বাংলাদেশের নগরজীবনে হিপহপ কালচারে দ্রবীভূত র্যাপ গানের বিস্তার, প্রভাব ও গভীরতাটা আন্দাজ করার বাই চেপেছিল মাথায়। শুরু থেকে সাম্প্রতিক গানগুলো যারপরনাই গত কিছুদিন থেকে যতটা সম্ভব টানা শোনার চেষ্টা করছিলাম। দ্রুতলয়ে গীত র্যাপ গানে গায়কি সহ সামগ্রিক পরিবেশনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্ত্যমিলনির্ভর গানের কলি বা লিরিক্স হচ্ছে তার প্রাণভোমরা। শুনতে যেয়ে মনে হলো মার্কিন মুল্লুক থেকে আগত ও হিপহপে একীভূত গানের ধারাটির সঙ্গে আমাদের পুথিপাঠের মৌন সাদৃশ্য রয়েছে! র্যাপের চরণকলি অনেকটা পুথির মতো বাদ্যযন্ত্র আর পৃথক সুর না জুড়ে দিব্যি আওড়ানো যায়। পুথিপাঠের ধাঁচকে যদি গায়নভঙ্গি ভাবি (*আশা করি সেটা কবীরা গোনাহ বলে বিবেচিত হবে না।) তাহলে দেখব কাহিনির আবহ বুঝে পাঠক নিজের কণ্ঠস্বরকে সেখানে খেলিয়ে নিচ্ছেন। কাহিনির প্রতি পরতে লুকিয়ে থাকা নাটকীয় অনুষঙ্গে তাল দিয়ে তার কণ্ঠস্বর দ্রুত থেকে মন্থর লয়ে ওঠা-নামা করে। গলাকে ওপরে উঠানো ও খাদে নামিয়ে আনার পাঠপদ্ধতি শ্রোতাকে পুথির কাহিনিজালে বেঁধে ফেলে। র্যাপ আঙ্গিকে গানের উপস্থাপনা পুথিপাঠ থেকে ভিন্ন হলেও কোথায় জানি দুটি মাধ্যম একে অন্যকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বলে ভ্রম জাগে মনে!
পুথিপাঠের ক্ষণে কাহিনি-প্রাসঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র ইচ্ছে করলে জোড়া যায়। মাত্রাজ্ঞান বজায় রেখে আলগা সুর ও অবহসংগীত ব্যবহারে অসুবিধা নেই। ওদিকে কিছু না জুড়লেও ক্ষতির কারণ ঘটে না। পুথিতে বর্ণিত কাহিনি রিসাইটেশন বা আবৃত্তির ক্ষণে পাঠকের গলায় যে-সুর উথলায় সেটা সকল অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দেয়। র্যাপকেও খানিক সেরকম মনে হলো। কবিতা আর ছড়াগানের আঙ্গিকে বিরচিত বুলি দেহের আন্দোলন ও কণ্ঠস্বরের সাহায্যে গায়ক দ্রুতলয়ে আওরায়। সময় যত গড়াতে থাকে শ্রোতার মনোযোগ গানের কথায় ঘনীভূত হয়। র্যাপ অঙ্গে পরিবেশিত গানে কথা বা লিরিক্সের গুরুত্ব যে-কারণে অপরিসীম। গায়কের গলা থেকে ছিটকে বের হওয়া শব্দের সঙ্গে শ্রোতা সবিরাম সংযোগ করে সেখানে। পুথির ক্ষেত্রে কাহিনির নাটকীয় মোচড় তার কাছে উপভোগ্য বিষয় হয়ে ওঠে। র্যাপ গানে গল্প বা বক্তব্য রাখার ছলে গায়কের আত্মকথন ও সেখানে নিহিত বার্তা শ্রোতামনে ভাবরসের জোয়ার বহায়।
নিজের কাহিনি শোনাতে বসা গায়কের কথায় আলগা সুর ও বিট যদি জোড়া সম্ভব হয় তো ভালো, জুড়তে না পারলে গানের কলি আওড়ানোর ছন্দটা সকল ঘাটতি মিটায়। পরিবেশনাকে আকর্ষণীয় করতে বেশি হলে মুখ দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ বা র্যাপের ভাষায় বিটবক্সিংকে (Beatboxing) গায়ক ব্যবহার করে থাকে। বিশ্ব জুড়ে শত হাজার বিটবক্সারের তালিকা থেকে নির্দিষ্ট কারো নাম বাছাই করা কঠিন। জগৎসেরা বিটবক্সার নিয়ে শ্রোতামহলে অহরহ মতভেদ ঘটে। বিটবক্সিং হচ্ছে এমন এক শিল্পকলা যেটি তার জন্মলগ্ন থেকে বিচিত্র উপায়ে নিজের উৎকর্ষ ঘটিয়ে চলেছে। মার্কিন মুল্লুকে কেভিন ওলুসোলা, রাহজেল, এমবি 14, আ্যাডাম রাপ কিংবা ভারতবর্ষে সেরা গণ্য ভিনেথ ভিনসেন্ট ছাড়াও বিশ্বমানের বিটবক্সারের তালিকায় অজস্র নাম রয়েছে। শ্রোতারা নিজ পছন্দ অনুসারে নামগুলো নিয়ে থাকেন। বিশ্বসেরাদের বাইরে পৃথিবী জুড়ে অজ্ঞাতনামা অসংখ্য বিটবক্সার এই কলার উৎকর্ষে নীরব অবদান রাখছেন। বাংলাদেশে ঢাকা ও বাইরের জেলাশহরের রাস্তাঘাট বা খোলা চত্বরে বিটবক্সিং করে যাচ্ছে এ-রকম প্রতিভার সুলুক গুগল ও ইউটিউবে গমন করলে মিলে। সংখ্যাটা প্রতিবেশী ভারত বা অন্য দেশের তুলনায় সীমিত হলেও একেবারে নগণ্য নয়।
সে যা-ই হোক, বৈচিত্র্য ও প্রাসঙ্গিকতার পরিসর বাড়াতে বাংলা র্যাপ গানের পরিবেশনায় পুথিপাঠের আঙ্গিক ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে মনে করি। যতটুকু শুনেছি এ-রকম নিরীক্ষা এখনো চোখে পড়েনি। মার্কিন ধাঁচের পরিবেশনরীতির মধ্যে স্থির থেকে অথবা এর থেকে খানিক বেরিয়ে এসে ভবিষ্যতে কাজটা যদি কেউ করেন তাহলে স্থানিক সংস্কৃতির দেহে সক্রিয় চিহ্নগুলোর সঙ্গে র্যাপের সংযোগ আরো নিবিড় হবে। দেশীয় সংস্কৃতির হরেক অনুষঙ্গ নিজদেহে একীভূত করার অদম্য যে-শক্তি র্যাপ গানে বহে তাকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করা শিল্পীর কামিয়াবি গণ্য হয়ে থাকে। মালজোড়া-ঘাটুগান-আলকাপ অথবা গাথা-পালা-কবিগান থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার পথেপ্রান্তরে ছড়ানো লোকচিহ্নের প্রয়োগকে র্যাপ গানের পরিবেশনায় অনেকে অপ্রাসঙ্গিক ভেবে থাকেন। কেউ আবার নাক সিটকান এই বলে যে, মার্কিন মুল্লুক বাহিত হিপহপের অবিচ্ছেদ্য অংশ র্যাপে আমাদের লোকায়ত গায়নপদ্ধতির সংযোজন বেমানান ও হাস্যকর। পরীক্ষানিরীক্ষায় না গিয়েই তারা নিশ্চিত যে পরদেশ থেকে আগত সংগীতমাধ্যমে ওসব চলবে না! অন্ধ অনুকরণ হিপহপের মৌল চেতনার পরিপন্থী আর সেটা তারা বোঝেন বলে মনে হয়নি। র্যাপ গানের বিশ্বস্বীকৃত বৈশিষ্ট্যকে আহত না করেও দেশের বিচিত্র গায়নপদ্ধতিকে সেখানে জুড়ে নতুন মাত্রায় আরোহন সম্ভব; — এই ভাবনায় গমন করতে না পারলে বাংলা র্যাপ ওরফে হিপহপকে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ রূপে সমাজের সকল স্তরে পৌঁছানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
মার্কিন দেশে ভূমিষ্ঠ র্যাপ আলাদা করে কোনো সংস্কৃতি নয়। র্যাপটা সেখানে হিপহপ নামে বিদিত জনসংস্কৃতির অংশ ও তার দেহে একীভূত। বিচিত্র সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ বক্ষে ধরে হিপহপের সীমানা যতদূর বিস্তৃত হয়েছে তার সবটা র্যাপগায়ক ব্যবহার করতে কার্পণ্য করে না, যদিও গানের কথায় ঠাসা বার্তা বা বক্তব্য কমজোর হলে সকল কেরদানি বৃথা মনে হতে থাকে। কবিতা ও ছড়াগানের যুগলবন্দি র্যাপ গাইতে উন্মুখ গায়কের মধ্যে তাই স্বভাবকবির গুণ থাকতে হয়। ফ্রিস্টাইল র্যাপের পালে জোর হাওয়া লাগার দিন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক পদ রচনার ক্ষমতা আরো অন্তিম হয়ে উঠছে। সাচ্চা র্যাপগাইয়ে যে-কারণে খাঁটি স্বভাবকবির গুণ রপ্ত ও নিজের মধ্যে সেটা ধরে রাখতে চেষ্টা করে। সংগীতের বিশেষ এই মাধ্যমে যেসব তাৎক্ষণিকতা বিরাজ করে গায়ক যদি সেগুলোকে যাপন করতে না শিখে তবে তার পক্ষে র্যাপে কেরদানি দেখিয়ে বাজিমাত করা কঠিন। স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের কারণে র্যাপকে নাগরিক গলিঘুঁজিতে ভূমিষ্ঠ লোকসংস্কৃতি (Urban Folk) বলে দাগানো শেষ কথা নয়, তার ভাষা ও পরিবেশনরীতি অকৃত্রিম হচ্ছে কি না এই ব্যাপারে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
একজন র্যাপারের সঙ্গে লোকায়ত কবি ও গায়কের তফাত এই জায়গা থেকে ভাবলে নগণ্য মনে হবে। তারা একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন আর এটাই হচ্ছে মেলবন্ধন বা ফিউশন। আমাদের র্যাপে এইসব লক্ষণ এখনো প্রবল নয় তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় হবে। পোলাপানের জগতে ঘোরাফিরা করতে স্বস্তি বোধ করলেও বয়স্কদের হৃদয়ে সে যখন স্থান করে নেবে সেদিন থেকে গায়ক নিজের গরজে নতুন চিহ্ন সেখানে একীভূত করতে মরিয়া হবে। স্থানিক সংস্কৃতির দেহে স্রোতের মতো বহমান অথবা অবলুপ্ত চিহ্নকে র্যাপে কীভাবে জোড়া যায় এই ভাবনা তাকে উতলা করবে তখন। সুদিনটা আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যাওয়ার আশা অন্তত আমার কাছে অবান্তর মনে হয়নি।
র্যাপ গানে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার অর্থ এই নয় তাকে সর্বদা মার্কিন হতেই হবে। র্যাপ গানটা যান্ত্রিক কোনো পদ্ধতি নয়। কারখানায় উৎপাদিত কম্পিউটার নয় যে আইবিএম-এর (International Business Machine) মতো প্রতিষ্ঠানের হাতে অব্যর্থ প্রমাণিত শর্ত একবাক্যে মেনে নিয়ে তাকে বাজারে আনতে হবে। কারখানায় কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিষয়টি যৌক্তিক হলেও র্যাপবুলি বিরচন ও পরিবেশনায় মার্কিনি, আফ্রিকান, ভারতীয় বা কোনো একটা মানকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করলে আপদ বাড়ে। হিপহপের বাইবেল আন্তর্জাতিক মান নিয়ে যে-কারণে বুলি কপচায় না।
র্যাপ গানে কামিয়াবি ঘটাতে বাংলার গায়ক সময়ে সৃষ্ট সকল গায়নপদ্ধতিকে প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করবেন। গানের মার্কিন তরিকাটা তিনি যেমন পাখির চোখ করবেন, এর পাশাপাশি প্রতিবেশী থেকে দূর-প্রতিবেশী কে কোন তরিকায় গান গাইছে তার অনুসন্ধান আখেরে তার নিজের জন্য লাভজনক প্রমাণিত হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, মার্কিন দেশে জন্ম নিলেও হিপহপ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। সাংস্কৃতিক বিস্ফার রূপে পৃথিবী জুড়ে সে ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন ধাঁচে র্যাপ গাওয়ার তরিকাটা স্বয়ং সেই বৈশ্বিক হিপহপের অংশ এখন!
