আমার রোজা আমার পূজা || অসীম দাস

আমার রোজা আমার পূজা || অসীম দাস

আমাদের ছেলেবেলায় রোজা-রমজানের মাসটায় ফেস্টিভ একটা অ্যাটমোস্ফিয়ার দেখে দেখে বেড়ে উঠেছি। ইশকুলে একমাস-দেড়মাসের জন্য ছুটি ডিক্লেয়ার করাটাই কি শিশুকিশোরদের কাছে যথেষ্ট উৎসব নয়?

হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই, ইশকুলছুটির ঘোষণাই একমাত্র না, আরও রয়েছে রোজাদিনের উৎসবমুখরতার চিহ্ন। সবই বিশ-একুশ বছর আগেকার উৎসবচিহ্ন। শুরু হতো শবেবরাত থেকেই। শিরনিভোজন আর ধূপবাতি-তারাবাতির ঋতু। পটকা ফাটানোর শিশুতোষ হর্ষ। পরে এল পটকা ফাটানোয় নিষেধাজ্ঞা। আজ আর মনে করতে পারি না কবে থেকে এই শিশুকৈশোরক শবেবরাতের আনন্দ বন্ধ হয়ে গেল।

শবেবরাতের পরেই রোজা। আমার শৈশবে রোজার দিনগুলি ছিল বছরের শেষ দিকটায়। মানে ফেব্রুয়ারিছোঁয়া। বার্ষিক পরীক্ষার শেষাশেষি।

ইউনিক মেমোরি বলতে একটাই, ইফতারির স্মৃতি। ইফতারি আজও রোজা-রমজানের দিনে খেতে ভালো লাগে। এখনও সেই নিখোঁজ দিনগুলিরই ফুর্তি ফিরে আসে ইফতারমুহূর্তে। কেবল সেই বিলবাড়ি গ্রামের রোজার বিশেষ একটা কালচার মিস্ করি ভীষণভাবে। এক্সচেঞ্জ হতো ইফতারি। ইফতারিবিনিময়। পাশের বাড়িগুলো থেকে বাবা-কাকার মুসলমান বন্ধুরা আমাদের বাড়িতে ইফতারি পাঠাতেন। জবাবি ইফতারিও পাঠানো হতো। শুধু আমাদেরকেই নয়, পার্শ্ববর্তী সবগুলো ঘরের পারস্পরিক ইফতারিবিনিময়ের চল ছিল।

রোজার মাসে ফুর্তির আরেকটা কারণ ছিল সকাল-বিকাল দিনভর রইদে পুড়ে খেলাধুলায় বারণের বালাই ছিল না। আর ছিল বাজারের খাবারদোকান। ওরা বারোটার দিকটায়, ঠিক দুপুরবেলায়, ইফতারি বানাইতে লেগে যেত। তেলে-কড়াইয়ে পেঁয়াজু-জিলিপি ইত্যাদি। ছোলা আর বেগুনি। রিয়্যাল বেগুনি। ফিনফিনা পাতলা স্লাইস বেগুনি। মিলিয়ে যেত মুখে দিতেই। দিনেদুপুরে কেনা বাজারের ইফতারি কিনে বাসায় মা-দিদিমার জন্যে বয়ে নিয়ে আসার মাঝপথে বাজারেই সাবাড় করে দেয়া যেত। দোকানিকে ফিডব্যাক দিতে হতো নুন হয়েছে কি না ডাইলের বড়ায় ঠিকঠাক। দুই-তিন পিস্ মাল মুফতে এসে যেত দোকানির গজগজানির সস্নেহ প্রশ্রয়ে।

একই চিত্র দেখেছি মামাবাড়িতেও। রোজার দিনে লম্বা নাইওরিতে মা আমাদেরে নিয়ে ম্যালা দিতেন কাদিপুরে। আমাদের মামাবাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার কাদিপুর। বালাগঞ্জ থেকে গোলাপগঞ্জ যেতে তখন নৌপথই ছিল ভরসা। আটানব্বই-নিরানব্বই সাল পর্যন্ত লঞ্চযোগে গেছি। ইদানীং স্থলরাস্তা হয়েছে, ট্র্যান্সপোর্ট এসেছে স্থলপথে হরেক প্রকার। তখন লঞ্চ কুশিয়ারা বেয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘাট ধরে ধরে সকাল দশটায় স্টার্ট করে বেইল পাঁচটায় গিয়া পৌঁছাত কাদিপুরে। একেবারে মামাবাড়ির ঘাটে।

সেইখানে, কাদিপুরে, দেখেছি সেই আমাদের বাড়ির মতোই ইফতারি নিয়া কালচারাল এক্সচেঞ্জ। মুসলমান মামাদের বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারির জবাবে হিন্দু মামাদের পিঠাপুলির প্রত্যুত্তর। আমাদের মতো আন্ডাবাচ্চাদের তখন পোয়াবারো। চুটিয়ে খেয়েছি ইফতারির তেলেভাজাভুজি।

ইফতারি এখনও রোজা-রমজানের দিনের মস্ত আকর্ষণ। শুধু খুঁজি দিনভর বাচ্চাকাচ্চাদের সেই ইফতারিভোজের দুপুরফুর্তি। ফিনিশ। এখন রমজানের পবিত্রতা বজায় রাখতে এমনকি বাচ্চারাও বাধ্য হয়। কিন্তু কবে থেকে এমন পবিত্রতা বজায় রাখবার কড়াকড়ি শুরু হলো, কবে থেকে এমন লুকাছাপা বাধ্যবাধকতা, স্মরণে নাই।

কিন্তু আছে। এখনও ওই ইফতারিবিনিময়ের স্মৃতিটা তো আছে। সেই স্মৃতিটার পূজায় নিমগ্ন আমি আজও। রমজানের পবিত্রতা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতায় বাচ্চাকাচ্চাদের বাজারদোকানে তেলেভাজাভুজি ভোজনের হুল্লোড় কবেই মিলিয়ে গেছে দূরে। এখনও প্রতিবার রোজার সিজন এলে মনে হয় সেই শিশুবান্ধব ইফতারি খাওয়ার দুপুরমুখরতা আচানক ফিরবে আবার। ফিরবে কি? ফিরবে না?

… …

অসীম দাস

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you