আমার ঈদ || সত্যজিৎ রাজন

আমার ঈদ || সত্যজিৎ রাজন

এক সিনেমাহ্যলের পাদদেশে ফেলে এসেছি কিশোর ও তরুণ রাত্রিদিনগুলা আমার। সেই সিনেমাহ্যল নাই আর। ছিল ‘রঙমহল’ নাম তার। বাংলাভাইয়ের বিভীষিকাময় নেত্তকুন্দনের সময়ে সেই সিনেমাহ্যলে এক্সপ্লোশন ঘটে, একটা ছেলে বোমায় মারা যায় এবং অনেক হ্যলদর্শক ও পথচারী চিরজখমের দাগ নিয়া বাইচা থাকে। এরপরে সেই সিনেমাহ্যল অনেকদিন বন্ধ থাকে এবং একসময় প্রেক্ষাগৃহ গুঁড়িয়ে ভেঙে বাণিজ্যিক বহুতলা টাওয়ার মাথাচাড়া দ্যায়। এখনকার রঙমহল টাওয়ার আমার আকৈশোরের রঙমহল সিনেমাহ্যল।

হ্যলের ঠিক দেয়ালসংলগ্ন আমাদের বাসা। সারাদিনে তিনবেলা তিনখানা শো। কত কিসিমের ঢিশুম ঢিশুম। কত পদের প্রণয়সাউন্ড। কত-না হাজার রকমের দর্শকের করতালি, সিটিশিস, বিস্ময়োল্লাস। সমস্তই আমরা বাসায় বসে শুনে গেছি। এক টিকেটে দুইটি ছবি। ভিতরে দেখেছি কমই। ইংরেজি সিনেমা। খারাপ খারাপ। দুষ্ট লোকেরা দেখে। দেশগেরাম ভরা খালি তিড়িংবিড়িং দুষ্ট লোকের দলে। তারা আমাদের বাসার পাশে এসে জড়ো হয় দিনে তিনবার। কত কত দূরদুরান্ থেকে ভেসে ভেসে আসে তারা! ভাবি, বিস্মিত হই। লোকগুলারে ভাল্লাগতে থাকে। এখন মনে হয়, এরাই ছিল শিল্পকলাসমুজদার। বোমা ফাটাইতে যেত না তারা কারোর শহরে বা মানুষজনতার ভিড়ে। একটু হ্যলে যেয়ে কেবল সিনেমাই দেখত। খারাপ খারাপ সিনেমা। এক টিকেটে দুই। ভীষণ পয়সা উশুলে উল্লসিত জনতা। বা আশার গুড়ে বালি ছিটাইয়া কাটপিসের রিপিটেশন শুধু। হতাশাসাউন্ড সমবেত দর্শকের। গালি। খিস্তি।

কিন্তু জোরালো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খবিসি সিনেমা দেখার সুযোগ তখন পর্যন্ত করে উঠতে পারি নাই। গৃহসংলগ্ন শুঁড়িখানা বা তীর্থস্থান হলে যেমন হয়, যাওয়া হয় না যাব-যাব করেও। বড় হয়ে সেইসব অপোরা সাধবাসনা চান্স পাইলেই মিটাইসি। গিল্লা খাইসি ইংরেজি সফটকোর যৌনোত্তেজী সিনেমারাশি। বিধি বাম। বদনসিবে সুখ সয় না। অ্যাডাল্ট হয়ে গেসি দুনিয়ার আগে। এখন আর সেই তৃণগুম্ফ গজাইবার বয়সের ইউফোরিয়া নাই।