বাংলাদেশে মার্কিন র্যাপটাকে হিপহপের অথেনটিক বাইবেল ধরে নিয়ে জোর করে হলেও নিজেকে সেভাবে উপস্থাপনের প্রাণান্ত কসরত চোখে পড়েছে বলে ওপরের কথাগুলো বলা। এই অনুকরণপ্রবৃত্তি হিপহপের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। হিপহপ হচ্ছে শৈল্পিক বিস্ফার। সমাজে কাউন্টার কালচার সৃষ্টির যৌক্তিকতা সে তুলে ধরে। প্রথাগত সামাজিক জীবনধারাকে উলঙ্গ করার সঙ্গে নতুন পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। হিপহপে মানিয়ে নিতে র্যাপারের ব্যক্তিজীবনকে গানের বিষয়বস্তু করার প্রয়োজন যে-কারণে সেখানে অন্তিম হয়ে ওঠে। গানের বুলিতে নিজের জীবনকে উগড়ে দেওয়ার ক্ষণে দেশ, পরদেশ ও পরিপার্শ্বের অগণিত ঘটনা গায়কের দেহে প্রবেশ করে এবং তাকে গড়েভাঙে। সোজা কথায়, আত্মকথনের ছলে গায়ক স্বয়ং শ্রোতা-দর্শককে তাদের নিজের জীবন ও যে-সমাজে তারা বিচরণ করেন তাকে অনুভব করতে সাহায্য করে। আত্মকথনে এইসব অনুষঙ্গ না থাকলে গায়কের মুখ দিয়ে র্যাপবুলি হয়তো বের হয় কিন্তু তাকে মার্কিনের নকল ভাবার বিড়ম্বনা থেকে শ্রোতার রেহাই মিলে না। ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের বেশে র্যাপের ময়দানে হাজির হওয়া হিপহপে মানা; — কথাটি বাংলা র্যাপ গানের মানচিত্র ঘুরে আসার ক্ষণে স্মরণ রাখা প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।
…
শতেক অন্তরায় থাকলেও বাংলা হিপহপে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের পারদ আপাতত ঊর্ধ্বমুখী। র্যাপবুলি বিরচন থেকে শুরু করে পরিবেশনায় নতুনত্ব নিয়ে আসার তাগিদ গায়কদের মধ্যে চোখে পড়ে। মার্কিন সহ র্যাপের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় কেরামতির সঙ্গে জানপেহচান ঘটাতে তারা বেশ জোর কদমে এগিয়ে চলেছেন। হালফিল র্যাপ গানে অবিচ্ছেদ্য ডিজে ও বিটবক্সিংকে ব্যবহার করে নতুন আওয়াজ বা বিট সৃষ্টির প্রবণতা বাংলাদেশের গলিঘুঁজি আর খোলা চত্বরে মজমা বসানো পোলাপানদের র্যাপ গানে চোখে পড়ে। বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্ট সুরের মসৃণ গতি ও সামঞ্জস্যকে ব্যাহত করা হচ্ছে ডিজের মূল লক্ষ্য। সিন্থেসাইজার ছাড়াও বিচিত্র কৌশলে সুরের মসৃণ গতিকে সেখানে আঘাত করা হয়। এই আঘাতের ফলাফল হিসেবে যে-নয়েজ বা Distorted Sound পয়দা হয় তাকে বিদঘুটে মনে হলেও র্যাপ গানের পরিবেশনায় ওটা নতুন ছন্দ এবং তাৎপর্যের জন্ম দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশী র্যাপ গায়ক স্কিবখানের (Skibkhan) সব চুপ গানটিকে তাৎক্ষণিক উদাহরণ হিসেবে এখানে বিবেচনা করা যায় হয়তো। র্যাপ গানের উপযোগী বুলির সাহায্যে গায়ক দেশে অহরহ সংঘটিত অনাচারে নাগরিকদের মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার অভ্যাসকে একহাত নিয়েছে। তারুণ্যে লেলিহান বয়সে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের মনে যেসব ভাবনা তরঙ্গ তুলে যায় স্কিবখান রাখঢাক না করে সেগুলো গানের কথায় গুলি করছে :—
সোনার বাংলা কি তাহলে শুধুই কল্পনা
যার দরকার আছে তার পাশে সরকার আর বিরোধী
বল কত টাকা দিলে কি করবি
বল কত টাকা দিলে বই খাতা বাদ দিয়ে ছাত্রের বেশে করবি তুই গুণ্ডামি
বল তোকে কোন সুরা পড়ে ফুঁ দিলে নিরীহকে মেরে পাবি তুই স্বর্গের চাবি
আমদানি রপ্তানি কোনটা চলবে আচারের বোতলে কোন নেশা ঢুকবে
কোন ক্যামিক্যাল দিয়ে কোন ফল পাকাবি
নারী নাকি নকশা কোন চোখে তাকাবি
গরীবকে গরীব থাকতে দে
বোঝা বুঝিয়ে আটকে দে
গরীব না থাকলে কীভাবে তোরা পাবি
পাঁচজনের পরিবারে তিরিশ চাকর চাকরানী
সব কেন চুপ
[সব চুপ; কথা ও গান : স্কিবখান, ২০১৭]
সোজাসাপ্টা কথার স্রোতকে শ্রোতার অন্দরে ঢুকিয়ে দিতে স্কিবখান ডিজে ও গ্রাফিত্তি দুটোই প্রয়োগ করেছে গানে। র্যাপে ডিজেটা সচরাচর গানের শুরু, শেষ বা মাঝামাঝি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্কিবখান ওটা দিয়েছে শুরুতেই। গানের শুরু থেকে শেষ অবধি নয়েজ বা গোলমালের এই ধাক্কা সামলানো শ্রোতার জন্য চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে ওঠে। র্যাপ গান শুনে অভ্যস্ত নয় এমন শ্রোতা রেকর্ডিংয়ের গোলমাল ভেবে গানটা না-ও শুনতে পারে। স্কিবখানের এতে কিছু যায় আসে না। কেননা সে জানে তার গানের শ্রোতারা নয়েজকে চুপ করিয়ে রাখার সংস্কৃতির সঙ্গে ঠিক রিলেট করে নিতে পারবে এবং তারা সেটা নিয়েছেও। এ-রকম আরো কিছু উদাহরণ বাংলা র্যাপ গানে চোখে পড়ে। ডিজেকে বাংলাদেশে এখনো শক্তিশালী আওয়াজ পয়দা করার ক্ষমতায় অতটা গরিয়ান মনে হয়নি। সময়ের সঙ্গে এই কলায় আরো দড় হয়ে ওঠা যদিও নামুমকিন কিছু নয়।
র্যাপে ডিজে সৃষ্টির প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। স্টুডিও আর নিখাদ পেশাদারিত্ব ছাড়া কামিয়াবি হাসিল কঠিন। তুলনায় বিটবক্সিং খানিক সহজ; — মুখ দিয়ে বিচিত্র সুরেলা ছন্দের আওয়াজ ছোঁড়ার ক্ষমতা রপ্ত করতে পারলে আর কিছু লাগে না। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ ও পথেঘাটে এ-রকম বহু পোলাপানের দেখা মিলবে যারা র্যাপের জুমলায় মুখ দিয়ে দিব্যি সুরেলা আওয়াজ ছুঁড়তে পারে।
ব্র্যাকডান্স আর গ্রাফিত্তির ব্যবহার বাংলা র্যাপ গানে ব্যাপক না হলেও বাড়ির ছাদে, পার্কে, স্কুলপ্রাঙ্গণ আর খোলা চত্বরে অথবা রেলস্টেশনে বাংলার ক্যারিয়ারসচেতন বাপমায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুষ্টু পোলাপানরা র্যাপের বুলি আওড়ানোর ক্ষণে ব্র্যাকডান্সটা কাভার করতে চেষ্টা করে। জালালি সেট-এর জালালি গানটাকে ব্র্যাকডান্স দিতে পটু ঢাকার কিছু পোলাপান এভাবে কাভার করেছিল। মনে রাখা প্রয়োজন, ডিজে, বিটবক্সিং, ব্র্যাকডান্স বা গ্রাফিত্তির কোনোটাই র্যাপের বুলি শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর অপরিহার্য শর্ত নয়; তবে হ্যাঁ, গানের পরিবেশনায় এইসব কৌশল জুড়ে নিতে পারলে সৃজনশীলতার নতুন বিস্ফার ঘটে। শ্রোতার কাছেও গানটা ভীষণ উপভোগ্য মনে হয় তখন। ইংরেজি ভাষায় গীত র্যাপ গানে বিচিত্র সাংগীতিক কৌশলের প্রয়োগ সড়গড় ঘটনায় পরিণত হলেও বাংলায় তার সবটাই এখনো হাঁটি হাঁটি পা পা যুগ অতিক্রম করছে। সুতরাং বাংলা ভাষার র্যাপ গানে সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার পরিণত স্বরূপের দেখা পেতে আরো কিছুদিন হয়তো অপেক্ষায় থাকতে হবে।
…
মার্কিন দেশে আফ্রো-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর পেটের ভিতর থেকে হিপহপ সংস্কৃতির উত্থানকে ব্লুজ, জ্যাজ ও রকএনরোল-এর মতোই যুগান্তকারী ঘটনা মানতে হয়। হিপহপের বীজ বহু আগে থেকে ওই দেশে পোঁতা থাকলেও ষাট-সত্তুরের রকোন্মাতাল দিনগুলোয় নিজেকে সে চেনাতে শুরু করে। বব ডিলানের একাধিক গানে বিশেষ করে Subterranean Homesick Blues ও Like A Rolling Stone-এ র্যাপের আদি কিছু লক্ষণ ধরা পড়ে। যতদূর জানি র্যাপ গানের ব্যাপারে ওই সময়টায় তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। গান দুটি ডিলান তাঁর নিজস্ব ধাঁচে গাইলেও দ্রুতলয়টা সেখানে র্যাপকে মনে করিয়ে যায়। Subterranean-এর ভিডিওগ্রাফি লা-জবাব ছিল। দ্রুতলয়ে গানটি গাইবার ক্ষণে ডিলান গ্রাফিত্তিকে ভালোই কাজে লাগিয়েছেন। বব ডিলান ও বব মার্লের এইসব সৃজনশীল পাগলামির প্রভাব আদিযুগের র্যাপগায়ক ওরফে র্যাপারদের মধ্যে যারপরনাই বেশ গভীর ছিল।
হাল জামানার অনেক গায়ক কথাপ্রসঙ্গে সেটা মাঝেমধ্যে আওড়ান। পপ ও কোমল রক গানের জনপ্রিয় তারকা ইংরেজ গায়ক এড শিরান যেমন তাঁর বেড়ে ওঠার দিনক্ষণে প্রভাববিস্তারী গায়কের নাম নিতে বসে লোকগান থেকে রকগানে বব ডিলানের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত আর র্যাপ গানে এমিনেমের সাবলীল বিস্ফারকে একত্রে জুড়েছিলেন। শিরানের মতে ভিন্ন প্রজন্মের দুই গায়কের সংগীতযাত্রায় মিল না থাকলেও নিজের সময়কে দুজনেই হাতের মুঠোয় নিতে সফল হয়েছেন। সে যাকগে, পঞ্চাশের শান্ত সুস্থির জীবনস্রোতকে স্মৃতিকাতর প্রেমের বিষাদে মুড়িয়ে রক গাইতে অভ্যস্ত এলভিস প্রিসলি যেন-বা আশির দশকে জ্যাকসন–ম্যাডোনার হাত ধরে পুনরায় ধরায় জন্ম নিলেন! বিষাদ আর উচ্ছলতায় জড়াজড়ি পপ গানের এই নবউত্থানের দিনকালে ব্র্যাকডান্স ও গ্রাফিত্তির জোয়ারে হিপহপ নিজেকে রঙিন করে তুলছিল।
