‘…গানগুলো যেন পোষা হরিণের পাল, তোমার চরণচিহ্নের অভিসারী’
— শহীদ কাদরী
আজম খান গাইছিলেন ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে…’
সারারাত জেগে থেকে গুমরেগুমরে (মায়াভরা পৃথিবীর এই বেদনার রেসকোর্সে পাওয়া-না-পাওয়ার নিকাশ-দূরত্বের এক চির-অমলিন প্রশ্নবোধকে শরবিদ্ধ হয়ে) গুরু আরও গাইছিলেন ‘পাপড়ি কেন বোঝে না…’ —
ঘুম না আসা — কতশত কথা যাকে নিয়ে ভাবা হইছিল — গুরু আজম খান এবং আমাদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের তোলপাড় যার কাছে যে-করেই-হোক পৌঁছাইতে পারে নাই ঠিক সময় মতন —
তাই ক্লান্তি এসে কোনোদিন যদি নিজ হাতে আমাদের চোখের পাপড়িগুলাকে বুঁজিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায় তবুও — সেই ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’-র এই জিজ্ঞাস্য-আকুতির মামলা যেন খারিজ হয় না।
যেমন খারিজ হয় না তুলনাহীনা বান্ধবী ‘মৌসুমী’ কাকে ভালোবাসে-র মামলা এই ডেল্টা বে-র লোকালয়ে — পুরুষপ্রধান অন্তরে-বন্দরে।
ফিরে ফিরে আসে চিঠি — গতকাল ঠিক দুপুরে — প্রিয় আকাশী … সুস্মিতার সবুজ ওড়না উড়তে থাকে আর এলোমেলো বাতাসে যখন উড়ে যায় ভালোবাসা বিপদসীমার উপর দিয়ে তখনও কী দিওয়ানা মাস্তানা নওজোয়ানদের নজরবন্দী হয়ে থাকার হুমকিটাকে কি এড়াইতে পারে বা পারছিলেন কি নাইন্টিজের সরলতার প্রতিমা ইয়োর হাইনেসরা?
বাংলা রক মানে বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় রক মিউজিককে ভালোবেসে এবং ভূমিকা করে কিছু আলাপ জিজ্ঞাসার আনকোরা মঞ্চায়ন করতে চাই। সালাম আদাব জানায়া আপনাদের দোয়াপ্রার্থী তাই। আলাপ-জিজ্ঞাসার জমিন অবশ্য বাংলার এক্সিলেন্ট (আরবান হৃদয়ের আলোড়ন-বিদ্যুৎ চমকিয়া) রক মিউজিক একা নয়, যদিও বাংলা রক তার একটি নজরকাড়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সাবসেট বলে অনুমান করি।
স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম এবং ইংরেজিয়ানাতাড়িত বাংলাদেশী রক পূর্ববঙ্গীয় বাংলা মানে ঢাকা-বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কলকাতাকেন্দ্রিক এবং অনুপ্রাণিত আধুনিক বাংলা গানের ‘মাধবীলতা-রজনীগন্ধা-গোলাপকাঁটা-বাগানবিলাস-এর কেতাবি ভদ্রতার অ্যারেনায় যে মোর আরবান ঝাঁকি এবং চপলমতি-অস্থির ও রাগী আত্মাদের প্রয়োজনীয় চিৎকারের একটা স্ট্যাবিলাইজার/মিডিয়াম হয়ে নিজের অস্তিত্ব মেলে ধরছিল কয়েক দশকের মধ্যে সেখানে — শুরুতে একেবারে পশ্চিমামুখী অন্ধ অনুকরণকারক ছিলেন না এ-রকম হাতে গোনা কয়জনার মধ্যে গুরু আজম খান এবং ফিরোজ সাঁই প্রমুখ এবং উনাদের তৎকালীন বাংলা ‘রক’ ও ‘পপ’ চর্চার স্বকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিকটা সম্ভবত এই যে উনারা ঐ সময়ের উঠতি বয়সের তরুণ আরবান মিডিল ক্লাসের একটা অংশের মন-মানসিকতার পালসটা ঠিকঠাক ফিল করছিলেন এবং উনাদের স্বতঃস্ফূর্ত গানের কথা ও সুরের ভাঁজ-খেয়ালে অতটা পশ্চিমা আক্রান্ত না-আঞ্চলিকতা এবং লোকগানের একটা শহুরে ঘষামাজা করা পূর্ববঙ্গীয় মোটিফ সবসময় ছিল যা উনাদের গান শুনলেই বোধকরি ঠাওর হয়। মানে উনারা যেভাবেই হোক ‘থিঙ্ক গ্লোবালি অ্যাক্ট লোকালি’-র একটা সুন্দর ম্যানিফেস্টেশন করতে পারছিলেন। এইটা আপনারা জানেন ঠিকই। তাও না বলে থাকতে পারলাম না।
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ঢাকা-বাংলার আধুনিক বাংলা গান মানে শিক্ষিত মিডিল ক্লাসের মনন-মেজাজের রূপান্তর, আবেগের ডানা ঝাপটানোর প্যাটার্ন — সাংগীতিক এক্সপ্রেশনের বাঁকবদলে রক মিউজিক একটা এখনো বারবার বলার মতন অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে জ্ঞান করি। নাইনটিজে ‘বাংলা (মিডিলক্লাস পেটিবুর্জোয়া) রক’ তরুণ সেনাপতির মতন তার ঝাকানাকা ধারালো মাধু্র্য, যান্ত্রিক সুরেলা কোলাহলপূর্ণ ঝানানা এবং বুক থেকে মুখ ফুটে তীব্রচিৎকার হয়ে তার জোসিলা কেরামতির ঘোরলাগা স্ফূরণ দেখাইছে। আমরা অনেকেই তার ভক্ত শ্রোতামণ্ডলী হয়েছি।
মেলো রক, সোলস, এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস, নগরবাউল — আরেকটু হার্ডকোর রকস্ট্রাটা, ওয়ারফেইজ — ক্লাসিক বাংলাদেশী রকের জামানা গিয়া অর্থহীন, আর্টসেল, ব্ল্যাক, নেমেসিস-এর অস্থির মাথানষ্ট সলো-রিফ-হেডব্যাং-মাতোয়ারা ড্রামিং (এবং সাউন্ডকোয়ালিটি-প্রকৌশল আগের চেয়ে ভালো)-এর ফানাফিল্লার কড়া সেকেন্ডওয়েভ-আন্ডারগ্রাউন্ড-মেটাল-অল্ট রক, পার হয়ে আরও নানান কিসিমের টুকিটাকি রক-জনরা বাংলাদেশের আরবান শিক্ষিত মিডিলক্লাসের তারুণ্যের একটা ভালো প্যাশন কিংবা ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’-এর জায়গা-চাহিদার মানচিত্র তৈরি করছে বলে মনে করি।
‘বাংলা রক’ তার সাংগীতিক এবং আবেগের ধার না হারাইলেও তাঁর আবেদন ও গতিবিধি সময়-রাজনীতি-প্রজন্মের টেস্ট-ইনফ্লুয়েন্স-প্যাশন বদলানোর ফেরে এবং ‘অধিকমাত্রায় ব্যবহার’-এর কারণে যদিও কিছুটা মেকি এবং অনেকের মতে কেবলই ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’ হয়ে থমকে গ্যাছে এই স্নেহাশীষ অভিযোগ একেবারে অগ্রাহ্য নয় বলেও মনে করি। যেমন — আরবান নরনারীর একমুখী প্রেমের মনোগ্রাফ ও মনযন্ত্রণা, ব্যক্তিমন ও পারসন টু পারসন এবং পারসন টু সমাজ-রাষ্ট্রের মিথস্ক্রিয়ায় নয়াবিষ্কৃত আবেগের চ্যান্ট-ব্যালার্ড, এবং মেজাজি হুঙ্কার-প্রেমময়তা বাদে —
রকের যে ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গিমা, রাগ, অবাধ্যতা ও স্বাধীনচেতা কোরাস, মনোলিথিক সমাজের যাবতীয় শেকল ভাঙার আহ্বান এবং হুঙ্কার, এগুলি শেষমেশ যেন শুধুই কিছু আলঙ্কারিক জারগন — সাংস্কৃতিক পুঁজি আর অনুকরণপ্রবণ এক ঠুনকো নাটকীয়তার প্র্যাকটিস হয়ে কিছুটা থমকে গ্যাছে বা আটকে আছে, আসলে কি তাই? সম্ভবত ‘রক মিউজিক’-এর এই পরিণতি বৈশ্বিক একটি ঘটনাই।
চিৎকার এবং হুড়োহুড়ির পর সমস্ত জীবিত প্রাণীই একটা সময় ক্লান্ত হইতে বাধ্য। (এই ক্লান্তি আর রক্তের ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর ঝোঁকে ‘ড্রাগস’ যেন সটান করে ঢুকে পড়ে ‘রক’-এর নিহিলিস্ট শূন্যতাকামী পালস-সিন্যাপ্সে … ‘অর্থহীন’ বাংলায় গায় ‘আমার শিরায় শিরায় গাঢ় অন্ধকার … ঘুমাবো আমি আলোর শেষে’)