ঈদের সময়টা আমরা বুঝতে পারতাম রঙমহলের গমগমা আওয়াজ শুনে। রঙমহলসংলগ্ন মহল হবার সুবাদে বছরজোড়া আওয়াজরাজ্যেরই ছিলাম বাসিন্দা আমরা। তারপরও উৎসবকালীন দর্শকদের গলার স্বরপর্দা আলাদাভাবে চেনা যায়। আমরা ডিস্টার্বড বোধ কখনোই করি নাই। রিয়্যালি। সিনেমাহ্যলের লাগোয়া বাড়ির লোকেরা জানে দূরাগত শব্দের বিউটি। তিনহাত দূরের ঈদের সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল আর ড্যানি সিডাক সারাক্ষণ চেঁচিয়ে যাচ্ছে, একেকটা ঘুষির আওয়াজের মতো ভুঁড়িস্ফীত জসীমের দাপুটে ফাইট ও সুঁচালো ঠোঁট ভেঙে ভেঙে গ্লিসারিনশিশি-উপুড়-করা কান্নাকাটি, অঞ্জু ঘোষ বা চম্পার ইজ্জত নিয়া সিনেমাজোড়া ছিনিমিনির হুঙ্কার-ঝঙ্কার। সমস্তই দেয়ালের ওপাশ থেকে আধোতন্দ্রার ভিতরে টের পেতাম। দূরাগত ধ্বনির মতো সংলগ্ন রঙমহলের শত শত মানুষের কলরবে আর রঙবেরঙের জামায় তামাশায় ঈদের হপ্তাজোড়া আমাদের পাড়ার গলি ঝিল্কি দিত।

বন্ধুদের ছিল মহানসিব। রাজকপাল। তারা খারাপ খারাপ সিনেমাও দেখত, দুই ঈদে মুনমুন-ময়ূরীর কাটপিসতাণ্ডব উপভোগ থেকেও বঞ্চিত হতো না। টাইটেলকার্ড উঠবার দুই-তিনমিনিট আগেই তারা হ্যলসিট ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেয়াল টপকায়ে আন্ধাইরে হামাগুঁড়ি দিয়ে পেয়ে যেত আমাদের বাসা। বাড়ির কেউ সন্দেহ করত না তারা সিনেমাহ্যলফের্তা খারাপ ছেলেছোকরা। আর যদি করত, অম্লান বদনে তারা ‘রাজনের বাড়িত গেসলাম’ বইলা পার পেয়ে যেত। আমার ডাকনাম রাজন, মায়ের আদরভরা ডাকনাম, হলেও-বা রাজকপাল নিয়া তো আর জন্মাই নাই। ইন্টারে পড়ার সময় মা হারাই। ইংলিশ-বাংলা খারাপ খারাপ সিনেমাখাদক আমার ঈদসুখী বন্ধুদেরে দেখে এবং তাদের মুখ থেকে খারাপ খারাপ সিনের বাস্তব সত্য শুনে এবং পোস্টারজাত অনুমান-আন্দাজ থেকে একটা হ্যাপিনেসের বলয় ঘিরে রাখত সবসময় আমারে।

বাসা থেকে এগারো কদম এগোলে বন্দরবাজার পয়েন্ট। দুনিয়ার সবকিছু পাওয়া যায় এই বিপুলা বাজারে। এবং বাঘের দুধ তো অত্যন্ত সুলভ রেইটে সেল্ হয়। এবং গানের আওয়াজে সরগরম দুনিয়া। বাজারের পানদোকানে, মুদিখানায়, হেয়ারড্রেসারের সেল্যুনে, এবং মহল্লার গলিতে ডেকসেট বাইর করে অ্যামপ্লিফায়ার লাগিয়ে ছেলেপিলেদের তারস্বরে চেঁচানি আর ভারী বিটের গানবাজনা শোনার চেয়েও শোনানোই ছিল মুখ্য। সবই ঈদের সুবাদে।

ক্যাসেটের দোকান সারবাঁধা। তারা বাজায় ঈর্ষণীয় নয়া নয়া ক্যাসেটের গানগুলি। ঈদ ছিল দোকানের গান শুনে শুনে সারাবছরের জন্য সংগৃহীতব্য গানের সিলেকশন সমাধা করবার মরশুম।

সেমাই, লাচ্ছি, মিষ্টি, পিঠাপায়েস এইগুলা তো হতোই নিমন্ত্রণবাড়িগুলায়। আশপাশের নানান রহস্যাঞ্চলে বেড়ানোও বাদ যায় নাই। বিশেষভাবেই কিশোরী বিষণ্ণতার বাড়ির সামনাসামনি গিয়া হাঁটাহাঁটি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শরীরচর্চাগুলাও পূজায় এবং ঈদে নির্বিঘ্নে সেরে নেয়া যেত।

সুন্দরই দিন কাটাইতাম, আগে, ঈদে এবং পূজায় আমরা রঙমহল-ঘিরিয়া বাড়ন্ত নওজোয়ানেরা।

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you