এই ঢাকা লিট ফেস্ট দাঁড়ায় কীভাবে? এই সমস্ত অনুষ্ঠানে যাতায়াত, যুক্ত থাকা স্যোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়ায়। জিমে যান বা না যান, গোল্ডজিমের মেম্বারশিপ আপনাকে আলাদা কাতারে দাঁড় করাবে। গুলশান বা ঢাকা ক্লাবের সদস্যরা আপনারই সমাজের এলিট। ফলে, আপাতত সমাজে ব্যক্তি নিজের আইডেন্টিটির শোপিচ হলো এই সমস্ত ফেস্ট। সমমনার ক্লাবযাপন।

বহুদিন আমরা কনজ্যুমারিস্ট দুনিয়ায় ছিলাম। বাই অ্যান্ড বাই। এনজয়। জীবন দিয়ে হলেও কিনতে থাকো। কেনা ও ভোগেই সুখ। এরও পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের টাকাওয়ালা অংশ পোস্ট-গুডস দশায় উপনীত। তারা শুধু পণ্য কিনতে চায় না আর। পণ্য থেকে বেশি কিছু তার প্রত্যাশা। তাদের কাছে পণ্য মাত্র বস্তু থেকে অধিক কিছু হয়ে উঠেছে। আপনি অর্গানিক ফুড খেতে চান যেখানে দুনিয়াই সিন্থেটিক। ভাত খাওয়া থেকে না খাওয়ার খরচ বেশি। ডায়েটিঙের কস্ট দরিদ্র পাঁচসদস্যবিশিষ্ট পরিবারের মাসিক খাওয়ার খরচ থেকে বেশি। গোল্ডজিমের নিয়মিত সদস্য ফাইফ স্টার হোটেলে নিজের ব্যাগ টানার জন্য হোটেলসার্ভিসের লোক খুঁজবে। টিশার্টের সুতোর তুলো ‘ফেয়ার কটন’-এ উৎপন্ন কি না সেটা হিসাবে করতে হচ্ছে। পণ্যের গুণ থেকে ব্র্যান্ডিং-এর মূল্য বেশি। আপনি আর পণ্য কেনেন না বাজার থেকে! পণ্যটির বস্তু ও অবস্তুগত ফলাফল ক্রয় করেন মুক্তবাজার থেকে। ঠিক তেমনি, সাহিত্যও এই কালে পোস্ট-প্রোডাক্ট। সাহিত্যের আছি ও থাকি হলো লাইফস্টাইল এখন। মানে, আপনি খাবার খান কি না তা থেকে আপনার ভেগান পরিচয় মূখ্য। সাইকোলোজিস্টরাও নন-পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট পলিটিক্সের সাবস্টিটিউট হিসাবে, ব্লগাররা পলিটিক্যাল রিফর্মার রাজপথের। ফলে, আম বলতে আর আম না। আমের ফ্লেভারই বিষয়। ফলে, সাহিত্য বলতে আমরা যা যা জানি বুঝি, তা তা সে আর নাই এই সময়ে এসে। সাহিত্য সাহিত্যের অধিক হয়ে উঠেছে। তার অর্থের পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পসাহিত্য তো পণ্যই। তার উপযোগও ভিন্ন ছিল এক সময়। কিন্তু এই উপযোগের মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য একটা শ্রেণির লাইফস্টাইল হয়ে উঠতে পেরেছে। এই সমস্ত উৎসবে লিট-লাইফ যাপন করা মানুষের আনন্দ যদি হয় তবে এই ফেস্ট আরো বড় হওয়া দরকার তো বটেই। অর্থনৈতিকভাবে দেশে এলিট সমাজ বাড়ছে প্রতি বছর, ফলে একদিন বাংলা অ্যাকাডেমিতে ফেস্টের লোক ধারণের তিল ঠাঁই থাকবে বলে মনে হয় না।

