ফকির সমছুল : মহৎপ্রাণ এক মরমি কবি || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

ফকির সমছুল : মহৎপ্রাণ এক মরমি কবি || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

যুগে যুগে বহু প্রতিভাবান মরমি সাধক সুনামগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করে নিজ এলাকার সাংস্কৃতিক ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন; করেছেন গৌরবান্বিত। তাঁরা গানের মাধ্যমে চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে।

সুনামগঞ্জে জন্মানো বাউল-শিল্পীদের প্রসঙ্গ উঠলে বহু নাম উল্লেখ করতে হয়। অনেক অনেক নামের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম ফকির সমছুল। গুণী বাউলশিল্পী ফকির সমছুল উত্তরাধিকারসূত্রেই একজন ফকির ছিলেন। তিনি প্রাগ্রসর মন-মানসিকতাসম্পন্ন একজন আদর্শ বাউল। গানের মাধ্যমে তিনি সমাজের অন্যায়, অবিচারকে তুলে ধরতেন, সমাজের বিভিন্ন বৈষম্যকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন।

ফকির সমছুল সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানার দরগাপাশা ইউনিয়নের ধরাধরপুর গ্রামে ১৩৪৮ বাংলার চৈত্র মাসের শেষ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা লাল মোহাম্মদ, মাতা সোনাভান বিবি।

প্রায় সকল বাউল-শিল্পীদের জীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তাদের পুরো জীবনটাই দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র্য ও সমাজের মানুষের অবজ্ঞা, অবহেলায় পরিপূর্ণ ছিল। ফকির সমছুলের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। নিজের জন্ম ও পরিবার নিয়ে লেখা এক গানে সমছুল বলেছেন, “সিলেট জিলা সুনামগঞ্জ থানা, পাগলাবাজার পরগণা। / জন্ম নেই আমি কমিনা, গ্রাম আখতাপাড়ায়। / … লাল মোহাম্মদ আমার পিতা, ছোটবেলা মরলা মাতা। / না শুনলা মোর মুখের কথা, আমার বাপ-মায়।”

মায়ের মৃত্যুর পর তাদের পরিবারে দুর্দিন নেমে আসে। সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। মা না-থাকলে একটা সংসারের কোনও শক্ত ভিত থাকে না। এমনকী সন্তানদের ভবিষ্যৎও হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। মা-হারা এতিম সন্তান ফকির সমছুলের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে তাঁর লেখা একটি গান থেকে মায়ের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তি ফুটে ওঠে — “তোমার মায়ের মতো আদর কে করবে রে তোরে। / ভুলেও দুঃখ দিও না মায়ের অন্তরে।”

শিশু সমছুলের স্কুলে আর বেশিদিন পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। সংসারের অভাব-অনটন  দূর করতে গিয়ে পিতার পাশাপাশি তিনিও কিছুদিন চাকরি করেন। আবার একসময় মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফেরি করে ব্যবসাও করেন। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল। এরমধ্যে কয়েকবার তিনি রোগে-শোকে আক্রান্ত হন। রোগশোক, জরাব্যাধি, অনাদর মানুষকে ধীরে ধীরে পালটে দেয়। দুঃখকষ্টের আগুন সোনার মানুষকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তর করে।

একটা সময় মানবসমাজের সমস্ত নিয়মকানুন তাঁর কাছে অর্থহীন লাগে। বরং স্রষ্টার প্রেমে তিনি ধীরে ধীরে মজতে থাকেন। তাঁর হৃদয়ে ভাবের উদ্রেক হয়। অন্তরে শুরু হয় প্রেম। মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে সংসারের মায়াজাল ছিন্ন করে একই জেলার ছাতক উপজেলাধীন হাবিদপুর নিবাসী পিরে কামেল শাহ নয়ান ভানু আহমেদ আলীর শরণাপন্ন হন। তাঁকে মুর্শিদ হিশেবে গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে থেকে একাধারে তেরো বছর তালিম নেওয়ার পর শেষে মুর্শিদের আদেশে নিজ গ্রামের পূর্বঠিকানায় একই জেলার আখতাপাড়া গ্রামে চলে আসেন। এখানে কিছুদিন কাটিয়ে মিনাবাজারসংলগ্ন মাসিংনদীর পূর্বতীরে ঘর বাঁধেন। সংসার বলতে কেবল তিনি আর তাঁর স্ত্রী।  তাঁর স্ত্রী ছিলেন স্বামীভক্ত। তাঁরা নিঃসন্তান দম্পতি ছিলেন।

ফকির সমছুল যেখানে বসবাস করতেন সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা ছিল হিন্দু। তা সত্ত্বেও যেন সেই এলাকা হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলমানের এক সম্প্রীতির এলাকা। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাঁর কাছে এসে বায়াত গ্রহণ করেন।