জ্যাকসন ফাইভ-এর দিন থেকে ব্র্যাকডান্স দিতে পটু মাইকেল জ্যাকসন তাঁর পপগানে হিপহপের নানা অনুষঙ্গ প্রয়োজনবোধে ব্যবহার করেছেন। নৃত্যকলায় তাঁর মাস্টারস্ট্রোক নামে বিদিত মুনওয়াকটা মূলত হিপহপের দেহ থেকে বেরিয়ে জ্যাকসনের পোষা বিড়ালে পরিণত হয়েছিল। বলাবাহুল্য র্যাপ তখনো যথারীতি হিপহপের অংশ রূপে দূরবিস্তারী শিল্পমাধ্যমে মোড় নিতে যাচ্ছিল। বিগত দুই দশকের রকোন্মাতাল হাওয়া আশির দশকে খানিক স্তিমিত হয়ে আসার দিনক্ষণে কার্টিস ব্লো, আইস-টি, বিগ ড্যাডি ক্যান্ডি বা রাকিম-এর মতো র্যাপারের আবির্ভাব হিপহপে নতুন তরঙ্গ যোগ করে। ওদিকে টুপাক শাকুর, স্নুপ ডগ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দুরন্ত র্যাপসৈনিকরা আসব-আসব করছিল তখন। রক, পপ ইত্যাদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ষাট-সত্তরেও র্যাপ তার নিজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে ছিল, তবে আশি থেকে নব্বইটা বোধ করি তার জন্য ছিল সন্ধিক্ষণ। এই কালপর্বে র্যাপের দেহে হিপহপ এমনভাবে মিশতে থাকে যে দুটিকে আলাদা করে চেনার উপায় সংকীর্ণ হয়ে আসছিল।
র্যাপ ও হিপহপের মাঝে বিদ্যমান সূক্ষ্ম প্রভেদের তোয়াক্কা অনেকে এখন করেন না। র্যাপকেই হিপহপ বলে দাগিয়ে থাকেন। ইতিহাস যদিও ভিন্ন কথা বলে সেখানে। হিপহপ হচ্ছে আমজনতার দৈনন্দিন জীবনের অজস্র খুঁটিনাটি থেকে উঠে আসা সৃষ্টিশীল বিস্ফার, যার গর্ভে একদিন র্যাপ জন্ম নিয়েছিল। হিপহপে একীভূত ব্রেকড্যান্স, ডিজে, গ্রাফিত্তি, বিটবক্সিং, ফ্রিস্টাইল ভার্স ইত্যাদিকে অবলীলায় নিজের করে নিতে পারার শক্তিই মূলত র্যাপকে স্বতন্ত্র উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। নব্বই দশকে পা রাখার দিনকালে আত্মীকরণ দুর্বার হওয়ার ফলে লোকে অতঃপর র্যাপকেই হিপহপ নামে ডাকতে শুরু করে। নিউইয়র্ক বা অন্যান্য শহরের পথেঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া বিচিত্র আর্টফর্মকে আত্মস্থ করার ক্ষমতাটি বুঝিয়ে দেয় অদূর ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক আঙ্গিকে সংগীতমাধ্যমটি নয়া সব মোড় নিতেই থাকবে।
রক এবং পপের মতো র্যাপ গানও ট্রেন্ডসেটার হিসেবে নিজের প্রমাণ দিয়েছে। গানের কথা, গায়কি, পোশাক-পরিচ্ছদ, দেহসজ্জা থেকে শুরু করে গায়কের জীবনের প্রতিটি বিচ্ছুরণে লক্ষণটা ধরা পড়ে। সমাজের ওপর থেকে নিচের তলা অবধি তার প্রভাবকে এই অস্বস্তি সহকারে সে অমোঘ করেছে, — একজন র্যাপার অনুশাসনে বন্দি সমাজের বিচিত্র কালাকানুন ও সংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখাতে ডরায় না এবং গানে উপচে-পড়া জীবনকে উদযাপনের হিম্মত রাখে। র্যাপ গায়কির এহেন প্রবণতাকে বিবেচনায় নিলে আশির দশক পরবর্তী রক, পপ ও ফিউশন আঙ্গিকে পরিবেশিত গানের সামাজিক উপযোগিতাকে ম্লান দেখায়। কাউন্টার কালচার-এ পরিণত হওয়ার যে-শক্তি একদিন রকএনরোলকে সময়-প্রাসঙ্গিক করেছিল আশির যুগবিশ্বে পা রাখার দিন থেকে সেখানে ভাটা পড়তে শুরু করে। সময়ের দায় পূরণে অগত্যা র্যাপ জোর কদমে আগুয়ান হয় তখন।
র্যাপার তখনই র্যাপার যবে জীবনের যে-স্তর থেকে সে উঠে এসেছে তাকে সরাসরি গানের কথায় গুলি করতে পারছে। শত্রুর বুলেটে মারা যাওয়ার আগে অবধি সর্বকালের সেরা র্যাপারের অন্যতম টুপাক শাকুর সত্যটি তাঁর গানে ও কথাবার্তায় অনেকটা এভাবে রিপিট করেছে সবিরাম :—
ব্রো, তুমি যদি মাদকের কারবারি হও তবে র্যাপে সেই কথাটা বলো। লুকোছাপা করো না, কারণ এখানে লুকোছাপার কিছু নেই। গুণ্ডামি বা সুপারস্টোরে লুট করাটা যদি পেশা হয়ে থাকে তাহলে গানের কথায় সেটা জানিয়ে দাও। নিজে গুলি খেয়েছো অথবা পুলিশকে গুলি করেছো অথবা শত্রুকে, — চোখ বুজে সবটা বলো তোমার গানে। মেয়েমানুষ দেখলে দেহে বুনো ক্ষুধা চাগাড় দিয়ে ওঠে। তাকে প্রপোজ করতে মন চায়? আরে ব্রো, কাজটা চটজলদি সেরে ফেলো ও গানে সেটা জানিয়ে দিতে ধানাইপানাই করো না। ধাম করে বলে দাও যে তুমি তাকে পেতে চাইছিলে। পুলিশের মুখের ওপর উচিত কথা বলতে শরমাও ক্যান ব্রো? বেটারা তোমার সঙ্গে যা করে তার কতটা ন্যায্য আর কতখানি বিষ ও বিদ্বেষ, — দোহাই লাগে ভকচক্কর না করে গানে কথাগুলো সরাসরি গুলি করো বাপধন। র্যাপ তোমার পিস্তল আর তুমি হচ্ছো একটা খুনি।
মনে রেখো তুমি যা করেছো তা তোমাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। এই সমাজের যারা মাতব্বর এবং সমাজটাকে কিনে নিয়েছে তারা তোমার বেআইনি ও অসামাজিক কাজগুলার নিন্দা করে থাকে। তোমাকে খুনি, দস্যু, মাস্তান বলে দাগায়। হাভাতে, অভদ্র ও অপরাধী জ্ঞান করে এড়িয়ে চলে। তারা তোমাকে ঠেলে দেয় ঘেটোর (Ghetto) জীবনে আর নিজেরা বাহান্ন কক্ষের প্রাসাদ বানিয়ে থাকে। আড়াই কক্ষের চিপায় বসে তুমি তখন ভাবো, — এতগুলা কক্ষ তাদের কী কাজে লাগে কে জানে! তারা শত কোটিপতি অথবা মাইকেল জ্যাকসন হোক, — টুপাকের কাছে লোকগুলা এক বরাবর। তো এই পরিস্থিতির মধ্যে তুমি আছো ব্রাদার! আউট-ল’ বা বেআইনি হওয়া এখানে নিয়তি।
সমাজের মুরব্বিদের মনে রাখা প্রয়োজন, বেআইনি কাজগুলা তুমি নিজের ইচ্ছায় করছো না; — হয় করতে বাধ্য ছিলে নতুবা তোমায় তারা সেদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। আমি মানছি তুমি অপরাধী কিন্তু সেক্ষেত্রে অপরাধের বিচার সকলের জন্য সমান হওয়া উচিত। কেননা অপরাধ সর্বজনীন এবং তার কোনো রং নেই। নিগার অপরাধ করলে যে-শাস্তি তারা দিয়ে থাকে, ধলা আদমির বেলায় একই শাস্তি প্রযোজ্য হওয়া উচিত। মুখে সমানাধিকারের বুলি কপচালেও বাস্তবে কেউ এর তোয়াক্কা করে না। সুতরাং চালিয়ে যাও ইয়ার।
ভালো কথা, তোমার কুকর্মের জবাবদিহি যদি করতেই হয় তবে ওপরওয়ালার কাছে একদিন করবে। ওপরওয়ালা জানে এটা তুমি কেন করেছিলে আর কী চলছিল সেখানে। হিপহপে নিজের পরিচয় তুলে ধরার ক্ষণে মনে রেখো তুমি এক স্বাধীন আদমি। ধলা মিয়া হওয়ার কারণে যেমন স্বাধীন, — কালো, বাদামি বা শ্যামবরণ হলেও কথা সমান। গায়ের রং ওপরওয়ালার দান। ওটা নিয়ে মাথা খারাপ করার দায় তোমার নেই। দেখার বিষয় একটাই, — কী গুণ ওপরওয়ালা তোমার ভিতরে ঠেসে দিয়েছিল আর কতটা কাজে লাগাতে পেরেছো তুমি। টুপাক মনে করে, একমাত্র ঈশ্বর তার বিচার করার ক্ষমতা রাখে; — এছাড়া কোনো বাপের বেটার পরোয়া সে করে না।
Only God can judge me; — টুপাকের এই র্যাপবুলি নতুন ঘটনা নয়, যেমন নতুন ছিল না মার্কিন দেশে কালো মানুষের নিজের জমিজিরেত বুঝে নেওয়ার পুরোনো লড়াইটা। ব্লুজের বিষাদ আর জ্যাজের ধ্রুপদি মেজাজে নিজেকে সংহত করে এর প্রকাশ তারা ঘটিয়েছিল। ওদিকে রকএনরোল-এ শ্বেতাঙ্গ যুবাদের একচেটে দাপটের ফোকর গলে একই কথা আওড়েছে বারবার। এখানে র্যাপের দেহে হিপহপের সকল অনুষঙ্গ জুড়ে যে-সংস্কৃতির বিস্ফার ঘটল সেটা নিখাদ জীবনবাস্তবতা ছাড়া কিছু ছিল না। সে আপনি মার্লি মার্ল, টুপাক শাকুর, লিল ওয়েন, লরিন হিল, নটোরিয়াস বি.আই.জি, আইস-টি, স্নুপ ডগ, 50 সেন্ট, ন্যাশ, রাকিম … ছদ্মনামে নিজেকে মোড়ানো অসংখ্য র্যাপারের যাকেই শুনুন না কেন, সকলের গানে জীবনের দগদগে ঘায়ে অবিরত জখম হওয়া আর চোয়ালভাঙা প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের গল্পটা পাবেন।
