হাওর সিরিজ || শামস শামীম

হাওর সিরিজ || শামস শামীম

উদগল
একটা পাখির মতো বিকেল
ডুবে গেল উদগল হাওরে
আমরা বারো রকমের মানুষ
হা করে তাকিয়ে রইলাম

.

মাটিয়ান
জলের কান্তার তুমি নাম মাটিয়ান
কান পেতে শুনি কত শব্দহীন গান
তোমার নাভিতে নামের প্রোজ্জ্বল ভূমি
শ্রীপুরে জিরোই পথিক, রাধাকেই চুমি

.

শনি
শনিদেবতাও ভরে রেখেছে মঙ্গলভাঁড়ার
তুলে রাখো মা, খুলে রাখো নয়ন অপার
গোপাট ধরে হাঁটি, আসি-যাই নীরব বেহেলী
অবিনাশী কীর্তিগাথা ধরে রেখো প্রাচীন হাবেলি

.

ছায়া
তোমার চৌরঙ্গী মোড়ে খাড়া চারজন দুয়ারী
আমি তো হতে চেয়েছিলাম গস্তিনাও সওয়ারি
নামেই ছায়া কেবল আদতে বিরান প্রান্তর
বৃক্ষলতাবাকলের শোকে কাঁদে পোড়া অন্তর

.

ভাণ্ডাবিল
দাড়াইনের তীরে রেখেছো মাথা, ঘুমাও আরামে
হিন্দু-মুসলিম সান্ত্রী তোমার, ফসলের মোকামে
ললাটে এঁকেছে কলঙ্ক কুলাঙ্গার স্বাধীন মেম্বার
তোমাকে উদোম বানিয়ে রাখে ভোটের চেম্বার

.

দেখার হাওর
দেখতে দেখতে কত দিঘি হলো সরোবর
আমাকে ভুলিয়ে রাখে তোমার নিদাগ চরাচর
দরিয়াবাজ বরষায় জমে হাডুডু খেলা
পুঁথির হাহাকারে কাঁদে কালাচানতলা

.

কানলা
ফসলে নুয়ে গেলে তোমার বুক
সীমান্ত জলে করে ধুকপুক
রঙের চর হয়ে ঘুমাও বিরামপুর
ওপারে বালাট ওই, বাজে কীর্তনীয়া সুর

.

খরচা
জীবন খরচ করে রচনা করেছ মহিমাস্মারক
ময়দানবী ভবন নাচে, কে তোমার বাহক
ছোট হয়ে যাচ্ছো তুমি আয়ুর মতো
ভুলে গিয়ে মুছে দাও প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষত

.

মহালিয়া
তোমার মহাল ভেঙে বইছে চিকন পাটলাই নদী
দিবানিশি গাও নাম, ডাকো তারে ওহে দরদী
বুড়া ঠাকুর এখনো সটান হাতে বিশ্বাসের লাঠি
নাম জপো, গায়ে মাখো — এ বড়ো পবিত্র মাটি

.

হালি
বুক ঘষে হেঁটে যায় নামগোত্রহীন কত কৃষক
পিআআসি কারবারিরা তোমার স্বপ্নহন্তারক
ঝড় আর বানের কাছে বন্ধক আছে তোমার শরীর
রাখেনি খোঁজ কেউ পুঁজির ডানাভাঙা তরীর

.

চন্দ্রসোনারথাল
পানিমন্ত্রী ভয়ে, দেখে — কৃষক মালেকের চোখে আগুন
ধান্দামান্দায় বিজি সবাই কেড়ে নিয়ে ফসলের ফাগুন
কোনও এক পৌরাণিক রাতে ভেঙে পড়ে আলোর থালা
তোমার বুকে আগুন রে বন্ধু আমার বুকে জ্বালা…

.

ডাকুয়া
ডাক দিলে ছুটে যাই, খুঁজি পৈরদাদার বাস্তুভিটা
বোরোর পারায় তুলে রাখো হারানো সুস্বাদু পিঠা
তোমার চিবুক ছুঁয়ে নামে পাতালের ধানগন্ধ শিশির;
হাঁক তুলে ডাক দেয়, আসো বন্ধু শিগগির!

.

ভরাম
গদাধর ভীমও ভয় পায় তোমার আফাল নাচন
শারফিন কালিরে ডাকে, বুকে দুরুদুরু কাঁপন
আগধানে পূজা দেয় কিষাণী পোয়াতি
হাজার বছর ধরে জারি আছে এমন বেসাতি

.

কালিয়াগুটা
একচোরে বিয়া করে আরেক চোরের হালি
এপারে কৃষ্ণের বাস ওপারে কালি
জলাত্তি ঢেউ ভেঙে এগোয় জ্যোতির নাও
ভাটিতেই থিতু চোখ, তুমি উজানে তাকাও —

.

পাগনা
জলাঙ্গী ঢেউ নেই মওসুমে কাঁদো চাষের বেদনায়
নলচুন্নি জেগেছে দেখো বহুবর্ণিল চেতনায়
চুলের মতো নদীগুলো হেমন্তে মাছের খামার
তোমাকে খুন করে মাজন সাজে চামুণ্ডা চামার

.

নলুয়া
বেঁধেছিলেন ঘর, তোমার জাঙ্গালে — রাধারমণ
কুশিয়ারা তল্লাট খুশিতে টলমল পেয়ে রাঙা চরণ
পাইলগাও বুড়াখালি দাস নোয়াগাও
সতত স্মৃতির ঘুড্ডি আকাশে ওড়াও

.

টাঙ্গুয়া
দুনিয়া দিয়েছে তোমায় রামসা স্বীকৃতি
খুন হয়ে যাচ্ছে রোজ তোমার প্রাণ ও প্রকৃতি
নেই সেই নয়কুড়ি কান্দা ছয় কুড়ি বিল
পর্যটক দঙ্গল এখন করে কিলবিল

.

জোয়ালভাঙা
ভেঙেছে বেভুতা কৃষকের ঘর, মই আর জোয়াল লাঙল
কলিকালে কুন্দ হেমইতে সেচ দেয় কোন-সে পাগল
তোমার মহাল লুটে বেলইজ্জা বাইন্যা
চাচাকেও গছিয়ে দেয় সলজ্জ কইন্যা


শামস শামীম রচনারাশি
নির্বাচিত কবিতা গানপার সংকলন

COMMENTS

error: