রানা নাগ স্মরণপত্র : কবির জন্যে এলিজি

রানা নাগ স্মরণপত্র : কবির জন্যে এলিজি

কবি রানা নাগ ২২ মার্চ ২০২৪ মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুকালে রেখে গেলেন পরিবার, পরিজন, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গুণগ্রাহী সমেত বহু মানুষ যারা রানা নাগের অন্তর অবলোকন করতে পেরেছিলেন বলে এখন মনে হয়।

দেবোত্তর সম্পত্তির কথা আমাদের মনে পড়ছিল কবির মরণোত্তর অন্ত্যেষ্টিকৃত্য/শ্রদ্ধাবাসরে অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে।  যেমন লোকে দেবতাদের সন্তুষ্টি সাধন ও পরলোকায়ত পুণ্যার্জন মনোবাসনায় দেবোত্তর সম্পত্তি ডিক্লেয়ার করে যায়, রানা তেমনি রেখে গেছেন তার কবিতাবলি।

কিন্তু, বলা বাঞ্ছনীয়, রানার দেবতা মাটিপৃথিবীর মানুষ; অমর্ত্য অতিজাগতিক কোনো অনুষঙ্গ নয়। রিসোর্সগুলো, কবি রানা নাগের কবিতা ছাড়াও অন্যান্য রচনাসমূহ, অনাদি অনন্ত মানুষের কাজে লাগবে। এই জন্যেই তো, এই ভেবেই তো, কবিতা ও অন্যান্য সমস্ত শিল্পচর্চা মানুষের।

মানুষ হিসেবে রানা নাগ কেমন ছিলেন তা আন্দাজ করা যাবে প্রস্থানোত্তর তার স্মরণে তাকে নিয়ে লেখা তার কবিবন্ধুদের এলিজিগুলো লক্ষ করলে। এত মানুষ তাকে নিয়ে লিখেছেন যে সবার লেখা একপাতে এনে দেখা আয়াসসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হবে।

এই কথাটা আপাতত শুধু কবুল করে রাখা যাক যে একজন কবির প্রস্থানপথে ফোটা গাথাকাব্য/স্মরণপঙক্তি সমুদয় সংকলিত হবার দাবি রাখে। সেই চেষ্টা আপাতত করা না-গেলেও ভবিষ্যতে এই সংকলনের বাইরে রয়ে যাওয়া বাকি সমস্ত রচনা পাঠকের কোলে তুলে দেবার প্রয়াস নেবেন কেউ-না-কেউ।

অকালপ্রয়াত কবি রানা নাগের কবিতা যারা পড়তে চান, কবির তিন-তিনটা কাব্যগ্রন্থ জোগাড় করতে পারেন। অতি সংক্ষেপে একটি নির্বাচিতা পাঠ করতে চাইলেও সুযোগ আছে, নির্বাচিত রানা নাগ, অ্যাভেইল করতে পারবেন একক্লিকে, সেইসঙ্গে একটি ট্রিবিউটগদ্য কবির শেষকৃত্য ও শ্মশানবন্ধুর স্বগতোক্তি

মৃত্যুসংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাজানি হওয়ার পরে রানা নাগের সান্নিধ্য ও সঙ্গস্মৃতি নিয়ে লিখেছেন অগণিত অনেকেই। লিখেছেন দেশেবিদেশে ছড়িয়ে থাকা তার কবিবন্ধুরা। আর এই শোকতর্পণ ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন কবির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে যাবার পরেও অব্যাহত চলছে। এরই ভিতর থেকে এলিজিগুলো, মর্সিয়া মাতমের গাথাগুলো, সংকলনাকারে একটা জায়গায় রাখবার এই প্রয়াস।

প্রয়াত কবির সতীর্থ সমবয়স্ক/অগ্রজ/অনুজ কবিদের কাছ থেকে এই সংকলনভুক্তির নিমিত্তে সম্মতি চেয়ে কড়া নেড়েছি ইনবক্সে, কেউই নিরাশ করেননি। লিখেছেন আহমেদ স্বপন মাহমুদ, হাসান মাহমুদ, রুবাইয়াৎ আহমেদ, মামুন খান, আবদুর রাজ্জাক, শিমুল মিলকী, দিলশাত সিদ্দিকা স্বাতি, রাজীব আর্জুনি, বিজয় আহমেদ, মুহম্মদ ইমদাদ, সাইফুল্লাহ এমরান, এনামূল হক পলাশ ও  সরোজ মোস্তফা।

আরেকটা কথা। সাধারণত সংকলনভুক্তির ক্ষেত্রে কিছু নর্মস মান্য করবার যে-কায়দা, কবিনামের আদ্যবর্ণ অথবা বয়সের অনুক্রমে ইন্ডেক্সিং/সূচিসজ্জা, আমরা তা টায়ে টায়ে ফলো করি নাই, ফলো করতে চাইও নাই। শ্রদ্ধাবাসরে এসে কে পেছনের কাতারে আর কে সামনের কাতারে কীসের ভিত্তিতে আসন গ্রহণ করলেন ইত্যাদি হীনম্মন্য সওয়াল জানি উঠবে না, সাবধানের মার নাই তাই বলে রাখলাম।

সকলের সুন্দর, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও শান্তিপূর্ণ জীবন কামনা করি। — সরোজ মোস্তফা

নবধ্যান
আহমেদ স্বপন মাহমুদ
তব্দা হয়ে বসে আছি
শুষ্ক মগড়ার নিস্তরঙ্গ জলের মতন।
অবশ-বিবশ ক্ষীণ দেহ লয়ে
শূন্যতর হাওয়ায়, নিরুদ্দেশে।

সেদিন শোক নেমেছিল শহিদ মিনারে
নেত্রকোনায়, ঢাকায়, সারা দেশে
বিদেশ বিভুঁইও ছিল শোককাতর
স্বজনের প্রস্থান শুনে।

কত উব্দা ঘটনা জগতে ঘটে!
অপ্রয়োজনীয় গুল্মও বাঁচে সুদীর্ঘ বছর,
অত্যাবশ্যক যারা কেন নিমেষে মিলায়
অলোকলোকে, কেউ জানে না।

জানে না কেউ জীবন কেন প্রস্থানে ধায়
রূপ কী তবে পরম আলোকে মিলায়!

রূপ আজ গিয়েছে চলে অরূপের সন্ধানে
রানা নাগ, সুজন যে-জন মগ্ন নবধ্যানে।
.
.
দলছুট মাছ
হাসান  মাহমুদ

মৎস্যের গতি নিয়ে ছুটে চলি
দেখি — নদী তীর ভাঙে
জলতেষ্টা নিয়ে কথা হয় ঢেউয়ের সাথে
উপকূল জানে আমি একা;
শিকস্তি দলের উপনেতা তুমি
এইকালে জব্দ হলে গানে
সন্তরণে মগ্ন একদল মাছ তোমার অনুগামী হবে
শুনেই সন্তুষ্ট চিত্তে পলায়নরত মানুষের ভিড়ে ডুবে যাই।

কী এক অপার পৃথিবী!

এখানে
জীবন, মৃত্যুর প’রে বিজ্ঞাপিত হয়ে
সহজিয়া সাধনায় মিশে যায় কিছু নাম
মমতা-আঁচলে লুকায় ধীবর জীবন
জলের জীবন, মাছের জীবন

দলছুট মাছ আমি,
দ্রোহ আর কান্না দিয়ে গড়ে তোলা এই জলতল
আদতে যা আমার উপকূল
সাথে দীপ্ত রানার প্রস্থান…

.
.
জীবন এমনই
রুবাইয়াৎ আহমেদ
মাতুলালয়ে মাতৃগর্ভ অন্ধকার চিরে
কান্নায় ভাসিয়ে চরাচর
জন্মেছিলাম আমি
আমার ক্রন্দনের ধ্বনি
বুঝি-বা পৌঁছে গিয়েছিলো
তোরই মর্মে অবচেতনে
ঠিক পরদিন আলোকিত করে পৃথিবী
চরাচরে মেলে দিলি ডানা
অথচ চলে গেলি আমারই আগে
শূন্য করে দিয়ে হৃদয়ের সমস্ত আয়োজন
জীবন এমনই রহস্যপুরাণ
আবির্ভাবের ক্রম মেনে চলে সযতনে
কেবল প্রস্থানের নাই কোনো ব্যাকরণ
এই আছি এই নাই
কেবল হাহাকার সত্য হয়ে থাকে
যাপিত সময়ে…

