সুরমাপারে সন্ধ্যাযাপন

সুরমাপারে সন্ধ্যাযাপন

এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু
পালাতে চাই তবু সে আসে আমার পিছুপিছু

খাওয়াদাওয়া হলো খুব সন্ধ্যার পরপর। কি খাইলেন, জনাব? ও, বুঝছি বুঝছি, চিলিচিকেন আর থাই-প্রনস্যুপ তো! সঙ্গে অ্যাপিটাইজার কিছু-একটা আর সবশেষে ডেসার্ট — ফালুদা, বা আইসক্রিম! ধুরো, ওইসব খাই নাই। খাইসি বাতাস। সুরমাবাতাস। বহুদিন বাদে বেশ ভরমন-খালিপেট খাওয়া হলো নদীর বাতাস। যদিও কথাটা আংশিক সত্য, অংশত মিথ্যা। কারণ নদী ছিল বাতাসবিহীন। ওয়ার্ডসওয়র্থের সেই বুড়া নাবিকের সমুদ্রের মতো স্তব্ধ চিত্রার্পিত নদী। কিন্তু নদীতীরে গেলে ভেতরে ভেতরে ঠিকই বইতে থাকে শো শো বাতাস, সেই বাতাসে দিব্যি মনের পাল তুলে নৌকাও ভাসানো যায়। এবং বললাম যে খালিপেট, — ডাহা মিথ্যা। আস্ত একথালা লেবুচনমনে চটপটি খেলাম সাবড়ে চেটেপুটে, লিখতে যেয়ে ছন্দে ছন্দে লিখছি কিনা খালিপেট! সত্যি সত্যি লেবুপাতার কুঁড়ি দেয়া চটপটি ভারি লেহ্য ও সোয়াদের হয়েছিল। অনেকদিন পর সমস্তই — সুরমাসঙ্গ, নদীবৈঠক, চটপটি ইত্যাদি। অনেকদিন পর আমার অনেকদিনের পুরনো বন্ধু বিপুল ও মৃদুল। দুজনেই বিবাহিত, ঘোর সংসারী, কিন্তু মরে যায়নি এখনও। অবাক জীবন্ত আজও, দুজনেই, আশ্চর্য প্রাণস্ফূর্তিময়!

বিপুল তালুকদার আর মৃদুল কান্তি সরকার। আঙুলের গিঁটে গুনে দেখলাম, ৯৬ থেকে ২০১৩, পাক্কা ষোলো বছরের কলকাকলি। একদিন সেলিব্রেইট করা দরকার ষোলো প্লেট চটপটি চেটে। দ্বিতীয়োক্তজন খুব শিগগির আমেরিকা চলে যাচ্ছে, সপরিবার। সব পাবে সেখানে, অপরিসীম সমস্তই পাবে এমনকি গাধার আন্ডা থেকে ব্যাঘ্রদুধ অব্দি, কিন্তু সুরমাপার পাবে না সশরীর। অবশ্য সংস্কৃত শ্লোক অসত্য নয়, সেই যে বলা আছে, য পলায়তি স জীবতি! যাক, থাকুক, সুরমাবাতাস বিহনে কেউ যদি থাকতে পারে ভালো!

সন্ধ্যার পর নদীতীর উপাদেয় এমনিতেই। হাঁটাহাঁটি করুন, বসে থাকুন চটপটিবিক্রেতার পেতে-দেয়া প্লাস্টিকচেয়ারে, চক্কর দিন চর্কিস্পিডে এ-মাথা ও-মাথা। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, মুরুব্বিদের কথা ফেলনা নিশ্চয় নয়। এছাড়া দারাপুত্রপরিবার নিয়া টাইম স্পেন্ড করার একটা ভালো জায়গা এই নদীতীর। তা, বেশ বাবুয়ানা হলো সন্ধ্যাতীরে নির্বাতাস সুরমাপারে বসে। বেশ ঊনিশশতকী বিলাস। মন্দ নয়, এমন করা, মাঝে মাঝে। অ্যাফোর্ড করতে পারলে ডেইলি কিনব্রিজকিনারায় যেয়ে ফ্রেশ এয়ার খাওয়া যায়। টাকাপয়সার অ্যাফোর্ডেবিলিটি নয়, টাইমের কনভিনিয়েন্সটাই মুখ্য।