সাহিত্য সন্মেলনই আনন্দবাদী ব্যাপর। এই সমস্ত ফেস্টে আনন্দ, ফুর্তি, লোকদেখাদেখি, দলাদলি ভালো হয়। সাহিত্যে এগুলোর ব্যক্তিগত গুরুত্ব অপরিসীম। দুনিয়াকে যতটা উদার করে দেখা যায় ততটাই ভালো। ফলে, লিট ফেস্টের বিরোধের কিছু নাই।  এটা আসলে এলিটের উৎসব। রাষ্ট্র যখন এলিট তৈরিতে ভূমিকা রাখে সেহেতু তাদের উৎসববে ভ্যালিডিটি দিতে হবে। আপনি কমোডিটিনির্ভর এলিট উৎপাদনের সব বন্দোবস্ত রাখবেন আর লিট ফেস্ট সমালোচনা করবেন তা হয় না। রিফর্মেশন নাই তো এই সমস্ত উটকো কথায় কাজ হবে না। সমাজের ক্রিম দিয়ে গড়া এলিট তো সমাজেরই অংশ। দেশ তো সকল শ্রেণির। এলিটের ‘ফেলো কড়ি, শোনো সাহিত্য’-কে না বলা উচিত না। আর সাহিত্যিকরা টাকাপয়সায় কমজোরি হলেও তারা এলিটের, ক্ষমতার সেবকই। হীনম্মন্যতা, ভাষাদুর্বলতা, অপর শ্রেণির প্রতি ঘৃণাবোধ উৎসারিত ফেস্ট বিরোধিতার কোনো মানে নেই। ইংরেজির পাশাপাশি, ফরাশি, জর্মন, আরবি, হিন্দি, উর্দু শিখতে, লিখতে, পড়তে ও বলতে পারলে ভালো হতো। একটা সমাজে যত বেশি ভাষা তত বেশি চিন্তা, যেহেতু প্রতিটা ভাষারই চিন্তাকাঠামো আলাদা আলাদা। বহু ভাষার সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ তৈরি করতে পারলে তা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য ভালো। দুনিয়ার নানা প্রান্তের সাথে আমদের সমকালীন ব্যবহারিক সাহিত্যিকদের কথা শোনা ও তাদের শোনানোর মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আগানো ভালো।

সাহিত্যের অর্থেও পরিবর্তন হয়েছে। সাহিত্যও অর্জন করেছে তার উত্তর-সাহিত্য দশা।  পোস্ট-গুডস দশা মানে যেমন পণ্যহীনতা না, তেমনি পোস্ট-লিটও সাহিত্যহীনতা না। আমাদের এই ভিন্নমাত্র অর্জন যতটা অর্থনৈতিক ততটা রাজনৈতিক না। ফলে, সাহিত্যও হয়ে উঠেছে উদযাপনের টুলস। মানুষ আনন্দ চায়। শুরু হয়েছে আনন্দজাগানিয়া লিট ফেস্ট। তাকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় কী!

