দুইরকম তারুণ্য || সুমন রহমান

দুইরকম তারুণ্য || সুমন রহমান

আমি প্রবাদসমূহের পারস্পরিক সংঘাত উপভোগ করি। অবাক বিস্ময়ে দেখি অচেতন লোকমানসের লীলা, একেকটি অহমের প্রয়োজনে জীবনের ঘাটে ঘাটে কত হাজার রকমের উছিলা বানিয়ে চলেছে সে! চল্লিশ পেরোলেই চালশে, এই আপ্তবাক্য যেমন পঁচিশের টগবগে শিরদাঁড়ায় শিরশির করে তাড়া দেয়, তেমনি পঞ্চাশে ন্যুব্জ-হতে-থাকা স্ট্যামিনার জন্য অদ্ভূত সান্ত্বনাও আনে। আবার আমার মতো মানুষ যে কিনা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করেও জীবনের লাগাম ঠিকমতো হাতে পায়নি, তাদের জন্য লাইফ স্টার্টস অ্যাট ফোর্টি! অদ্ভূত প্রশান্তি আসে, চেয়ারের পেছন গদিতে গা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবি, এত কিসের তাড়া, কিবোর্ডের ওপর এত হামলে পড়ছিই বা কেন, জীবন শুরু হতে তো আরো বেশ ক’মাস বাকি! ধীরে রজনী! রিল্যাক্স!

কবি বিনয় মজুমদার তারুণ্যকে দেখেছিলেন সামনাসামনি, প্রায় তাঁরই সমান লম্বা ছিল নাকি সে! এই কবিতা তিনি লিখেছিলেন চল্লিশের ঘরে। টেনিস খেলোয়াড় তিরিশেই বুড়িয়ে যায়, বিস্মৃত হয়ে যায়, কিন্তু চল্লিশের সাহিত্যিকের সামনে জীবনের সম্ভাবনাগুলো কেবল খুলতে শুরু করে। জাতিসংঘ সনদে বা বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞায় তারুণ্য আঠারোয় শুরু হয়ে চব্বিশে শেষ। আবার যারা মানব পাচার বা হিউম্যান ট্রাফিকিং নিয়ে কাজ করেন তারা দেখছি একুশ পেরোলেই কাউকে তরুণ বলতে চান না! অর্থাৎ বাইশ বছরের ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ আদমকে পাচার করা হলে সেটি নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে চান তারা! বোঝা যায়, তারুণ্য স্রেফ বয়সসীমা নয়, তার রাজনীতি আছে, ব্যবস্থাপনাও আছে। প্রথম আলো-র তরুণ তালিকায় আমার নাম দেখে এক অভিমানী তরুণ অধ্যাপক আমার বয়স নিয়ে সশব্দ ভাবতে শুরু করেছিলেন অন্য এক পত্রিকায়। প্রথম আলো-র দোকানে ঝুনা নারিকেলকে ডাব বলে গছিয়ে দেয়ার পেছনের রাজনীতি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তিনি? বোঝা যায়, তারুণ্যের রাজনীতি শুধু সংজ্ঞাতেই নয়, পরিবেশনায়ও।

এই পরিবেশনাটুকু কারা করে? প্রতিষ্ঠান করে, আবার প্রতিষ্ঠানবিরোধীরাও করে। অদ্ভূত এক দশা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্পসাহিত্যচর্চার। একদা তারা পথ দেখিয়েছিল মুক্তকচ্ছ তারুণ্যকে, কিন্তু আজ দালির ঘড়ির মতো তাদেরও সময় যেন গলে গেছে, আবহমানের পিঠে উঠে ফ্রিজ হয়ে গেছে! অতীতবিহারী তারা, নিজেদের স্যানাটোরিয়ামকে তারুণ্যের সূতিকাগার ভেবে ভেবে সেই কবেকার জীবন একবিংশ শতাব্দীতে বয়ে বেড়াচ্ছে! আদতে তারাও প্রতিষ্ঠান। বিরোধিতার প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে তারুণ্য হলো পণ্যের নতুন সম্ভাবনা। নতুন ক্রেতাগোষ্ঠী। ঠিক আছে, হিপের পকেটদুটো আরেকটু নামিয়ে দাও, আর ফ্রন্টে দুটো টর্নস্টিচ। হয়ে গেল ফাটাফাটি তারুণ্য!