সুরমা নদীর উত্তরভাগটাকে বেশ সুন্দর চোখকাড়াভাবে বাঁধানো-সাজানো হয়েছে। কিনব্রিজের তলাকার দুই-পার্শ্বস্থ কালিঘাট-তোপখানা রোডের বেশ অনেক জায়গা লম্বালম্বি ধরে দোকানপাট তুলে দিয়ে সে-জায়গাটাকে রেলিঙঘের দিয়া, ব্লক বসায়া পাকা করে, খুব মনোহর কাজ হয়েছে। দেখতে দেখতে এই শ্রীবর্ধিত নগরপ্রসাধনের বয়স হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক বছর হবে। এই কাজটা হয়েছে বোধকরি সার্কিট হাউসের ফ্রন্টভিয়্যু বিউটিফিকেশনের চিন্তা মাথায় রেখে। এর ফলে নগদ লাভ হচ্ছে পৌরবাসী সকল নাগরিকের, লাভ হচ্ছে পর্যটনপ্রিয় স্বজেলা বা ভিনজেলা বা ভিনদেশ থেকে বেড়াতে আসা মানুষদের। আর আমাদের মতো চাকরিভৃত্যরা এ-স্থলের ফায়দা ও ফজিলত বলে ফুরাতে পারবে না। যা-হোক, নদীতীরর্তী দৃশ্য ও বাতাস ভোগ করার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে শহরবাসী মানুষদের। এর উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসুক।

তবে একটা বিষয় ভেবে বেশ মনখারাপ লাগছে। সেটা হলো, শহরের সেই পুরনো গন্ধটা উবে যাচ্ছে। খুব দ্রুত মুছে যাচ্ছে আমাদের ছেলেবেলা, আমাদের আমি  হয়ে ওঠা, আমাদের বেড়ে-ওঠা দিনগুলো! উবে যাচ্ছে সেই দোকানপাট, ফুটপাত, বস্তি ও ভিখিরিরা। হাওয়া হয়ে যাচ্ছে আস্ত আমিটা! আমার প্রথম যৌবন! নারকেলবিক্রির সারি-সারি দোকানঘরের তোপখানা, ফুটপাত জুড়ে বসা রাজার হালে হকার, মাটির হাঁড়িপাতিল-তৈজসপত্র আর রঙিন শীতলপাটিবিক্রেতারা, মাটির কলসি-ঠিলার স্তূপ ও মৃৎপাত্রের-খেলনাবাটির পসরা, আলী আমজাদের ঘড়ির অদূরে ঝুপড়িবাসী শিশু ও পঙ্গু পুরুষেরা আর সিঁড়িতে নাইতে-নামা রাস্তানারীদের কাতার, নেয়ে উঠে শুকাতে দেয়া তাদের রঙবেরঙের শাড়ি, কালিঘাটের ঘিঞ্জি ভিড়, খেয়া পারাপার … কিচ্ছু নাই আগের মতো, সমস্ত উধাও। ঘিঞ্জি ভিড়ও ভালো লাগত খুব, তবে বিশেষভাবেই ভিড় ভালো লাগত পূজা আর ঈদসিজনে। এখন সব বদলাচ্ছে, সবকিছু ঝকঝকে-তকতকে হচ্ছে, দ্রুত।

ফুরিয়ে যাচ্ছি আমরা, আমাদের পুরনো শহর নতুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ফুরিয়ে আসছে আমাদের তরুণ-তুখোড় মুখরতার সময়স্মৃতি। সেই শ্যাওলামাখা বাতাস, সেই স্যাঁতস্যাঁতে ফুটপাত, সেই পুরনো বৃটিশ আমলের দরদালান, আদালতপাড়া, পৌরপার্ক, চুনসুরকির থমথমে দেয়াল — সবকিছু আজকের তুলনায় ছিল গরিব-গরিব কিন্তু ছিল কেমন যেন আপন-আপন গন্ধমাখা — ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে সব। শহরটা আর নিজের বলে মনে হয় না এখন। খুব দ্রুত পর হয়ে যাচ্ছে সে। এখন কেমন অস্বস্তি হয় হাঁটতে-চলতে, এখন ফুটপাত অনেক প্রশস্ত ও হকারমুক্ত হলেও হাঁটতে মন চায় না সেই ফুটপাতে। হকারছাড়া ফুটপাত আদৌ ফুটপাত বলেই মনে হয় না। মনে হয় যেন ফুটপাত নয়, বিদেশের অপরিসর সমুদ্রসৈকতের বেফায়দা বিলাসিতা।

মানুষের ঠেলাধাক্কা ছাড়া লোকালয় আমার কাছে যথেষ্ট লোকালয় বলে মনে হয় না কখনোই, রিসোর্ট বা স্বাস্থ্য-পুনরুদ্ধারের স্যানাটোরিয়াম মনে হয়। এখন আমার পৃথিবীটা আমার হাত থেকে ফসকে গেছে বলে মনে হয় সারাক্ষণ। মনে হয় যেন আগন্তুক আমি, কর্মসূত্রে উপনিবেশিত কোম্প্যানিস্টাফ বা ভ্যাকেশনে বেড়াতে-আসা মানুষ মনে হয় নিজেকে, নিজের জন্মশহরে নিজেকে কেমন যেন ট্যুরিস্ট মনে হয়। এই হলাম আমি, এই আমাদের শহর, এরই নাম উন্নয়ন।

এপিগ্র্যাফে উদ্ধৃত পঙক্তিনিচয়ের রচয়িতা কবীর সুমন।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you