হিজলমহাল

হিজলমহাল

প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে কাজ নাই, সিটি কর্পোরেশন এবং অ্যাডজ্যাসেন্ট এলাকায় সার্চ করলেই অবাক হবার মতো খবর মিলবে। এমনিতে একেকজন তালেবর আমরা ভাবি যে একেকটা ‘আমার’ আইসাইটে যা নাই তা আসমুদ্দুরহিমাচল ঢুঁণ্ডেও খবর করা যাবে না। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। বিপুল ভুবনের কতটুকু অজানা তা নিয়া আমার শরমভরম কম, যতটুকু জানা তাতেও গলত বিস্তর, তবু চোখের সামনেকার ব্যাপারস্যাপার সহসা আবিষ্কৃত হয় এবং এদ্দিন যে এর বিন্দুবিসর্গও জানতাম না তা ভাবিয়া খামোশ রইতে হয়। হিজল সম্পর্কে পেহচানা ভালোই ছিল ভাবতাম, কিন্তু হিজলের মার্কেট আপডেট জানলাম অতি রিসেন্টলি। হিজল শুধু দেখনদারি দিয়াই নয়, কাজেকামেও জব্বর। এমনিতে হাওরপার ধরে যেতে যেতে দূরে দূরে হিজলের দৃষ্টিনন্দন অবস্থিতি নজর কাড়ে। সিলেট-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ বেল্টে ভ্রমণকালে বাহনবাতায়নে হিজলের আনাগোনা সাধারণদৃষ্ট। কিছুদিন আগেও সিলেটের শহরসংলগ্ন প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িভিটায় একাধিক পুকুর মজুত ছিল, এবং পুকুরধারে গোটাকয় হিজল আর আশশ্যাওড়ার গাছ। গত দুই দশকের নিসর্গবিনাশী তাণ্ডবে সেসব উবে গেছে ভেবেছিলাম। না, উবে যায়নি, আছে তলে তলে। এবং অবাক করার মতো বড় প্রয়োজনে হিজলচাহিদা ক্রমবর্ধমান।

মৎস্যচাষীদের কাছে গেলে হিজলের কদর জানা যায়; — বিশেষত সেইসব মৎস্যচাষী যারা হাওরের চলন্ত খোলা পানিতে মাছচাষ করেন। হিজলের ডাল ছালবাকলাসমেত পানিতে ফেলে রাখতে হয়। এর চামড়া পানিতে পচে ঢের দেরিতে। এবং ডালগুলোকে মাছচাষীরা ‘কাঁটা’ ডাকেন, ‘ডাল’ বা ‘ইজল’ ডাকটাও চালু, বুনোঝাকড়া পাতাপল্লবিত হিজলডালে যদিও কণ্টক বা কাঁটা নাই। হিজলডালের ছাল মূলত মাছের ফ্যুড-স্টার্টার হিশেবে কাজ করে। এই হিজলছালে মাছ তার গতর আঁচড়ায়। হিজলডাল ঘিরিয়াই মাছেদের দিনভর কোলাহল লক্ষ করা যায়, রাত্তিরে নিদ্রা যায় তারা ডালগুলোর প্যাঁচানো পরিসর ঘেঁষে। এইখানটাতেই তাদের নিশ্চিন্ত ফুর্তিফার্তা আর ঘরবাড়ির নির্ভরতা। মাছেদের বাসা এই হিজলের ডালবাকলা। আশশ্যাওড়ার ডাল দিয়ে যেমন পুকুরের আবদ্ধ পানিতে একসময় মাছবাসা বানাতে দেখতাম, দুপুরের ঝিমরোদে শ্যাওড়াডালগুলো মাছঠোক্করে তিরিতিরি কাঁপতে দেখতাম, হাওরবিলে হিজলের ডালগুলোও ওইভাবেই তিরিতিরি কাঁপে কি না তা অবশ্য দেখা হয় নাই। নিজস্ব পুকুর ছিল বর্তমান প্রতিবেদকের ধূসর কোনো অতীতে, সেই পুকুরতীরে দুপুরযাপনের অভিজ্ঞতাই নিকটজন্মের স্মৃতিশ্রেষ্ঠ, নিজস্ব হাওর ছিল না কোনোকালেই এবং দূরের ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কাজেই হিজল সংক্রান্ত যা-কিছু অভিজ্ঞতা তা খানিকটা রিয়ার্ভিয়্যু দর্পণে দেখা আর খানিকটা লোকমুখবাহিত। তবে শ্যাওড়াগাছের ডাল পুকুরে ফেলা হলেও হাওরে ফেলা হয় না সচরাচর। কারণ শ্যাওড়া, আমাদের অঞ্চলে বলে ‘হ্যাওরা’, সাধারণত দ্রুত পচে যায়। ছালের সেন্টটাও তুলনামূলক অল্পস্থায়ী।

হিজলডালের বা হিজলকাঁটার পাতা ঝরিয়ে, ডাল শুকিয়ে নিয়ে, শাখার কষ মেরে পানিতে ফেলতে হয়। এর ঘ্রাণ মাছনাসারন্ধ্রের জন্য উত্তেজক। হাওরের মাঝখানে একাকী কিংবা সারিবদ্ধ হিজলগাছ দেখি আমরা দূর থেকে। সেসব গাছের গোড়ায় নৌকা বান্ধা থাকতে দেখি। কিন্তু মাছের বাড়বৃদ্ধির জন্য ডাল কেটে পানিতে ফেলতে হয়। হাওরের ব্যাপ্ত জলভূভাগ ছাড়া হাওরসংলগ্ন বসতবাড়িগুলোতে এই গাছ পাওয়া যায়। একেক সিজনে গেরস্তপ্রতি বিশ-পঁচিশহাজার টাকা আয় হয় হিজলকাঁটা বিক্রির মাধ্যমে। একেকটা গাছ থেকে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১০/১৫ ডাল মেলে। ১০০ থেকে ২৫০ টাকা রেঞ্জের রেইটে একেকটা ডাল বিক্রি হয়; আবার ৫০০ টাকার ডালও রয়েছে। ব্যাপারটা, গাছের ডাল কেটে এই বিকিকিনির ব্যবসাটা, আমাদের ইকোনোমিতে সেভাবে কাউন্ট হয় না। খালি এই একটাই তো নয়, এমন আরও অনেক ইনফর্মাল ব্যবসায় আছে যেগুলো দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখছে সেই হিসাব কেউই কিতাবে রাখে না। ভালোই হয় হিসাবের বাইরে থাকলে, বেহুদা গবরমেন্টের ট্যাকশো বসে না প্রান্তিক জনপদবাসীর উপরে।

একটা হাওরে মাছচাষ মানে কিন্তু পুরা হাওরের পানি মাছে থৈ থৈ করবে এমন নয়। বিলগুলোর মাঝখানে একেকটা গাতা বা গর্ত থাকে, যেগুলোকে বলা হয় ‘ঝাঁপ’ বা ‘গড়’, এতদঞ্চলে সেই গাতা বা গর্ত ‘হরই’ নামেই বেশি সম্বোধিত হয়ে থাকে দেখতে পাই। বিলের ডাক বা নিলাম যখন হয়, আগ্রহী ‘বিলুয়া’ তখন হরই আন্দাজে ক্যাল্কুলেইট করেই বিলের দাম হাঁকায়। হরইয়ের বাইরের জায়গাগুলো হচ্ছে জাওর। হরইয়ের ভিতরেই মাছের মূল অধিবাস। জাওর জুড়ে মাছেদের চরাফেরা, মাছের লীলাখেলা, মাছেদের প্লেজার। খানাখাদ্য হরইয়ের মধ্যেই দিতে হয়। কিন্তু যত বড় আয়তনের জাওর, হরই ততই ছোট হয়ে থাকে। জাওর ছোট থাকার মানে হচ্ছে সেই বিলের হরই বড়। অতএব সেখানে খানাখাদ্য অনেক বেশি রিকোয়ার্ড।

শুধু যে হিজলডাল দিয়াই ফিশেদের খাদ্যপুষ্টি নিশ্চিত করছেন আপনি, তা নয়, একদমই তা নয়। সিঁদল, বিস্কুটগুঁড়ো, খৈল, ভুষি ইত্যাদি লবণ সহযোগে ১দিন পানিতে ভিজাইয়া রাখিয়া তারপর মাছেদেরে দিতে হয়। আড়াই থেকে তিন লক্ষাধিক টাকার খাবার লেগে যায় মোটামুটি মাঝারি আয়তনের একজন বিলুয়ার একসিজনে। এইভাবে একটানা তিনসিজন শেষে সেচযোগ্য হয় বিল, মাছেরা স্বাস্থ্যপুরুষ্ট হয়, অনেক সময় বিলুয়া নিজে না সেচে বিল বেচে দেয় ব্যবাসায়ীদের কাছে।

এই হাওর ও বিলকেন্দ্রী মাছচাষীদের মধ্যে একটা আলাদা ভাষার হাসিমস্করা, হরর কাহিনি, লোককথা আর বাচনভঙ্গি-প্রবচনের জগৎ রয়েছে। “যেমন আছে বনের ভিতর বাঘের আনাগোনা, হাওরে তেমন হেজা” … হাওরপারের এদিকটায় ‘হেজা’ মানে ‘দেওলা’/দৈত্যদানোর মতো কিছু-একটা, আবার হুবহু তা না, হেজার কিচ্ছাকাহন আলগ কিসিমের।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you