রকস্টারের জীবনপ্রণালি || আহমদ মিনহাজ

রকস্টারের জীবনপ্রণালি || আহমদ মিনহাজ

শাহরিয়ার নাজিম জয়ের বেমক্কা প্রশ্নবাণের মুখোমুখি খালিদ নিজের গাওয়া গানের মতোই ভানহীন। রকস্টারের যেমন হওয়া উচিত, নিজের যাপন ও বিশ্বাসে স্বতঃস্ফূর্ত চারিত্র্য তো উনারা ধারণ করেছিলেন সেইসময়। আক্ষরিক করেছিলেন। জানি না কী কারণে মাঝপথে এসে হোঁচট খেলেন একে-একে! নগরসমাজের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেদের পোড়ানোর নেশা দপ করে নিভে গেল আকস্মিক। যুগপ্লাবি সংগীত-আন্দোলনের ভিতরে নিজেকে তাঁরা নিয়ে গেলেন এবং আচমকা সেখান থেকে প্রত্যাহার করলেন নিজেদের! মাকসুদদের হাতে বোনা বামবা  তো সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সময়ের সঙ্গে তার দেহে সক্রিয় প্যাশন নিস্তেজ হতে দেখেছি। রকগানের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার আগুন জ্বলে উঠল এবং দপ করে নিভেও গেল যেন-বা! কেন? কী কারণে? এসব প্রশ্ন নিয়ে সোচ্চার আলাপ উঠতে দেখি না।

যদি না নিভত তাহলে এর ছাইভস্ম থেকে জন্ম নিতো বাংলা গানের নতুন ভাষা। জীবনপ্রণালিও। সে-ক্ষমতা খালিদ-প্রজন্মের ছিল। অ্যাভয়েড রাফার মতো এখন যারা গাইছেন, উনাদের মধ্যেও বারুদটা দবদব করছে। সময় এমন, এর পানে তাকানোর, মনোসংযোগের পরিবেশটা মিসিং। তরুণদের কাছে রাফার গান ভীষণ পছন্দের কিন্তু সেখানে সত্তর থেকে টানা তিন দশকের যে-ঘূর্ণি ও উত্তাপ, সেইটা কেন জানি চোখে দেখার মতো দ্রষ্টব্য ঘটনা হয়ে উঠতে পারছে না। দায়ী কে? যারা এই সময় ব্যান্ডগানের কাফেলা বইছেন,—উনারা? নাকি দায়টা স্বয়ং শ্রোতার? জয়ের সঙ্গে আলাপে খালিদ জিজ্ঞাসাটিকে সরাসরি ডিফেন্ড করেছেন। সময়ের সঙ্গে তাঁর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা বা প্রভাব যা-ই বলি, সেটা কেন কমে এসেছে?—বেখাপ্পা প্রশ্নের জবাবে অকপটে বলছেন : জনগণকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবে, আমাকে না। জনপ্রিয়তা কমলে জনগণ জানে, আমি জানি না। খালিদের উত্তরটি পরোক্ষভাবে হলেও শ্রোতাকে দায়বদ্ধ করে বৈকি।

শাহরিয়ার নাজিম জয়ের টিজমার্কা প্রশ্নের উত্তরে খালিদ কিন্তু যে-কোনো রকস্টারের মতোই সোজাসাপ্টা। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, নরমাল লাইফ  কী বা কাকে বলে সেটি জানার মওকা তাঁর কপালে জোটেনি। নিদারুণ স্ট্রাগলের ভিতর দিয়ে বেছে নিয়েছেন গানের ভাষা। সেই ভাষা যেটি তাঁর জীবনপ্রণালিকে ধারণ করতে সক্ষম। জেলের গরাদে থাকার দিনগুলোকে পিকনিক ভাবা কিংবা সেলে বসে গানের আসর জমানোর শক্তি দিতে পারে এমন ভাষাই হচ্ছে রকগানের চাবি। প্রেম কিংবা বিষাদের গানকেও যেটি ভণিতাহীন ডেলিভারি দিতে জানে। সুইডেন আসলামের সঙ্গে মোলাকাত কিংবা নিজের জেলজীবনকে খালিদ ওভাবেই দেখেন। মাইকের স্ট্যান্ড হাতে নিয়ে পিটাইছেন আর গান করেছেন;—এটাই তো এই ঘরানার গানের সহজ শক্তি। স্বয়ংক্রিয় জীবনবেদ ছাড়া রকগান সত্যিকার অর্থে রকগান হয়ে ওঠে না। জয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে বসে খালিদ সেটা ক্লিয়ার করেছেন। বাংলাদেশে ব্যান্ডগানের সূচনালগ্নে এক-একজন শিল্পীর স্ট্রাগল আসলে কেমন ছিল তার আভাস যেখানে পরিষ্কার। কেন্দ্রকে বিচ্যুত করে প্রান্তিকের এই জার্নিটা নিয়ে ভাবনা করার প্রচুর অবকাশ রয়েছে। অবকাশ থাকলেও সাংগীতিক বিস্ফারটাকে ডকুমেন্টেড করার ঘটনায় আমাদের দারিদ্র্য খালিদের কথা থেকে বেশ টর পাওয়া যায়।

বাউল গানটা যেমন নিখাদ বিশ্বাস ও জীবনপ্রণালি, অন্য পথ ঘুরে রকগানও তা-ই। ওটাই পুঁজি ছিল খালিদ-প্রজন্মের। একটা লাইফস্টাইলকে গানে ক্রমশ ধারণ করছিলেন উনারা। বিদেশি রকগানে ওইটা ঘটতে দেখেছি আমরা। লম্বা সময় ধরে দেখেছি। স্টাইলটিকে জীবন ও গানের দেহে ধারণের স্ট্রাগল যে কেবল শিল্পীরা করছিলেন এমন নয়, প্রিন্স মাহমুদের মতো গীতরচয়িতা ও সুরকারদের লম্বা তালিকা সেখানে যুক্ত করাটা অনিবার্য হয়। দারুণ সব বাজিয়ের নাম আসবে কাতার-কাতার। বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাদীপ্ত সাংগীতিক উত্থান, প্রাণপ্রাচুর্যের বন্যায় রঙিন লোকগানের রসে চোবানো বাংলায় আরেকটা স্বকীয় ধারার পদসঞ্চার, এইটা বাংলাদেশের গান  বলার স্পর্ধা যাকে দেখে আমরা করেছি সেইসময়! আত্মপরিচয়, এবং একইসঙ্গে সময় এখানে প্রকাশিত  বলার মতো দার্ঢ্য যার ভিতরে দপদপ করছিল। তারুণ্য যেটি বলতে চায়, সে যেটি করে দেখাতে চায়, তার অকপট উচ্চারণ ছিল সেখানে। প্রায় ত্রিশ বছর মেয়াদি সাংগীতিক কালপর্ব, ইংরেজি নাম্বার শোনার নাগরিক অভ্যাসকে বাংলা গান শুনতে বাধ্য করানোর ঘটনাটি গভীর সমাজরাজনৈতিক তাৎপর্যে মহার্ঘ হওয়ার পথে ছিল, তার মধ্যেই গোলকাধাঁধায় পথ হারালো শেষমেষ!

কিরিল সেরিব্রিনিকভের একটা ছবি দেখেছিলাম,—লেটো; রুশ ভাষায় যার অর্থ সামার বা গ্রীষ্ম। কমিউনিস্ট শাসিত সেকালের মস্কো শহরে তরুণ প্রজন্মের রকগানে বিজড়িত হওয়ার স্ট্রাগলকে ছবিটি তুলে ধরেছিল। একশো খবরদারির চাপ সামলে আন্ডারগ্রাউন্ড রকগানের উত্থানে অবদান রাখা ভিকতর সোই এবং মাকে নোওমানকোর রকস্টার হয়ে ওঠার জার্নি ছিল ছবির প্রাণ। একজন রকস্টারকে কতটা আজব পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যেতে হয়, যেখানে তার ব্যক্তিজীবনের শত টানাপোড়েন তাকে ভোগায়, সেন্সরশিপের দূরবীন তাক করে রাখে রাষ্ট্র, তার মধ্যেই সামারটা আসে। গানের মঞ্চে প্রাণবন্যা ঠিকরায়। লেটোয় ধারণ-করা সেকালের রাশিয়ায় (এমনকি একালেও) রকগানকে দ্রষ্টব্য সাংস্কৃতিক ঘটনায় রূপদানের স্ট্রাগলকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত সেফ জোনে  ছিল মানতে হয়। চড়াই-উৎরাই  থাকলেও অতটা বাধা ও প্রতিকূলতাকে তাকে মোকাবিলা করতে হয়নি। কাজেই সুযোগ ছিল একে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়ার, যেখান থেকে উত্থান ঘটত নতুন কোনো ধারার। তা-সত্ত্বেও প্রাপ্তি কম নয়। সে কী হয়েছে এবং আরো কী হতে পারতে অথবা এখন কী হচ্ছে, একে পাখির চোখ করে শুধু দেখাটা বাকি।

লিঙ্ক : টিজমার্কা সাক্ষাতানুষ্ঠানে কেমন করে একজন রকস্টার তাঁর জীবনপ্রণালির ইশারা রেখে যান, বুঝতে/দেখতে চাইলে এই লিঙ্ক ক্লিক করতে পারি—
শারিয়ার জয়ের রম্য কথানুষ্ঠানে রকস্টার খালিদ সাইফুল্লাহ
(১৩টি প্রশ্ন | পর্ব ১৭৯ | Khalid | Shahriar Nazim Joy | Channel i Shows)


গানপারে ব্যান্ডসংগীতজীবী খালিদ সাইফুল্লাহ
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you