পশ্চিমে-হলিউডে-এলেতে-ম্যারিকায়-বিলাতে উৎপাদন এবং ট্রেন্ডিং হওয়া বড় পুঁজির নতুন নতুন পপ এবং অল্ট-কাউন্টার কালচার এবং সেইসব কালচারের বাইপ্রোডাক্টের ভ্যারিয়েন্ট সিঙ্গাপুর-চিন-জাপান-বোম্বে-দিল্লি হয়ে এবং ডায়াসপোরা প্রবাসী ব্ল্যাক পিপল ও গ্লোবাল সাউথ এশিয়ান এথনিসিটি সচেতনতার অবদানে গ্যালো টুয়েন্টি-টেন-শন এর দশকে ইন্ডি রক, হিপহপ, লোফি মিউজিক, কে পপ এ-রকম নয়া নয়া চালান দেশের তরুণদের মাতায় রাখছে, ব্যস্ত রাখছে, তথাকথিত উন্নত বিশ্বের সাথে কানেক্টেড রাখছে। মানে ‘রক’ সম্ভবত পশ্চিমে তার সেই সত্তর দশক, নাইন্টিজের ক্রেজটা — টুয়েন্টি টেনের দশকের দিকে এসে তার ‘কুলনেস’-টা হারাইছে বা অন্য আরও নতুন নতুন ক্রেজ বাজারে আসছে।
মানে সময়ের পালসটা হয়ত অন্য জিনিসে মজা পায়া গ্যাছে। ‘বাংলা রক’-এর গ্লোরি তাতে খুব একটা কমে নাই। তার এখনো অনেককিছুই দেয়ার এবং আবিষ্কার করার আছে। শেষপর্যন্ত ‘বাংলা রক’ তো একটা অ্যাটিচ্যুডই যেটা মনে জখম লাগলেও সেইটাকে নিয়া হীনম্মন্যতায়/কষ্টে না থেকে প্যাশনেটলি বিষয়টা ডিল করার (কিছুটা রোমান্টিসিজম-আক্রান্ত) ‘তাড়না’ সম্প্রচার করে।
যা-ই হোক বাংলাদেশের রক আর পশ্চিমের রকের টাইমফ্রেম একটু আলাদা। নাইনটিজে যে সাউন্ড মুভমেন্টের উণ্মেষ ঐদিকে ঘটেছিল মেইনস্ট্রিম আর বাজারে বিকাইতে বিকাইতে তার রেশ এই বাংলার বন্দরে ভিড়তে এবং ট্রেন্ডিং হইতে বা বিস্তার করতে তাও তো বছর প্লাস-মাইনাস পাঁচের মতন লাগছে বা লাগত আগে। এখন তো আঙুলের ডগায় বিশ্ব (ইন্টারনেট) পরিস্থিতির কল্যাণে ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক গ্যাপ আর প্রভাবিত হওয়ার বাফারিং বা আত্মীকরণের মুহূর্তগুলির মধ্যে সময়ের ফারাক খুব-একটা নাই। আর উদারমনা সর্বদা প্রভাবিত হইতে প্রস্তুত ঢাকার-বাংলার মিডিলক্লাস, পেটি-উচ্চমধ্যবিত্ত কোমলমতি গ্লোবাল ইয়ুথরা কমবয়স্ককালে যে-কালচার এবং কালচারের বাইপ্রোডাক্ট-আইকন কনজিউম করে অভ্যস্ত (হয়) হইতেছে এখন ঐটার রেশই তো মনে-আচরণে কমবেশি বহন (করে) করতেছে/করতে থাকবে পরবর্তীতে, কমবেশি আমরা সবাই।
এখন যেমন হিপহপ মোর ট্রেন্ডিং। অবস্থাদৃষ্টে লিরিকে-সারবত্তায় মাঝেমাঝে মনে হয় যে এখন ‘রক’-এর চেয়ে ব্যবহারিক অর্থে হিপহপই বেশি ‘রকিং’ একটা চর্চা। যদিও একবাক্যে এভাবে বলাটা ঠিক হয় না সম্ভবত।
সে যা-ই হোক পেট এবং মন ভরা ভালোবাসা নিয়া নানান রকম (যদিও সংখ্যা বিচারে খুব-একটা বেশি নয়) বাংলা ও বাংলাদেশি রক শুনতে শুনতেই হঠাৎ একটা ঘটনা ঠাওর হইল যে এই যে আমাদের জোসিলা বাংলা রক এবং শিক্ষিত আধুনিক মিডিলক্লাস পেটিবুর্জোয়া বাংলাদেশি বাঙালির আরেক মনোরঞ্জন আধুনিক বাংলা গানের যে বাতাবরণ এর প্রায় অধিকাংশ গানবাজনাই সমাজের উৎকৃষ্ট প্রতিচ্ছবি হয়ে মোটাদাগে শুধুই যেন বাংলার দুর্ধর্ষ মিডিলক্লাস পুরুষদের আবেগ-যন্ত্রণা-মনোকামনা-কনফেশন ও বিভিন্ন ভাবাবেগ ধারণ করে আছে।
আমাদের এত প্রিয় এবং গর্বের বাংলা রক ব্যান্ডগুলির এই প্রায় পাঁচ দশকের গানবাজনার রেকর্ডে অধিকাংশ ট্র্যাকই পুরুষ বা ব্যাটাছেলের নানান রকম আবেগ-উচ্ছ্বাস-বর্ণনা-চাওয়া-না-পাওয়ারই সুরেলা হায়রোগ্লিফিক্স জার্নাল যেন। (তার মানে সব গানই একরোখা তা নিশ্চয়ই না, সুন্দর সুন্দর অনেক জেন্ডার-নিউট্রাল ভাবাবেগের রকিং গানও আছে)
আর আরেক উৎকৃষ্ট ঘটনা ‘আধুনিক বাংলা গান’ যে বহন করে রবীন্দ্র-নজরুল-বাবুকালচার-মিডিলক্লাসের বিকাশ-পরম্পরা — সেখানেও এই পরিস্থিতির খুব একটা বিচ্যুতি বোধ করি নাই, তাই না?
ব্যান্ডের গানে বা ‘রক মিউজিক’-এ ব্যাটাছেলেপ্রধান গান বেশি হওয়ার কারণসমূহ বোধ করি খালি চোখেই নির্ণয় করা যায়। যেখানে তিন-চারটা ব্যতিক্রম বাদে ছুপা ভিক্টোরিয়ান মোরালিটির ধারক ও বাহক শিক্ষিত রক্ষণশীল ধর্মপ্রাণ মিডিলক্লাস সমাজবর্গে শখের বাইরে সিরিয়াসলি মিউিজিক করাটাই একটা বৈষয়িক কারণে না-খোশ ব্যাপার, সেখানে ‘রক মিউজিক’-এর মতো ‘ফালতু অপসংস্কৃতি’-র চর্চা করতে ব্যাটাছেলেদেরই সমাজের ভ্রুকুটি সহ্য করে যাইতে হইছে একটা সময় পর্যন্ত সেইখানে মেয়েলোকের পার্টিসিপেশন খোঁজাটা ঠিক হবে না।
ভদ্রলোকের মেয়েরা পরিপাটি নম্র-ভদ্রস্থ হয়ে মঞ্চে উঠে/বসে হারমোনিয়াম বাজায়ে গান গাইতে পারে এতটুকু অন্তত ধার/আমদানি করা ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর বরাতে মেনে নেয়া যাইতে পারে ঠিকাছে কিন্তু বারোয়ারি লোকের সামনে গিয়া শরীর দুলায়া ড্রামস-লিড বাজানো এগুলি ত আসলে ভাবাই যায় না। আর ইন্সট্রুমেন্ট বাজানোর মধ্যেও সম্ভবত একটা জেন্ডার-পলিটিকসের হাত আছে। শুনছি যে স্বয়ং রবিশঙ্করের সাথে বিয়ের পর উনার প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী (উনিও দুর্দান্ত সেতার বাজাইতেন, মায়েস্ত্রো ছিলেন উনি অ্যান্ড জেনে ভালো লাগে যে চৌরাসিয়া উনার ছাত্র ছিলেন) ইগো ক্ল্যাশের কারণে উনি আর কখনো বাসার বাইরে বাজান নাই। উনার শিষ্যরা ছাড়া বাকি জীবন আর কেউ উনার বাজানো শোনেন নাই।
অধিকাংশ রকগানগুলি ছেলেমানুষরাই লিখছেন, সমাজব্যবস্থার পাওয়ারস্ট্রাকচারে ‘নারী-পুরুষ’ যেভাবে বিলং করে ঐটা নিয়ে তেমন একটা প্রশ্ন তোলেন নাই, স্বাধীনতা-হ্যাডম যার বেশি সে কোনোকিছু কামনা করলে, প্রেমে পড়লে, একবার প্রেমিকাকে বা যার প্রতি দুর্বলতা উনাকে মনে মনে শতবার ভেঙেচুরে সরলতার প্রতিমা বানায়ে, (কারো জন্য প্রেম হইলে প্রথম প্রথম মনে মনে এ-রকম করাটা/ফিল-হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ত) আরেকবার বিশালতার উপমা বলে ডেকে এরপর কল্পনা আর বাস্তবের ফারাকটা খোলাসা হইতে শুরু করলে ‘রয়েছ তুমি বহু দূরে আমাকে রেখে ছলনায়’ দোষী সাব্যস্ত করা আরকি। হা হা। এ-রকম গানের বিপরীতে নারীর বা মেয়েলোকের প্রেমিকার রোল ব্যতীত সামাজিকভাবে সবচেয়ে চেরিশড গতানুগতিক মাতৃত্ব নিয়ে কিছু গান আছে সম্ভবত।
