বন্দন সরেরস্বতী দেব নারায়ণ
আইজ কেন ক্ষীরনদী হরিদ্রা বরন
ভাটির ময়ালে এই গীতিবাক্য দুটি ‘মুখপদ’ হিসেবে দোহার দিয়া ‘সরস্বতী বন্দনা’ গাইতে গাইতে কামলাগণ ‘পোষে-মাঘে’ জমিতে ‘রোয়া’ দেওয়ার সময় ‘হাইর’ গাইয়া সুর মিলাইয়া শাইল-বোর ধানের‘খেত’ লাগাইত। আর গিরস্ত খেতের ‘আইল্য’ বইয়া ‘তামুক’ সাজাইতে সাজাইতে গানের মাঝে তাল মিলাইয়া ‘বাহার’ দিত — ‘ঘুইরা ল্য রে, ঘুর। একবার ঘুইরা, সাতবার ঘুর। ঘুর ঘুর সোয়া, হাইল খেতঅ বোর-র রোয়া।’ বাহারে সকলেই স্লোগানের মতো জোরেশোরে আওয়াজ দিত, তাতে সুরে-সুরে বাহারে-বাহারে শ্রমের ক্লান্তি দূর হইত। তাছাড়া পথেঘাটে-প্রান্তরে কিম্বা আসরে বাউলগণ একতারা বাজাইয়া গাইত — ‘এসো মা গো সরেরস্বতী কণ্ঠে এসে করো ভর, তিলেকমাত্র থেকে যাও মা বসিয়া জিহ্বার উপর’। গাঁয়ের নারীগণে গিরস্তালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে গীত গাইত — “শোনো শোনো নগরবাসী শোনো দিয়া মন, জন্ম লইলা মা গো ‘স্বরাই’ কিসেরি কারণ”। সংগীতগুরুগণ সাধন-ভজনকালে কপালে বাদ্যযন্ত্র ঠেকাইয়া ভক্তিকাতর হইয়া গাইত — ‘আমায় কৃপা করে চরণতরী দেও গো জননী / এ গো সংগীতসাগর মাঝে সাঁতার নাহি জানি / সংগীতরূপিনী তুমি দেবী বীণাপাণি।’ একসময় এভাবেই জাতপাত ভুলে গানেয়ালদের হৃদমাঝারে ভক্তি-বিশ্বাসের সাথে গানের দেবী সরস্বতীর আসন ছিল। বর্তমানে সরস্বতীর ভাবজগতে তা নানা কুন্দলের কারণে গানের গলায় জাতপাত ও মতাদর্শের তাবিজ ঝুলাইয়া বাম-ডানে বিভক্ত হইয়াছে।
শুধু তা-ই নয়, মাঘের শুক্লা শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে ভাটির ঘরে ঘরে আরতি, গান, আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন শিক্ষার মহড়া চলত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে আরতি প্রতিযোগিতার পাশাপাশি মেয়েলি গীত হইত।‘আলতি লও আলতি লও মা গো সরস্বতী / তোমারে পুজিলাম মা গো ভোগ-নৈবদ্যে অতি।’ আরতি প্রতিযোগিতা সরস্বতী পূজার একটি বিশেষ আনুষ্ঠানিক পর্ব। একসময় গ্রামভিত্তিক ‘বারোয়ারী’ পূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিমা তৈরির প্রতিযোগিতা, পূজার অর্ঘ্য সংগ্রহ, মন্দিরস্থাপন ও যাত্রাগানের মহড়া চলত। যদিওবা দেবী সরস্বতীর স্থায়ী বা ‘স্থাপিত মন্দির’ নাই বললেই চলে। তাই মন্দিরে প্রতিমা স্থাপন করে ‘বারোয়ারী’ পূজা কম হয়। তবে এখনও ভাটিগাঁয়ের ঘরে ঘরে ‘মধুমপালা’র পাশে ঘট বসিয়ে আসন স্থাপন করে তাতে বই, খাতা ও দোয়াত-কলম রেখে সরস্বতীর প্রণাম মন্ত্রপাঠ করে ব্রাহ্মণ ছাড়াই দেবীর আরাধনা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দেবীর আসনে ইংরেজি বই দেওয়া বারণ। পূজার উপাচার হিসেবে বিশেষভাবে অভ্র-আবির, আমের মুকুল, যবের শিষ, দোয়াত-কলম ও বাসন্তী রঙের গাঁদাফুল দেওয়া হয়। সরস্বতী পূজার পূর্বে ‘বড়ই’(কুল) খাওয়া যায় না। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই পালনীয়। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ থাকে। কিন্তু সরস্বতীপূজায় দেবীকে সাক্ষী রেখে হাতেখড়ি দিলে প্রভূত বিদ্যালাভ হয় বলে বিশ্বাস। উপবাস থেকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে পূজার সমাপ্তি হয়। ঘরে ঘরে‘ঘট পূজায়’ব্রাহ্মণ ব্যতীত সরস্বতীপ্রণাম মন্ত্রপাঠ করেই আরাধনা শেষ হয়।