আর্থিক সক্ষমতাই এই ফেস্টের মূল শক্তি। অর্থের সাথে একটাকিছুকে জমকালোভাবে করতে পারার বিষয় আছে। এই শহরে নানা দেশের লেখকরা এসে অয়োজকদের চিড়িয়াখানায় বন্দি হয়ে থাকে। তারা মূলত মঞ্চে বসে আমাদের দেশের মিডিওকার লেখকদের সাথে হাত মিলিয়ে ফিরে যায়। এতে বাংলা সাহিত্যে উপকার থেকে ক্ষতিই বেশি হয়। বাংলাদেশি সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু না জানা লোকটি যাদের সাথে বসেন ও কথা বলে যা ধারণা লাভ করেন, তারপর তার আর এই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী থাকার কথা না। আমি এদের সাথে মিলেমিশে, চলাচল করে জেনেছি কতটা সাহিত্যের উচ্চ বোধ তাদের। দেশের জীবিত ও মৃত কোনো বড় লেখকের রিপ্রেজেন্টেশন নাই। আয়োজকদের ভাই দুলাভাই নামক একই মামা চাচা দিয়ে বছরের পর বছর একই ফর্মে অনুষ্ঠান চলছে। বিশ্বসাহিত্যের দরকারে বাংলা সাহিত্য কারা করে তার নমুনা নিয়ে নানাদেশের লেখকরা ফিরছে। কে আর এই সাহিত্যের দিকে মুখ তুলে তাকাবে। কোনো কোনো সময় অর্থ শোকের উৎসবে পরিণত করতে পারে। উৎকর্ষতা অবশ্য অন্য বিষয়। আমাদের এলিটরা সাহিত্যের রাজনৈতিক মুক্তি জানে না। নানা কৌশলে এলিটের হাতে টাকা এসছে। গায়ক ভালো কিন্তু বাদক যা-ইচ্ছে-তাই হলে যেমন গান হয় না, লিস্ট ফেস্টও তেমন হচ্ছে বছরের পর বছর। তাদের কোনো চাওয়াপাওয়া নাই। অনুষ্ঠানটা শেষ হলেই হলোর মতো ব্যাপার। এলিট তেমন কোনো রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, অপরকে মূল্যায়নের বোধ, প্রান্তিক অনুসন্ধান, শিল্পের চাহিদা ও উদ্দেশ্য নানা বিষয়ে তারা উদাসীন।  ফলে, এই সমস্ত অনুষ্ঠানে বিরাট বিরাট নবেল লরিয়েট থাকে, স্টার থাকে, ফিগার থাকে, পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা থাকে, উজ্জ্বলতা থাকে। বাংলাদেশি সাহিত্যটুকু নাই। সাহিত্যসভার উদ্দেশ্য ও সেই উদ্দেশ্যর কাছাকাছি যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। প্লান নাই। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে অপচয়ে পর্যবসিত হয়। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সাহিত্যের নামে এত বড় অপচয় আর নাই। এ যদি সাহিত্যের কোনো কাজে লাগত তবে এর থেকে বেশি খরচকে আমার কম মনে হতো। বেশিরভাগ প্রোগ্রাম বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো করে। আকদের অনুষ্ঠানে কাজি আসেন, গায়ে-হলুদে ঘরের মেয়েরা শুধু নাচবে, রং খেলায় বাড়ির বাচ্চারা থাকবে, মেহেদিতে একটু নামকরা গজলগায়ক চাই-ই চাই, বরযাত্রীতে নিকটআত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব সকলে, বৌভাতে ঘুরেফিরে বাংলা অ্যাকাডেমি ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী কোটায় চান্স পাওয়া শিল্পসাহিত্যিক। কী আমাদের কাজে লাগবে আর  লাগবে না তার হিসাব বোঝার মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নাই এখানে। কাদের আমরা এখানে আনছি, কেন আনছি তার কোনো স্পষ্ট উত্তর নাই। এই সমস্ত লেখকদর্শন দিয়ে আমারা কী করব। দেখার জন্য দেখা, করার জন্য করা দিয়ে কিছু হয় না। যারা আসে তাদেরকে এই দেশে গৃহবন্দি করে রাখা হয় নিরাপত্তার অজুহাতে। দেশের তরুণ লেখকেরা তাদের সাথে কথা বলারই সুযোগ পায় না। আদানপ্রদানটা কী ঘটে এখানে তবে? তিনি বলবেন আর আমরা শুনব। আমাদের পক্ষ থেকে শোনানোর জন্য যারা মনোনীত হয় তাদের ৯০ ভাগের কোনো সাহিত্যরুচি নাই। তারা কোটাজীবী সরকারি, বেসরকারি, প্রকল্পবাস্তবায়নের লেখক। এই হলো আমাদের ফেস্ট আয়োজন। এবং অনুষ্ঠানকর্তারা সচেতনভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের দূরে রাখতে চায়। গত বছর যারা আমচাষ নিয়ে কথা বলেছে এ বছর তারা হালচাষ নিয়ে কথা বলেছে।

ঢাকা লিট ফেস্ট হয়ে উঠেছে আমার পরিচিত ভাইব্রাদারসিস্টারদের সুযোগদান কর্মসূচি। প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরপেক্ষভাবে আমরা কিছুই পারি না যেন এই দেশে। আমাদের যতটা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ততটা পলিটিক্যাল ও কালচারাল ওরিয়েন্টেশনের বিবর্তন হয় নাই। এই সমস্তের সমালোচনা জারি রাখা আমাদের কর্তব্য।

সাহিত্যের কী কী উপকার হলো বছরের পর বছর ফেস্ট করার পর? যারা এই দেশে আসেন তাদের বইপুস্তক বিক্রি হয়। কিন্তু আমদের লেখকদের কোনো বাজার তৈরি করার কোনো কর্মকান্ড নাই এই সমস্ত ফেস্টে। সাহিত্য বিক্রি করা দরকার উচ্চমূল্যে দেশে, বিদেশে। সাহিত্যিকদের খেতে হবে না? অপরকে যেমন বিক্রির সুযোগ দিতে হবে সাথে সাথে নিজেরটাও বেচতে হবে। তা না হলে, এগুলো কোনোই কাজে দিবে না আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া। আমাদের কবিসাহিত্যিকদের উৎপাদনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক মূল্য তৈরি হোক।