.
.
জমাট বরফতল!
মামুন খান
আমি না।
চোখ কাঁদে
লুকিয়ে।
তবুও কেউ কেউ বুঝে যায়
মণির আড়ালের
জমাট বরফতল।

পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রাখতে পারি মুখ
কিন্তু, তার থেকে পালাতে পারি না
কিছুতেই খুলতে পারি না তার
না থাকার এই প্রবল বেষ্টন!

.
.
পার্থিব
আবদুর রাজ্জাক

চক্রে বিশ্বাসী, জীবনের বিশাল চাকায়
পুনর্জন্ম তার শান্ত বিরতি
আমাদের চারপাশে ফিসফিস করে বিচিত্র সুগন্ধ।
তোমার পর্থিব উপস্থিতিই আমাদের চঞ্চল করে
তোমার শ্লোক বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়
তোমার জ্ঞান মাহাজাগতিক সমুদ্রে স্থির থাকে
আমরা বিদায় নিয়েছি—
ঘাসগুলো, ঘাসফুলগুলো, সকালের শিশিরকণা
জেগে থাকে, নতুন আনন্দকে নিয়ে—
তুমি আবার উঠবে বলে!

.
.
অলীক সৌপায়ন
শিমুল মিলকী

আজও উঠানে গল্প বলছে মহুয়া
মান্দার গাছে কবিতা পড়ছে শালিক

আদর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত-খামারে চলছে লাঙল
রক্তপোড়া ইতিকথা টপকে আসছে ভোর

ধানের চিৎকারে উদার হচ্ছে মাটি
মরণে ধরে রাখা জীবন — ছড়াচ্ছে স্বপ্নমুদ্রা
পৃথিবীর নিয়ম বুঝে…আজও হাসছে…
                                    আমাদের রানা!

.
.
গল্প লেখবো একদিন একখান
দিলশাদ সিদ্দিকা স্বাতি

মগড়াপারের কোনো-এক ছেলের গল্প
যে ছেলের মনটা যেন নরমসরম, মস্ত আকাশ
যে ছেলের গতরখানা নাদুসনুদুস, আউলা বাতাস
যে ছেলে মেঘ হয়ে যায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে আবার
যে ছেলে রয় না একা কোনোমতেই
যে ছেলে চুপ করে যায় হঠাৎ করেই, এক সে রাতে
সেই ছেলেটার গল্প বলি এখন শোনো
সে ছেলের একা হবার আকাশ হবার স্বপ্ন যেন
সে ছেলের গল্প হবে এক আখ্যান

.
.
এ শোকের সমাপন
রাজীব আর্জুনি

নৈবেদ্যেও হবে না জানি
এ শোকের সমাপন
দীর্ঘশ্বাসে ফিরবে না কেউ জানি,
তবু
এই দৃশ্যকাব্য  মায়াবী মুকুর
সারিবদ্ধ বৃক্ষদের স্তবগান
তবু এই চিহ্নায়ক রীতি
বিধিলিপি
নিয়ে নাও
অর্ঘ্যজ্ঞানে।
পৃথিবীতে অনেকেই মরে গিয়ে বেঁচে যায়
শুনি;
কেউ কেউ মরে গিয়ে বেঁচে থাকে
থাকে সমাসীন আলোকিত গানে;

নৈবেদ্যেও হবে না জানি
এ শোকের সমাপন
দীর্ঘশ্বাসে ফিরবে না সখা, মানি।

.
.
রানাদার জন্য প্রার্থনা
বিজয় আহমেদ
অনেক উঁচা চূড়ার থেকে পৃথিবীটাকে
দেখতে কেমন লাগে, আপনি এখন জানেন মনে হয়।
এই যে বাতাস বয় শিস তুলে তুলে
গমক্ষেত আনত হয় সিজদায়, সন্ধ্যায়…
হাটুরে মানুষগুলো বাজার শেষে ফেরে বাড়ির
মতো দেখায় এমন কোনো গ্রহে।
মনে হয়, সবকিছু দেখছেন আপনি
এই সজল বাংলার।
আর আমার খোদা, চিরবসন্তে মুড়িয়ে দিক
আপনার দ্বিতীয় জীবন।