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহি নমোহস্ততে।।
সনাতনী বিধানমতে দেবী সরস্বতী বছরে তিনবার পূজিত হন। দুর্গাপূজার সময়, বাসন্তীপূজার সময় ও শ্রীপঞ্চমীতে। তবে শ্রীপঞ্চমীর পূজাকেই আমরা বিশেষভাবে সরস্বতীপূজা বলি। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রসমূহে শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতীপূজার বিধান নেই। লক্ষ্মীপূজার বিধান আছে। ‘শ্রী’ মানেই লক্ষ্মী। তাই শ্রীপঞ্চমীর উদ্ভব। শ্রীপঞ্চমী সম্বন্ধে ‘সম্বৎসর প্রদীপ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে ‘পঞ্চম্যাং পূজয়েৎ লক্ষ্মীং মস্যাধারং লেখনী চ।’খ্রীস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বরাহ-মিহির তাঁর বৃহৎসংহিতায় প্রতিমালক্ষণ হিসেবে সরস্বতী প্রতিমার কথা উল্লেখ করেন নাই। এমনকি মৎস্যপুরাণেও লক্ষ্মীপ্রতিমার উল্লেখ আছে কিন্তু সরস্বতীপ্রতিমার উল্লেখ নেই। তবে তান্ত্রিক সাধকেরা ‘বাগীশ্বরী’-র পূজা করতেন, যেখানে ধ্যানযোগে দেবীকে শুভ্রা, পদ্মাসনা, পুস্তক, বর্ণমালা ও সুধাকলস ধারণে পাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। খ্রীস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে সরস্বতী বন্দনায় উল্লেখ করেছেন, ‘শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠান, শ্বেতবস্ত্র পরিধান, শিরে শোভে ইন্দুকলা, করে শোভে জপমালা, শুকশিশু শোভে বাম করে। তাঁর আর এক হস্তে পুস্তক, মসীপত্র ও লেখনী তার সঙ্গী। ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী, বেণুবীণা, নানা বাদ্যযন্ত্র, নিরন্তর তাঁর সেবা করে। তিনি বিধুমুখে দেবধ্বনি, বীণাপাণি, বর্ণময়ী, বিষ্ণুমায়া। তিনি চর্তুভূজা। দ্বিভূজা নন।’ (সূত্র : প্রসঙ্গ পঞ্চবিংশতি; ড. অতুল সুর)
মহাভারতশুরুর বন্দনাতেও সরস্বতী দেবীর উল্লেখ আছে। ‘নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্। দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ।’ তবে মধ্যযুগের ভাস্কর্যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সরস্বতীর মুর্তি পাওয়া গিয়াছে। দেবীর উৎপত্তি সম্পর্কে পুরাণসমূহে উল্লেখ আছে, ‘সৃষ্টিকালে প্রধান শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয় : রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী।’ পরমআত্মার মুখ থেকে এ দেবীর আবির্ভাব হয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণ থেকে উদ্ভূত। যেখানে উল্লেখ আছে, লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুইজনেই নারায়ণের স্ত্রী। সরস্বতী পূজা প্রথমে বৃহস্পতি রায়মুকুট তাঁর ‘স্মৃতিরত্নহার’ গ্রন্থে পরে রঘুনন্দন তাঁর ‘কৃত্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে শ্রীপঞ্চমীতে লক্ষ্মীর সঙ্গে করার বিধান দেন। আবার ড. অতুল সুর রচিত ‘প্রসঙ্গ পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থে ‘সরস্বতী পূজা কত প্রাচীন?’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন ‘আর্যরা যখন পঞ্চনদের উপত্যকা থেকে ব্রহ্মাবর্ত দেশের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেন তখন সরস্বতী নদীর তীরেই তাঁরা তাঁদের যজ্ঞকর্মাদি সম্পাদন করতে শুরু করেন। সরস্বতী নদীর তীরে দেবধ্বনি হত বলে পরবর্তীকালে সরস্বতীকে তাঁরা বাগদেবীর আধার স্থানরূপে গণ্য করেন। তার মানে বাগদেবীকে বোঝাতে সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীকেই বোঝাত।
এক-কথায় বৈদিক যুগের সরস্বতী নদীই পরবর্তীকালে বাগ্দেবীতে রূপান্তরিত হয়।’সরস্বতী শব্দের অর্থ বাগদেবী, বাক্যভারতী, বাণী ও প্রাচীন নদীবিশেষ। তিনি জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ওবিদ্যার দেবী। সরস্বতী শব্দটি ‘সার’ এবং ‘স্ব’ দুটি শব্দে গঠিত। আবার যা ‘সুরস বতি’ সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ জলের আধার। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।’ সরস্বতীর বাহন শ্বেতহংস। কারণ শ্বেতহংস অসার ফেলে সার গ্রহণ করে। যেমন, দুধ ও জল মিশ্রিত করে দিলে হাঁস শুধু দুধটুকুই গ্রহণ করে নেয়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। সরস্বতী শুক্লবর্ণ। যার মানে সাদা বর্ণ। সাদা ভাল গুণের এবং পবিত্র ও স্বচ্ছতার প্রতীক। সরস্বতী বীণাধারিণী। বীণার ধ্বনি ছন্দময়। জীবনও ছন্দময় হউক। বীণার সুর মধুর। মুখনিঃসৃত বাক্যও মধুর হউক।
সরস্বতী বেদপুস্তক ধারিণী। ‘বেদ’ জ্ঞানের ভাণ্ডার। বেদই বিদ্যা। গরুড়পুরাণে সরস্বতীর শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। অনন্ত জিজ্ঞাসা আর নানা কৌতূহলপ্রবণ মানুষ তাই শক্তির আরাধনায় তার সমাধান খোঁজে। সেটা ধর্মাচারেই হউক বা লোকচারবিশ্বাসেই হউক বা যে-কোনো মাধ্যমে। তাই সরস্বতী পূজা ও তার আচার-অনুষ্ঠান মানবমঙ্গলের প্রতীক। যদিও বর্তমানে তার ভাবরস অনেকাংশেই একদিনের আনুষ্ঠানিক পূজাতেই সীমাবদ্ধ।
ভাবজগতের শক্তি ও নিত্য উপাসনায় একসময় সরস্বতী পূজা শেষে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে প্রতিমাবিদায়ের (বিসর্জনের) প্রথা ছিল না। প্রতিমা গৃহে রাখার নিয়ম ছিল। বর্তমানে পূজা শেষে প্রতিমা অন্যত্র স্থাপন করা হয়, স্থানাভাবে মন্দিরের আশেপাশে বা গাছের নিচে। ভাটি অঞ্চলে নির্দিষ্ট ‘বরতী গাছ’-এর তলে প্রতিমা রাখা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে সিলেট শহরে ‘প্রতিমাযাত্রা’-র ঐতিহাসিক আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত আছে। ট্রাক বা ভ্যানগাড়িতে প্রতিমা স্থাপন করে নানা আঙ্গিকের কারুসাজ ও আলোকসজ্জা দিয়ে গানবাজনা সহ ধুপ-আরতিনৃত্য প্রদর্শন করে সন্ধ্যার পর সারাশহর প্রদক্ষিণ করে তা শেষ হয়। শহরের লোকজন এ-প্রতিমাযাত্রা দেখে আনন্দবোধ করে, যার ভাবজগৎ ভিন্ন। এমনটি এ-বাংলায় আর দ্বিতীয় হয় না। গ্রামে প্রতিমা আগমন বা বিদায় নিয়ে শ্রীকন্যা নাইওরিদের মতো আনন্দ-বেদনার সুর বেজে ওঠে। প্রতিমা আগমন যেন ‘নিরাকার’ থেকে ‘সাকার রূপ’ এবং বিদায় বা যাত্রা যেন ‘কার’ থেকে ‘নিরাকার রূপ’ অর্থাৎ, জন্ম-মৃত্যুরই খেলা। তাই সরস্বতী প্রতিমা যাত্রাকালে গাঁয়ের নারীগণ কাতর কণ্ঠে গীত গায় :
পূজা লইয়া মা গো স্বরাই বিদায় হইলা
জয়-জোকারে মা গো বৈকুণ্ঠেতে গেলা।
… …
- সরস্বতী দেবীর কথকতা || সজলকান্তি সরকার - March 22, 2021
COMMENTS