গানপার বৈশাখ-সঞ্চালকীয় : তবুও বৈশাখ

গানপার বৈশাখ-সঞ্চালকীয় : তবুও বৈশাখ

মুদিদোকানির পৌনঃপুনিক প্রতিবছর ব্যবহার্য ব্যানারে শুভ নববর্ষ এসো হে বৈশাখ  লেখা আল্লার দুনিয়ার সবচেয়ে শস্তা স্বাগতিক সৌজন্যটুকুও নাই, তবু বৈশাখ। তবুও বৈশাখ।

কর্পোরেট ব্যাঙ্কবিমা ব্যবসাবাজির ভবনগুলায় গ্যাসবেলুনের ঝোলানো ওয়েলকামবার্তা নাই, রাস্তায় রাস্তায় আল্পনা নাই, দাড়িছাড়া সদ্যতরুণদের দিকে দাড়িয়াল সদ্যতরুণদের আউটসাইডার তাকানো নাই, বাঙালি মুসলমান আর বাঙালি হিন্দুর মৌরসিপাট্টা নিয়া সাংস্কৃতিক পরিচয়চিন্তা নাই, তবু বৈশাখ। তবুও বৈশাখ।

মঙ্গল শোভাযাত্রা নাই, পেঁচা নাই বিচ্ছু নাই সাপ নাই হাতি নাই পিকক শাকুরা পাখি নাই, স্টেশনক্লাব নাই রয়্যাল নাই দিনদুনিয়া নাই দয়াল নাই, টিগার্ডেনে সমরের ঠেক নাই, সিদ্ধি নাই গরমে সেদ্ধ হওয়া নাই, শিকড়ের টানটোন নাই আদেখলা দেশাত্মবোধ নাই, ছাত্রলীগগিরি নাই তেঁতুলশফি নাই, উদীচী নাই দধীচি ঋষি নাই, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য নাই, কীর্তি নাই কাইজ্জাফ্যাসাদ নাই, কালচারাল হেজিমোনি নাই, বৃথা সাংস্কৃতিক পার্ফোর্মিং প্রশংসা সাংস্কৃতিক অবজ্ঞা নাই, রিসোর্ট নাই পার্ক নাই, নিরালা ফ্ল্যাটের বন্ধু নাই, তবু বৈশাখ। তবুও বৈশাখ।

বোমায় মানুষ মারতে পারঙ্গম যারা তাদেরও হাতপা প্যারালাইজড হয়ে গেছে, এ এমন বৈশাখ। অহিংসা হাসিঠাট্টার খোরাক যাদের কাছে তারাও অসহায় বাধ্যগত অহিংস আজ। অভাবনীয় অকল্পনীয় বৈশাখ।

লোকে লোকারণ্য নাই, টিভিতে স্পেশ্যাল প্রোগ্র্যাম্স্ নাই, শাড়ি নাই লেহেঙ্গা নাই কুর্তা পাঞ্জাবি টিশার্ট নাই, ইলিশ নাই বালিশ নাই ইব্লিসের শাপশাপান্ত ঘটানো মিচকি মোল্লা হুজুর নাই, বাংলায় গাছতলায় গান নাই প্যান্ডেলের খাড়ারইদে ইশকুলকিশোরীর নাচ নাই নৃত্যলহরি নাই, তবু বৈশাখ। তবুও বৈশাখ।

গরুর গাড়ির চাক্কা নাকে পরা অ্যারাবিয়্যান মুটকি চিরকুটগায়িকার বিলাইমিয়াউমিয়াউ নাই, জলের গানের কৃত্রিম বাউলাভিনয় নাটামি-ভাঁড়ামি নাই, দুর্ধর্ষ সংগীতাধীশ্বর ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস্ নাই, মেলায় যাই রে বাসন্তী রঙ  ডুগডুগি বুষ্টুমি নাই, মেটাল নাই রক নাই মেঘদল  নাই শিরোনামহীন  নাই আর্টসেল ওয়ারফেজ  নাই সহজিয়া সোনার বাংলা সার্কাস  নাই, সিটি কর্পোরেশনের ডিসিনিবাসের সরকারি আপিশের আলোকসজ্জা নাই, তবু বৈশাখ। তবুও বৈশাখ।

ছোকরাগুলো প্রথমবারের মতো ভাড়া-করা ট্রাকে চেপে ঢোলডপ্কি পিটিয়ে ইকেলেলে প্যানপ্যানিয়ে নগরকীর্তন করবে প্ল্যান কষে রেখেছিল, পরিকল্পনা প্ল্যানপ্রোগ্র্যাম্স্ বৃথা যায়। তারপরও বৈশাখ।