ফকির সমছুলের বিভিন্ন সময়ে লেখা ও গাওয়া গানে ফুটে ওঠে সামাজিক শোষণ ও ধর্মীয় কোন্দল সহ নানা বৈষম্যচিত্র। তিনি তাঁর বহু গানে ধর্মের পোশাকি বিষয়আশয় থেকে অধিকতর গুরুত্ব দিতেন ধর্মের অভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যকে। কেবল বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানকেই মানুষ যখন ধর্মজ্ঞান করে বসে থাকে তখন সমাজে ভেদাভেদ বাড়ে, অশান্তির সৃষ্টি হয়। এমন কথাই তুলে ধরেছেন ফকির সমছুল তাঁর একটি গানে — “ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি জগতে। / ধর্ম বলতে সত্য বোঝায় পূর্ণ হয় জীব দয়াতে। / হিন্দু বলে আমরা বড়, মুসলমান তোলে না ঘরও, / চা-নাস্তা আর পানাহার বসে করে একসাথে / …মুসলমান কয় আমরার ইসলাম, আমরা করি আল্লারই কাম / …তকি আর দাড়ি রাখিয়া, লম্বা কুর্তা গায় পরিয়া / রাসুলের খাইছলত ছাড়িয়া, চলে নফছের খায়েশেতে।” বরং ধর্ম বলতে হৃদয়ের পবিত্রতাকেই বোঝায়, এমন ইঙ্গিত করে গানে লিখেছেন ফকির সমছুল — “কলবের নামাজ পড়ো মুমিন ভাই। /  কলবের নামাজ না পড়িলে, বেহেস্তে যাইবার আশা নাই।”

সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের কথাও ফুটে উঠেছে তাঁর কিছু গানে। যেমন, একটি গানে তিনি বলেছেন — “ধনীর দোষ ধরা পড়ে না সমাজে। / গরীবে দোষ না করলেও বিচার হয় কাজে কাজে।”

ফকির সমছুলের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অনেক জ্ঞানীগুণী সহ সাধারণ মানুষ তাঁর নিকট এসে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন প্রতি বছর পৌষ মাসের ২৭ তারিখ নিজ বাড়িতে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এ যেন ফকির সমছুলের অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম ভক্তের মিলনমেলা। ফকির সমছুলের সংস্পর্শে এসে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সকলেই গানের মাধ্যমে, প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমে মশগুল হন। গ্রামে শতকরা নিরানব্বইজন হিন্দু থাকা সত্ত্বেও ফকির সমছুলের সংস্পর্শে এসে তারা তামসিক পূজা ছেড়ে দিয়ে কলির ধর্ম অনুযায়ী নামকীর্তন করে ধর্ম পালন করেন। এছাড়াও জামালগঞ্জের বিছনা নামক গ্রামে এমরুল কয়েস লোকউৎসবে ফকির সমছুল সবসময়ই অতিথি হিশেবে উপস্থিত থাকতেন। সেখানে তিনি পেতেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

ফকির সমছুলের বাড়িটি বর্তমানে ফকিরবাড়ি নামে খ্যাত। তাঁর বংশ সম্পর্কে জানা যায়, তিনি আখতাপাড়া নিবাসী পিরে কামিল আবিদ শাহের নাতির ঔরসজাত সন্তান।

ফকির সমছুলের প্রথমদিককার বেশিরভাগ গানই হারিয়ে গেছে। প্রথমদিকে গাওয়া তাঁর গানগুলো তিনি লিখে রাখতেন না বলেই এমনটা ঘটেছে। ‘আশিকের রত্ন’ নামে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা অসংখ্য গানের খণ্ড। সেই খণ্ডগুলো আবার একত্র করে ঘাস প্রকাশনী  থেকে ‘আশিকের রত্নসমগ্র’ নামেও মলাটবন্দি করে প্রকাশিত হয়েছে।

একজন আদর্শ শিল্পী ও গীতিকার হিশেবে সমকালীন বাউলশিল্পীদের মধ্যে ফকির সমছুল অন্যতম। তাঁর লেখা গানের মধ্যে গভীর দর্শনের পাশাপাশি বিষয়বৈচিত্র্য অতিশয় সুন্দর ও সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। আর সেজন্যই রুচিশীল শ্রোতাদের নিকট তাঁর গানের চাহিদা ব্যাপক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ফকির সমছুল পরলোকে পাড়ি জমান। যে-শিল্পী লিখেছিলেন — “কোথা হইতে আসে মানুষ, আবার কোথায় যায় / ফিরিয়া আসিয়া কেউ আর খবর না জানায়।”

পরলোকে ফকির সমছুলের শান্তি হোক, এই কামনা।

মোহাম্মদ জায়েদ আলী রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you