আর সমাজ-রাষ্ট্রের পরিস্থিতে মেয়েলোকের নড়বড়ে অবস্থান নিয়েও কিছু ইন্টারেস্টিং ট্র্যাক আছে। যেমন — এলআরবির ‘নষ্ট নারী’ গানে একজন বারবণিতাকে সমাজ কীভাবে দেখে ঐটার বর্ণনা দেয়া আছে, আবার ফিডব্যাকের ‘মেলা’-তে বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনারা যে হ্যারাসড হয় ঐটার নির্লিপ্ত উচ্চারণ শোনা যায়, জেমসের ‘সেলাই দিদিমণি’ নামে একটা গান আছে, দলছুটের ‘আহ্ ইয়াসমিন’, শেখ সাহেদের সম্ভবত ‘রক্তজবা’ নামে একটা গান আছে। খুঁজলে এ-রকম আরও কিছু গান শোনা যাবে নিশ্চয়ই। তবে সংখ্যায় তেমন একটা বেশি হবে না বোধহয়। ‘সচেতন বুদ্ধিজীবী’ ঘরানার ব্যান্ড ‘লীলা’-র ‘দুপুরবেলায় মুরগি রাইন্ধো না’-তে সম্ভবত নারী-পুরুষের টিপিক্যাল ভূমিকাগুলিকে অন্যভাবে ভেবে দেখার একটা তলব সুরে সুরে করেছেন উনারা। গানটা সুন্দর আছে কিন্তু ‘মুরগি’ তথা ‘মাংস’ তথা ‘কাম’ (অথবা ‘এসট্যাবলিশমেন্ট’ কি?) আর ‘বৈরাগ্য’-কে আলাদা করে দেখার একটা শুদ্ধবাদের মোটিফ কি গানটায় আছে? জানি না। কিন্তু দুপুরবেলায় মুরগি না-রান্ধতে যে আপাত হিতৈষীকর রিকোয়েস্ট এবং তার যা ভালো লাগে না ঐটা মাইনা নেয়ার বিনীত নিবেদন যে জানাচ্ছে নইলে সংসারটা ‘স্বপনসংসার’ আর হইতে পারতেছে না সেটার মধ্যে চিকন একটা হেডমগিরির দেমাগ কি অবচেতনভাবে নাই? মানে যার যেইটা ভাল্লাগে না ঐ ইস্যুটাকে ভালোবাসা দিয়ে অতিক্রম করতে পারলেই ত একজন আরেকজনের মাঝে ঝিরঝিরিয়ে বয়ে যাওয়াটা হয়ত কবুল হয় আরকি। জানি না যদিও, হু নোউজ! বেচারি ‘ইয়াসমিন’-কে নিয়ে এদেরও একটা গান আছে।
মেয়েলোকের প্রেম সংক্রান্ত অপরাধ বা বিট্রেমূলক গানগুলির বাইরে এ-রকম দু/একটা গান থাকলেও তাতে বর্ণনাকারী বা কর্তা একজন ছেলেই। সে লিরিকে নিজের সুবিধাজনক জায়গা থেকেই এগুলি অবলোকন এবং বর্ণনা করে নিজের একটা আদর্শগত স্ট্যান্ড তৈরি করার চেষ্টা করে হয়ত। কিন্তু প্রজাপতির অন্য ডানার খবর মানে যে-মেয়েলোকদের অবস্থা বর্ণনা করে গানগুলি গাওয়া হইল সেখানে তার নিজের কথাটা, দৃষ্টিভঙ্গিটা ত আর শোনা হয়ে ওঠে না শেষমেশ, তাই না?
ব্যান্ড ‘শূন্য’-র ‘বেহুলা’ গানে তো মেয়ে-মরদের ঐ ত্যাগের মহিমা তিতিক্ষাকেই গ্লোরিফাই করে ‘দেখাইছে’ মনে হয়। মানে এমপাওয়ার্ড ‘নারী’ বিষয়টাকে গতানুগতিক সামাজিক লিটমাস টেস্টের ভালো-মন্দের ভেতর দিয়েই এ-প্লাস পাইতে হইল যেন। তবে ‘শূন্য’ বা ‘লীলা’ উনাদের ‘নিয়ৎ’ নিশ্চয়ই ‘ভালো’। এ নিয়া আর সন্দেহের যোগব্যায়াম না করি।
‘রক’ জনরার চেয়ে আধুনিক বাংলা গানের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ-রকম পুরুষদৃষ্টিভঙ্গির জমিন থেকে বদান্যতা করে এবং ধন্যবাদ-জ্ঞাপনমূলক মা ও মাতৃ্ত্বের মহান (পবিত্র) ত্যাগ-তিতিক্ষার সুললিত বর্ণনার গান অনেক বেশি করে আছে বোধহয়।
আর প্রেম সংক্রান্ত বিভিন্ন স্টেইজের গানে প্রেমিকার নামে শপথ, প্রেম হইলে নানা রকম কুসুমিত শব্দমঞ্জুরি ও ভাবাবেগ, প্রেমে ব্যর্থ হলে, বিরহ আসলে, ছ্যাক খাইলে তখন আবার নিজে নিজেই মনের আদালতে কোর্টমার্শাল বসায়ে ‘অপরাধী’ বানায় দেয়ার একপাক্ষিক গতানুগতিক প্রচার-প্রচারণা।
বাংলাদেশের ‘আধুনিক বাংলা গান’-এর শ্রদ্ধেয় ফিমেইল আর্টিস্টদের কথা আসলে শাহনাজ রহমতুল্লাহ্, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, নীলুফার ইয়াসমিন, পিলু মমতাজ, আঞ্জুমান আরা বেগম, শাকিলা জাফর, শাম্মী আখতার, আবিদা সুলতানা, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী প্রমুখ উনাদের নাম নিতে হয়। উনাদের পরে আরও অনেকেই আছেন।
পিলু মমতাজ, সাবা তানি, সুমনা হক, মেহরীন (উনি এবং কয়েকজন মিলে অল ফিমেইল একটা ব্যান্ড করছিলেন একবার শুনছিলাম), বেবি নাজনীন, মিলা, আলিফ আলাউদ্দীন, এলিটা করিম, ন্যান্সি, তিশমা প্রমুখ উনারা কমবেশি ‘পপ’ ঘরানার ‘আধুনিক বাংলা’ করছেন বা করেন।
এছাড়া গুণী কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতির সম্মানীয় এবং প্রিয় ফিমেইল আর্টিস্ট উনারা তো আছেনই। লালনগীতির ফরিদা পারভীন আছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের ‘আধুনিক বাংলা গান’ বা ‘পপ’ ঘরানার অধিকাংশ গানে — গানগুলির শ্রদ্ধেয় ফিমেইল আর্টিস্টরা গাইছেন বলে মানে গান+ফিমেইল-আর্টিস্ট এই দুই ভ্যারিয়েবল মিলে ফিমেইল ন্যারেটিভ হয় যেন। মেইল আর্টিস্টদের প্রচুরসংখ্যক গানে মেইল জ্বালাযন্ত্রণার কথা যেভাবে এক্সপ্লিসিটলি স্পষ্ট কথাতে আসে বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষিত মিডিলক্লাস ঘরানার ফিমেইল আর্টিস্টদের গানে এইটা একেবারে কম বা অন্যরকম (ভাবে আছে) মনে হয় আমার কাছে। হইতে পারে যে ছেলেরা যেভাবে নিজেদের প্রকাশ করে, তাদের সামাজিক ডমিনেন্সি, ঐতিহাসিক স্বাধীনতার কারণে লিরিকে তার প্রতিফলন ঘটে।
আর ছেলেদের থেকে মেয়েদের আবেগ এক্সপ্রেশনের ওয়েটা সম্ভবত কিছুটা অন্যরকম (শ্রেণীবিচারেও অন্যরকম)। ঐটার রেশ গানেও পড়ে। মোটা দাগে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজকাঠামো পারিবারিক সেটিং-এ মেয়েরা ত অবনত-বাধ্যগত-নিচু গলার কোমল সাবমেসিভ চরিত্রই। এক্সপ্লিসিটলি নিজের ভাবাবেগকে প্রকাশ করার একটা ওপেন স্পেস সম্ভবত বাংলার নারীদের সোশ্যাল মিডিয়া যুগের আগে খুব-একটা বেশি ছিল না। উঁচু স্বরে কথা না বলার সামাজিক ও ধর্মীয় ছবক এবং অর্থনৈতিকভাবেও মাইনোরিটি হওয়ার কারণে আলঙ্কারিক ও প্রতীকী ভদ্রশোভন ভাষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ‘আধুনিক বাংলা গান’-এর ফিমেইল ন্যারেটিভের গানগুলি হইছে। সেখানে খুবই ভদ্র এবং মাপা কথার লিরিকে যেন ‘বুকভরা নীরবতা’ আর ‘তটিনীর মৃদ্য ছন্দ’-কে সাথি করে নিয়ে ‘অনেক কথাই যাই গো বলে কোনো কথা না বলে’-র চালে নিজেদের মনোবেদনা-সিচুয়েশনগুলির লিরিক্যাল প্রজেকশন ঘটছে।
মেয়েলোকের প্রেম রসালো গসিপের জিনিশ হইতে পারে কিন্তু মেয়েমানুষের অবাধ প্রেম-যৌনতা মিডিলক্লাসের কাছে লজ্জা‘জনক’-রাখঢাকের ব্যাপার এখনো। তাই গানের কথাতেও সোজাসাপ্টা-স্ট্রেইটকাট হওয়াটা হয়ত অবচেতনভাবেই ঘটে নাই। আরেকটা বিষয় হইছে যে ফিমেইল গীতিকার বোধহয় বেশ কম এবং ফিমেইল মেন্টালিটির প্রজেকশন থাকতে পারে এ-রকম গানের তেমন চাহিদা-বাজার-সমাজ নাই/ছিল না বা মার্কেট ছোট বলে প্রোডিউসাররা টাকা খাটান নাই সম্ভবত?