ঠিক আছে, কিন্তু কোথায় তারুণ্য? ম্যাজিক তিনচাকার তারকা  অনুষ্ঠানের প্রতিযোগী রিকশাচালক ওমর গণি তাঁর মধ্য-পঞ্চাশে ঢাকায় রিকশা চালাতে চালাতে আব্বাস উদ্দীন সংগীত অ্যাকাডেমির সাইনবোর্ড দেখে থমকে দাঁড়ালেন। ভাটিয়ালিশাসিত শৈশব, তারপরের দীর্ঘ বিস্তৃত দারিদ্র্য, আজ বহুদিন পর গানের মনটা তাঁর জেগে উঠল। প্যাডেল ফাঁকি দিয়ে দিয়ে তিনি তাল শিখলেন লয় শিখলেন, আজ যখন ষাটোর্ধ্ব বয়সে তারকা হবার দোরগোড়ায়, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনচাকার তারকা’ হয়ে গেলে কী করবেন? বাড্ডায় রিকশা গ্যারেজের পাশে ছোট্ট খুপড়িঘরে থাকেন স্ত্রীকন্যাসমেত, বললেন, বৌ মাইয়া গ্রামে পাঠায়া দিব। গার্মেন্টসে দিব না। অর্থাৎ খ্যাতি হলে অর্থ হলে একটুখানি পর্দাপুশিদাও দরকার। আমি শিখলাম তারুণ্য কিংবা বার্ধক্য আসলে একেকটা দশার নাম। শিখলাম অতৃপ্তিই মানুষকে তরুণ রাখে, বয়সকে অগ্রাহ্য করতে শেখায়। আর তৃপ্ত মন তার বয়সের আস্তাবলে ফিরে যেতে চায়।

আজ বাংলাদেশে যাদের বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের ঘরে, তাদের শৈশব নীতিকথা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীন রাষ্ট্রের অহমিকা দিয়ে শানানো তাদের চেতনা, প্রখর তাদের জাতীয়তাবোধ। মিছিল তাদের তৎপরতার নাম, স্লোগ্যান তাদের ভাষা, ফিকে-হয়ে-আসা সাম্যবাদের স্বপ্নখানা মনে করতে করতে এখনো তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। আর যারা বিশের ঘরে, তারা স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। চোখ মেলেই বিশ্বায়ন দেখেছে, রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় আদর্শের শক্তপোক্ত বাউন্ডারি তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো। তারা বেড়ে উঠছে ম্যাচবাক্সের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্বপ্ন দেখছে ক্রেডিট ট্রান্সফারের, একে অপরকে চিনছে ফেসবুকে। মাত্র দশটা বছরে মধ্যবিত্তীয় নগরতারুণ্যের মধ্যে আমরা কী দুস্তর ব্যবধানটাই না দেখছি! বড়ভাইয়ের কাছে যে সূর্যসেন একটি পতাকা, ছোটভাইয়ের কাছে সে অ্যাডভেঞ্চারমাত্র।