.
.
দরজাহীনতা!
মুহম্মদ ইমদাদ
রানাদা, পৃথিবীতে এত দরজা
এত যাওয়া
এত ফেরার সম্ভাবনা
এত এত সূর্যের ভেসে ওঠা
অন্ধকারেও নদী কী সচল
সন্তানের ঘুমন্ত মুখে এত আলো
এত বন
পাখির আওয়াজ গাছের প্রবীণ
পাতার চেয়েও হরিৎ
কী নীল এই আকাশ!
মেঘের গর্ভ-ভরা মধুর পানি!
প্রেমের জন্মস্থান এই পৃথিবী
আর আপনি,
মায়ের দুধের দেশ
বাঁশিনির্মাতার জোছনার তৈরি ঘর
শেষরাতের নিঃসঙ্গ তারা
তার আলোয় দৃশ্যমান বাংলাদেশ আর
প্রিয় বেদনার পাশ দিয়ে
চলে গেলেন
গভীর দরজাহীনতার দিকে
নিরঙ্কুশ আগুনে
যার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে আরো বেশি পুড়ে যাওয়া ছাড়া
কী থাকে শ্মশানবন্ধুদের
থাকে না বলেই, রানাদা, আপনার মৃত্যু
এখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে
শত শত মৃত্যুর মতো নেত্রকোণায়
ময়মনসিংহে, ঢাকায়…
আপনার বন্ধুরা কুড়িয়ে নিচ্ছে
কোথায় কার কাছে রাখবে
এই মৃত্যুকে তারা
কোথাও রাখবে না
কেননা, তারাই তোমার কবর!

.
.
আমাদের চোখে
সাইফুল্লাহ এমরান
আমরা রানাকে আর পাবো না
রানার আত্মাটা জোছনা মাখবে মগড়ার ঘাটে।

.
.

সুফির আত্মায় তুমি আছো
এনামূল হক পলাশ

আমার ভেতরে বন্ধুরা থাকে
বন্ধুরা আমাকে ভালোবেসে রাখে।
ধর্মের মোহ থেকে মুক্ত হয়েছি
কাব্যে আমপারা ভালোবেসেছি।
ধ্যানের ভেতর তুমি আছো হে কবি
সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি সেই ছবি।

বিজ্ঞান জানে না হিন্দু-মুসলমান
সুফির আত্মায় বাস করে তোমার প্রাণ।

.
.

তোমার নামের নদী
সরোজ মোস্তফা

ধ্যানী কাফেলায় তীর্থে তীর্থে
তোমার নামের নদী বইছে জখমে।
গারো পাহাড়ের পাশে
মেঘবাহকের পাখি কিছু একটা বলতে এসে
হারিয়েছে ঘাসের পাতালে।

হাওরের গীতসংলগ্ন গ্রামগুলো
মন্দির-মসজিদের জ্ঞানে থাকলেও
সব হাড়গোড় এক করে
তোমার কাছেই গেছে।

অগ্নিতে দেহ ভিজিয়ে
এই মৃত্যু কারুকার্যময় মোমদানি।
ফসল দেখার ক্ষণে
          এই মৃত্যু চন্দ্রনিকেতন
.                            কে রাখবে মনে!

সব নাম একা হয়ে গেলে
তোমার কলসে তুমি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে
মগরাও মরমি বিদ্যার নদী
অশ্রু মুছে না কখনো।


রা না  না গ  স্ম র ণ প ত্র
কবির জন্যে এলিজি
সংকলক : সরোজ মোস্তফা
প্রকাশকাল : এপ্রিল ২০২৪
০৬ এপ্রিল ২০২৪ গানপার


রানা নাগ স্মরণপত্র

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you