আমার শোনা সবচেয়ে কড়া এবং দুর্দান্ত ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর আত্মসম্মানঅলা বাংলা গানটা কোনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা কালচারাল এলিটের করা গান না, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরানার ফিমেইল আর্টিস্টেরও না। গানটা করছেন কিন্তু সমাজ-অর্থনীতির (ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে) প্রান্তে থাকা একজন কাঙ্গাল — একজন ‘বাউল’, একজন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। পরানের বন্ধুকে ডাক দিয়ে যে ঐতিহাসিক মনোবেদনা-বঞ্চনার মর্মগাথা উনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাইছেন তার ধারেকাছের কোনো স্পষ্ট ভাষায় ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর বাংলা গান বা শিক্ষিত মিডিলক্লাসের বাংলা গান আমি শুনি নাই। হয়ত আছে কিন্তু শুনি নাই।
মমতাজ যেভাবে ‘বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া’, ‘নান্টু ঘটকের কথা’ … গাইতে পারেন বা শেফালি ঘোষ বা ‘বাংলা লোকগান’-এর আঁচলের নিচে এবং শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের কালচারের গানে এত এত স্পষ্ট ও জোরালো অ্যান্ড স্বতঃস্ফূর্ত ভাষার ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’ বা চরিত্র-ভাবের গান যে আছে সেইটার তুলনায় শিক্ষিত মিডিলক্লাসের গানে বা মধ্যবিত্ত কালচারাল এলিটবর্গের অ্যারেনার ফিমেইল আর্টিস্টদের গানে ব্যাপারটা এতটা স্পষ্টভাবে নাই। থাকলেও তা রেটরিক্যাল ভাষায়।
তো এখান থেকেই এই ফারাকের বিষয়টা মনে হইছিল আরকি।
বিদেশে মানে আমেরিকার কথা যদি ধরতে হয় তো আমেরিকান ওয়ার্কিং মিডিলক্লাসের ইতিহাসটা বা দূর থেকে ইউরোপের ইতিহাসটা অন্যরকম। তাই হয়ত আমেরিকান বা শিল্পায়নের অবদানে মোর বিকশিত অর্থনীতিঅলা রাষ্ট্রের মহিলারা ইকোনমিক যে ফৃডমটা অর্জন করতে পারছিলেন বা যেসব সামাজিক-বুদ্ধিবৃত্তিক মুভমেন্টগুলি হইছে তার প্রেক্ষিতে একটা ফিমেইল ন্যারেটিভ হয়ত ধীরে ধীরে সর্বস্তরে স্পেস পাইছে। ফিমেইল আর্টিস্টরা স্পষ্ট ভাষায় ফিমেইল ন্যারেটিভের গান গাইছেন/গাইতে পারার বাস্তবতা তৈরি (হয়ে)ছিল। মেইনস্ট্রিম মানে হলিউড যদিও সবসময় মেইল গেজে চলে কিন্তু সোশ্যাল মুভমেন্টেরও একটা ব্যবসায়িক প্রতিক্রিয়া থাকে সম্ভবত, জেনারেশনের মাইন্ডসেট বদলায় আর যেহেতু বাজারটা বড় সেই কারণে হলিউডে বা ইংরেজি আর্টকালচারে গানে ব্রিটনি-ম্যাডোনারা পর্যন্ত ফিমেইল ন্যারেটিভের গান গাইতে পারছে/পারে।
‘সাবকনশাস’ নামের ব্যান্ডের একটা চমকপ্রদ ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর স্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড ভাষায় একটা গান আছে। ন্যান্সি, মিলা, মেহরীন প্রমুখ পপ ঘরানার আর্টিস্টদের কিছু স্পষ্ট ভাষায় ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’ গান আছে। উনাদের বাইরে সায়ান, কৃষ্ণকলি উনারা যেহেতু নিজেরা গান লিখেন, গান — উনাদের গানগুলিতে তাদের যাপন ও অভিজ্ঞতা থেকে গাওয়া সমাজ-রাজনীতি এবং জীবজগৎ ও মানবজগৎ নিয়ে চমৎকার ‘ফিমেইল দৃষ্টভঙ্গি’-র ইনসাইট আছে/পাওয়া যাবে অবশ্যই। কিছুদিন আগে সায়ান — উনার ‘ফরজ আদায়’ নামে মজার একটা গান শোনা হইছে। গানে কন্যাদায়গ্রস্ত এক পিতার করুণ অবস্থাটাকে স্যাটায়ার করে মজার ছলে গাইছেন সম্ভবত উনি। কৃষ্ণকলি ইসলামের ‘হাঁটতে হাঁটতে একা নুড়ি’ গানে ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বা এন্টিটির দুনিয়ার এই বিশদ জগৎসংসারের বাঁকগুলিকে অবাক চোখে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়া নিজের আইডেন্টিটিকে আবিষ্কার করার/জানান দেয়ার একটা সুন্দর-প্রফুল্ল চিত্তের ঘটনা আছে সম্ভবত।
বাঙলাদেশে মানে ঢাকায় এফএম রেডিও বিকাশের মনোহরী সময়টাতে ‘প্রজাপতিটা যখন তখন’ (‘ঝালমুড়ি ১’ মিক্সড অ্যালবাম) গানটা মনে হয় আমরা অনেকেই শুনেছি। অসংখ্যবার বাজানো শ্রোতাপ্রিয় একটা ট্র্যাক। আবিদা সুলতানা নামে একজন গানটি গেয়েছেন। লিরিকও সম্ভবত উনার। উনার আর কোনো গান পরে আর শোনা হয় নাই। গানটার মধ্যে হাইপার যান্ত্রিক শহুরেপনা আর পিচগলা রোদ্দুর অ্যান্ড পোড়া ডিজেলের আজন্ম আশ্বাস থেকে কিছুক্ষণের জন্য পরিত্রাণ নেয়ার একটা মুভ/ফিল অনেকের কানের ভেতর বেজে উঠে রেশ রেখে যায় মনে হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশের ইকোসিস্টেমের মধ্যে নিজেকে ছড়ায় দেয়ার যে একটা রিলিফ বা অনেক ঘেও ঘেও রোদের পাশে একটা সবুজ পুকুরের নৈসর্গ (কল্পনায়-স্মৃতিচারণে বা বাস্তবে) যে কয়েকড্রপ শ্যামল স্বোয়াস্তি দেয় ঐটা আরকি। গানটার মধ্যে একটা প্যাগান আশ্লেষ আছে যেটা প্রকৃতি ও নারীময়তার একটা শেইডের মেজাজ এবং গুণকে ইশারায় জানান দেয় মনে হয়।
তো বাঙলাদেশের ‘আধুনিক বাংলা গান’ বা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পপুলার গানের বর্গে সরাসরি মোর স্পষ্ট ভাষার ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর গান সংখ্যাবিচারে কম হইলেও আমার ধারণা অধিকাংশ ভালো/দক্ষ/শ্রোতাপ্রিয় ফিমেইল আর্টিস্টদের অনেক গানেই বাংলার নারীবর্গ যে সমাজে বা প্রেমে কমবেশি ‘অধীনস্ত’ বা অনেক সময়ই ‘বঞ্চিত’ — এই বিষয়টা গানের কথার মধ্যে রেটরিক্যালি লেয়ারড হয়ে থাকে এবং যতটা সম্ভব বিনয়ী এবং সাবমেসিভ সুরে তা গাওয়া হয়। বা আরও অ্যাকাডেমিক সুরে হয়ত বলা যায় যে সমাজে নারী-পুরুষের ‘পাওয়ার পজিশন’ তাদের গানের ভাষা বা আবেগ প্রকাশের ওয়ে/ভাষার উপর স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা বিস্তার করে (থাকে)।
শহুরে শিক্ষিত আধুনিক বাঙলাদেশি মিডিলক্লাসের গানবাজনার আলাপে বেশ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা যাদের এড়িয়ে যাওয়া মনে হয় যায় না — তারা হচ্ছেন ‘সিনেমার গান’ এবং অবশ্যই ‘রবীন্দ্র-নজরুল’। বাঙলাদেশের কালচারাল এলিটদের ড্রইংরুমে চা-কফির সাথে রবীন্দ্র-নজরুল এবং এক-ধরনের ‘ফোক’ নাস্তা হিসেবে পছন্দের চয়েজ হিসেবে এককালে ত অবশ্যই ছিলই; সম্ভবত ‘ছিল’ না — এখনো আছে।