ব্ল্যাক কমিউনিটির লেবেল গায়ে সেঁটে বনিআদমকে সমাজে পৃথক করে রাখা, তাকে হাভাতে, গুণ্ডা, দস্যু, মাদকাসক্ত, চোরাকারবারি নিগার নামে দাগিয়ে ক্রমাগত প্রান্তিক থাকতে বাধ্য করা, এবং এভাবে ওই মানুষটাকে হয় লড়ো নয় মরোর জায়গায় কোণঠাসা করার ফলে সমাজে যেসব বৈপরীত্য দেখা দিয়েছিল র্যাপের ছন্দ সেখান থেকে উৎসারিত হয়েছে চিরকাল। হিপহপের সকল চিহ্নকে নিজদেহে একীভূত করতে পারা র্যাপকে তাই সমাজের ভিতরে আরেকখানা সমাজ মানতে হয়। জীবনের কটু-তিক্ত সত্যকে যাপন করার ঔদ্ধত্য, উচিতকথা মুখের ওপর ছুড়ে মারতে সংকোচ বোধ না করা, এবং নিপীড়ন সহ্য করে ভালোবাসার জন্য আকুলতা ও সেই দমটাকে ধরে রাখার গল্পই মূলত র্যাপে একীভূত হিপহপকে বিশ্ব জুড়ে তরঙ্গের আকারে আছড়ে পড়তে শক্তি দিয়েছিল।
রকএনরোল-এর অবসন্ন হয়ে পড়ার দিনক্ষণে আরেকটা বিস্ফার যেখানে কালো ও সাদার চিরন্তন দ্বন্দ্বকে নতুন মোড় নিতে দেখেছি। অধুনা র্যাপঈশ্বর বিবেচিত এমিনেমের উদাহরণ এখানে বোধ করি প্রাসঙ্গিক। মিশিগান অঙ্গরাজ্যে এইট মাইল রোড নামের যে-সড়কটি ডেট্রোয়টকে প্যাঁচিয়ে ধরে এগিয়েছে তার জন্মকর্মের সবটাই সেখানে। গায়ের চামড়া সাদা হলেও এমিনেম প্রকট আয়বৈষম্যে জর্জরিত মার্কিন সমাজে হাভাতের একজন ছিল। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনো গরিব। নাইন ইলিভেনের ঝাটকায় সংখ্যায় তারা বেড়েছে বৈ কমেনি। গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়া অনেক অভিবাসীর তুলনায় এই শ্বেতাঙ্গরা দরিদ্র। রূঢ় এই সত্যটা হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাজিমাতের গণ্য কারণ ছিল।
ছন্নছাড়া ওইসব শ্বেতাঙ্গের উপমা হয়ে এইট মাইলের পরিসীমায় এমিনেমের দিনরজনী কেটেছে। সমাজবিরোধী কারবারে আবিল এক অঞ্চলে বসবাস করে র্যাপার হওয়ার স্বপ্নে মশগুল ছিল বেচারা। সাদা আদমি র্যাপ গাইবে, র্যাপযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ র্যাপারকে চ্যালেঞ্জে হারিয়ে দেবে, — ভাবনাটা একপ্রকার হাস্যকর ও অবান্তর ছিল তখন। লিংকিন পার্কের র্যাপ মেটাল আর টুপাক শাকুর শুনতে-শুনতে বড়ো হওয়া এমিনেমের দুর্দান্ত গীতকলি রচনার ক্ষমতা থাকলেও র্যাপযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ভেঙে চুরমার করার আত্মবিশ্বাস প্রবল ছিল না। বিশ্বাস ফিরে পাওয়াটা ছিল তার জন্য কঠিন চড়াই। জাতে কালো কিন্তু তাকে ভালোবাসে ও তার গুণের কদর করে এ-রকম কিছু ইয়ারদোস্তের সাহায্য না পেলে শ্বেতাঙ্গ যুবার পক্ষে র্যাপ গানে বিশ্বজয় করা হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত! এইট মাইল শিরোনামে নির্মিত ছবিতে র্যাপঈশ্বর এমিনেমের চড়াই উতরানোর গল্প খানিক উঠে এসেছে, যেখানে লিড রোলে তার অভিনয়প্রতিভা নজরকাড়া ছিল।
গুস্তাভ এলিজা ওরফে লিল পিপ-এর কথাও এই ফাঁকে বলে নিতে হয়। ব্যক্তির মগজে ঘাপটি মেরে থাকা একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও অর্থহীনতার অনুভূতিকে হৃদয়হরা বিষাদে মুড়িয়ে হিপহপের সোজাসাপ্টা বয়ানে হাজির করার ঘটনা সচরাচর ভাবা যায় না। শ্বেতাঙ্গ ও স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা কোকেইনখোর লিল পিপ একুশ বছর বয়সে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর আগে সেই প্রমাণ রেখে গিয়েছে। পিপের গানে উচ্চারিত কথারা সরাসরি তার ব্যক্তিত্বের পাতালে সক্রিয় বিষাদকে র্যাপের বুলিতে তুলে এনেছিল। Star Shopping, Life, Beamer Boy, Save That Shit, Feelz-এর গানগুলো শুনলে মনে হয় র্যাঁবোর মাতাল তরণিতে উঠে পড়েছে এক অকালপক্ক বালক! মাথা খারাপ করা খ্যাতির মধ্যে যে কিনা অনায়াস জানিয়ে দিচ্ছে, ‘কোনো সুখকর ঘটনাই আমাকে দশ সেকেন্ডের বেশি সুখ দিতে পারে না। দশ সেকেন্ড পরে সুখী হওয়ার মতো কিছু থাকে না জীবনে।’
লিল পিপের সংক্ষিপ্ত জীবন নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র Everybody’s Everything-এ ভিন্ন ধাঁচের র্যাপ গানে তার বাঁচনমরণের গল্পগুলো পরিচালক সযত্নে উঠিয়ে এনেছিলেন। দাদা-দাদী ও মায়ের বয়ানে হাসিখুশি এক বাচ্চার সংগীতপ্রতিভা ও অবিরত নিজেকে একলা করে ফেলার বিষাদমোড়ানো কাহিনি দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। পিপের জীবনযাত্রায় তার পিতামহের প্রভাব গভীর ছিল। গায়কের অকালপক্ক ব্যক্তিত্বে যেটুকু ইতিবাচক সংবেদন তার ষোলআনা ছেলেবেলা থেকে দাদার সান্নিধ্য ও নাতিকে লেখা একের-পর-এক পত্রাঘাতের অবদান। পক্ষান্তরে নিজেকে একলা করে ফেলার বাতিক যেন ছেলেকে পেয়ে না বসে সেজন্য মা চাইতেন পিপ সারাক্ষণ বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে থাকুক। পরিবারের চেষ্টা সত্ত্বেও মাত্রাছাড়া কোকেইন আসক্তি আর নিমিষে অবসাদে ডুব দেওয়ার ঝোঁক মিলেঝুলে মনোবৈকল্যের (Bipolar Disorder) কিনারায় উপনীত পিপের মনে সদা এই জিজ্ঞাসা তোলপাড় তুলেছে, — সবকিছুর যদি একটা কারণ বা যুক্তি থেকে থাকে তাহলে নিজের বেঁচে থাকার যুক্তিগুলো কেন অর্থহীন বিদ্রুপ হানছে তাকে? আকাশের তারা দেখতে-দেখতে কেন মনে হচ্ছে লিল পিপ এই বুঝি টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে! প্রথম হিট গান Star Shopping-এর অন্তে পৌঁছে গায়ক গাইছে :—
Look at the sky tonight, all of the stars have a reason
A reason to shine, a reason like mine and I’m fallin’ to pieces
Look at the sky tonight, all of the stars have a reason
[Star Shopping; Lyrics and Song: Lil Peep]
আঠারোয় পা দিতে-না-দিতে গগনচুম্বি খ্যাতির দেখা পাওয়া; দেশ জুড়ে বিরতিহীন কনসার্ট ও নির্ঘুম রাত্রিযাপন; মগজে সারাক্ষণ ঘুণপোকার মতো কুরে খাওয়া গানের পঙক্তি চটজলদি লিখে ফেলতে-ফেলতে তাতে সুর বসানো; কোথায় কোন অবস্থায় গাইছে তার পরোয়া না করে নিজের কণ্ঠস্বরের ওপর অগাধ বিশ্বাস থেকে গানটা গেয়ে ফেলা; কোকেইনে টালমাটাল হয়ে মঞ্চে উঠার পর নিজেকে সামলে মাইক্রোফোনে ঝড় বইয়ে দেওয়া আর নিষ্পাপ শিশুর বিস্ময়ে ‘এইটা আবার কী জিনিস!’ ভাবতে-ভাবতে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের মডেলিং; হাসিমুখে টিনএজ ভক্তদের সকল আবদার মিটানো; সরল বিশ্বাসে উভকামী হওয়ার রোমাঞ্চ ও টুইটারে বিজ্ঞাপন ‘তোমরা জেনে রাখো লিল পিপ একজন উভকামী’; রাশিয়া আর জার্মানি মাতিয়ে বাড়িতে ঢুকেই ‘ওহ! ভোগবাদ কী বীভৎস এক জিনিস মা!’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠা; জীবনের অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া গেরিলা পিতামহের লেখা চিঠিগুলো যখের ধনের মতো আগলে রাখতে-রাখতে ক্রমশ এই গভীর সংবেদনে নিজেকে জখম করা যে, — সুন্দর যদি কোনো রমণীর নাম হয়ে থাকে তবে তাকে আগলে রাখার ক্ষমতা তার নেই! গানের কথায় অগত্যা এই উচ্চারণটি অমোঘ হয়েছে, — Fuck my life, can’t save that girl.
যাকে বাঁচানো গেল না সে তাহলে আবর্জনা আর লিল পিপ ওই ভাগাড়ে বসে প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে জীবনে সুখকর কোনো উত্তেজনাই দশ সেকেন্ডের অধিক স্থায়ী হয় না! সকল উত্তেজনা একের-পর-এক নিঃসঙ্গ সড়ক ধরে বাড়ির পথ ধরে! লোকে গমগম করলেও বাড়িটি আসলে শূন্য ও নীরব, যেমন তার জীবন :— Down another lonely road, I go / Just another lonely road to home / I just wanna know, I just gotta know / Do you wanna glo? / Baby, we could glo. [দ্রষ্টব্য : Save That Shit; Lyrics & Song Lill Peep]
গ্লো (Glo) শব্দটি এখানে গোটা গানের চাবি। সুইডিশ রক্তের উত্তরাধিকার লিল পিপ নিজের দেহ ও মুখমণ্ডলকে ট্যাটু দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল। গ্লো শব্দটি তার হাতে ট্যাটু করা ছিল। সুইডিশ উৎস থেকে আহরিত শব্দটির অর্থ নিয়ে ভক্তকুলে বিতণ্ডার অন্ত নেই। কেউ মনে করে গানের পাঞ্চলাইনে শব্দটি বসিয়ে পিপ বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনকে ভালোবেসে নমনীয় হওয়ার মতো প্রেরণা অবশিষ্ট নেই। কেউ আবার ভাবে, পিপ বলতে চাইছে, জীবনে ইতিবাচক কিছু থাকতেও পারে। ওটা হয়তো শুদ্ধ ও অকলঙ্ক। কেউ তাকে দূষিত করতে পারে না কিন্তু ওই জীবনে কী যাওয়া সম্ভব?
মার্কিন দেশের পেটের ভিতরে জীবনের শেষ ট্যুরে রওয়ানা হওয়ার রাতে গাড়ির মধ্যে পিপ চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। হৈ-হুল্লোড়ে মশগুল থাকার ক্ষণে নিজেকে সকল উত্তেজনা থেকে সরিয়ে নিতে অভ্যস্ত অকালপক্ক বালককে জিগ্যেস করার উপায় নেই গ্লো দিয়ে সে কোন সন্ত অথবা শয়তানের গন্তব্যে যাত্রার ইশারা দিয়েছিল। সে নেই তবে তার গান এখনো জীবিত। র্যাপের স্বভাবসিদ্ধ ধারার বাইরে গিয়ে নতুন দ্যোতনায় আভাসিত গানগুলো কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত মার্কিন হিপহপের জগতে শ্বেতাঙ্গ এক যুবার স্মরণীয় উত্থানকে অবিরত স্মরণ করিয়ে যায়।
লিল পিপের ডিপ্রেশনকে একদিক থেকে ইতিবাচক ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। অস্তিত্ব নামের ডোপামিন দেহে টানার পর থেকে মানুষ পিপের গানে ব্যবহৃত ডিজে ও গ্রাফিত্তির লাল-নীল-সবুজে ছোপানো ঘোলাটে প্রেতপুরীর বাসিন্দা বৈ আর কিছু নয়। অযুত শিহরণ ও উত্তেজনায় মেতে থাকতে গিয়ে ভুলেই গেছে দিককুলহারা সাগরে নাবিকের দিন কাটাচ্ছে সে! আপাত সঠিক গন্তব্য লক্ষ্য করে তার সকল যাত্রা মূলত বেঠিক। পিপের গান কানে ঘাই দিয়ে যাবার ক্ষণে অনুভবটা আচমকা মনে জাগে, — হা ঈশ্বর! খতম হওয়া ছাড়া বুঝি বাঁচার পথ নেই আর! সংগীতের কোনো জাত-কুল-গোত্র-রং হয় না, তার একটাই রং এবং সেটা সর্বজনীন;—লিল পিপের সুরেলা ছন্দে গাঁথা র্যাপবুলি এই অনুভবে উপনীত হতে শ্রোতাকে প্রেরণা দিয়ে যায়।
…
মার্লি মার্ল, টুপাক শাকুর, আইস-টি, নটোরিয়াস বি.আই.জি, এমিনেম, ন্যাস, 50 সেন্ট কিংবা অকালপ্রয়াত লিল পিপ-র মতো শিল্পীদের জীবনজার্নি ঠাহর করা ছাড়া র্যাপের বৈশ্বিক প্রভাবের সুরতহাল উপলব্ধি করা কঠিন। অন্ত্যমিলে গাঁথা ও দ্রুতলয়ে পঠিত কবিতায় গানের আবেশ জাগিয়ে তোলার কেরামতি এতদিন মন কেড়েছে। গানের প্রতি অঙ্গে উপচানো জীবনবেদ টের পেয়ে শিহরিত, সংক্ষুব্ধ হয়েছি। এখন দেখতে পাচ্ছি গান আর গায়ক মিলেঝুলে একটাই সত্তা সেখানে! গায়কের ব্যক্তিজীবন থেকে তার শিল্পীজীবনকে আলাদা করা অন্তত র্যাপ গানে সম্ভব নয়। তারা যদি আলাদা হয় তবে র্যাপটা বানোয়াট আর শ্রোতা সেটা নিমিষে বুঝেও ফেলে।
র্যাপ গাইতে হয় নিজের দেহ দিয়ে। দেহটা ধরায় আসার পর থেকে যত দুখসুখ সহ্য করেছে তার সবটা গলেমিশে এক-একটি উচ্চারণের জন্ম হয় সেখানে। একতিল খাদ মিশানো বারণ। জীবন তিক্ত বা সুন্দর যেমন হোক, নিজের জীবন দিয়ে গায়ক যে-জীবনকে জানতে পেরেছে এর বাইরে ভান-ভণিতার সুযোগ গীতমাধ্যমটি কাউকে দেবে না। কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে; — ঠাকুরের এই উক্তি র্যাপ বা সামগ্রিক হিপহপ কালচারে বিলকুল মিছে কথা। কবিকে যদি তার জীবনচরিতে পাওয়া না যায় তবে সেটা ঠাকুরের কবিতা হতে পারে কিন্তু র্যাপ নয়। পাশ্চাত্যের জলবায়ুতে র্যাপ গায়কের দেহে হিপহপ সংস্কৃতির ছাপ ও সেগুলো সঙ্গী করে বেড়ে ওঠার এইসব কাহিনি যে-কাউন্টার কালচার জন্ম দিলো ভেতো বাঙালির জীবনে তার অভিঘাতকে মনে হয় গোনায় নেওয়ার সময় হয়েছে। প্রচুর শোনা ও দেখা এখনো বাকি রয়ে গেছে যদিও! যারপরনাই এই র্যাপকাহনকে আরো গভীরে ডুবুরি হওয়ার প্রাকপ্রস্তুতি ভাবতে মন স্বস্তি বোধ করছে। পাঠক যদি তার ভাবনা বা সংশোধনী এতে যোগ করেন তাহলে নিজের গলতি শুধরে অতলে ঢোকার ভরসা পাবে মন।
এই ফাঁকে কবুল যাই, হিপহপের মালমসলায় ভরা র্যাপসংগীত এমন এক জীবনের কথা বলে যাকে যাপনের অভিজ্ঞতা অধমের নেই। ওই জীবনকে বাস্তবিক যাপন করার সাহস, ইচ্ছে বা বয়সটাও নেই, তথাপি এর আকর্ষণ অমোঘ। অমোঘ এই সত্য, — প্রতিটা মানুষের ভিতরে বিপরীত এক মানুষ বাস করে! মানুষটা হয়তো হাভাতে, গুণ্ডা, খুনি, ধর্ষক, মাদকাসক্ত, চোরাকারবারি, বেশ্যার দালাল আর মনোবিকারে আবিল জগতে নিজেকে বিচরণ করতে দেখার অভিজ্ঞতায় শিহরিত হয়। জগৎটি তাকে সে যা নয় সেটা হওয়ার আস্বাদ উপহার দেয় ও ত্বরিত সেখান থেকে পালাতে বলে। বাস্তবে দূরে থাক, গানের মধ্যে এই নরককে বেশিখন সইতে পারা কঠিন! আমেরিকায় আইস-টির মতো র্যাপাররা যারপরনাই অকপটে কথাগুলো অনেকটা এভাবে বলে থাকে :—
দেখো এই গান এমন এক জীবন থেকে উঠে এসেছে যেখানে আমি একদিন ছিলাম। ওখানে থাকতে চাইনি আর এখনো চাই না। স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের রয়েছে আর আমরা সে-কথাটাই বলে চলেছি অবিরাম। আমি চাই না যে আমার পরিবার আমার কারণে বিপদে পড়ুক। উৎকণ্ঠায় তারা দিন কাটাক। যদিও খুব কম র্যাপার তার জীবনে এই নিশ্চয়তার দেখা পায়। সাফল্য এক সোনার হরিণ আর সকলে সেটা ধরতে পারে না। এতকিছুর পরেও তারা র্যাপটাই গায়, যেহেতু এছাড়া তাদের পক্ষে নিঃশ্বাস টানার দ্বিতীয় গবাক্ষ খোলা নেই। জীবনের বৈপরীত্যকে র্যাপ গানে গীত কবিতা উলঙ্গ করে যায়।
মোটমাট এই কথাটা বোধ করি এখন বলা যায়, — র্যাপ সকলের জন্য হলেও সকলের নয়। সত্যিকার নরকবাসের অভিজ্ঞতা যার হয়েছে তার পক্ষে এই ছন্দে নিজেকে বিদীর্ণ করা হয়তো সহজ। ওই মানুষটার ভিতরে দ্বিতীয় বা বিপরীত এক সত্তা ঘাপটি মেরে থাকে এবং নিজের সত্তাকে সে আবিষ্কার করে। সত্তাটি সেখানে র্যাপছন্দে নরকযাপনের কাহিনি শ্রোতাকে শোনাতে ইতস্তত করে না। টুপাক শাকুরের মতো সেও জানে যেসব কার্যকারণদোষে নরকে পড়ে আছে সেগুলোর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নরক থেকে পালিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যাওয়ার আকুলতা তাকে ভোগায় এবং শ্রোতাকে তথ্যটি জানিয়ে দিতে কৃপণতা করে না।
স্বাভাবিক মানে হচ্ছে সেই জীবন যেখানে কেউ তাকে থ্রেট করছে না অথবা সে বাধ্য নয় অন্যকে থ্রেট দিতে। চাকু-বোমা-বন্দুক, মাদক-মারপিট-চোরাকারবার ছেড়ে নিরীহ, নির্ভার থাকতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভীষণ ক্লিশে হলেও অনিশ্চয়তায় যার দিনরজনী কাটে সেই ব্যক্তি নিশ্চয়তার স্বাদ পরখ করতে চাইবে এটা স্বাভাবিক। বৈপরীত্যটা মনে হয় র্যাপের ভাষাকে সম্মোহক ঘটনা করে তোলে। গায়ক যতই ফিরতে ব্যাকুল হোক পেছনে-ফেলে-আসা অতীত তাকে ছাড়ে না। দুঃসহ প্রেত হয়ে অতীতটা তার ঘাড়ে চড়ে নাচে ও তাকে নাচায়। প্রেতের পাল্লায় পড়ে হয়তো একজন টুপাক শাকুর মাত্র পঁচিশ বছরে পা রাখার দিনে আকস্মিক গুলি খেয়ে গাড়িতে ঢলে পড়ে। একজন 50 সেন্ট দেহে নয়টা বুলেট ঢোকার পরেও বরাতজোরে বেঁচে যায় এবং র্যাপযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার পণ নিয়ে মঞ্চে ওঠে। কার্টিস জেমস জ্যাকসন ওরফে 50 সেন্টের প্রকৃত উত্থান নয়টা বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়ার পরে ঘটেছিল, তার আগে নয়।
গানের জগতে টাকার খেলা ও রাজনীতি সমানে চলে। 50 সেন্ট তার খপ্পরে পড়ে মরতে বসেছিল। জীবনযুদ্ধে জেরবার মা ছিল একমাত্র ভরসা। নিজের দেহ বিক্রি করে হলেও কিশোর 50 সেন্টকে মমতায় আগলে রাখা মাকে খুন করা হয়। এলাকার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ যার হাতে ছিল ওই সময় সেই বিগ বসের দলে যোগ দিয়ে পিস্তলবাজিতে হাত পাকানোর দিনে 50 সেন্ট জানতই না এই লোকটা হচ্ছে তার পিতা। পুরোনো বিগ বসকে ফাঁসিয়ে নতুন বসের উত্থান ঘটলে তার জীবন আরো অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। নতুন বস তার মাকে খুন করেছিল এই তথ্যটি সেন্ট জানতে পায় নদী দিয়ে বহুত জল গড়িয়ে যাওয়ার পরে। গানের স্বত্ব নিয়ে বিবাদে নতুন বস তাকেও হত্যা করতে মরিয়া ছিল। এমিনেমের কল্যাণে 50 সেন্ট অবেশেষে র্যাপ দুনিয়ায় শক্ত পায়ে দাঁড়ানোর মাটি খুঁজে পায়। সেইসঙ্গে পরিবারকে সকল আপদ থেকে সুরক্ষিত রাখার শক্তিটাও। Get Rich or Die Tryin অ্যালবামের ৩ নাম্বার গানের কলিতে মারো নয় তো মরোর খেলায় নিজের বিজয়কেতন উড়ানোর গল্পটা সে উগড়ে দেয় :—
In the Bible it says, what goes around, comes around
“Hommo” shot me, three weeks later he got shot down
Now it’s clear that I’m here, for a real reason
Cause he got hit like I got hit, but he ain’t fucking breathing
[Many Men (verse 3); Get Rich or Die Tryin; Words and song: 50 cent]