ধরেন কুন্ডেরা বা মুরাকামি তারা নিজ নিজ ভাষায় সাহিত্য করে। কিন্তু বিশ্বপাঠকমহলে তাদের পৌঁছে দিয়েছে অনুবাদক-প্রকাশকরা। আমাদের সাহিত্যের বড় ফিগারগুলোকে প্রতিষ্ঠানিক দক্ষতায় বিশ্ববাজারের সাথে মিল করিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব এরা নিতে পারে নাই। যারা তাদের হয়ে কাজ করে তাদের জন্যই কোনো আন্তর্জাতিক রাস্তা তারা তৈরি করতে পারে নাই। তাহলে এই এই জমকালো ফেস্টের অর্জনটা কী? এই সমস্ত বসাবসি দিয়ে সাহিত্যের কিছু হয় না। এগুলো যত-না শিল্পসাহিত্যের উন্নয়নমূলক ব্যাপার তার থেকে বেশি বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যাপার। সাহিত্যের বাজারমূল্যের দিকে অগ্রসর হতে হবে। সেই রাস্তা তৈরির একটা প্রচেষ্টা ঢাকা লিট ফেস্ট হয়ে উঠুক। সাহিত্য-উন্নয়ন অন্য জিনিস। সাহিত্যের ভেতরের রাজনীতি ধরতে না পারলে, তার বাজারব্যবস্থা-অর্থনীতি অনুধাবন না করলে একশ বছরে দুশোটা লিট ফেস্টেও কিছু হবে না। উদ্দেশ্য ও সেই অনুযায়ী কার্যপ্রণালি পরিবর্তন না হলে এগুলো হবে বিপুল অপচয়ের খরচের খাতা।

আমি আনন্দবাদী মানুষ। মানুষের উচ্ছল মুখ আমার ভালো লাগে। উৎসবকেন্দ্রিক তরুণতরুণীদের উজ্জ্বল মুখ আমি বারবার দেখতে চাই। তবে সেই আনন্দের মধ্যে যেন কিছু প্রাপ্তি থাকে। মাত্র আসাযাওয়া আর আয়োজকদের শুধুমাত্র অনুষ্ঠান শেষ করতে পারার গর্বে যেন এগুলো শেষ না হয়। ঢাকা লিট ফেস্ট যেন ‘শূন্য-গোয়াল’ বা ‘কানা-মামা’ বোধ উভয় থেকে বের হয়ে একটা সত্যিকারের উৎসব হয়ে উঠতে পারে।

ঢাকা লিট ফেস্ট কেমন হতে পারে?

ঢাকা লিটি ফেস্ট

ধরেন, ২০২৫ সালের লিট ফেস্টের থিম শহিদুল জহির। অনুষ্ঠানের জমকালো ভাব ও অধিক লেখক আনা বাদ দিয়ে এই দেশ ও বাইরের দেশের লেখকদের গ্রান্ড দিন যারা শহিদুল জহিরের সাহিত্য অনুবাদের পাশাপাশি তার উপর আন্তর্জাতিক নানা সাহিত্যপ্লাটফর্মে লিখবে। ঐ বছরের অনুষ্ঠানে শহিদুল জহির নিয়ে ফ্যুলডে একটা সেশন থাকবে যেখাবে দেশিবিদেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখক, অনুবাদকরা কথা বলবে। প্রত্যেক আমন্ত্রিত অতিথি যাতে অংশগ্রহণ করবে অন্য সকলকিছু বাদ দিয়ে। বাকিদিন আপনাদের যা ইচ্ছা করুন।

এই অনুষ্ঠানের কাঁচামাল তরুণ লেখকদের পিছনে ব্যয় করুন যাতে তারা পনেরো-বিশ বছর পরে বাংলা সাহিত্যকে কিছুটা রিপ্রেজেন্ট করতে পারে আন্তর্জাতিকভাবে। পারলে সাহিত্যের ইন্সটিটিউট করুন।

জনগণের ট্যাক্সের টাকার কিছু তো অনুদান আছে এই লিট ফেস্টে। ফলে, তার অপচয় গায়ে লাগে বৈকি! ফলে, কোনোভাবেই কেউ এই ফেস্টের বাইরের কেউ না।

ঢাকা লিট ফেস্টের মঙ্গল ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you