শহুরে-শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের আধুনিক মিডিলক্লাস হওয়ার (সাংস্কৃতিক) বিকাশের পরিক্রমায় ‘রবীন্দ্র-নজরুল’ ত খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই। ‘রাবীন্দ্রিকতা’ ও কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি আধুনিকতার পাশে সোনালি আঁশ পাটের বাণিজ্য বিস্তারের পুঁজি পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি মুসলমানের সোনার বাংলার পালে যে হাওয়া লাগায় — সেই হাওয়াতে দেশীয় জোতদার-কৃষকদের মধ্যে যে একটা পয়সাঅলা-স্বচ্ছল পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান শ্রেণীর বিকাশ ঘটে যারা সম্ভবত বাঙলাদেশের শহুরে-শিক্ষিত জাতীয়তাবাদী আধুনিক মিডিলক্লাসের কালচারাল আদি পুরুষ — সেখানে পরিচয়-শ্রেণী ও কালচারাল সচেতনায় এবং আত্মপরিচয় বিনির্মাণে কলকাতাকেন্দ্রিক রাবীন্দ্রিকতা নিয়ে একটা টেনশন বা ক্ল্যাশ বা অ্যাকাডেমিক ভাষায় যাকে সম্ভবত ‘কালচারাল হেজেমনি’ বলে তাকে মেনে নেয়া না-নেয়া বা তার কাউন্টার/বিকল্প পরিকল্পনায় প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী আধুনিক বাঙালি মুসলমান মিডিলক্লাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিকুজি হয়ত।
কিন্তু ‘রবীন্দ্র-নজরুল’ দুনোজনেতেই ‘নারী’ (বা নারী কখনো ব্যক্তি বা ফোর্স বা স্পিরিচ্যুয়াল ‘প্রাকৃত’ আইডেন্টিটি হিসেবে) যেভাবে সেলিব্রেটেড ঐ ‘ভাব’-ভালোবাসা-ভক্তি-ট্রিটমেন্টটা পরের দিকে এসে বাঙলাদেশের উঠতি শিক্ষিত আধুনিক মিডিলক্লাসের কালেক্টিভ ‘আধুনিক বাংলা গান’ বা আন্তরিকভাবে বাজারের পার্পাস সার্ভ করা পপুলার গানবাজনার ধারায় তেমন আর ‘অ্যাফোর্ডেবল’ হয় নাই, কানেক্টিং থাকে নাই বা — সমাজ-অর্থনীতি এবং জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অস্থির পালাবদলের সাথে সাথে ‘রবীন্দ্র-নজরুল’ শুধু একরকম কালচারাল এলিট উপাদান বা এক-রকমের জাতে-ওঠা সাংস্কৃতিক ক্যাপিটাল হিসেবে প্রাসঙ্গিক আছে। এর বাইরে দেশের শিক্ষিত মিডিলক্লাসের পপুলার গানবাজনার লাইনে বা (পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মিডিলক্লাসের কালেক্টিভ মনস্তত্ব-আবেগ-জীবনযাপনে) তেমন রিলেটেবল ইনফ্লুয়েন্সিয়াল কোনো ঘটনা আর না, তাই কি?
রবীন্দ্রনাথের অনেক গান এবং গানের জেন্ডার সম্বোধন বর্তমানের প্রেক্ষিতে অ্যান্ড্রোজেনাস। বাইনারি নারী-পুরুষ বা যে-কোনো লৈঙ্গিক পরিচয়ের লোকেরাই সুরে সুরে ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়’ এটা জিগাইতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু’-র কথা আবার মনে পড়ে। আজম খান ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু’-র উপর কাউকে বাঁচানো/না-বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে অভিযোগ রাখেন নাই বা কাউকে বাঁচানো/না-বাঁচানোর দায়িত্বও আসলে ‘সালেকা-মালেকা-ফুলবানু’ উনাদের না বরং ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে — সখী যাতনা কাহারে বলে’-তে ‘সখী’-কে যে-কারণে সাক্ষী রেখে মনের কথাবিহ্বল দুরবস্থা শেয়ার করা (মানে মনের কথা যার কাছে খুলে বলা যায়) ‘সালেকা-মালেকা-ফুলবানু’ উনাদেরকে ডাক দেয়ার কারণও কি ঐরকম না যে উনাদের সাথে ‘বিষয়’-টা শেয়ার করলে উনারা কিছুটা হইলেও হয়ত মনের জ্বালা-যন্ত্রণাগুলাকে ‘এমপ্যাথি’ সহকারে ট্রিট করলেও করতে পারেন বা অভিযোগ নয় ‘উনারা’ আসলে শুধু মিডিয়ামই। উনাদের শোনানোর ভনিতায় অন্যদেরকে জানানো? হা হা — অনেক কষ্টকল্পনা হইল কি?
এদিকে আমাদের প্রিয় দুখু মিয়া — পূর্ববঙ্গের জাতীয় কবি কে. এন. ইসলামের গান একেবারেই তেমন শোনা হয় নাই যদিও, তবু দুখানি গানের কথা মনে হইল — ‘চাঁপা এনে দাও, নয় বাঁধব না চুল’ মানে ‘বেলফুল এনে দাও চাই না বকুল, চাই না হেনা, আনো আমের মুকুল’ আর ‘জাগো মাতা-কন্যা-বধূ-জায়া-ভগ্নী, জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’-র কথা মনে হলো।
‘রবীন্দ্র-নজরুল’ — উনাদের গান তো আর উনাদের সাহিত্য-শিল্পের ভাব-দর্শনের বাইরে না তাই উনাদের (গানে) ‘নারী’ বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা-ট্রিটমেন্টটা বাংলাদেশের শিক্ষিত লোকের পপকালচারে তেমন আর ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ফোর্স না, এমন কথা বলা যায় কি না?
‘রবীন্দ্র-নজরুল’-এর পাশাপাশি লালন এবং কিছু সিলেক্টিভ ‘লোকসংগীত’ আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং কালচারাল এলিটদের মধ্যে সচেতনতা এবং দরদ দিয়ে চর্চা হয় সম্ভবত। যার অবদান হচ্ছে ‘বাংলা-আনুশেহ্’ এবং এ-রকম অনেকগুলি ‘ফোক ফিউশন’ বা রিমিক্স প্রজেক্ট। এইটা ভালো না খারাপ, ‘হয় নাকি হয় না’ বা কতটুক অথেনটিক হইতে পারল … সেটা না — বরং এই যে ‘লোকসংগীত’ (লোকাল ফর্মের দিকে) এর দিকে ‘কনশাস’ হয়ে ফিরে দেখা (ফিরতে হইল কেন?) এবং গ্রামগঞ্জের আঞ্চলিক গানটানগুলিকে জীবন-যাপন-ভাব-দর্শনের বাইরে কেবল ‘ফোক পারফমেন্স’ বানায় ফেলা এতে বাংলার ‘লোকগান’-এ মেয়েমানুষ বিষয়ক যে ভাব-ট্রিটমেন্ট ঐটাকে কি খেয়াল-নজরে নিয়া এই ‘ফোক ফিউশন’-গুলি চলমান নাকি শুধু ‘ভঙ্গিমা’ আর ‘সুর’-টুকু নেয়া?
‘লোকগান’-এ ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’ নিয়ে ‘ফোক ফিউশন’-করাদের মধ্যে অনেকেই এই ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’ টাইপ বিষয়টা নিয়ে কনশাস নিশ্চয়ই। কারণ আ কাডেমিক পড়াশোনার লাইনে নারী, জেন্ডার, নৃতত্ত্ব, ফোকলোর, আঞ্চলিক কালচার-বৈচিত্র্য, লোকাল মোটিফ … এগুলা রিডিসকভার এবং উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজবাস্তবতা নিয়ে লেখাপড়া, গবেষণা শিক্ষিত পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত এবং কালচারাল এলিটদের প্রাণের এবং দরকারি জিনিস।
যা-ই হোক সিনেমা এবং ‘সিনেমার গান’ও আধুনিক শিক্ষিত মিডিলক্লাস, গরিব ওয়ার্কিং ক্লাস, গ্রামগঞ্জের লোক, মানে শ্রেণী-রুচি এবং ফিমেইল ন্যারেটিভ এই বিষয়-আশয়ের সাথে জড়িত ও লেপ্টে থাকা একটা ফোর্স বলেই মনে হয়।
কিন্তু সিনেমাতে যেহেতু কাহিনির প্রয়োজনে নায়ক-নায়িকা দুনোজনেরই আবেগ-আখ্যান কিছু-না-কিছু পরিমাণে থাকে সেখানে নায়কের পাশাপাশি নায়িকার বা এক-ধরনের ফিমেইল ন্যারেটিভও থাকে। কিন্তু ‘কিভাবে’ থাকে তা তলিয়ে দেখা যায়।
অধিকাংশ ছবিতে নায়ক যেভাবে সুপারম্যানগিরি করে বেড়ায় ঐটার প্রেক্ষিতে নারী বা নায়িকাদের গানগুলির ভাষা এবং কথার রেটরিক্যাল ইঙ্গিতে সমাজে ছেলেরাই নায়ক এবং নানা রূপে সাধারণত যেমন ‘উদ্ধারকর্তা’ অ্যান্ড বেশি পাওয়ারফুল, সেই মনস্তত্ত্বের/দৃষ্টিভঙ্গির পুরুষ-ইগোকে তৃপ্তি দেবার টোপের মধ্য থেকেই গতানুগতিক পাওয়ার ডাইনামিক্স বা বড়-ছোটর ‘সিম্বলিক অর্ডার’-ই কী নায়িকাদের গানে বেশি দেখানো হয় কি না এইটাও জায়গা মতো খতিয়ে দেখার বিষয় মনে হয়।
যদিও মেয়েরা যে কথা দিয়েও আসে না, ফাঁকি দেয় এই চির-অমলিন অভিযোগের একটা উচিত কথার কাউন্টার ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ সিনেমার গ্রামীণ প্রান্তিক নারী বেদেনি জোসনাই দেয় যে — কাজের সময় তারে ডাকাডাকি করলে বা ফ্যামিলিরে ম্যানেজ করতে তার যে প্যারা নিতে হয় ঐটা তুমি যতই রাজার ছেলে হও, পোংটা প্রেমিক হও বুঝতে পারো না ক্যানো?
এদিকে ‘রংবাজ’ ছবিতে আমাদের প্রিয় লাস্যময়ী কবরী অভিনীত বস্তির মেয়ে মালা চরিত্রটি যে তার দয়িতের জন্য মালা গেঁথে শিডিউলড টাইমেই অপেক্ষারত — অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তার আনচান করা মন মিষ্টি অভিমান নিয়েই একটু কৌশলী হতে চেয়ে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গেয়ে ওঠে যে ‘এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাব … ভালোবাসা কারে কয় তারে শেখাব’
কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে তার অসহায়ের জায়গাটা সম্ভবত স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পায় যখন সে প্রথমে ডানাঅলা পতঙ্গ প্রজাপতিকে উড়ে গিয়ে নায়ককে মনে করায় দিতে বলে যে ‘আমি নই তার হাতের খেলনা’ এবং পরে যেন আরেকটু কম আত্মবিশ্বাসী সে পাখির ঠোঁটে কথা তুলে দিয়ে বলে যে ‘যা রে পাখি তারে গিয়ে বল না / আমি কী এমনতর খেলনা?’
এই অ্যাক্টটা (পরম-আত্মা) কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা রাধারমনের বিরহিনী (জীব-আত্মা) রাধা যমুনার পাড়ে ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ টেলিযোগাযোগব্যবস্থায় তার করুণ অবস্থার কথা জানায়া শ্রীকৃষ্ণকে বার্তা প্রেরণের আর্কিটাইপটা মনে করায় দেয়।
প্রজাপতি, ভ্রমর, পাখি — প্রাণ-প্রকৃতির এই ডানাঅলারা ইকোসিস্টেমের চক্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মানুষের ইগোর কাছে পলকা পোষমানা মাইনরিটি যেন। পরিস্থিতি মোতাবেক নারী চরিত্রদের সাথে এদের যোগসাজশ তুলনামূলকে একটু বেশিই। নারী এবং পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতির কোমল দশাকে বা মাতৃ্ত্ব ধারণার সমার্থক স্পিরিট হিসেবে ভাবার প্রবণতা থেকেই এরকমটা আমরা করি হয়ত। এর পেছনে সহজিয়া-প্যাগান ভাবধারার ব্যাকড্রপও থাকতে পারে। কিন্তু প্রকৃতিকে বিনষ্ট-নিয়ন্ত্রণ করার যে পুঁজিবাদী পুরুষপ্রধান সিস্টেমের মধ্যে আমরা থাকি সেখানে এই নারী-ফুল-পাখি-লতা-পাতা-প্রজাপতি এই ধরনের বিষয়গুলিকে অবচেতনভাবেই ‘অধস্তন উপাদান’ হিসেবেই বেশি করে সিনেমার গানগুলিতে ট্রিট করা হইত/হয়ে থাকে কি না?
যদিও গেল-শতকের নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে (সম্ভবত) বাংলার শিক্ষিত মিডিলক্লাস সাপ্তাহিক বিনোদনের খোরাক হিসেবে সিনেমাহলে যাওয়া ছেড়ে দিছে। এর পরের কয়েক দশক সিনেমা হলগুলির নিয়মিত দর্শক হিসেবে শ্রমজীবী নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং গঞ্জের পুরুষেরাই ঢাকাই সিনেমার প্রাণ ছিল সম্ভবত। সেইসব ছবির গানের কথা ও দৃশ্যায়নে স্বাভাবিকভাবেই (বলিউড এবং তামিল ছবির অনুকরণপ্রবণ) ‘মেইল গেইজ’ এবং পুরুষপ্রধান চরিত্রদের চাওয়া-পাওয়ার চোখ ও মনকামনা এবং ভাষার রাজনীতি দিয়েই নারীচরিত্ররা তাদের ‘তুমি-কবি-আমি-কবিতা’-সুলভ গানগুলি কমবেশি গাইছেন বা এ-রকম প্রবণতার গানই বেশি হইছে। যেহেতু নানা বয়সের অতৃপ্ত পুরুষেরাই মূল ভোক্তা। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
‘বস্তির রানী সুরাইয়া’ মুভিতে ‘কী সুন্দর মাশাআল্লাহ্ তুই যেন হায় রসগোল্লা / ইচ্ছা করে এখন তরে গপগপ কইরা খাই … কী সুন্দর মাশাআল্লাহ্ তুই যেন হায় কোকাকোলা / ইচ্ছা করে এখন তরে ঢকঢক কইরা খাই’ গানে এবং গানের দৃশ্যায়নে ফিমেইল চরিত্রের মনোবাসনার একটা উদ্দাম প্রজেকশন আছে ঠিকই তবে পুরুষ কান/কামকে সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টাটাই তাতে বেশি মনে হয় (যেমনটা অধিকাংশ সিনেমার ‘আইটেমগান’-গুলিতে হয়)।
সিনেমার সাথে মূলধারার পাবলিক টেস্ট বা জনসাধারণের মনস্তত্বের একটা কালচারাল সম্পর্ক তো আছেই। যদিও তা হয়ত মোটাদাগে এবং ‘শ্রেণীরুচি’-র বিষয়টা আরও তলিয়ে দেখার ব্যাপার। তবে এই ‘মাস পিপল’ প্রসঙ্গে যে-বিষয়টা মনে হয় চলে আসে তা হইতেছে — মোটাদাগে জনসংস্কৃতি বা পপুলার কালচারে মেয়েদেরকে কীভাবে দেখানো হয়/হইতে থাকে তার পেছনে (সমাজের পাওয়ারডাইনামিক্স-মূল্যবোধ এবং) নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক পজিশন-বৈষম্যের পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে বা রাষ্ট্রের জাতীয় মূলধারার ইতিহাসের বয়ানে মেয়েলোকের পজিশনকে কীভাবে পোর্ট্রে করা হয় ঐটাও হয়ত পেছনে পেছনে কাজ করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে শহুরে বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণী ও তাদের সহযোগী হিসেবে পেটিবুর্জোয়া মিডিলক্লাসকেই ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারায় গেইনার হইতে দেখা গ্যাছে। জাতীয় ইতিহাসটা এনারাই লিখেন। তো সেইখানে নারীকে কীভাবে সাপোর্টিং রোলে কাস্ট করা হয় (প্রধানমন্ত্রীরা নারী হওয়া সত্ত্বেও) সেটাও সম্ভবত শিল্প-সাহিত্য-গানবাজনায় মেয়েলোকের ন্যারেটিভের উপস্থাপন ও তৈরিতে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ে।
আমাদের মূলধারার পলিটিক্যাল রিয়ালিটিতে ৭১, ৭৫, ৮৩-৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এইসব রাজনৈতিক ইভেন্টগুলি শিক্ষিত মিডিলক্লাসের আইডেন্টটিটি বিনির্মাণে দরকারি স্টপেজ। আর এইসব ঘটনাগুলির জাতীয় ন্যারেটিভে ফিমেইলদের যেভাবে দেখানো হয়/হইছে/হবে ঐটার একটা কালচারাল প্রভাব তো থাকার কথা বলে মনে হয়। যেমন মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সিনেমায় মেয়েরা শুধু রেপড হয় বা অপরাজেয় বাংলায় মেয়েটা ফাস্টএইড বক্স হাতে, নট অস্ত্র। এ-রকম আরকি।
তো এখন শিক্ষিত আধুনিক মিডিলক্লাসের উৎপাদিত গানবাজনা কালচারের বাইরে — ময়মনসিং গীতিকা, ভাটিয়ালি, ‘যেদিন গাড়িয়াল উজান যায় / নারীর মন মর ছুইরা রয় রে’-র ভাওয়াইয়ায়, জারিগানে, আঞ্চলিক-গ্রামগঞ্জের গানে, যেমন — চাটগাইয়া, সিলটি ভাষার গানগুলিতে, ধামাইলে, বয়াতি গানে, কবিগান-পালাগানগুলিতে মানে আঞ্চলিক অডিও এবং ওরাল ফর্মগুলিতে মেয়েলোকের জীবনযাপন জ্বালাযন্ত্রণা এগুলা খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসছে/সেলিব্রেটেড এটা দাবি করতে চাই।
এই আসাটা শিল্পী-গাতক-বয়াতি যিনি/যারা গান বাঁধছেন উনাদের দরদি মনের সংবেদনশীলতা সমাজ-অবজার্ভেশন থেকেই কী ঘটছে?
মানে আলাদা করে শেখায় দেয়া সচেতনতা/কনশাসনেসের ইন্ধন থেকে উনারা এ-রকম করেন নাই বলে মনে হয়। কারণ ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর অনেক আঞ্চলিক গানের গীতিকারই হইতেছে পুরুষ। চট্টগ্রামের কিংবদন্তি ‘লোকশিল্পী’ আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার উনাদের ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর শ্রোতাপ্রিয় বাজার-পাওয়া অনেকগুলি গান আছে। এর বাইরে আরও নিশ্চয়ই আছে। আব্বাস উদ্দিন, শচীনকর্তা, রহমান বয়াতি উনাদের গাওয়া দু-একটা পরিচিত ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর ‘লোকগান’ ত আমরা কমবেশি সবাই শুনছি।
এখন তাহলে এই প্রশ্নটা চলে আসে যে গ্রামীণ কৌম সমাজ, তথাকথিত চোখে আধুনিকতা থেকে একটু পেছানো, এনলাইটমেন্টের আলোর তেজটা ধরে আসা, ধর্মীয় গোড়ামি-পর্দাপ্রথার প্রভাব বেশি, ঐ অর্থে শিক্ষিত না বা কম-শিক্ষিত, প্রচণ্ড পুরুষ-ডমিনেটিং সমাজব্যবস্থার ভেতর থেকে গ্রামগঞ্জের গানে কোন কোন কি ফোর্সের দরুণ এত (চমৎকার সব) স্পষ্ট ভাষার ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর গান বান্ধা হইল।
জ্য জ্যাক রুশো সাহেবের মতে সম্ভবত মানুষের মুখে ফোটা ভাষা আর গানের (আবিষ্কারের) পেছনে তার আবেগ-অনুভূতি বা নিজেকে নিজের মত অপরদের কাছে প্রকাশ/এক্সপ্রেস করার দুর্বার ‘প্যাশন’ কাজ করে/করেছে। সহজাত লোকাচারের গানের পেছনে এই নিজের কথা, ভাবের কথা, দুনিয়া এক্সপিরিয়েন্স করার কথা নিজের মত অন্যদের বলার-শেয়ার করার টান-প্রয়োজনীয়তা (এবং চর্চা) থাকে। যেটা হয়ত সামাজিক-মানসিক-পারিবারিক এবং বসবাসের সেটিং এবং শিক্ষার টেনশনের কারণে শহর আর গ্রামের গানের কথার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য তৈরি করে, করে কি?
গ্রামীণ নারী তো মজলুমেরও মজলুম। অর্থনৈতিকভাবে ভালনারেবল। তার গল্প এখন এনজিওগুলির উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ন্যাশন্যালি টেলিকাস্ট হয়। তার জীবনযাপনের অনুষঙ্গ কেমন তা কেবল দূর থেকেই জানা-শোনা।
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই মেয়েলি গীত, বিয়ের গান, বিভিন্ন পার্বণ-আয়োজনে কাজের একঘেয়েমিরে ইগনোর করতে দলগত এবং একমনেও গান করার চল আছে। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজে দরকারি কাজেই মেয়েদের-নারীদের গৃহস্থালি এবং বাইরের কাজের (যেমন— ধান নিড়ানি, চাল গুড়া করা, গবাদি পশুপাখি ম্যানেজমেন্ট, সেলাই ইত্যাদি) মাধ্যমে যৌথ (পরিবার ও) সমাজে বিলং করতে হয়। সেইখানে ঘুমপাড়ানি গান থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনাচারে ছড়া-ফোড়নকাটা, মনের চাওয়া-পাওয়া, আবেগের প্রকাশ-অভিব্যক্তি, সমাজের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার অসহায় নীরব সাক্ষী হয়ে থাকার ব্যক্তিগত ও সামাজিক না-বলা কথাগুলি উনারা নিজেদের মহলে সুর দিয়ে বেঁধে গেয়ে যান বোধ হয় (যেমনটা এক্সোডোসের শিকার হওয়া ‘আফৃকান’ মানুষদের গানে, ব্ল্যুজে আমরা কালো দাসজীবনের খতিয়ান পাই)।
এভাবে ‘লোকগান’ ও লোক-সংস্কৃতিতে বাড়তি কোনো কনশাসনেস-সচেতনতা ছাড়াই উনারা জীবনের সাবলীলতা দিয়ে ‘কন্ট্রিবিউট’ করেন। এতে উনাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি, কেতাবি ভাষায় যাকে বলে ‘ন্যারেটিভ’ তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই থাকে। উনারা এইভাবেই ঐতিহ্য-কালচারের চর্চাকে পরম্পরায় ধরে রাখেন। গ্রামে হোক, শহরে হোক বাংলার নারীরাই আসলে বাংলার কালচারের আকর।
এহেন জীবনঘনিষ্ঠ আচারের পাশে বাউল ভাব-দর্শন-লোকাচারে, সাধন-ভজনে এবং বয়াতি কালচারে ‘নারী’ অ্যাজ অ্যান আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে বেশ ‘কদর’ পাওয়া একটা ঘটনা।
বাংলার সহজিয়া ভাব-তন্ত্র-সাধনে, বৈষ্ণব ধারায় ও সুফিজমের আঞ্চলিক অভিযোজন মারফতের চর্চায়, বাউল এবং ‘লালন’-এ ‘নারী’-কে অধিকাংশ সময়ই বেশ কদর দিয়েই ট্রিট করা হইছে সম্ভবত। পালাগানের বৈচিত্র্যময় জীবন এবং আধ্যাত্মিকতা-ঘনিষ্ঠ বিষয়ের গানের মধ্যে ফিমেইল পালাকার এবং নারী-পুরুষের সমতার সুর সবসময়ই সেলিব্রেটেড। ( যেমন, ‘…এ জীবনে দূর হলো না বাউল করিমের পেরেশানি / আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী / আমি কুলহারা কলঙ্কিনী…’ এইখানে শাহ আবদুল করিম নিজেরে বলতেছেন ‘কলঙ্কিনী’, এটা হয়ত অন্তমিলের কারণে বলতে পারেন উনি। অথচ ‘কলঙ্কিনী’ তো হয় ‘রাধা’ মানে মেয়েলোকেরা। কিন্তু নিজেরে ‘কলঙ্কিনী’ বলতে শাহ আবদুল করিমের কোনো দ্বিধা নাই যেন) যদিও এ-রকম দাবিদাওয়া গবেষণা, রেফারেন্স, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া আন্দাজে বলাটা নির্বুদ্ধিতা হয়ে যায় কিন্তু এই ধরনের সহজিয়া ভাব (যদিও তা হয়ত পূর্ববঙ্গীয় গ্রামীণ মুসলিম সমাজের পুরো চিত্রটা পোর্ট্রে করে না) গ্রামগঞ্জের গানে ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে সম্ভবত।
ক্যাসেট-ফিতা-রেডিও-টিভি-সিডি-এম্পিথ্রি মানে রেকর্ড আসার আগে ‘গানবাজনা’ কীভাবে (গ্রামীণ) সমাজে তার ভূমিকা রাখছে এবং রেকর্ড-ইন্ডাস্ট্রি বুম করার পর বাজার কীভাবে ‘গানবাজনা’-র সাথে নারী বা প্রান্তিক নারীর যোগাযোগ/সম্পর্ককে ইনফ্লুয়েন্স করছে বা শ্রোতা/কনজ্যুমার হিসেবে কীভাবে ট্রিট করছে তা জানি না কিন্তু গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পুরুষপ্রধান সমাজে নারীর মনোবেদনা-প্রেম-বিচ্ছেদ-জ্বালা-যন্ত্রণা-মাতৃত্ব এইসব উপাদান ‘লোকগান’-এ আলাদা করে একটা স্পষ্ট জায়গা নিয়ে যে আছে এর বহুধা কারণের পেছনে ‘গান’ জিনিসটা বাংলার গ্রামীণ সমাজে অ্যাজ অ্যা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদান হিসেবে কীভাবে (ভাব এবং জ্ঞানের ধারক হয়ে) লেপ্টে আছে/ছিল তা হয়ত একটা দিশা দেখাইতে পারে।
কালচারের সহজাত উপাদান থেকে ‘লোকগান’-এর ‘ফোক’ এবং ‘কমোডিটি’ (কপিরাইট ক্লেইমড) হওয়ার যাত্রা।
পুঁথিসাহিত্যে, আঞ্চলিক ঐতিহ্যবাহী নানা ফর্মের লাইভ গানে-আসরে শ্রোতা হিসেবে ‘নারী’-র অংশগ্রহণও হয়ত একটা চলক হইতে পারে। এছাড়া আমাদের অঞ্চলে রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ-বিরহী গান-কথার চল তো অনেক কাল থেকেই প্রচলিত। রাধা অ্যাজ অ্যা নারী তার পার্সপেক্টিভের বিচ্ছেদ কিংবা করুণ রসের গান তো হিন্দু-মুসলমান দুনোরই শ্রুতি-অভিজ্ঞতায় আছে। বাংলার ‘ফোক টেইল’ কিংবা কৃষিভিত্তিক প্রান্তিক সহজিয়া ভাব-আধ্যাত্মিকতায় ব্যক্তিচরিত্র হিসেবে ‘নারী’ এবং ‘দেবী/স্পিরিচ্যুয়াল ফোর্স’, ‘আদি শক্তি’ হিসেবে ‘নারী’-কে খাতির করার আন্তরিক রেওয়াজের কথা আবারও বলতে চাই। (তবে এই ‘ভাব’-এর খাতিরের মাধ্যমে প্রচলিত ‘ক্ষমতাকাঠামো’-তে গ্রামীণ নারীর প্রাপ্য অধিকার এবং অবস্থানগত পরিস্থিতির বিরাট কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বোধহয় ঘটে নাই)
এর সাথে উৎপাদনব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে প্রান্তিক নারী যাকে ছেড়ে তার পুরুষ/স্বামীকে কাজে গঞ্জে যাইতে হয়, শহরে যাইতে হয়, ‘দেশান্তরী’ হইতে হয় সেই ‘অবরোধবাসিনী’ নারীর মনোবেদনা এবং বিয়ের কারণে ‘বাপের বাড়ি’-র সাথে বিচ্ছেদের ‘ন্যারেটিভ’ অনেক ভাবেই ‘লোকগান’ এবং ‘লোকগান’-এর নির্যাস ব্লেন্ড করা ‘লোকগান ফর্মেট’-এর গানে বারবার আসছে মনে হয়। জসীমউদ্দীনের ‘কাজল ভ্রমরা’, সম্ভবত মীরা দেব বর্মনের লিখা শচীনকর্তার গাওয়াতে ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’ বা উনারই লিখা সম্ভবত আরেক অমর গান ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খায়া যাও’ গানের কথায় গ্রামীণ নারীর একটা আওয়াজ পাওয়া তো যায় মনে হয়।
মীরা দেব বর্মনের নাম নিলে অনেকেরই হয়ত প্রিয় মৌসুমী ভৌমিক এবং প্রিয় সাহানা বাজপেয়ীর কথা মনে পড়ে। কৈশোর কিংবা পোস্ট-কৈশোরের মিষ্টি হ্যাংওভার-মাখা ‘একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে’-র মতো চমৎকার ‘আধুনিক ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর গান কিংবা মৌসুমী ভৌমিকের চমৎকার গভীরে তলিয়ে শোনার মতো (সরাসরি হয়ত থাকে না কিন্তু মর্মকথায়) ফিমেইল ন্যারেটিভের বাংলা গানের কথার না-বলাটা খুবই অনুচিত হবে। বাংলাদেশে উনাদের ভক্ত-শ্রোতামণ্ডলীও অনেক আছেন। জলছবি ভেবে ভুল করা আরতি মুখার্জির মিঠা মেলোডির হৃদয়গ্রাহী স্যুইং — আরেকটি অমর মিষ্টি গান ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়’-ও আছেন। ভাষার যোগ — কিছুটা কালচারাল সম্পর্ক থাকলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পূর্ববাংলা-ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা গানবাজনা নিয়েই আপাতত আলাপ সারতে চাইতেছি।
‘শিক্ষিত মিডিলক্লাস’-এর আরেকটা যে গর্বের আবিষ্কার ‘জীবনমুখী গান’, এর যে শ্রেণী অ্যান্ড ব্যক্তি সচেতনতা এবং রাজনৈতিক ভয়েস-ওভার তা গাওয়ায় এবং ইন্সট্রুমেন্টালি এক-রকম পশ্চিম থেকে অনুপ্রাণ নিয়ে শুরু হইলেও ‘লোকগান’-এর অনেক ফর্মেই দৈনন্দিন ভূগোল আধ্যাত্মিক ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি দিনদুনিয়ার হক-বেঠিকের চিন্তা-প্রশ্ন জারি রাখার একটা চল যে ছিল/আছে তাকে ‘ক্যাশ’ করেই তো ‘গণসংগীত’-এর উত্থান হয়েছিল মনে হয়।
আরও কিছু কথাও বলা দরকার। গ্রামীণ সমাজও স্ট্যাটিক না। তারও খোলচালে-ভেতর-বাহিরে বদল ঘটতে থাকে। গ্রামীণ জনপদে শহুরেপনা-মডার্নিটির প্রবাহ আঞ্চলিকতার এক্সক্লুসিভনেসটাকে ল্যুজ করে দেয়। বাজার-প্রযুক্তি জীবনযাপনের অনেক মৌলিক চিরায়ত প্র্যাকটিসকে অন্য চেহারার মেক-আপ দেয়। যেমন বলা যায় — যোগাযোগের ব্যবধান ঘুচায় দেয়ার টেলিকমিনিক্যাশনের সাথে সাথে দয়িত-দয়িতার ছটফট মনের উচাটন বিষয়ক গানগুলি বা চিঠির আলাপের গানগুলি হয়ত মোবাইলে মিসড-কল দেয়া-নেয়ার সুরেলা ভনিতায় (অ্যান্ড অপারেটরদের বিজ্ঞাপনবিচিত্রায়) সুইচ করে।
গ্রামীণ মেয়ে তার কলাপাতায় মোড়া একরত্তি জীবনটাকে হাতে করে নিয়ে শহরে, শহরের পেরিফেরিতে সস্তা শ্রমের কাঁচামাল হয়ে গামের্ন্টসে-কারখানায় কাজ করতে আসে। গঞ্জের দোকানে টেইলারিং-এর কাজ শিখতে শিখতেই আছলাম নামের বাইশ বছরের স্বপ্নাতুর ছোকড়া দালাল ধরে পাড়ি দেয় দুবাই কি সিঙ্গাপুর। আছলামের বাল্যবন্ধু মুবিন ঢাকায় যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হইতে। গ্রামের মধ্যে শহর, শহরের মধ্যে গ্রাম ঢুকে যায়/আছে। শহুরে শিক্ষিতরা শেকড়ের কনশাসনেস থেকে লোকসংগীতের পাড় ধরে টান মারে, ইউকুলুলে আর হিপহপ মিশায়ে ফোকের ককটেল সিরাপে আমাদের রিফ্রেশমেন্ট সাপ্লাই দেয় চালু প্রোডিউসার-কোম্পানিঅলারা। গঞ্জের দোকান থেকে শাকিরা আর মিলার গানের ভিডিও ফোনে ভরে নেয়ে ক্লাস সেভেন পড়ুয়া চটপটে বালক সি আর সেভেন ভক্ত এমডি সাদ্দাম হোসেন।
আর য়্যুটিউব থেকে এখন সর্বদা সম্প্রচার হইতে থাকা ‘কন্টেন্ট’-এর অউিও-ভিজ্যুয়াল ম্যাশআপ-এর এন‘গেইজ’মেন্ট চক্র — যার ভোক্তা টার্গেট অডিয়েন্স শ্রেণীবিচার একাকার করে যেন সবাই। পপ মিউজিকের সবসময়ই ধান্দা থাকে যে কত বেশি সর্বস্তরের ভোক্তা বা জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। উঁচা ক্লাস, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, ওয়ার্কিং নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, গ্রামীণ ডেমোগ্রাফ সবার দিকেই সে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়। এই সময়ের য়্যুটিউবকন্টেন্টকেন্দ্রিক ‘আধুনিক এবং ফোক গানবাজনা’-র মধ্যেও এই প্রবণতা আছে বোধ হয়। যদিও একটা টার্গেট অডিয়েন্স থাকে কিন্তু কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় যে উপরে থাকে তার ইনফ্লুয়েন্সটাই সম্প্রচার হইতে থাকে।
শহর যেমন গ্রামীণ ‘লোকগান’-এর পাড় ধরে টান দেয় তেমনি গ্রামগঞ্জও মডার্ন টেকনো সাউন্ড-বিট-ইন্সট্রুমেন্ট এবং টিভি-সিনেমা-য়্যুটিউব-টিকটকে দেখা ‘নারী-পুরুষ ধারণা’ দ্বারা আক্রান্ত ও অনুপ্রাণীত হয়। জীবনের ফেরে গার্মেন্টসে, কারখানায়, ছুটা বুয়ার কাজ করতে, রিকশা চালাইতে, বস্তিতে থাকতে আসানারী-পুরুষের (শ্রমজীবী) ভাষা, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়াও কমার্শিয়াল প্রোডাকশনে গান হয়। সেইসব গানে (নিদর্শন স্বরূপ দ্রষ্টব্য) কাইন্ড অব অর্থনৈতিকভাবে অ্যাক্টিভ/স্বাবলম্বী (সামাজিকভাবে অতটা না সম্ভবত) বেগানা মেয়েলোকের চমকপ্রদ (মোর ম্যাটেরিয়ালিস্টিক/ব্যবহারিক ভাষার)‘ন্যারেটিভ’-এর গান আছে/থাকে। তবে সেইসব স্পষ্ট-এক্সপ্লিসিট ভাষার (নারীকণ্ঠে গাওয়া এবং গীতিকার অধিকাংশ সময় পুরুষ) ‘ফিমেইল ন্যারেটিভ’-এর গানগুলি কখনো কখনো নারীসমাজকে কি উল্টা এক ধরনের এক্সপ্লয়েট করে কি না বা গানগুলার ডিরেক্ট শ্রোতা হিসেবে (সাবজেক্ট যখন নিজেই শ্রোতা) শ্রমজীবী মেয়েলোকেদের অংশগ্রহণটা আসলে ক্যামন তা বোধহয় আরেকটু তলিয়ে দেখা যাইতে পারে।
* ইমরান ফিরদাউস, তাহনী ইয়াসমিন, শাশ্বত কাশফিয়া স্নেহ, সারিকা সিরাজ, সোয়েব নাবিল — উনাদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ঋণ
— নাফিস সবুর / জুলাই ২০২১
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS