বিগত-দশকগুলোয়-অবধারিত-হয়ে-ওঠা ভাষার ওপর ঠেকনা দিয়ে ব্যক্তি-অনুভবের ভাষান্তরে নব্বইয়ের কবি এখন আর বাধ্য নয়। ভাষা তাঁর ইচ্ছা ও ঝোঁকের অধীন, যে-অঙ্গে মন মাতে তাকে কবিতায় জীবন দিতে বাধা নেই। ভাষার মাঝে বিদ্যমান বর্ণপ্রথার তাবেদারি নয় বরং কবিতার প্রথাসিদ্ধ নির্মিতি উপেক্ষা করে সেখানে গুরুচণ্ডালী দোষ ঘটানোর প্রবণতায় অতীতদিনের কবিদের তুলনায় তাঁরা বরং অনেক বেশি নির্ভার ও স্বনির্ভর। বিগত দশকগুলোর ন্যায় একরৈখিক ভাবাদর্শ ও সাহিত্য-আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার কারণে নব্বইয়ের কবিতার ভাষা-প্রকরণ ও প্রয়োগে ব্যাপক ভিন্নতা চোখে পড়ে। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা বা চিত্রকল্পের স্বভাবসিদ্ধ ব্যাকরণ ভেঙে নতুন সুর সংযোজনে ভাষার বিবিধ রূপকে নিজ প্রয়োজন অনুসারে নিষ্কাশন ও একত্র সন্নিবেশের ঝোঁক দশকের কবিতাকে জটিল ও বিচিত্রগামী করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ কবি মাতিয়ার রাফায়েল-র নাম স্মরণ করা যেতে পারে। অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতকে সৃষ্ট সাহিত্যিক ভাষার ব্যাকরণকে রাফায়েল বিশেষ কারণে বেছে নেন এবং নিজস্ব ছকে সেখানে অর্থগত বিপর্যাস ঘটান :—
কে হায় ঘরের ঠাকুর ফেলিয়া ধরে আর বিদিশি কুকুর! তখনই ‘জনমত’ ওঠে, স্বদেশি জগতে নয়া কোনও জ্ঞান না হৈলেও চলিবে। পৃথিবীর ইতরবিশেষ কিছু হয় তো হৈলে হৌক। নিদেন তালুক হারানো ভালুকদের সামনে আমরাও না হয় হইলাম কালো চামড়ার নিচে মামলুক। দে’খো না, মা’গো, বিৎরে বিৎরে পোকায় কাটে কাটুক!…
পেল্লাই যুগেরও শুরু এই অব্দেই। প্রলয়ে তাড়িতের স্বপ্নে-ভাঙা জলপাই ডালে-ডালে পাতার প্রতিধ্বনিগণ ভূমিষ্ঠ হৈল জনগণে। প্রসববেদনার ইতি, ইহারই পর। নয়া পরিবেশবাদের কথা লৈতে লৈতে খুলিয়া ফেলিল পৈতে, নয়া ব্রাহ্মণের সভাসদগুলি। গঙ্গাস্নান পূর্বে, নয়া মাল মূলের। শিরায় হাজিয়া মসৃণ তনু সুশীল-সুশীল চিল হৈয়া যাইবার কালে। আকাশ বাঁকানো শঙ্খের খিলানে, নীল দরিয়াতীরে, বকে বকে ওড়া চুম্বকচোখে, অথই অথই দিল দরিয়ার।
(পেল্লাই যুগের শুরু)
বাংলা সাহিত্যে বাবু কালচারের সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ও তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঔপনিবেশিক আরোপনের রাজনীতিকে পরিহাসদীপ্ত শ্লেষে আঘাত হানার প্রয়োজনে কবি ওই সময়ের ভাষাঅঙ্গে নিজেকে জোড়েন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ হয়ে ‘সুহাসিনীর পমেটম’ কিংবা ‘গুড ফ্রাইডে আইল্যান্ডে নরমাংস ভক্ষণ’-এ লিপিবদ্ধ ভাষা-প্রকরণ তাঁর কবিতায় নতুন অঙ্গে অনুরণিত হয়। এহেন বয়ানের আশ্রয়ে যেন-বা বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের মতো ভাষার ঔপনিবেশিক আরোপনের ইতিহাসকে কবি বিদ্রুপের শেল হানেন। তাঁর এই শেলাঘাত এডওয়ার্ড সাঈদের ছকে প্রাচ্য স্বভাবে মর্মরিত ঔপনিবেশিক দাস-মনোভাবকে পরিহাসবিদ্ধ করে যায় :—
কাম নাই, কাম করে নিম্নকোটি, নিষ্কাম উচ্চকোটি করে ভাষার আড়তদারি,
সমকাম মানে সমাজতন্ত্র, উভকাম মানে কর্পোরেট-আমলাগোত্র, বহুকাম আর
লিবারাল গণতন্ত্র আসছেটা কই?
হেই হেই রামতনু লাহিড়ী, বাড়ি আছো নাকি গাছো বে’ ওপরছো?
সেইগোত্রে বেহাল আমার দিনকাল রাতকাল যায়, ‘বুলবুলির লড়াই
দেখিয়া’…দেখিয়া…
(অধুনা রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ)
…
ফিরা আসে একদিন নাবিক, দেখে আর অবরুদ্ধ যবনিকা মেলাদিন পর : দিকে দিকে শুধু দূর দূর, দূর নোঙর, নোঙর ফেলা ভোর। টিম টিম ঝোলান লণ্ঠন; ‘মা, আমাদের রাইতকে রাইত পার হওয়া হাওয়া লণ্ঠনটি গেল কোনাই? খুঁইজা দ্যাখো তো সেই ইন্দুরটিই নিয়া গেল কি না…’ পুনর্বার, গুলাইয়া যায় আবছা আবছা অন্ধকারে অন্ধকার; ক্ষয়ে যাওয়া পাথর; তামসিক জীবনে পুনর্বার। চাপা পড়া নাভিশ্বাসে। ক্রম প্রসারিত হাত, গোপন অনুভব…পুনর্বার, ব্যস্ততা ঝাড়া দিয়া ওঠে দূরে অনতি, বাঁকানো লাল ঝুঁটিঅলা মোরগ এক, মধ্যবয়েসী; দুঃসহ যাপন যার আপন রাত্রিকালীন বিবরণে…এবং অন্যত্র, আরেক খাড়া লালঝুঁটি বনমোরগ, জানায়ে দেয় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তার সাবালকত্ব অর্জনের মুহুর্মুহু বহু এষণাযুক্ত সাড়ম্বর ঘোষণা :
কুককুরুকো কু কুককুরুকো কু, কুক…দূরতর, বাতাস বহিয়া নিয়া আসে কানে…
(প্রহরী)
কালীপ্রসন্ন সিংহের সংবাদ বিবরণীর ধাঁচে অগ্রসর এই কড়চাকাহিনি রস-পরিহাস আর ইয়ার্কিঘন বয়ানে কবিতার ছন্দ ব্যঞ্জনা ও রূপকতায় বিশেষ হানি না ঘটিয়ে নিজ মকামে পৌঁছায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অঙ্গে বঙ্গীয় রেনেসাঁপ্রসূত ব্রাক্ষণ্যবাদী প্রভাবে সৃষ্ট আরোপিত ইতিহাসকে উপজীব্য করায় এই কবিতা হিন্দু ও মুসলমান জনমানসে বিরাজিত সাংস্কৃতিক সংঘাতকে নগ্ন করে তোলে। ইতিহাস ও সমকালে সক্রিয় চিহ্নসূত্রের আড়ালে যেসব দমননীতি ভাষা সাম্রাজ্যবাদকে অনিবার্য করে সেখানে ঢুকে পড়ায় আপাত দুর্বোধ্যতার আদলে বোনা মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতা স্বেচ্ছায় প্রতি-অভিসন্দর্ভ (Counter Discourse) তৈরির দিকে ঝুঁকে থাকে! সংস্কৃত রূপমূল থেকে আগত শব্দের পাশাপাশি কথ্যরীতির শব্দের সহাবস্থান ঘটিয়ে বিরচিত পঙক্তিরা একই অঙ্গে কবিতা ও আখ্যানবীজ ধারণপূর্বক উপসংহারে পৌঁছায়। ভাষাকে কেন্দ্রাতিত অবয়ব প্রদানের বাসনা মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতায় গোপন কোনো বিষয় নয়, যদিও দিনশেষে সংস্কৃতি ও কথ্য শব্দের সহাবস্থান থেকে বিরচিত পঙক্তিমালা কেন্দ্রাতিত হতে পেরেছে কি? অথবা এডওয়ার্ড সাঈদের ঘরানা মেনে প্রাচ্যবিদ্যা পাঠের ঐকরৈখিক লয়তালের দাসত্বে নিজের আয়ুক্ষয় করছে? পাঠশেষে এহেন জিজ্ঞাসা পাঠকের মনে ওঠে। কবিতায় ব্যতিক্রম পথে মোড় নেওয়ার প্রবণতা কবিকে প্রতিকূল স্রোতে লগি ঠেলার শক্তি যোগায় বৈকি; তবু মনে রাখা প্রয়োজন, নব্বইয়ের কবিতা সর্পিল গতিতে সেই তীরের দিকে এখনো ধাবমান যেটি ‘সবুজে শ্যামল নীলিমায় নীল’ হলেও প্রকৃত অর্থে বায়বীয় ও নিরালম্ব।
রিলেটেড রচনারা
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
COMMENTS