কাশ্মিরের কবি লাল্লেশ্বরী : তাঁর কবিতা || মঈনুস সুলতান

কাশ্মিরের কবি লাল্লেশ্বরী : তাঁর কবিতা || মঈনুস সুলতান

কাশ্মিরের কবি লাল্লেশ্বরী, যিনি লাল দেদ বা লাল্লা নামেও পরিচিত, জন্ম হয় ত্রয়োদশ শতকের পয়লা দিকে, পণ্ডিতপরিবারে — শ্রীনগরের কাছাকাছি পানড্রেথানে। বারো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়েছিল, কিন্তু কবির পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না। চব্বিশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে তিনি গুরু সিদ্ধাশ্রীকান্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। লোকগাথার সূত্র থেকে জানা যায় যে, এক-পর্যায়ে কবি লাল্লেশ্বরী কাশ্মিরের প্রচলিত সুফি তরিকার রীতিরেওয়াজের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। শেখ নুরুদ্দীন নূরানী (যিনি নন্দঋষি নামেও পরিচিত), এর সঙ্গে কবি লাল্লেশ্বরীর মাতৃসুলভ সম্পর্কও কাশ্মিরের লোকগাথায় বিধৃত হয়ে আছে। শেখ নূরানী বা নন্দঋষির উল্লেখ তাঁর কবিতায়ও আছে।

সে-জামানার একজন মুসলিম ইতিহাসবেত্তার বিবরণানুযায়ী, কবি নাকি ভাবের ঘোরে মশগুল হয়ে হিব্রু পুরাণের নবি বা সুফি ধারার দরবেশদের মতো নৃত্য করতেন। ধারণা করা হয় যে, বৌদ্ধ শ্রমণ, নাথ যোগী, ব্রাহ্মণ গুরু, তান্ত্রিক ও সুফি সন্ত প্রমুখ সকলের সঙ্গে কবি লাল্লেশ্বরীর মিথস্ক্রিয়া হয়েছিল একাধিকবার, এবং এতে তাঁর সাধনপ্রক্রিয়া সমৃদ্ধ হয়েছিল।

চারণকবি বা বাউলদের মতো কবি ঘুরে বেড়াতেন; লোকশ্রুতি অনুযায়ী, কখনো তাঁর পরিধানে বস্ত্রাদি থাকত না। তিনি সুরছন্দে, লোকগীতির মতো তাঁর কবিতা, যা কাশ্মিরি সহিত্যে ‘ভাখ’ নামে পরিচিত, পরিবেশন করতেন — দর্শন করতে আসা ভক্তকূলের সামনে। কাশ্মিরি কাব্যকলার সমজদাররা তাঁর অবদানকে মিরাবাঈয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।

এখানে উপস্থাপিত ভাখগুলোর ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাবতর্জমার সূত্র ইন্টারনেট। প্রথম পাঁচটি ভাখের কাশ্মিরি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যান্ড্রু শেলিং, ৬ থেকে ১৬ অব্দি ভাখগুলোর ইংরেজি তর্জমাকারের নাম রনজিৎ হসকোত, ১৭, ১৮ ও ১৯ ভাখ তিনটি ইংরেজিতে ভাষান্তরিত করেছেন জি. গিয়ার্সন।


কাশ্মিরের কবি লাল্লেশ্বরী : তাঁর কবিতা
কাশ্মিরি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ : অ্যান্ড্রু শেলিং, রনজিৎ হসকোত ও জি. গিয়ার্সন
ভাবতর্জমা : মঈনুস সুলতান


১.
একজন সুশিক্ষিত মানুষকে ধুকে মরতে দেখেছি আমি অনাহারে,
ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেছে পত্রালি —

চিন্তাভাবনায় অক্ষম এক আহম্মক তার পাচককে প্রহার করছে,
এ-ধরনের ঘটনাও ঘটল আমার চোখের সামনে,

বহুদিন ধরে প্রতীক্ষা করছে লাল্লা —

দূরীভূত হবে কখন — এ-জগতের রহস্যময় আকর্ষণ।

২.
চাইলে এলোমেলো করে দিতে পারি হয়তো
উত্তর থেকে উড়ে আসা মেঘমালা,

সেচে শুকিয়ে দিতে পারি সমুদ্র —

জড়ো করে জগতের পুষ্পকমল
তৈরি করতে পারি অর্চনার ডালা,

কিন্তু পরিবর্তন করা কোনো আহম্মকের মন
তোমারও সাধ্যের অতীত জেনো লাল্লা — এ-সাধন।

৩.
রাজপথ ধরে হাঁটছি আমি
কিন্তু ফিরে যাব না কখনো এ-সরণীতে —

যাত্রার মাঝপথে দাঁড়াই দু-দণ্ড বাঁধের উপর,
ভরে ওঠে হৃদয় দখিনা সমীরের সংগীতে,

চলে যায় দিন, নামে নিকষ রাত্রি — অতঃপর —
পোটলা-পকেট বা খুঁতি খুঁজেও পাই না একটি কড়ি

বিপন্ন হয় লাল্লা — বিভ্রান্ত হয় তার বোধ,
কীভাবে করব আজ পারানি পরিশোধ?

৪.
তোরণ পেরিয়ে আমি — লাল্লা — আজ
প্রবেশ করি হৃদয়ের বাগিচায়,
দেখি — শক্তির সঙ্গে সঙ্গমে এক হয়ে গেছেন নটরাজ।

নিমজ্জিত হই আমি পরম সুখের অজর সরোবরে,
এইখানে — এ-জীবনে জন্ম-মৃত্যু চক্রের শিকলও ছেঁড়া হলো।

বিশ্ব কী আর করতে পারে আমার?

৫.
গুরু আমাকে দিয়েছেন কেবলমাত্র একটি দিকনির্দেশনা,
বাইরে থেকে ফেরাও চোখ লাল্লা,
উড়ুউড়ু মন — গুটিয়ে ডানা
তাকাও অন্তরে —

অন্দরের অতলে সংগোপন আছে যে-সত্তা,
নিবদ্ধ করো মনোসংযোগ ওই গুপ্ত কুটুরিতে।

আমি, লাল্লা — হৃৎকমলে আঁকড়ে ধরে এ-সুবচন,
দেখি, নীরবে নৃত্য করছে অন্তরাত্মা আমার

নিরালোকে — নির্লিপ্ত — নিরাবরণ।

৬.
খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে ক্লান্ত করে তুলি আমি —
গূঢ় সংকেতের রহস্য ভেদ করতে
এর চেয়ে বেশি মেহনত করতে পারবে না কেউ,
নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে আমি খুঁজে পাই
শরাবের সোরাহিতে পূর্ণ এক তলকুটুরি,
তাবৎ তরল মধুময় নির্যাসে ভরপুর;
চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে সুরভিত শরাবের সোরাহি,
কিন্তু পান করার নেই-যে কেউ।

৭.
কে এ-মালঞ্চের মালাকর, তার স্ত্রীই-বা কে?
তাঁকে অর্ঘ দেয়ার জন্য কী ফুল চয়ন করবে তারা?
কী ধরনের জল ছিটিয়ে মাল্যকে করে তুলবে সতেজ?
কোন মন্ত্র জপে তারা জাগ্রত করবে

অবচেতনের সঙ্গোপনে তন্দ্রাচ্ছন্ন যে-গভীর সত্তা।

৮.
মালাকরের হৃদয়-মন, তার স্ত্রী — বাসনার প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস
তাঁর জন্য চয়ন করবে তারা উপাসনার উপযুক্ত কুসুম,
ছড়িয়ে দেবে পুষ্পদামে জোৎস্নাসিক্ত মধুরিমা,
নীরব মন্ত্রোচ্চারণে জাগিয়ে তুলবে সংগোপনে সুপ্ত নিজস্ব সত্তা।

৯.
গ্রন্থাদি কী শিক্ষা দিয়েছে,
অনুশীলন করেছি আমি নিজে নিজে,
তারা যে-বিষয় সম্পর্কে আমাকে দেয়নি কোনো ধারণা —
আমি নিজে নিজেই শিখে নিয়েছি তা,
বনস্থলে বাস করেছি আমি — লড়েছি সিংহের সঙ্গে
এই অব্দি আসিনি আমি হেলাফেলা করে।

১০.
আছেন এমন কেউ কেউ,
দু-চোখ মুদ্রিত করেও জাগ্রত তাঁরা,
কিছু কিছু মানুষ জগত-সংসারের দিকে দুইনয়ন মেলে
তাকিয়ে থেকে নিদ্রায় ঢলে পড়ে দ্রুত,
সড়কের সঠিক নিশানার সন্ধান পেয়ে হয় নিমেষে পথহারা।

১১.
কেউ কেউ নোংরা থেকে যায় আজীবন
অবগাহন করেও পবিত্র গঙ্গাজলে,
কোনো কোনো মানুষ বিত্তবেসাতে নিমজ্জিত হয়েও
রাখতে পারে তাদের দুইহাত সাফসফা,
হয় না বিভ্রান্ত জগৎসংসারের হরেক ছলে। 

