সিলেট প্লাবন ২০২২ || আহমদ মিনহাজ

সিলেট প্লাবন ২০২২ || আহমদ মিনহাজ

পানিবন্দির পুরা হপ্তা সিলেটের বাইরে ছিলাম। মেঘালয়-আসাম জুড়ে অতিবৃষ্টির আশকারা পেয়ে দুর্বার পাহাড়ি ঢল যবে সব ভেঙেচুরে উজান থেকে ভাটিতে নামছিল আমি তখন বৃষ্টির জন্য কাতর রাজশাহীর বাতাসে সুমিষ্ট আমের ঘ্রাণ শুঁকছি। শুক্র ও শনিবারের জাদুবাস্তব বারিষ হু-হু বেগে ঘরদোরে ঢুকে পড়ার খবর সেখানে বসেই শুনতে হয়েছে। দূরাতীত কালে জাদুটোনার দেশ বলে বিদিত কামরূপ কামাখ্যা ওরফে আসামের সঙ্গে নাড়ির টানে বাঁধা সিলেটের ভূপ্রকৃতি বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে একেবারেই আলাদা। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনে যার উদয় সেই খ্যাপা দুর্বাসা পদ্মা বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণের জেলাগুলোকে পরিবেষ্টন করে ঢাকার অদূরবর্তী মুন্সীগঞ্জ অবধি বিস্তৃত হলেও মরুপ্রায় বরেন্দ্রর রুক্ষ ভূমি ভরা-আষাঢ়েও একপ্রকার বৃষ্টিবিহীন ছিল বলা যায়। ঢাকা থেকে রাজশাহী সারাটা পথ জুড়ে ঝুম বৃষ্টির জন্য গোটা দেশ হাপিত্যেশ করছে মনে হলো। ওদিকে সিলেট আর সুনামগঞ্জে তার গুণ্ডামি ততক্ষণে লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের নদনদীর তুলনায় আমাদের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, পিয়াইন, জাদুকাটা বা কালনিকে খাল মানতে হয়। অতিপ্রাকৃতিক বারিষ থেকে সৃষ্ট জলের বিপুল ভার খালগুলো দিয়ে যখন নামে তার চাপকে ভয়ানক ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। দেশের অতিকায় নদনদীর তুলনায় তারা বামন প্রায়। পুরাতন চর তছনছ করে নতুন চর তৈরির ক্ষমতাও নগণ্য। বিপরীতে এ-কথা সত্য বটে, — আমাদের এইসব মৃদুমন্দ খালগুলো বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চলের একটির সঙ্গে সংযুক্ত। খেয়ালি প্রকৃতির কী বিস্ময়…কী বিস্ময়…শতবর্ষে তৃতীয়বারের মতো একটা গোটা দিন মানে ওই শনিবারে চেরাপুঞ্জিতে নয়শো মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টি ঝরেছে! পাহাড়ের সংকীর্ণ গিরিখাত দিয়ে বৃষ্টির জল ওইসব খালে আরবি ঘোড়ার গতিতে নামছিল। আচমকা সর্বনাশের সংকেত তাই রাজশাহীর পথে নিজেকে রওয়ানা করার ক্ষণে টের পেয়েছিলাম।

সে যাহোক, শাহী ঈদগাহ এলাকায় কখনো পানি উঠেছে বলে আমার জানা নেই। অষ্টাশি, আটানব্বই কিংবা দুহাজার চার সালের অতিবৃষ্টির বছরে ঈদগাহ বা সিলেটের ‍তুলনামূলক উঁচু এলাকায় মানুষকে পানিবন্দি হতে দেখিনি। এবার তারাও উপায় নাই গোলাম হোসেনের দলে ভিড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ছড়া উপচে ভ্যালি সিটি  সহ এলাকার বেশকিছু অংশে পানি ঢুকে পড়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পরে অবশ্য নেমে যায় বলে খবর জানতে পাই। আপনারা যারা হপ্তা ধরে পানিবন্দি ছিলেন (*এবং অনেকে এখনো আছেন) তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করলে ঘটনা গুরুতর কিছু নয়। সুনামগঞ্জ, ছাতক, কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের তুলনায় যেমন শহরবাসীর দুর্ভোগকে নগণ্য মানতে হয়।

শ্রীহট্টে মধ্যমা নাস্তি  প্রবচনটা এই সুবাদে মনে পড়ছিল! ভূঅঞ্চলটি আপাতদৃষ্টে শান্ত-সুবোধ মনে হলেও হুট করে চরমপন্থী হতে না ডরায়। বিশ্বজলবায়ুর পরিবর্তন প্রকৃতির নিজেকে রিফ্রেশ  করতে আপনা খেয়ালে ঘটে থাকে। জলবায়ুর পালাবদল প্রাকৃতিক অনিবার্যতা হলেও আমাদের বেতাল কাণ্ডকীর্তি তার স্বাভাবিক গতিকে প্রতিহত ও চরমভাবে বিড়ম্বিত করছে তাতে সন্দেহ নেই। সিলেটের সাম্প্রতিক দুর্দশায় এই বিড়ম্বনার ভূমিকা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন, তবে হাওর ও নগরাঞ্চলে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার গলদটা খোলা চোখে সবাই দেখতে পাচ্ছি। পরিবেশবিজ্ঞানী জেমস লাভলক ধরিত্রীকে গাইয়া  নামে সম্বোধন করে থাকেন। অযোনিসম্ভূত দেবী গাইয়া গ্রিক পুরাণে ধরিত্রীর জনয়িতা ও সংস্থিতির প্রতীক বলে বিদিত। বলা কওয়া নেই হুট করে তার এই চণ্ডকালীর বেশ ধারণের পেছনে আমাদের পাগলাটে উন্নয়ন পরিকল্পনার অবদান মোটেও কম নয়। সুতরাং মানব ছাড়া যত প্রজাতি এখনো ধরিত্রীর বুকে বিচরণ করছে তাদের সুরক্ষায় দেবী এখন মাতঙ্গী। ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে / মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’; — মুকুন্দ দাসের চরণ আওড়ে গড়াভাঙার খেলায় মেতেছেন দেবী।

দেবী গাইয়ার স্বাভাবিক সংহারের রীতিনিয়মকে আমরা নিজদোষে বোধহয় ত্বরিত করছি এবং দুনিয়া জুড়ে সেটা ঘটছে। এই তো বছর তিন আগে আমাজনের বিস্তীর্ণ এলাকা একমাস ধরে দাবানলে পুড়ে খাক হলো। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল নিয়মিত ঘটনায় মোড় নিয়েছে ইতোমধ্যে। হিমালয়ে শুনতে পাই জমাট বরফ গলে প্রায় পাঁচ হাজার ছোটবড়ো হ্রদ তৈরি হয়েছে। সাইবেরিয়ার বরফ ওদিকে গলছে অবিরাম। বিশুদ্ধ বায়ুর ভাণ্ডার উত্তর মেরুটাও আগের মতো নিষ্কুলষ নেই। ওখানকার অতিকায় হিমবাহ দ্রুত গলছে। সুবিপুল জলের ভাণ্ড প্রশান্ত মহাসাগরকে আপাতত নিজের ঠিকানা করে নিয়েছে। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রকৃতির উৎপাত অহরহ খবরের শিরোনাম হয় ইদানীং। আসামের মালা গলে পরে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া সিলেট ওইসব বৈশ্বিক ঘনঘটার বাইরে থাকতে যাবে কোন দুঃখে!

ইতিহাস সাক্ষী, অতিকায় উল্কাপাতের কারণে বিশ্বে বরফযুগ আসন্ন হলে তার ধাক্কায় ডাইনোসরদের একচেটে গুণ্ডামি খতম হয়েছিল চিরতরে। আফ্রিকা মহাদেশের সাগরে পানির প্রবাহ এভাবে এক সময় নিচে নামতে শুরু করে। প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচা কঠিন বুঝে আমাদের আদি পুরুষরা উত্তাল সাগরপার ধরে হাঁটা শুরু করেছিলেন। তাদেরকে ওই সময়কার জলবায়ু-উদ্বাস্তু বলা যেতে পারে। পায়ে হেঁটে ও ভেলায় চড়ে সেকালের অস্ট্রেলেশিয়া মহাদেশে ঢুকে পড়েন সকলে মিলে। অদ্য উল্টো ধারা বইছে। অতিকায় হিমবাহে বন্দি সুবিপুল জলের ভাণ্ড গলতে শুরু করায় মহাসাগরে পানির উচ্চতা ঊর্ধ্বগামী। বেদ-পুরাণ-মহাভারত  থেকে শুরু করে বাইবেল-কোরান  অবধি মহাপ্লাবনের বিবরণ পাই। ধরিত্রী মনে হচ্ছে এ-রকম এক প্লাবনে ফের ভাসতে চলেছেন। মানব প্রজাতির জীবনে নয়া শরণার্থীকাল সহসা এল বলে! এর সঙ্গে লড়াই করে জীবনের বাকি দিনগুলো তামাদি হবে মনে হচ্ছে। মনকে এই বুঝ দিয়ে আপাতত শান্ত রাখার চেষ্টায় আছি বলতে পারেন।

পানি ঢুকে পড়ার দিন থেকে কাউকে সংযোগ করতে পারিনি। পরিবারের সঙ্গে সুস্থির ফোনালাপের সুযোগ হয় সোম-মঙ্গল নাগাদ। মঙ্গল হোক সকলের। সুবদ্ধির উদয় ঘটুক কালের বিবর্তনে দেড় হাজার সিসি (Cubic Centimetre) আয়তন ও সক্ষমতায় উন্নীত মানব প্রজাতির ঘটে।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you