প্রথমবার প্রেমিকার দেয়া পাঞ্চাবি আর প্রেমিকের দেয়া শাড়িব্লাউস্ পরে একরিকশায় গায়ে-গা সাঁটায়ে ভেসে ভেড়াবে ভেবেছিল যেই দুইটা মানুষ, কোথাও নেমে পরস্পরের ঘামে-কামে লেপ্টানো মুখের সেল্ফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করবে ভেবেছিল, হয়তো-বা আগামী বৈশাখের আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তারা ফিজিক্যালি চিরতরে, এই জীবনে পয়লা বৈশাখে বেড়ানোই হবে না আর তাদের নসিবে। একটাও যুগল মুরতি চিত্রপ্রমাণ না রেখে এই পৃথিবীতে কিংবা এই অনিঃশেষ অনন্ত মহাবিশ্বে ভেসে বেড়াবে তারা আন্তরিক অসনাক্ত ব্যথায় চিরবিচ্ছিন্নভাবে। এরপরও বৈশাখ।

বৈশাখ এসেছে। সে থাকবে না। আবার আসবে। সে ঘুরবে। সে ঘুরবে চিরচক্রাকারে। একে তুমি সমীহ করো। সম্ভ্রম জ্ঞাপন করো।

বৈশাখ এসেছে দ্বারে। বেরিয়ো না উঠানে, যেয়ো না গাছতলায় ইশকুলঘরে গেঁয়োনাগরিক বাজারচাতালে, স্টেজের মাচাঙে না চেপে তুমি ডিফ্রেন্ট কায়দায় তারে রিসিভ করে নাও। সুয়াগাৎ জানাও তারে ঘরের ভিতরেই তিনফুটি ডিস্ট্যান্স বজায় রেখে।

জেনো বৈশাখ থাকবে না। থাকলে একটা তালও পাকবে না বাংলায়। জেনো জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়ের বৃষ্টিপ্রসূতি সে। এবং শ্রাবণরোম্যান্সের সে প্ররোচনাকারী। শীতের শেহজাদি সে। হেমন্তের ঘুমথমথমা মায়াবিকেলেও সুর বাজে তারই তিনতারের সমাহারে সেতারে। এই বৈশাখ। অভিবাদন জানাও তারে।

ব্ল্যাক বৈশাখ! ব্লকড বৈশাখ! লকড-ডাউন বৈশাখ!

রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ-আবাহনী গীতিকা গাইবার সময় এই প্রথম মানুষ খেয়াল করল মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে  বলবার অতি অভ্যস্ত স্বাভাবিকতাটাও প্রকট নিষ্ঠুরতা। বাকি আর থাকবে কেউ, মুমূর্ষুরে উড়ায়ে নিয়ে গেলে? এ বৈশাখ নতুন রবীন্দ্রনাথের আবাহনকল্পে হাতে নিয়ে এসেছে ভেঁপু, অবর্ণনীয় উত্থানস্তোত্র, অদর্শিত নর্তকের পদছন্দ। অকহতব্য থম-ধরা এই বৈশাখ, দমচাপা, আবদ্ধ। অনুৎসবের এ বৈশাখ, অনুদযাপনের, এ বৈশাখ কালো।

দুনিয়ায়, মানবেতিহাসে, এই পয়লা এমন ঘটেছে ভেবো না। প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় এমন দিনের কথা মানুষই নিজের হাতে গেঁথে রেখে গেছে, করণীয় বলে গেছে এমন উৎসবহীনতায়। আছে মানুষেরই বিবৃত মলমাস, মলবর্ষ, যখন উৎসব করা বারণ।

যখন কলেরা এসেছে, প্লেগ এসেছে, বেনামা মারী ও মড়ক এসেছে, যুগে যুগে, সভ্যতার পর সভ্যতায়, জনপদের পর জনপদে, সংলগ্ন জনপদগুলো সমীহ করেছে সেই বিপন্নতার উৎসবহীনতার মানবেতরতার সময়টাকে।

এইভাবেই সে এগোয়। এইভাবেই বৈশাখের কখনো উৎসব কখনো অনুৎসবের ভিতর দিয়াই সময় এগোয়। বিকল্প তরিকা আলাদা রাস্তা নাই সময়ের। সভ্যতার এ-ই সিল্করুট।

বৈশাখ কাউরে করে না বঞ্চনা। মানুষই মানুষের বঞ্চনার কারণ হয়। মানুষই মানুষেরে খেতে দেয় না। মানুষই মানুষেরে মেরে ফেলে প্ল্যান করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বিনা বিচারে বিনা সাজায় বিনা শোধরাবার সুযোগ দিয়ে ক্রসফায়ারে। শ্রেষ্ঠ ঘোষণা দ্যায় গায়ের জোরে একপক্ষ নিজেদেরে, আরেকপক্ষ নিজেদেরে নিকৃষ্ট ভেবে ভেবে অসুস্থ গোঙরায়া আবোলতাবোল মরে। নেপোয় চাটে চামে পেয়ে যাবতীয় দধি ও দুগ্ধ।

বৈশাখ তোমারে সময় দ্যায়, মানুষ দ্যায় না। আকালের দিনে ধান কেড়ে নিলেও কচুঘেঁচু যোগায় সে তোমার নিদানি নিঃস্ব অভুক্ত দুপুরে। মানুষের যাবতীয় তন্ত্রমন্ত্রই আখেরে মানুষেরই হাতে মানুষধ্বংসী হয়ে ওঠে। সে প্রতিবেশিরে না মেরে নিজের জায়গা করে নিতে শেখে নাই আজও।

অতএব বৈশাখ। সমীহ করো। বৈশাখ সে, ব্ল্যাক হলেও। ব্লকড হলেও বৈশাখ, লকড-ডাউন হলেও। কোয়ারেন্টাইনড বৈশাখ। উহার সামনে হও শ্রদ্ধাবনত।

ভোর হলে, ব্ল্যাক চলে গেলে, রেপ্লিকায় রঙ ফিরে এলে, প্রেমিকার ঘেমো থুৎনিচিবুকলগ্ন লকলকা আগ্নেয় ওষ্ঠাধর মেসেঞ্জারভিশ্যুয়াল চলচ্চিত্রকলে নয় বাস্তবেই নিজের ঠোঁটচাপা দেবার মতো সন্নিধানে পেলে, এই বিপন্ন বৈশাখ ভুলে যাবা? না, আগামী অনির্দিষ্ট অথচ অত্যাসন্ন বহুবর্ণ বৈশাখের উদযাপনলগ্নে এই বৈশাখটাকে ফেরায়ো স্মরণে। একটা বাদুড়ের বাসস্থানে যেয়ে তোমার নগ্ন নখর বসাবার আগে এই বৈশাখের স্মৃতি ইয়াদে রেখো। ধূসর রোদদগ্ধ ভুবনচিলের বংশবিনাশের প্রাক্কালে একটাবার এনো স্মরণে এই নিরুৎসব বৈশাখ। তোমার বর্তনে ভোজন লাগাবার আগে নেউল-চিকা-মাছরাঙা-আইড়মাছের বরাদ্দ খাবারে টান পড়ল কি না তালাশে রেখো।

মনে রেখো, অন্ধকারে আছো। মনে রেখো, জয় তুমি করেছ যত তারচে অধিক পরাজিত করেছ নিজেরে টের পাও নাই। বিস্তর জানাশোনা জানোয়ারি করাকরি হয়েছে, এইবার একটু পশ্চাতে ফেলে এসেছিলে যারে তারে দেখো, নজর দাও তার দিকে, ভুল হয়েছে কনফেস্ করো। বসে বসে এইবার ভাবো। লজ্জায় জিভ কাটো। তোমার গরিমার অঙ্গ খাইল ঘুণে, ভেবো। বৈশাখে এইবার লোকালয়ে লোকালয়ে দ্যাখো গৌতম বুদ্ধ। শুধু নির্বাণ ভাবো। উৎসবের খানাপিনা আবার হবে, এই দুনিয়ায় এসে পয়মালের মতো হার্মাদের মতো উদর ঠেসে খালি তো উগার সাবাড় করে গেলে, এই শিক্ষাটা আবার পাবার ফুরসত হবে কি না জোরালো সন্দেহ। উৎসবহীন বৈশাখ, তবুও বৈশাখ। ক্ষমঃ ক্ষমঃ ক্ষমঃ অপরাধ  গাইবার এই বৈশাখলগ্ন।

তবুও বৈশাখ, তবু নববর্ষ, নয়া সাল, নওরোজ, নতুন বছর, নয়া জার্নি বিগিন্স!

মুখোশে মুখোশে মূক দুনিয়া তাকিয়ে আছে আরেক নতুন মুখরতার পানে। মাঙ্গলিক মাস্কপরিহিত দুনিয়াবাসীরা গৃহবন্দি নির্নিমেষ নিষ্পলক চেয়ে রয় বিশ্বজোড়া মাঙ্গলিক শোভাযাত্রায় শামিল হবে বলে। ফেরো সুসময়, ফেরো সুবচন, ফেরো সুদিন, ফেরো লাল, ফেরো রঙিন, ফেরো!

উৎসবহীনতায়, মানুষের মিলন-অনিশ্চিত বিরহে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদে আল্লাবিল্লা প্রার্থনারও কোনো মওকা থাকে না, মানুষেরই মিলনধারণায় নিহিত প্রণয় প্রার্থনা পরিণয় যাবতীয় দুনিয়ার সমস্তকিছু। ভুলে যেয়ো না এই স্মৃতিশিক্ষাটুকু। মনে রেখো। মনে রেখো।

মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক। রহম হোক। সকলের। বাংলার। বিশ্বের। দুনিয়ার।

আবার হবে লাল, রঙিনতা, হবে শোভাযাত্রা মানুষের! এই তিনফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে পারলেই আশা আছে শেষবারের মতো দুনিয়াটা প্রাণসমন্বিত বৈচিত্র্য-সহাবস্থানের দুনিয়া হবে। এই নিখিল নিরাশায় আশার গান গাওয়া ছাড়া বাঁচাটাই নিরর্থ।

তবু শুভেচ্ছা। ভালোবাসা। মাঙ্গলিক দুয়াদুরুদ আশীর্বাদ। সাব্বে সাত্তা সুখিতা ভাবান্তু। সবসময় সিজন্স্ গ্রিটিংস্!

শুভ বঙ্গাব্দ ১৪২৭!
—  গানপার

ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী হিরণ মিত্র

… …

COMMENTS