আসা-যাওয়ার ঘূর্ণিচক্করে কে কাকে মেরে বসবে তার ঠিক নেই। দিনের শেষে যে-লোকটা বেঁচে থাকে সে হচ্ছে খেলোয়াড়। বেঁচে থাকার ঘটনাকে অগত্যা অবিশ্বাস্য হলেও যৌক্তিক ভাবতে বাধ্য হয় সে। বরাতজোরে পাওয়া জীবনে কিছু করে দেখানোর জেদ মনে তীব্র হয়। তিক্ত এই ধ্রুপদি সংগত ছাড়া সাচ্চা র্যাপার ভবে জন্মায় না। জন্ম নিলেও বেশিদিন তার আয়ু থাকে না। তারাই র্যাপার যারা একদেহে প্রফেট ও ডেভিলকে লীলা করতে দেখছে এবং সজোরে নিজের সত্তাকে মঞ্চে উগড়ে দিতে পেরেছে।
…
বাংলার পটভূমি মার্কিন থেকে পৃথক হওয়ার কারণে ওইসব অবিশ্বাস্য র্যাপারের এই দেশে জন্মগ্রহণ আকাশকুসুম কল্পনার শামিল। বাংলার র্যাপ গায়ক তার স্থানকালের ধাত অনুসারে জন্ম নেবে এবং নিচ্ছেও। বাংলাদেশে নিখাদ র্যাপ গানের সূচনাকাল রূপে শূন্য দশকের পুরোটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও র্যাপ আঙ্গিকে বাংলা গানের আভাস নব্বই দশকের মাঝামাঝি অবমুক্ত ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা অডিও অ্যালবামে ঝিলিক দিয়েছিল। দলের নামে রিলিজ হওয়া অ্যালবামের বেশ কয়েকটি গানে র্যাপের আদি লক্ষণ যেমন দ্রুতলয়ে গানের কথা আওড়ানোটা গোপন ছিল না। ক্যাসেট আকারে অবমুক্ত অ্যালবামের প্রচ্ছদে ব্যান্ডসদস্যরা নিজের পরিচয়টা এভাবে দিয়েছিলেন :—
জঘন্য রেকর্ডিং এবং যা-তা মিক্সিং করে ক্যাসেটটির বারোটা বাজিয়েছেন আজম বাবু। সস্তা সেন্টিমেন্টের বস্তাপচা গান লিখে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আশরাফ বাবু। হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে অশ্রাব্য গান গাওয়ার অপচেষ্টা এবং অসহ্য আবহ সংগীত সৃষ্টি করেছেন পার্থ।
ব্যতিক্রম প্রচ্ছদের সঙ্গে দ্রুত খোলস পাল্টাতে থাকা সময়ের প্রবণতাকে ধারণের চেষ্টা অ্যালবামের গানগুলোকে শ্রোতাপ্রিয় করেছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগসন্ধিক্ষণে পা রাখার দিনকালে দুনিয়া জুড়ে যে-পালাবদল ঘটতে শুরু করে বাংলাদেশেও তার আঁচ লেগেছিল। কম্পিউটার ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ধাক্কা তখন সবে পড়তে শুরু করেছে। সন্ধিক্ষণ ও পালাবদল মিলেঝুলে নাটকীয় ওই সময়টা অ্যালবামের চলছে শিরোনামে গীত দ্রুতলয়ের গানটিতে ভাষা খুঁজে নিয়েছিল। র্যাপ গানের আঙ্গিকে ছোঁড়া বুলির কিয়দংশের উদ্ধৃতি আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :—
জব্বর বিনোদনের খবর এখন — চলছে
বাংলা ছবির ধুম পড়েছে এখন — চলছে
শাবনাজ-নাইম জুটি খুবই গরম, তাই পুরনো নায়িকারা সব হিংসায় জ্বলে শুধু
ফরীদির মাথায় ঘুরছে গিরিঙ্গী প্ল্যান — চলছে
মৌসুমীর ফিল্মে দারুণ পজিশন — চলছে …
…ইঁদুর বিড়াল খেলা, কেঁদে চলেছে বিপাশা — চলছে
খুব ভালো চলে টিপু সুলতান — চলছে
হানিফ সংকেতের রম্য অনুষ্ঠান, ওই হয়রান গফুরের
বেহুদা প্যানপ্যানানী, অন্টি ভাবির গানে পাচ্ছে সংগীত ঊনস্থান,
তাই বাংলা খবর ভালবাসেন আমার আব্বাজান — চলছে…
ডিশ অ্যান্টেনার বাহাদুরি — চলছে
দেখো সারাদিন এম টিভি — চলছে
জী টিভির যত সুড়সুড়ি — চলছে
জুহি মাধুরীর নাচানাচি আর নাদিম–শ্রাবণের গানের চাক্কি — চলছে
নচিকেতার গান জীবনমুখী আর বম্বের হিন্দি গানের ঘ্যানঘ্যানানি — চলছে…
ব্যাংয়ের ছাতার মতন জন্মেছে ব্যান্ড — চলছে
হিট হচ্ছে তবু ব্যান্ডের গান, শুনি — রেনেসাঁ, এলআরবি, সোলস আর মাইলস…
সোলো ক্যাসেটে তপন-বিশ্বজিৎ, দিলরুবার গাওয়া পাগল মন হিট!
তসলিমার বিক্রি কুরুচি — চলছে
খবর — মুক্ত ফুলন দেবী — চলছে
সারাদেশে মাস্তানের সন্ত্রাসী — চলছে
প্রশাসনের নামে ভেলকিবাজি — চলছে
[চলছে; কথা : চারু; গান : ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা, ১৯৯৪]
দেশ জুড়ে যা চলছে তার দিকে বিদ্রূপের বাণ হানলেও ত্রিরত্নের গানটির মধ্যে বাংলা সংস্কৃতির ট্রানজিশনটা বোধ করি ইতিহাস হয়ে আছে। ওপার বাংলায় নচিকেতা এই বেশ ভালো আছি গানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপন্ন ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নবউত্থানকে তুলে ধরতে ফিলারের মতো করে র্যাপবুলি ছুড়েছিলেন সেই সময়। মুখড়া, মধ্য ও অন্ত ভাগের স্তবকে সুসংগতি ক্ষুণ্ন না করে ধীরলয় থেকে দ্রুতলয়ে গানের মুডটাকে পাকড়ে ধরার কুশলতা কানে আবেদন বহায় :—
এই বেশ ভালো আছি, এই বেশ ভালো আছি
এই বেশ ভালো আছি, কর্ম-কাজ নেই, গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই
অফিস-কাছারি নেই, হাজিরা-কামাই নেই
শব্দ বা পরিবেশ দূষণ বালাই নেই
সময় দেই না বলে তেলে-বেগুনে জ্বলে গিন্নীর রাগ নেই
টেলিফোনে ডাক নেই, শহরেতে কারফিউ, লোকজন কেউ নেই
১৪৪ ধারা, ফুটপাথে থাকে যারা, কেউ কোত্থাও নেই
নেই, নেই, কিছু নেই, তবুও তো আছে কিছু, বলতে যা বাধা নেই…
ভেঙে গেলে জোড়া যায় মন্দির-মসজিদ
ভাঙা কাচ, ভাঙা মন যায় না
রাম আছে, শ্যাম আছে, কোরানি সেলাম আছে
রক্তলোলুপ কিছু হায়না
পার্কেতে ঘোরা নেই, সিনেমায় যাওয়া নেই
উঠতি যুবকদের যাতনার সীমা নেই
শিহরণ আনে প্রেমে এমন বাতাস নেই
যুবতীর কটাক্ষ, চিরে দেয় এ বক্ষ
হায় রে এমন দিনে সেই অবকাশ নেই
চাল নেই, ডাল নেই, পয়সার দাম নেই
তবুও TV-র screen-এ খেলার বিরাম নেই
নেই, নেই, কিছু নেই, তবুও তো আছে কিছু, বলতে যা বাধা নেই
[এই বেশ ভালো আছি; কথা ও গান : নচিকেতা চক্রবর্তী]
ওপারে নচিকেতা ও বাংলাদেশে ত্রিরত্নের গানে ফিলার হিসেবে র্যাপবুলি প্রয়োগের নেপথ্যে আকাম সংস্কৃতির প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। এমটিভি-র কল্যাণে আমেরিকান র্যাপ গায়কদের পরিবেশনার সঙ্গে শ্রোতা-দর্শক তখন একটু-একটু করে পরিচিত হতে শুরু করেছেন। ষাট থেকে আশির রক-পপ বিস্ফারে মজে থাকা বাংলাদেশের ব্যান্ডগায়কদের ওপর সংগীতের এই জনরাটি বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্যান্ড গানে এর সম্ভাবনা নিয়ে তারা ভাবিত না হলেও ব্যান্ড আঙ্গিকে গান করতে অভ্যস্ত ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে র্যাপবুলির ধাঁচটাকে নিজের গানে জায়গা করে দিয়েছিল। চলছে গানটা সেক্ষেত্রে হালকা চালে গীত হলেও তাৎক্ষণিক সময়ে বহমান প্রবণতাকে তারা নজরে এনেছিলেন।
বিটিভি জামানা থেকে ডিশ জামানায় বাংলাদেশের প্রবেশ, বাংলা লোকগান ও আধুনিক গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যান্ডসংগীতের উত্থান, নাটক ও থিয়েটার করে পেট চলে না দেখে উন্নাসিকতা পায়ে দলে হুমায়ূন ফরীদির ঢাকাই সিনেমায় গমন ইত্যাদির মধ্যে সঙ্কর সংস্কৃতির (Hybrid Culture) যুগলক্ষণগুলো ধরা পড়েছিল। ত্রিরত্নের কাণ্ডারি আশরাফ বাবু, চারু, পার্থের বিদ্রূপ ও হাস্যরসে মোড়ানো হালকা চালের চলছে যাত্রাটা পেজগি অ্যালবামের গানগুলোয় এসে বোধ করি নীড় খুঁজে পেয়েছিল। হিপহপের জরুরি সব লক্ষণ প্রকটিত না হলেও প্রচলিত আঙ্গিকে গান করার ক্ষণে দ্রুতলয়ের বুলির এই সংযোজন শ্রোতাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
বাংলা র্যাপ গান তার সত্যিকার ভাষা খুঁজে পেতে শুরু করে স্টোইক ব্লিস ও ফকির লাল মিয়ার সময়ে পা রেখে। সময়টি অবধারিতভাবে নব্বই পরবর্তী ছিল। শূন্য দশকেও ব্যান্ড গানের জয়জয়কার বজায় ছিল। তার মধ্যেই তারা নিজের বিজয়কেতন উড়ান। ছয় নাম্বার বিপদ সংকেত অ্যালবামে সময়-প্রাসঙ্গিক টানটান র্যাপবুলি দিয়ে নিজের আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখা ফকির লাল মিয়ার যাত্রা দূর নিউইয়র্ক শহরে শূন্যের মাঝামাঝি এসে গতি পায়। সাম্প্রতিক দৌড় দে বা ধ্বংস-র মধ্য দিয়ে ফকিরের যাত্রা এখনো বিরতিহীন। স্টোইক ব্লিস-এর আলোকবর্ষ দূরে অ্যালবামে বাঁধাই গানগুলো, ব্ল্যাক জ্যাং-এর এই মামা এই বা ক্যান ইউ বি মি-র বসগিরি অর্থাৎ নিজেকে বাংলা র্যাপের মাস্তান রূপে জাহির করার বুলি এভাবে ক্রমপরিণতি খুঁজেছে তিলোত্তমা ঢাকা, নো বাউন্ডারিজ, চ্যাম্পিয়ন ও বাংলা হাইপ-এর গ্যাংস্টাসুলভ র্যাপছন্দের পরিবেশনায়।
স্টোইক ব্লিস-এর এসিড-কে গানটি বাংলা ও ইংরেজি বুলির মিশেলে র্যাপ গানে সময়-বাস্তবতায় গায়কের বিজড়ন ও নিজেকে জাহির করা অর্থাৎ শোম্যানশিপকে তুলে এনেছিল। দ্রুতলয়ে কথার গুলি ছুঁড়তে পারার খেলায় র্যাপার এসিড-কের সঙ্গে দেশি এমসিজ-এর এমসি শাকিউ-র তুলনা হয়তো করা যায়। অধুনা বিস্মৃত এসিড-কে-র গায়কিতে নিজের মানসিক অস্থিরতাকে র্যাপ অঙ্গের উপযোগী বুলিতে অবমুক্ত করার ধাক্কাটা কানে লাগে :—
এসিড ছুঁলে আকাশ পোড়ে ছিটে পরে পৃথিবীতে (Psychopath)
আত্নার হাটে চারিপাশে বিবেক নির্বিকার (Maniac)
বিদ্যুৎ চমকায়, মাটি কাঁপে রাতের রূপে দিন ফিরে আসে
মানব দানব সবাই হয় এসিডের শিকার (Bring the main one back)
পুলিশ আইলে লুকাই দা, রক্ত হাতে মুখে দাগ (Shit)
আর বিছনার নিচে লাশ পরে থাকে, ভাঙ্গা কোমর ভাঙ্গা পা
হাতে ছুরি দিশেহারা নিয়তির বিধানে
কাচের মতো স্বপ্নগুলো যদি ভেঙ্গে পড়ে যায় (Double R)
হাতে এসিড একা একা আগে পিছে কেউ নেই দেখার (Yeah)
গ্রামের বাসার পুকুরে তো লাশ পুড়ে ধুমায়
বন্দুকের গুলি মাথার ভিতরে ঘুমায়
[এসিড-কে; কথা ও গান: এসিড-কে, স্টোইক ব্লিস]
বাংলা র্যাপ গানের সূচনা খানিক আগে-পরে দূর নিউইয়র্ক ও ঢাকা শহরে একসঙ্গেই শুরু হয়েছিল। ফকির লাল মিয়া ও স্টোইক ব্লিস-এর গায়করা নিউইয়র্কে বসে দেশের সঙ্গে নিজের সংযোগ খুঁজে ফিরছিলেন। এসিড-কে গানে বিষয়টা ধরা পড়েছে। নিউইয়র্কের প্রবাসজীবনের তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার সঙ্গে দেশের মাস্তানজীবনের সংযোগ স্মৃতিকাতর বুলির মধ্য দিয়ে গায়ক স্মরণ করছে। লিরিক্স খানিক খাপছাড়া হলেও আত্মপ্রকাশের ভঙ্গিটা গ্যাংস্টা র্যাপে বাংলার শুরুয়াত কোন উচ্চতায় পৌঁছাতে আকুল ছিল তাকে চিনিয়ে যায়। বাংলা ব্যান্ডসংগীতের মতো র্যাপটাও সূচনালগ্ন থেকে এই সংগীতের জন্মভূমি মার্কিন দেশে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিল। যে-কারণে তাকে ভারতীয় হিপহপের ঘরানায় ফেলে দাগানোর যে-প্রবণতা ইন্টারনেটে গমন করলে মিলে সেটা অবান্তর ও হাস্যকর। সে যা-ই হোক, হেই এইটা বাংলা হাইপ, পুরা পাগলা টাইপ; — বাংলা হাইপ গানের মুখড়ায় র্যাপার আসিফুল ইসলাম সোহানের ঘোষণা বাংলা র্যাপ গানের গোড়াপত্তনের দিন থেকে সক্রিয় খেলোয়াড়দের অন্যতম ব্ল্যাক জ্যাং-এর জার্নি ও মঞ্চে পুনরায় ফেরত আসার চিত্র তুলে ধরে।
একজন গ্যাংস্টারকে নিজের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ধরে রাখার কৌশল নিয়ে ভাবতে হয়। এলাকায় তার রাজত্ব, হাওয়া খারাপ টের পেলে সাময়িক আত্মগোপন ও পুনরায় জাঁক করে ফিরে আসার মধ্যে যে-জীবনটা ঘুরপাক খায় সেটা আকস্মিক পাল্টা আঘাতে খতম হতে পারে। এখন র্যাপার যদি র্যাপ গানের ময়দানকে নিজের এলাকা ভাবে ও সেখানে দাপিয়ে বেড়ানোর বাসনা রাখে তাহলে ময়দান ছাড়া যাবে না। সাময়িক বসে পড়লে দাপটের সঙ্গে ফিরে আসার ধান্ধাই হচ্ছে র্যাপ। ফেরত আসার ক্ষণে মনে রাখতে হচ্ছে, — নিজের ঝুলিতে শব্দের ছুরি-বোমা-বুলেট অথবা বক্সিংয়ের রিংয়ে উঠে পড়ার সুবাদে ঝোপ বুঝে প্রতিপক্ষের চোয়াল বরাবর মোক্ষম মুষ্ঠাঘাতের রসদ মজুদ থাকলেও প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবা যাবে না, কেননা সুযোগ পেলে তারা ঠিক ঝেড়ে দেবে। মার্কিন র্যাপগানের জগতে গোড়া থেকে বিদ্যমান পাটাতনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাক জ্যাং-এর সদস্যরা বাংলায় বুলি আওড়ে যাচ্ছে। গানের কথা বা লিরিক্সের তুলনায় যে-ভিডিওগ্রাফি তারা করে সেটা বোধ করি এক্ষেত্রে অধিক মনোরঞ্জক। অবশ্য এ-নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে আর থাকাটা স্বাভাবিকও।
ছুরি চাপাতি রামপুরি বাইর কর / 5গান শটগান / হাতে লইয়া চল / অলিতেগলিতে পোলাপাইন করে শোর / গ্যাঞ্জাম করতে গেলে হালা সব দেয় দৌড়; — বাংলা গ্যাংস্টা র্যাপের শুরু থেকে অনেক শ্রোতার কাছে ক্লাসি বলে গণ্য ‘দেশি এমসিজ’ গ্যাঞ্জাম গানের মুখড়াটি দিয়ে পোলাপানদের মাঝে একসময় আলোড়ন তুলেছিল। বাংলিশ গ্যাংস্টাজ, ঢাকাইয়া গ্যাংস্টা বা এ-রকম সব বুলি কপচানোর ভড়ংটা র্যাপের আসল পাওয়ার বোধহয় খুঁজে নিয়েছে দেশি ড্রিল : নাটের গুরু-২ গানে পা রেখে :—
একনায়কতন্ত্র নাকি জাদুমন্ত্র
সিন্ডিকেট স্পনসরিং, ষড়যন্ত্র
Cause দেশি এমসিজ আনসে গণতন্ত্র
হিপহপ যোদ্ধারা, আইসা পড়সে
র্যানডম র্যাপ রাজাকার, বইসা পড়সে
ধইসা পড়সে, আর্টফর্মটা সহ
কালক্ষেপণে busy, প্লাটফর্মটা ‘ওহো’
র্যাপ রেনেসাঁ, আই অ্যাম ইন চার্জ রেফ্রি
হিপহপ মরলে, আই অ্যাম রিচার্জ ব্যাটারি
আনসি গুণ্ডার্যাপ, Not, রক ব্যান্ড কবিগান
হিপহপ আমার কালচার, দেশি my অবদান
সবকিছু শেষ, নাকি সব আবার শুরু,
লাহুস্তা, নাটের গুরু
[দেশি ড্রিল : নাটের গুরু-২; কথা ও গান: এমসি শাকিউ; দেশি এমসিজ]
বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে পেরেশানরা দেশি এমসিজ-র র্যাপবুলি শুনে আঁতকে উঠতে পারেন। ভাষার স্বকীয়তা, নান্দনিকতা ও শুদ্ধতা নিয়ে গুরুতর শঙ্কায় পতিতদের পক্ষে ইংরেজি ও ঢাকাই বুলি মিশ্রিত দোআঁশলা র্যাপবচন সইতে পারা কঠিন। পোলাপানরা ভাষার গর্ভনাশে মত্ত এই ভাবনায় তাদের বুকে কাঁপুনি ওঠা স্বাভাবিক। বিনয়ের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এইসব গানবাজনা ঠিক তাদের জন্য নয়। তারা শুনতে চাইলে বাধা নেই তবে না শোনাই উত্তম। যেহেতু, শুনতে গিয়ে যে-রায় তারা ঠুকে বসবেন সেটা পোলাপানদের সঙ্গে ঠোকাঠুকিতে লিপ্ত হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় ফল উৎপাদন করবে বলে একিন হয় না।
কোন পথে আগানো গেলে সাহিত্য বা সংগীতের ভাষা স্বকীয়তা অটুট রেখে বিশ্ব জুড়ে স্রোতের মতো প্রবাহিত বিচিত্র ভাষাকে বুকে টানবে ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক ও মতান্তর অতীতে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এখানে দেশি এমসিজ-এর র্যাপবুলিকে হিপহপের প্রথানুগ স্বভাবের সঙ্গে মিলঝুল করে বুঝে নেওয়াই উত্তম। মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে আগত পোলাপান নগর ঢাকার পথেঘাটে নিজের মধ্যে সংযোগ সারতে গিয়ে সচরাচর যে-ভাষায় কথা বলে তাকে মাথায় রাখা প্রয়োজন। র্যাপবুলিতে ব্যবহৃত ভাষা স্বভাবের দিক থেকে বেতাল গোছের হয়ে থাকে। এ্যানার্কি বা নৈরাজ্যের লক্ষণ সেখানে সবসময় দপদপ করে এবং হয়তো এ-কারণে ভাষার ছিরিছাঁদ বলে কিছু থাকে না; — সত্যটি মানতে না পারলে গানগুলোকে এড়িয়ে যাওয়াই মঙ্গল।
ভাষার বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তার বিচিত্র স্তরভেদ রয়েছে এবং বাংলা ভাষা সেখানে ভিনগ্রহের জীব নয়। শ্রেণিক অবস্থানটা নির্ণায়ক হয়ে ওঠে অনেক সময়। একটি দেশে সমাজের ভিতরে সমাজ, গোষ্ঠীর ভিতরে গোষ্ঠী, এলাকার ভিতরে এলাকারা থাকে। সবগুলোর যোগফল থেকে সৃষ্ট শ্রেণিকাঠামোয় আবার বিচিত্র স্তর ও পৃথক শ্রেণি-পরম্পরা সচল হয়। দেশি এমসিজ র্যাপের ছন্দে যা আওড়ায় সেগুলো ওইসব পোলাপানদের ডেলি লাইফকে বিবেচনায় নিলে অস্বাভাবিক ভাবার কারণ থাকে না। প্রমিত ও ঢাকাই বাংলার পাশে ইংরেজি শব্দকে তারা অবলীলায় বসায় এবং ঘরে-বাইরে বাতচিত সারে। তাদের কাছে ওটা হচ্ছে মাতৃভাষার চেনা স্বরূপ।
সুশীল সমাজে ওঠবস করতে অভ্যস্ত কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী বা ভাষাবিদের উদ্বেগভরা তিরস্কারে এইসব তরুণ নিজেকে শুধরে নেবে এমন ভাবাটা বোকামি। ভাষা প্রধানত আমজনতার মুখের বুলিতে বাঁচে এবং মরে। বাংলা ভাষার যুগাবর্ত এভাবে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে ভাষাটি বেঁচে থাকবে নাকি অবলুপ্ত হবে সেটাও নির্ভর করছে বৈশ্বিক তরঙ্গে বাঙালি জাতি কোন পথে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলছে তার ওপর। অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতি যদি নিজের প্রাসঙ্গিকতাকে বিশ্বে তুলে ধরতে পারে তবে তার ভাষার মরণ নেই। এর ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব তখন আপনা থেকে বাড়তে থাকবে। আলাদা করে তাকে সুরক্ষার ভাবনায় রাষ্ট্র ও ভাষাপণ্ডিতকে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে না।
পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক ভাষার চাপে বাংলা ভাষার বিপন্ন দশার কথা অনেকে আজকাল বলাবলি করে থাকেন। ওপার বাংলায় ভাষার এই দুরবস্থার জন্য স্বয়ং ওখানকার সরকার ও নাগরিক জনগোষ্ঠীর দায় অধিক। ব্যবসাবাণিজ্য থেকে প্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বেশ পিছিয়ে পড়েছেন। তাদের ভাষার ওপর এটা গুরুতর চাপ তৈরি করছে। বাংলার বদলে কলকাতার চারদিকে হিন্দি, পাঞ্জাবি বা ইংরেজি খৈয়ের মতো ওড়ে। জাতি হিসেবে নিজেকে সকল ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে না পারলে শক্তিশালী ভাষাও একসময় গুরুত্ব হারায়। ব্যাপক সংখ্যক লোক ভাষাটিতে কথা বলার পরেও তার মরণযাত্রা নতুবা গৌণ হওয়ার নিয়তি রোধ করা সম্ভব হয় না। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা জবানের কপালে গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার দুর্দিনটা বোধ করি ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে।
অল্পসংখ্যক লোক একটি ভাষায় কথা বললে বা তাদের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করলে সেই ভাষার মরণ ঘনায়। এই কথাটি ভাষাপণ্ডিতরা প্রায়শ আওরে থাকেন। কথা সত্য হলেও জনগোষ্ঠী যদি বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে আগুয়ান থাকে তাহলে নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা তার পক্ষে সহজ। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সে তখন নিতে পারে, যেটি তার ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে সুরক্ষিত রাখে। মৃত ভাষা হিব্রু ইহুদিদের কল্যাণে এভাবে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। লোকজন ওই ভাষায় কথা বলে না কিন্তু পাঠ্য ও লিখিত আঙ্গিকে তার চর্চা বেগবান হয়েছে। তুলনায় সংস্কৃতকে নতুন জীবনীশক্তি দানের শক্তি বাস্তবতা বিবেচনায় ভারতবর্ষের নেই। বাংলা ভাষা এমনকি খোদ বাংলাদেশে ইংরেজির দাপটে দূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে যদি বিশ্বসমাজে দেশটি তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে বিফলকাম হয়। সাহিত্যের ওপর ভর করে একটি ভাষা বাঁচে না। ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক রূপে হাজির করার মধ্য দিয়ে।
র্যাপ ও হিপহপ আঙ্গিকের পরিবেশনায় ভাষার বিষয়টি আরো কুটিল। এটা এমন এক শিল্পকলা যেখানে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসা বুলিকে সে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। মৌখিক বুলির পাশাপাশি র্যাপটা যে-গায়ক গাইছে তার সামাজিক অবস্থান ও স্তরভেদ নির্ধারক হয় সেখানে। একজন র্যাপার যদি সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের ভাষাজগৎ থেকে উঠে আসে তার র্যাপের বুলিতে ওই জগতে চর্চিত শব্দ, বাক্য ও বাগ্বিধির প্রাধান্য অমোঘ হয়ে ওঠে। র্যাপার যদি চাকরিখাটা বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের ভাষাজগতে বিচরণ করে তবে র্যাপ গানে বুলি ছোড়ার ক্ষণে সেই ভাষার প্রভাব তার ওপর আপনা থেকে প্রবল হওয়া উচিত। সরাসরি সমাজের ওপরতলার লোক যদি হয়ে থাকে অথবা ওই স্তরে যাতায়াতে অভ্যস্ত হয় তাহলে র্যাপে সেভাবে কথা বলা তার জন্য সমীচীন বৈকি।
বাংলা র্যাপ গানের শ্রোতাদের ব্যাপক উপহাসের শিকার ট্রাই গ্যাং-এর লেভেলে নাই গানটাকে আলোচনার এই পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক করা বোধ করি অবান্তর হবে না। ক্লাব, পার্টি, মাদক ও নির্বিচার নারীসঙ্গে অভ্যস্ত বড়োলোকের বখাটে পোলা মেয়েবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানতে যেয়ে তাকে Bitch সম্বোধন করে বুলি ছুড়ছে গানে :—
লেভেলে নাই, (নাই) লেভেলে লেভেলে লেভেলে তুই লেভেলে নাই
I’m so fucking rich, I’m so fucking rich
তোর life এর থেকে বেশি আমার জুতার দাম
আমার জুতার দাম bitch, আমার জুতার দাম…
তোর বাপ আমার টাকার fan টাকার fan আমার টাকার fan
তোর মা আমার ex girlfriend, ex girlfriend bitch ex girlfriend
লেভেলে নাই, (নাই) লেভেলে লেভেলে লেভেলে তুই লেভেলে নাই
I’m so fucking rich, I’m so fucking rich
টাকা গাড়ি বাড়ি অভাব নাই সব সালা ফকিন্নী লেভেলে নাই
লেভেলে নাই লেভেলে নাই লেভেলে লেভেলে নাই
যখন দেছ তুই কামলা থাকি আমি world tour দেখ
World tour-এ world tour-এ, world tour-এ bitch world tour-এ
আমার maid এর salary, বছর ভইরা যা কামায়
তোর পুরা family, bitch তোর পুরা ফ্যামিলি
[লেভেলে নাই; কথা : সজল শরিফ; গান : ট্রাই গ্যাং]
বাংলা র্যাপ গানের শ্রোতারা গানটিকে পরিহাস ও গালিগালাজে বিদ্ধ করলেও এর অন্তে শায়িত ব্যাধিকে বোধ করি অস্বীকার যাওয়ার উপায় নেই। এ তো মিথ্যে নয় গেল দেড় দশকের উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশের ভিতরে আরেকটি বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের অনেক বিভাগীয় বা জেলা শহরে বিত্তবানদের চেয়েও বিত্তবান একটি শ্রেণির বাড়বাড়ন্ত গোপন কোনো বিষয় নয়। ঢাকায় মিরপুর-মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে এ-রকম এলাকার বাসিন্দারা যদি সামাজিক বিন্যাসের একটা স্তরে অবস্থান করে তবে গুলশান-বনানী-বারিধারা-উত্তরার বাসিন্দারা পৃথক আরেকটা স্তরে বিচরণে অভ্যস্ত। স্তরটার ভিতরে আবার নতুন স্তর গজিয়ে উঠেছে যেখানে লেভেলে নাই গানের so fucking rich-দের বসবাস। তাদের ডেলি লাইফ অতিরিক্ত টাকাওয়ালা হলে যা হয় সেই কেতা অনুসারে চলে। দিনটাকে তারা একভাবে যাপন করে। রাতে সেটা রং পাল্টায়। গানটির কথা ও ভিডিওগ্রাফির মধ্যে রদবদলটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
so fucking rich-এর কাতারভুক্ত ছেলেমেয়ের জীবনে বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির অস্তিত্ব যদি আদৌ থেকে থাকে তাহলে তার প্রকাশ বাদবাকি স্তরে ধুঁকতে থাকা ছেলেমেয়ে থেকে পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক। যে-জীবন সেখানে রোশনি ছড়ায় তাকে বিবেচনায় নিলে বাদবাকিরা সত্যিই লেভেলে নাই! এমনকি লেভেলে উঠার চেষ্টায় যত মন্ত্রী, নেতা, পাতিনেতা, আমলা, ঘুষখোর, সিন্ডিকেটরা উতলা, — তারাও নাই। বাংলাদেশের বিত্তবান সমাজে সক্রিয় অতিশয় স্থূল ভোগবাদী বিকারকে বোঝানোর মতো শব্দবন্ধ বেছে নিতে পারায় গানটিকে বেখাপ্পা ভাবার সুযোগ থাকছে না। পপুলার কালচারে so fucking rich-রা সচরাচর প্রবেশ করে না এবং করার হেতু নেই। লেভেলে নাই গানটির সুবাদে সমাজের ওই স্তরে বিচরণে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েরা নিজেকে কীভাবে সবকিছুর সঙ্গে রিলেট করছে তার খানিক আভাস পাওয়া যায়। পুঁজিবাদী সমাজের নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের ঢুকে যাওয়া ও শ্রেণিচরিত্রে তার অভিঘাত টের পেতে গানের র্যাপগুলিটা সাহায্য করে। যারপরনাই র্যাপকে ব্যবহার করে ট্রাই গ্যাং-এর ইতর গলাবাজি কানে স্থূল শোনালেও গানটি উপযোগিতার জন্ম দিয়ে যায়।
গানের কথা ও ভিডিওগ্রাফির অশ্লীলতা আর নারীবিদ্বেষী বাগাড়ম্বরে আঁতকে ওঠা রুচিবাগিশদের হয়তো বোঝার সময় হয়েছে আচমকা আঙুল ফুলে কলাগাছ একদল বড়োলোকের কাঁধে ভর দিয়ে বাংলাদেশ ভোগবাদের প্রথম স্তরে মাত্র প্রবেশ করেছে। সূক্ষ্মতার আলখাল্লায় নিজেকে মুড়িয়ে স্থূল অর্থাৎ দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছাতে আরো সময় লাগবে। রাতারাতি শত কোটির মালিক বনে যাওয়া বড়োলোক ও তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের কাছে রাতভোর পার্টিতে হুল্লোড়, মদ-ইয়াবা-আইস-কোকেইন-সিসায় বুঁদ হয়ে থাকা আর মেয়েমানুষ নিয়ে মাস্তিটাই হচ্ছে জীবন। একে চাঙ্গা রাখতে হলে নতুন রসদ দরকারি যা কিনা অভিনব পন্থায় তাদের অশ্লীল থাকার উত্তেজনাকে আয়ু দিতে পারে। সুতরাং লেভেলে নাই-এ শ্রোতা যা শুনে (এবং দেখেও) তাকে শোভনতার দোহাই দিয়ে রাখঢাক করে পরিবেশন করলে সেটা হতো আরো বড়ো অশ্লীলতা।
[প্রথম অংশ সমাপ্ত]
বাংলায় হিপহপ ও র্যাপ নিয়া গানপারে অন্যান্য রচনা
বাংলায় রিদম অ্যান্ড পোয়েট্রি নিয়া প্রাথমিকা
বাকরুদ্ধ ভুবনের পলিটিক্যাল অ্যান্থেম : স্কিবখানের ‘সব চুপ’
র্যাপ, রাজা কুমারী, প্রাচ্য ও পশ্চিম
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS