বছরে একবার-দুইবার নয়, সিলেটে এবি ভিজিটে আসতেন এলআরবি নিয়ে স্টেজে অ্যাপিয়্যার করতে কয়বার সেই হিসাব মনে হয় বের করা সাধ্যের অতীত না-হলেও শক্ত হবে। একটা ক্যাল্কুলেশন করতে পারি এইভাবে যে, ২০১৭ অব্দের শুরু থেকে ২০১৮ অব্দের অক্টোবর অব্দি মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত এই বাইশ মাসের মধ্যে এবি কমিয়ে বললেও ছয়/সাতটা শো করেছেন শুধু সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং অ্যাডজ্যাসেন্ট অ্যারিয়ায়।
বায়না পাওয়া দিয়া গায়েনের বলবৃদ্ধি মাপবার একটা ট্র্যাডিশন আছে এই দেশে। সেহেতু বলা যায় আইয়ুব বাচ্চু ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত বলশালীই ছিলেন। যদিও হয়রান হয়ে গেছিলেন অসুখবিসুখের পরে, এইটা টের পাওয়া যেত উনি স্টেজে এলে। বাজাইতেন যখন অতটা বোঝা যেত না, যদিও নোট মিস্ করতেন, গাইবার জন্য ভোক্যাল কর্ডগুলা ব্যবহৃত হলেই বোঝা যেত দুরন্ত সেই কিশোর কোথাও বুঝি বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়রান আর পেরেশানি নিয়া স্ট্রাগল করছে। এরপরও শো থামান নাই।
সিলেটে শেষ বাইশ মাসে এলআরবি নিয়া বাচ্চু ট্যুর করেছেন ছয় থেকে সাতটা। আরও অধিক হলেও অবাক হব না। আইয়ুব বাচ্চু এত শো করতেন যে সবাই ভাবত, ও আচ্ছা, আইয়ুব বাচ্চু তো নিশ্চয় নেক্সট মান্থেও আসবেন, তো থাক, পরের শোতে যাওয়া যাবে। এবং প্রায়শ দেখা যাইত কোনো-একটা ব্যাংকের অ্যানুয়্যাল জেনারেল মিটিঙের নাইটে এবি এসে শো করে যাওয়ার হপ্তা বাদে জানা যাইত এলআরবি এসেছিল অমুক ব্যাংকের বায়নায়। এইরকম হতো কর্পোরেট, ক্লাব, কলেজ-ইশকুল, নানান জাতের রিইউনিয়ন ইত্যাদির শোগুলোতে এবির ঝটিকা সাংগীতিক সফর।
এই নিবন্ধে একবার ঘুরে দেখব ২০১৮ মার্চে এবি উইথ হিজ টিম এলআরবি সিলেটের একটা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ময়দানে এসেছিলেন শো করতে। সেই শোয়ের আয়োজক ছিল একটা অটোমোবাইলস্ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান। কন্সার্টে এবি ছাড়াও এসেছিলেন ম্যাক উইথ হিজ ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ম্যাক স্টেজে আসেন, টানা আট-নয়টা নাম্বার পার্ফোর্ম করেন। শো-স্টপার আইয়ুব বাচ্চু উইথ এলআরবি স্টেজে উঠতে উঠতে রাইত দশটা প্রায়।
ভালো স্কোর করেছিলেন এবি, সেদিনের কন্সার্টে, ভক্ত-অভক্ত দুই শিবির থেকেই স্বীকার করছিল উপস্থিত সবাই। মিউজিকটার ধক জ্যান্ত ধরা যায় আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবি-র বাদনে, এই কথাটা বলাবলি করছিল লোকে। একটাই সমস্যা দেখা যাচ্ছিল সেদিনের কন্সার্টে, সেই জিনিশের দেখা আগে এই নিবন্ধকার পায় নাই, জিনিশটা সংক্ষেপে এ-ই যে এবি নিজের এবং বাংলার মার্চের ইতিহাসবিশ্রুত সব-কয়টা গানের বাজনার মোড়ে মোড়ে একেকটা চকিত মোচড়ে একগাদা হিন্দি ফিল্মি ম্যাসালা গানের ধুন ঢুকিয়ে দেন। লোকে সেই-কারণেই মজা পাচ্ছিল হয়তো, তবে বিরক্তও হচ্ছিল কেউ কেউ। এবি-র গ্রেইট সব নাম্বারগুলোতে এই চিপ চটক উত্যক্ত করে এমনকি তার দীর্ঘকালিক ভক্ত শ্রোতাদেরেও। অবশ্য সিলেটের এই কন্সার্টটার পরে একসময় টের পাওয়া যায় এবি রিহার্স করছিলেন ওইসময়টায় গানবাংলা চ্যানেলের কোনো প্রোজেক্টে দেশজোড়া বাংলা-হিন্দি ফিউশন নিয়া সাংগীতিক সফরের। মৃত্যুর আগের কন্সার্টটায় ইন্ডিয়ান বাদ্যযন্ত্রী নিয়া বাচ্চু শো করেছিলেন এবং পরবর্তী প্ল্যানগুলা নিয়া আগাচ্ছিলেন। নিশ্চয় একটাকিছু নতুন বেরিয়ে আসত।