১২.
কিছু সংবাদ খারাপ আবার কিছু সংবাদ অতীব নিকৃষ্ট

শরতে নাসপাতি, আপেল ও অ্যাপ্রিকট পেকে উঠবে
গ্রীষ্মে হবে বৃষ্টিপাত,
জননীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ছাড়বে ঘর —
ভিন্ন পুরুষের হাতে তারা রাখবে হাত,
কন্যারাও খুঁজবে নিজ নিজ বর।

১৩.
রাজছত্র, চামর, রথ ও সিংহাসন
মঞ্চাভিনয়ের ছলাকলায় শিহরণ,
চন্দ্রাতপে সাজানো পালঙ্ক
ও পট্টবস্ত্রের সুচারু বসন,
বলো তো দেখি,
কোন দ্রব্যটি সঙ্গী হবে তোমার
যখন আসবে শমণ?

১৪.
নৃত্য করো লাল্লা —
কেবলমাত্র বাতাসে ভর দিয়ে নিমগ্ন হও নিবিড় নৃত্যে,
আকাশকে করো পরিচ্ছদ, শরীরে ধারণ করো নীলিমা,
গান করো লাল্লা সুরলয়তালে গান করো দিলখোলা চিত্তে —
দেহমন থেকে দূরীভূত হোক সীমা,
নয়ন তুলে তাকাও সূর্যকরোজ্জ্বল দিবসের দিকে,
কিরণের চেয়ে সুন্দর পোশাক আছে কী কোনো —
আছে কিছু কী রোদের চেয়ে পবিত্র,
নয়ন তোলো — তাকাও অনিমিখে।

১৫.
তৈরি করেছে ধনুক কাঠে আর নলখাগড়ায় তির
অদক্ষ মিস্ত্রী কিন্তু নির্মাণ করতে হবে যে প্রাসাদ —
মিনারের উচ্চ শির,

এদিকে জনবহুল বাজার
তালাবদ্ধ নয় হে — হাট করে খোলা দোকানের দুয়ার,
গঙ্গাজলেও পবিত্র হলো না শরীর —
কী হলো তোমার লাল্লা — খুঁজে পাও না পথ,
চারদিকে ঘিরে আসে যে তিমির।

১৬.
গুরুকে করেছি এ-সওয়াল সহস্রবার
কোনো সংজ্ঞায় নিরুপিত হয় না যার পরিচয়,
কী নাম তাঁর?

তর্পণে তর্পণে লাল্লা হয় কেবলই পরিশ্রান্থ,
একই সওয়াল শুধায় সে বারংবার —
যে-পথে ফেলছে কদম — তা কী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত?

নাস্তি থেকে উত্থিত হয় সে — নেই নির্দিষ্ট আকার,
কাটে সাঁতার — লাল্লা পায় না খুঁজে আকুল পারাবার।

১৭.
হারিয়ে যাবে পবিত্র গ্রন্থরাজি, তবে তান্ত্রিক সূত্রাদি থেকে যাবে বিদ্যমান। তাও যখন বিলুপ্ত হবে তখনও অস্তিত্ব থাকবে মনের। যখন থাকবে না মনও — তখন নিখিল নাস্তিতে নিমজ্জিত হবে চেতন-অবচেতন, আর কণ্ঠস্বর মিশে যাবে তুমুল শূন্যতায়।

১৮.
স্বর্গের স্বরূপ তুমি, পৃথিবীও প্রতিফলিত হয় তোমাতে। সর্বত্রব্যাপী পরিব্যাপ্ত বাতাস, নৈবদ্যের চাল, পুষ্প ও জল তুমি; সর্বত্র প্রতিফলিত হয় তোমার বিভা, তোমাতেও বিদ্যমান কেবল তুমি, কী আর অবশিষ্ট আছে বলো — যা দিয়ে সাজাতে পারি তোমার উপাসনার উপযুক্ত উপচার?

১৯.
দুর্বল সুতায় বোনা গুণ,
এ দিয়ে কী সমুদ্রজলে নৌকা টেনে নেয়া যায়?
প্রভু কী কখনো শুনবে আমার প্রার্থনা,
তিনি কী আমাকে পার করবেন নিরাপদে —
পড়ে আছি যে-পরিখায়?
আগুনে পোড়া হয়নি এ-রকম কাদামাটির পেয়ালায় টলমল করে — চোঁয়ায় জল,
কম্পমান আত্মা আমার … নেই কোনো পাথেয় সম্বল,
আকুতি যেন মিলিয়ে যায় গাঢ় কুয়াশায়,
হায় — বলো কীভাবে পৌঁছবে লাল্লা গন্তব্যের নিশানায়।


মর্মমুরাকাবামালা
মঈনুস সুলতান রচনারাশি
মাহমুদ আলম সৈকত অনূদিত লাল্লেশ্বরীর কবিতা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you