হে অনেক লিচুগাছের দেশ, হে অনেক শ্রাবণের আশ্লেষ …

হে অনেক লিচুগাছের দেশ, হে অনেক শ্রাবণের আশ্লেষ …

লিচুগাছগুলো ভিজিছে শেষলা আষাঢ়ের বৃষ্টিতে। একটা বানর একা একা লাফাচ্ছে এ-গাছ থেকে ও-গাছ। দলছুট বানরের ত্রস্ত অসহায়তা তার লাফানোর দিকে দর্শকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে। একমাইল শান্তিকল্যাণের ন্যায় লিচুতরুদের ভিড়ে একটা বাংলো। সুনসান। বৈকালিক তন্দ্রামদালস আলো। বৃষ্টিতে এবং বানরের একলা লাফানিতে বিকেলের আবহ হয়েছে আরও করুণ। শুধু কাঠবিড়ালিদের চলাফেরা মাঝেমাঝে এই লিচুদেশে একটা চনমনে চাঞ্চল্য জাগাইছে।

বিদেশী সিনেমায় দেখা গ্লাসউইন্ডোর রেইনফ্যল্ বাইরে। এত হাল্কা আবেশের বৃষ্টি! মিউট রেইন। এতই মিউট যে এই লিচুজঙ্গলেও শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে না বৃষ্টিপাতের। শুধু থমথমে এক প্রকারের ঝিমানি লিচুপাতাগুলোকে রেখেছে দরজায়-খিল-দেয়া কামরার মতো ঘুমন্ত। যদিও আষাঢ়, অন্তিম আষাঢ়ের দিক, মনে হতেছে যেন তবু ঝরিছে শ্রাবণ। পুরা শ্রাবণের সাব্লিমিটি লিচুবনে এই বৃষ্টিপতনে। এবং লগক্যাবিনের মতো ঘরের বারান্দায় বিছিয়ে-রাখা আপ্যায়নচেয়ারে বসে এইসব দেখিছে এক ভাষাহারা লোক, বোবা এবং তদুপরি ভীষণ উজবুক। পড়ালেখা-জানা, বিদ্বান, বটে! এইমাত্র শাখামৃগ হইতে আঁখি ফিরায়ে সে ন্যাস্ত হয়েছে বইয়ের পাতায়।

একুশবছর আগে পড়ে সেরে এতকাল-ভুলে-থাকা বই। শ্রীকান্ত। চতুর্থ পর্ব। পয়লাই মিছরির সেই ছুরিকায় দৃষ্টি আটকায় — “এতকাল জীবনটা কাটিল উপগ্রহের মতো। যাহাকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরি, না পাইলাম তাহার কাছে আসিবার অধিকার, না পাইলাম দূরে যাইবার অনুমতি। অধীন নই, নিজেকে স্বাধীন বলারও জোর নাই।” … ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শ্রী শরতের চন্দ্রস্নিগ্ধ ঘনঘোর মেলোড্রামা। মনোরমণীয়। অরণ্যে লিচুর ঝোপে শ্রীকান্তকৈশোরের ন্যায় গা-ছমছম প্রণয়নিবদ্ধ সন্ধ্যা আসে নেমে।


দেবদারুপত্রালি বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে যেমন বিদেশী সিনেমার দৃশ্য বলিয়া ভ্রম হয়, লিচুপত্রালি বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যে তেমনি চিরদিন মাতুলালয়ের ছবি ঝিল্কে ওঠে। ব্যাপ্ত জমিজিরেত চৌদিকে রেখে লিচুগাছ তার মনোরম সংসার পাতে। একবিঘৎ ফাঁক রেখে গা-লাগোয়া গাছের ঘেঁষাঘেঁষি লিচুতরুর পোষায় না। চারিপাশে ঢের পরিমাণে স্পেস্ চাই তার। পাতার ছাতা মেলিয়া বসা চাই লিচুগাছের।

টঙ্গিঘরের সামনেকার লিচুগাছ ঘিরেই দিনভর যারা শাখামৃগের ন্যায় লেজঝোলা কাটাইত একদা, তাদিগের জীবন আজ ঝুলে গেছে এক অনপনেয় উদভ্রান্তির দিকে। সেই লিচুগাছটারে কেটেছেঁটে বামন করে ফেলা হয়েছে সভ্যতা সম্প্রসারণের স্বার্থে। এখনও, তবু, বৃষ্টি হয় এই লিচুগাছের ঝোপালো পাতায়। এখনও, তথাপি, বৃষ্টি হয় এই বিধ্বংসীভূত সভ্যতায়। এখনও লিচুওয়ালা বাড়ি ঘিরে তেরচা ছায়া আর রোদ খেলা করে সাতসকালে খাড়াদুপুরের দাহ-ঝলসানো গরমে।

এই দেশে জন্মে যেয়ে যারা মামাবাড়ি পেয়েছেন গোলাপগঞ্জ-ঢাকাদক্ষিণ-ভাদেশ্বর এলাকায়, তারা জানবেন লিচুগাছওয়ালা বাড়ির বৃষ্টিদুপুরবাহিত উথালপাথালতা কাকে বলে।


এবং মনে পড়ে সেই শ্রাবণশর্বরী। লিচুগাছ মনে পড়ে। সেই বানর, পিঠে যার জখমের চেরা দাগ। মনে পড়ে বৃষ্টির মতো নরম দুপুর। সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ বৃষ্টির ঝিরিঝিরি। লিচুগাছের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস, ঘুম ও ঘন বনভূম, মনে পড়ে একগোছা বাঁশের মাথায় হামিংবার্ডের লঘু ওড়াউড়ি। গ্রীষ্মবল্কানো এই বৃষ্টিহীন তিনদিনের নাভিশ্বাসে সেই বিস্মৃত-লগ্নমধুরিমা ফিরায়ে এনে একটু পরিত্রাণের পাঁয়তারা আদৌ অনর্থক নয়।

এই নিদাঘ ঋতুতে তুমি ফিরে আসো পুনরায়, হে অনেক লিচুগাছের দেশ, হে অনেক শ্রাবণের আশ্লেষ …

লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৬

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you