তবে এবি গিটার দিয়াই শ্রোতা আটকে রাখেন, এতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। সিলেটট্যুরে এইটা আরেকবার প্রমাণ হয়। হিন্দি ফিল্মি মিউজিকেই নিজের গিটারিস্ট স্কিলগুলা দেখিয়ে দিয়েছেন ওইদিনের মঞ্চে। গিটারে একাই একশ এবি তার সহগিটারিস্টদেরেও দর্শনীয় সুযোগ দেন সোলো ও বৃন্দ বাদনের। লোকে সেইটা অ্যাপ্রিশিয়েইট করে, এঞ্জয় করে। এবং যুগলবন্দীকালে পাব্লিকের মুখরতা তাক-লাগানো।
শুধু গিটার তিনটাই তো নয়, এলআরবি-র ড্রামস্ ময়দানের আস্ত ভূমি-নীলিমা ব্যাপ্ত করে রেখেছিল। মনে হচ্ছিল একেকটা হ্যামারের ঘায়ে মাটি তিরিশহাত ডেবে যাচ্ছিল, পুনরায় পায়ের তলা মাটি ফিরিয়া পাচ্ছিল পরবর্তী হ্যামারিঙের অব্যবহিত প্রভাবে। এবি মিউজিকের দিক থেকে যেভাবেই হোক অডিয়েন্স সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন। যদিও গায়ক এবি বহুদিন ধরেই নিখোঁজ। ওইদিনও ভোক্যাল আইয়ুব বাচ্চু অত্যন্ত অনুল্লেখ্যই ছিলেন বলা যায়। বাদক এবি নিঃশ্বাসের শেষ দিন পর্যন্ত বর্তমানই ছিলেন বটে। স্টেজে শেষ দিন পর্যন্ত কব্জি আর আঙুলমালায় আগুনফুল্কি উড়াইতে পেরেছেন এবি।
সিলেটট্যুরে সেই মার্চরাত্রিতে কয়টা গান আস্ত গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, মনে করতে পারছি না এখন, তবে চার-পাঁচটার বেশি নয় বোধহয়। বাজিয়েছেন বেশ। জনপ্রিয় নাম্বারগুলোর মুখ-মধ্যস্তবক সমবায়ে একটা কোলাজ করেছেন সবশেষে, মিডলি বলে যারে। আর, আগেই বলা হয়েছে, বাজারে চালু অনেক হিন্দি ফিল্মিগানার ধুন অবাধে অনায়াসে মিশিয়ে টেক্লিন্যালি স্কিলড মিউজিক উপহার দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু যা পাব্লিকেরে ক্ল্যাপ্সপ্রসূ করে রেখেছে আগাগোড়া। মার্চ মাস বলিয়াই হয়তো কয়েকটা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানেরও ধুন শোনা গিয়েছে এবি-র গিটারে সেদিন; যেমন, “মাগো ভাবনা কেন / আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে / তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি / তোমার ভয় নেই মা / আমরা প্রতিবাদ করতে জানি” … ইত্যাদি। ‘হকার’, ‘ঘরছাড়া এক সুখী ছেলে’, ‘হাসতে দ্যাখো গাইতে দ্যাখো’, ‘তারাভরা রাতে’, “এক-আকাশ তারা তুই একা গুনিসনে / গুনতে দিস তুই কিছু মোরে / পুরো জোছনা তুই একা পোহাস নে” … এবি-র নিজের এই নাম্বারগুলো মোটামুটি তিনি গেয়েছেন সেই রাতে।
সেই মার্চরাতের পরে এবি সিলেটে আর-কোনো কন্সার্টে এসেছিলেন কি না, খবর নিতে পারি নাই। কিন্তু মাত্র মাস-সাতেকের মাথায় তিনি ইন্তেকাল করলেন। উনার একটা দারুণ কম্পোজিশন আছে ‘শেষ চিঠি’ শিরোনামে, যেইটা ‘আনপ্লাগড এলআরবি’ অ্যালবামে এসআই টুটুল গেয়েছিলেন পয়লা, “শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি হয় / ক্ষমা কোরো ক্ষমা কোরো আমায়”, আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে শেষ কন্সার্টসঙ্গ হচ্ছে এইটা জানতে পারলে নিশ্চয় হ্যালো বলতাম উনাকে একটাবার, অনেক নুন খেয়েছি উনার সুরের সংগীতের, এই কথাটা জানাইতাম নিশ্চয়, কৃতজ্ঞতাটা জানাইতাম, অনেক ভরিয়ে রেখেছেন আমাদেরে এইটা হাতজোড় শ্রদ্ধায় নিশ্চয় একবার বলার চেষ্টা চালাইতাম। হয় নাই। শেষ দেখায়। জানতেও পারি নাই। ভীষণ ফ্রেশ দেখাচ্ছিল বাচ্চুকে। ফ্যাট ঝরিয়ে একদম ছিমছাম অল্পবয়সী লাগছিল। অনেক ফর্শা, শান্ত, কন্টেমপ্লেইটিভ দেখাচ্ছিল। তবু, আফসোস, অতটা কাছে থেকেও বুঝতে পারি নাই, বলা হয় নাই, কুর্নিশ জানানো হয় নাই, “ক্ষমা কোরো ক্ষমা কোরো আমায় …
… …
- জুয়েল, সেদিনের সেই বিকেল - January 3, 2025
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
COMMENTS