কিন্তু শুধু কি এ-রকমই একরৈখিক? বড়ভাইয়ের গানের রুচি তৈরি হয়েছে রবীন্দ্র-নজরুল-হেমাঙ্গ-সলিল-আজম খান দিয়ে, ব্যান্ডের রিদমে প্রথম প্রথম একটু সশঙ্ক থাকলেও ক্রমে সেটাও তার নিজের ছন্দ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে ছোটভাইয়ের কাছে ফিরে এসেছে রিমিক্স আব্বাস উদ্দীন, রিমিক্স শাহ আবদুল করিম, রিমিক্স কাঙালিনী সুফিয়া। এমনকি শক্তপোক্ত দেশের ধারণায় অধিষ্ঠান না করেও হায়দার হোসেনের স্বাধীনতা খোঁজার তিরিশ বছরের প্রজেক্টে তার অস্বাচ্ছন্দ্য নেই। শহিদ মিনার, লালন ফকির কিংবা দুঃখিনী বর্ণমালা পূনর্জন্ম পেয়েছে তারুণ্যের টি-শার্টে। সাম্যবাদের সম্ভাবনার স্বপ্নযুগের সবচেয়ে রোমান্টিক বিপ্লবী চে গুয়েভারা আজ স্বপ্নহীন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড।

তবু অভিমান হয়। ছোটভাই দৌড়াচ্ছে, আমিও দৌড়াচ্ছি। কিন্তু আমার হাত থেকে রিলে বাটন সে নিচ্ছে না। আমার আদর্শ সে নিচ্ছে না, আমার বিশ্বাসে ওর আস্থা নেই, আমার স্বপ্নে ওর পূর্ণতা আসে না। ফলে আমার দৌড়ও আমি থামাতে পারছি না। পাশাপাশি দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছি, এ নিশ্চয়ই পূরাণকথিত স্বপ্নহীন তারুণ্য, আমার অস্তিত্বের অস্বীকৃতি হয়ে বেড়ে উঠছে! সাম্যবাদের দুধকলা খেয়ে পরিপুষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আজ সে অচেনা, পরিণত মেরুদণ্ড নিয়ে আছড়ে পড়ছে বিশ্বায়নের দরজায়। মজারু দ্বীপে যাওয়ার টিকিট দরকার ওর, স্যাক্রিফাইস শেখেনি, অপেক্ষা ওর ধাতে নেই, ঐতিহ্য নিয়ে কোনো প্রেজুডিস তৈরি হলো না ওর, আমার বর্ষপুরাতন কমিটমেন্টগুলো ওর কাছে স্রেফ খেলনা, আমি যাকে ভাষা বলি ওর কাছে তা এক প্রমিত ভঙ্গিমাত্র, আমি যাকে ফুল বলি ওর কাছে তা ইমোটিকন। ফলে আমি দৌড়াই, হাঁপাতে হাঁপাতে। চুলে কলপ লাগাতে লাগাতে। চশমার পাওয়ার বাড়াতে বাড়াতে। আমার ভাঙাচোরা অপ্রতিভ স্বপ্নগুলোসমেত। প্রলম্বিত তারুণ্য সহ আমাকে হয়তো কাকতাড়ুয়ার মতো লাগে। কিন্তু ভুল সমাবেশের সামনে জানাজার জন্য শুই কিভাবে?

কিন্তু আমি কি আমার কাচের ঘর থেকে বের হয়ে দুদণ্ড ওকে দেখেছি? ভেবেছি কি, ভিসা অফিসের কিউতে দাঁড়িয়ে আনমনে কী স্বপ্ন দেখে সে? ছদ্মনাম নিয়ে ব্লগে লাজুক পছন্দের কথা লেখে সে, আবার স্বনামেই হ্যাক করে রেবের ওয়েবসাইট। গার্মেন্টসশ্রমিকদের রাস্তা অবরোধের কারণে ওর ফেডএক্স ক্যুরিয়ারের অফিসে যাবার পথে দেরি হয়ে যায় বলে সে ওদের মনে মনে শাপশাপান্ত করে, কিন্তু ফিরে এসে রাত জেগে সে কক্সবাজারের পক্ষে ক্যানভাস করে নেটে, শাশ্বত-র চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য ধর্না দেয় এই মেইলে সেই মেইলে, ভ্যালেরি টেইলরকে তাঁর নিজের বানানো প্রতিষ্ঠানে বহাল রাখার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে শক্ত পায়ে দাঁড়ায়। সে সোভিয়েত চেনে না কিন্তু বিভক্ত রাশিয়ার পোলভল্ট তারকা ইয়েলেনা ইসিনবায়েভার মুগ্ধ দর্শক, গুয়াতেনামোর সমালোচক আবার বারাক ওবামার ফ্যান, টুইন টাওয়ারে হামলা ওকে বেদনার্ত করে এবং ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনেও সমান বেদনা। মৌলবাদ ওর অপছন্দ, কিন্তু ইরানী ফিল্মের ভক্ত। আমার মানবধর্মের বার্তাকে পাশ কাটায় না, যদিও নিজেকে সে পলিটিক্যালি মুসলিম ভাবে। বাংলা অ্যাকাডেমির প্রমিত বাঙলা অভিধান কিনে বাড়ি ফেরার পথে সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ দেখতে সিনেপ্লেক্সে ঢুকে পড়ে। আমি ডায়ালেকটিক্স দিয়ে জগৎ ব্যাখ্যা করতে শিখেছি, তবু অনুজের মনোভঙ্গির এই ডায়ালেকটিক্স বুঝতে পারি না।

আমাদের তারুণ্যের গল্পগুলো তৈরি হচ্ছে এই দুই প্রজন্মের দুইরকম চিন্তার টানাপোড়েনে। এই রশি টানাটানির খেলায় কখনো গোঁয়ার্তুমি জয়ী হয়, কখনো-বা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। অনুজের অভিধানে আমি যেন সেই ঘাড়ভাঙা ঘোড়া যার জায়গা আর্কাইভে, রেসের ময়দানে নয়। কিন্তু আমি মীমাংসা না করেই মাঠ ছেড়ে যাই কী করে? আমার এই অমীমাংসিত ও অপ্রতিভ স্বপ্নগুলো ধরে রাখবার এই অদম্য সংগ্রামকে তারুণ্যভিন্ন কীইবা ভাববো আমি?

এর বাইরে যে বাংলাদেশ, নাগরিক মধ্যবিত্তের পারসেপশনে প্রবেশ-না-করা বিশাল গরিবি বাঙলা, তার গতিপ্রকৃতির কাছে আমাদের দুইভাইয়ের এই টানাপোড়েনের মূল্য কতখানি? আমাদের ব্যবধান দিয়ে কি ‘তাহাদের’ তারুণ্য প্রভাবিত হয়? যে তারুণ্য চড়াসুদের টাকায় গলাকাটা ভিসা কিনে মধ্যপ্রাচ্যের কিংবা মালয়েশিয়ার জেলে বা বদ্ধ ফ্যাক্টরিতে ক্রীতদাসের জীবন কাটায়, দূর প্রত্যন্ত জঙ্গলে আত্মঘাতী বোমারুর স্কোয়াডে নাম লেখায় যে জঙ্গী যুবক, বা আরো যেসব শ্রমঘন জীবনে তারুণ্য কোনো আলাদা দ্যোতনা নিয়ে উঁকি দেয়নি কোনোদিন, তারা কিভাবে অভিষিক্ত হয় তাদের তারুণ্যে? শাহ আলম সরকারের গানে যেমন, তাদের যৌবন কী একটা গোল্ডলিফ সিগারেটের মতোই দ্রুত ফুঁকে-ফুঁকে নিঃশেষ করে দেয় তারা? তারা কি স্রেফ রেমিট্যান্স, স্রেফ ক্রসফায়ার, স্রেফ পিতার সংসারের ঘানি টেনে-যাওয়া বোবা আদমসুরত? কী বিশাল এই অকর্ষিত অমা, তার সামনে দাঁড়ালে নিজেদের দুই প্রজন্মের এই টানাপোড়েন লাক্সারি মনে হয়, খেলনার মতো লাগে!

  • লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রচ্ছদছবির শিল্পী সত্যজিৎ রাজন

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you