ভাটিবাংলার কবি শাহ রমিজ আলী || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

ভাটিবাংলার কবি শাহ রমিজ আলী || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

খুব অল্প সময়ে মরমি গান গেয়ে যে-মানুষটি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে বাঙালি শ্রোতাদের নজর কাড়েন, সেই শিল্পীর নাম রমিজ আলী; — যাঁকে পল্লিকবি শাহ রমিজ আলী নামে ডাকা হয়। সহজ-সরল গানের ভাষায় তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে খুঁজেছেন এবং আত্মিক শান্তিও লাভ করেছিলেন।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ১২ ডিসেম্বর, সুনামগঞ্জ জেলাধীন ছাতক উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়নের ছনখাইড় নামক গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে পল্লিকবি শাহ রমিজ আলী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফুরকান আলী এবং মাতার নাম গুলজান বিবি। নিজের জন্ম নিয়ে লিখতে গিয়ে একটি গানে রমিজ আলী লিখেছেন — “সুরমা নদীর দক্ষিণপারে রাজা ভবন নাম / পোস্টাফিস ছাতকবাজারে বাগবাড়ি মোকাম, বন্ধু / সুনামগঞ্জ জেলা আমি জাতে বাংলাদেশী / সুখেদুঃখে আমরা একে অন্যের প্রতিবেশী, বন্ধু” … (রমিজ গীতিকা সমগ্র, ৪র্থ খণ্ড, গান ৮৫)

নিজ গ্রামের নৈছত মোড়ল তালুকদার একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে রমিজ আলী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে একটি বেসরকারি স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। গানের প্রতি তাঁর শৈশব থেকেই প্রবল আকর্ষণ ছিল। তারই প্রেক্ষিতে একসময় তিনি ‘জ্ঞানের সাগর’ অভিধায় খ্যাত মরমিকবি দুর্বীন শাহের সান্নিধ্যে আসেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে শিষ্য হিশেবে তিনি ভাবতত্ত্বের অফুরান জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পান। একসময় নিজে গান লিখতে শুরু করেন। রচনা করেন অনেক তাত্ত্বিক গান। লোকসংস্কৃতির বিকাশে তাঁর রচিত গানসমূহ সমাজ বদলে অনন্য ভূমিকা রাখছে।

শাহ রমিজ আলী ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ২৭ বছর বয়সে যুক্তরাজ্য গমন করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সহধর্মিণী বেগম রাজিয়া খাতুনকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসেন। তাদের পরিবারে ছয় পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। রমিজ আলীর স্ত্রী রাজিয়া খাতুনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়ে তিনি আমৃত্যু মরমি সংগীত রচনার জগতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।  দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে বসবাস করে বাংলার মাটি ও মানুষকে নিয়ে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেন। রমিজ আলী গান রচনা করে নিজেই সুর করতেন এবং বিভিন্ন আসরে পরিবেশন করতেন। তাঁর রচিত অমূল্য গানগুলোই তাঁকে সবার নজরে নিয়ে আসে এবং বাংলার মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এনে দেয়। তাঁর লেখা পল্লিভাবধারার গানগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করলে দেখা যায়, এর মধ্যে রয়েছে — প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব, বিরহ-বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, মারফতি, মুর্শিদি, হামদ ও নাত প্রভৃতির সমাহার।

রমিজ আলীর অনেক গানই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হলো —

একবার দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে পাইয়াছি তোমার লাগ
দাঁড়াও নইলে প্রেমাগুনে করে দিবো খাক্॥

একটা কথা কই রে বন্ধু না-করিও রাগ
আমায় ছেড়ে কার সঙ্গে তোর এত ইতিবাগ॥

আমি কি দিছলাম না রে বন্ধু আদর সোহাগ
অভাগিনী নারীর প্রেমে দেখাইলায় দেমাগ॥

কত নিশি গেল রে বন্ধু থাকিয়া সজাগ
এখন আমার আন্ধাইর ঘরে জ্বলে না চেরাগ॥

রমিজ পাগল মরে যদি লইয়া প্রেমের আগ
শেষ বিচারে দেখাইব বুকের পোড়া দাগ॥
(রমিজ গীতিকা সমগ্র, ২য় খণ্ড, গান ৫৭)


ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর ওস্তাদ দুর্বীণ শাহের অনুপ্রেরণায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে রমিজ আলীর গান নিয়ে ‘রমিজ গীতিকা’ প্রথম খণ্ড প্রকাশ হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে রমিজ গীতিকা দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হয়। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে  প্রকাশ হয় রমিজ গীতিকার তৃতীয় খণ্ড । এভাবে একে একে তিনটি খণ্ড প্রকাশ হয়। গানপ্রেমী পাঠক ও শ্রোতাদের ভালোবাসা ও উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় সর্বশেষ ৩২৮টি গান নিয়ে চতুর্থ খণ্ডসহ সবগুলোকে একত্রিত করে ‘রমিজ গীতিকা সমগ্র’ নামের  একটি একক গানের বই বের করতে হয় তাঁকে।বর্তমানে শাহ রমিজ আলীর অন্যতম শিষ্য, বিলেতপ্রবাসী মরমি গীতিকার নবীন সিদ্দেক তাঁর রচনাবলির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত গানপাগল শ্রোতাদের চাহিদা মিটিয়ে চলেছেন।

রমিজ আলী সাধনাজগতে চন্দ্রচড়ী দরবার শরিফের শামসুদ্দিন চৌধুরী সাহেবের সাহচর্য লাভ করে পিরে কামিল আলহাজ্ব মাওলানা কাজী আব্দুর রাজ্জাক (কাজিবাড়ি) সাহেবের নিকট বায়াত গ্রহণ করে আধ্যাত্মিক জগতের সোপান লাভ করেন।

ক্ষণস্থায়ী এই মায়ার দুনিয়া ছেড়ে সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। রমিজ আলীকেও ছেড়ে যেতে হয়েছে।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের অন্তর্গত কিথলি শহরস্থ নিজ বাসভবনে উনআশি বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন মরমি কবি শাহ রমিজ আলী। সেখানেই তিনি চিরশায়িত। ছয় পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ভক্ত রেখে গেছেন এই মরমি কবি। কোনও-এক গানে রমিজ আলী লিখেছিলেন, ইহজগৎ ঘুরে খুঁজে এলাম — পাইলাম না তোর বাসস্থান / যৌবন গেল জলের স্রোতে, রূপলাবণ্য ছাই দেহেতে / পঞ্চত্বের মিলনে অবসান / সেদিন রমিজি ছুরতে আইও — হইলে আমার তিরোধান। … (রমিজ গীতিকা সমগ্র, ৩য় খণ্ড, গান- ১২৫)।

শাহ রমিজ আলী আমাদের দেশের এক অমূল্য সম্পদ। শক্তিমান, আপোসহীন এই সংগীতস্রষ্টার গান আলোকবর্তিকা হয়ে চিরকাল আলোকিত করে যাবে আমাদের সমাজকে। তিনি তাঁর অমূল্য গানের মধ্য দিয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।


মোহাম্মদ জায়েদ আলী রচনারাশি

COMMENTS

error: