যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা : লিউবা ইয়াকিমচুক || ভাষান্তর : জয়দেব কর
শুঁয়োপোকা
ঠাণ্ডায় সংকুচিত হয়ে ওঠে তার হাতের আঙুলগুলো
বিয়ের আংটিটি অনামিকা থেকে খসে
টুং টাং শব্দ তুলে ফুটপাথে গড়িয়ে যায়
গাছের পাতার মতো কাঁপতে থাকে তার হাত
আর শুঁয়োপোকার ন্যায় নিজস্ব পথচিহ্ন ধরে যেন
তার মেয়ের পায়ের কাছে গড়িয়ে যায়
. এবং
. থামে
দুইজন পুরুষ এগিয়ে আসে
হুকুম করে তাকে হাতদুটো প্রসারিত করতে
ঠিক তালি দেওয়ার ভঙ্গিমায়
ওরা তার পাসপোর্টের দিকে তাকায়
একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে দেয়
তার বৃদ্ধাঙ্গুল তর্জনীতে
ঠেসে ধরে চাপ দেয় ওরা
স্নাইপার রাইফেল চালানো
কড়া-পড়া চামড়ার পরিবর্তে পোড়া শনাক্ত করে
ওরা তাকে তার ডাকনাম ধরে ডাকে
হয়ত এটা অন্য কারও নাম —
বুচ
ওরা তাকে বিবস্ত্র করে
ওরা তাকে শুইয়ে দেয়
ওরা তাকে পরীক্ষা করে
সারিবদ্ধ হয়ে
ওদের নয়জন
(তার প্রিয় সংখ্যা)
নীল স্নানপোশাক পরে
(তার প্রিয় রঙ)
তাকে ধর্ষণ করে
সেকন্ডহ্যান্ড নাইকের স্নিকার পায়ে
(তার প্রিয় ব্র্যান্ডের জুতো)
ওদের নয়জন
আলুথালু তার ওপর সওয়ার হয় —
বেশ্যা নয়, সে এক সাধারণ নারী
তার শিশুকন্যাটি ভ্রূণের মতো কুঁচকে যায়
অশ্রুশূন্য দৃষ্টিতে মায়ের বিয়ের আংটি কুড়োয়
তা মুখে নেয় যেমনটি করে
কুকুরের মুখে ঝুলে থাকে হাড়
আর সে দেখে একটি শুঁয়োপোকা
সাবাড় করে দিচ্ছে তাদের সবুজ নগর
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন ওকসানা মাকসিমচুক এবং ম্যাক্স রোসোচিনস্কি।
.
প্রার্থনা
হে আমাদের পিতা,
পূর্ণিমা ও রিক্ত সূর্যের স্বর্গে
যে তুমি করো বাস,
আমার পিতামাতাকে করো রক্ষা
মৃত্যুর হাত থেকে,
যাদের বাড়ি আগুনের কবলে
— তারা তা করবে না পরিত্যাগ
কবরের মতো।
আমার স্বামীকে করো রক্ষা
যুদ্ধের অন্য দিকে
যেন নদীর অন্য পাশে
তার বন্দুক তাক করে আছে সেই বুকে
যে-বুকে একদিন সে করত চুম্বন
বয়ে বেড়ানো এই
বুলেটপ্রুফ পোশাক আমি
খুলে ফেলতে পারি না —
আমার গায়ে তা লেগে আছে
চামড়ার মতো।
আমার গর্ভে তার সন্তান
যাকে বের করে দিতে
পারি না জোর করে
কারণ ওই সন্তানই
আমার দেহের প্রতি তাকে
দেয় অধিকার।
আমার ভেতর ধারণ করি এক মাতৃভূমি
আর পারি না সে-মাতৃভূমি উগড়ে দিতে,
কারণ তা আমার হৃদয়ে প্রবাহিত হয় রক্তের মতো।
হে পিতা,
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য
দিয়ে দাও ক্ষুধার্তদের
এবং তাদের থামাও
একে অন্যকে গ্রাস করা থেকে
বিভ্রান্তদের দাও আমাদের আলো
এবং হতে দাও তাদের নির্মল
ক্ষমা করো আমাদের
ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরগুলোর জন্য।
যদিও আমরা ক্ষমা করি না
আমাদের শত্রুদের।
আমাদের ফেলো না পরীক্ষায়
এই পচে-যাওয়া জগতের সাথে তলিয়ে যেতে;
কেবল মন্দ থেকে মুক্তি দাও
মাতৃভূমির বোঝা থেকে পেতে রেহাই —
যা খুব ভারী এবং কাজে আসে কদাচিৎ!
আমি, আমার স্বামী, আমার মা-বাবা,
আমার সন্তান এবং আমার মাতৃভূমিকে
রক্ষা করো।
*মূল ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ওকসানা ম্যাকসিমচুক এবং ম্যাক্স রোসোচিনস্কি।
ছুরি
আত্মীয়দের সঙ্গে আমরা ভাগ করি
টেবিল আর কবর,
শত্রুদের সঙ্গে কেবল কবর।
এ-রকম এক প্রতিদ্বন্দ্বী আসে
ভাগ করতে চায় কবর আমার সাথে।
হুঙ্কার ছাড়ে :
আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়ো
আমি তোমার চেয়ে অনেক শক্ত
আমি তোমার চেয়ে অনেক কঠিন।
তারপর,
উপর্যুপরি ছুরি
বসিয়ে দেয় আমার পেটের নিচে —
স্প্রিংয়ের মতো চাপে।
তারপরও সে আমাদের চেয়ে ছোট
আমাদের চেয়ে দুর্বল।
কারণ তার কাছে তো মাত্র একটি ছুরি,
আর আমাদের সংখ্যা অনেক।
আমরা বসে আছি একই টেবিলে
প্রত্যেকের বুকে নিজস্ব ‘কিন্তু’,
প্রত্যেকের দেহে নিজস্ব ক্ষত নিয়ে।
সে ফের হুমকি ছাড়ে :
আমি আরও ধারালো,
তোমাদের কেটেই ছাড়ব
আমি আরও মোটা ছুরি,
তোমাদের দ্বিখণ্ডিত করব
চিপ, চপ, চিপ, চপ
শেষজনও মারা গেছে।
ধরে রাখো, তারা বলে ধরে রাখো,
আর আমরা শক্ত করে
ধরে রাখি আমাদের টেবিল।
বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে
আমরা সকলে পান করি গুলি
আমাদের শত্রুকেও ঢেলে দিই এক পেয়ালা।
*মূল ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন স্ভেতলানা ল্যাভচকিনা।
বার্ধক্যে মৃত্যু
দাদু ও দাদি মারা গেলেন,
একই দিনে মারা গেলেন তারা,
একই সময়ে,
একই মুহূর্তে,
লোকে বলল তারা বার্ধক্যে মারা গেছেন।
তাদের মুরগিটিও মারা গেল —
ছাগল এবং কুকুরও,
বিড়ালটি ছিল বাইরে
এবং লোকে বলল তারা
বার্ধক্যেই মারা গেছে।
তাদের কুটির ভেঙে পড়ল,
ধ্বংস হলো গোয়ালঘর,
গুদাম পড়ল মাটিচাপা,
লোকে বলল সবকিছুই
বার্ধক্যের কারণে পড়ছে ধসে।
তাদের সন্তানরা দাদু-দাদিকে
সমাধিস্থ করতে এল
অলহা তখন গর্ভবতী
সেরহি মাতাল
সোনিয়া ছিল মাত্র তিন বছরের
তাদের সবাইও গেল মারা
হলুদ পাতা ঝরালো ঠাণ্ডা বাতাস
ঢেকে দিলো তাদের —
দাদু, দাদি, অলহা, সেরহি ও সোনিয়াকে,
যারা সবাই মারা গেছে বার্ধক্যে।
*মূল ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আনাতোলি কুদ্রিয়াভিস্কি।
.
পচন
ইস্টার্ন ফ্রন্টে কিছুই পরিবর্তন হয় না
আমার আর তা সহ্য হয় না
মৃত্যুর মুহূর্তে ধাতু গরম হয়
আর মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
লুহানস্ক নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলো না
এটি বহুদিন আগে হানস্কে পরিণত হয়েছে
লু মাটির সাথে মিশে গেছে
রক্তিম ফুটপাতের ওপর।
আমার বন্ধুরা বন্দি
আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি না,
যোগাযোগ করতে পারি না
বেসমেন্টের আবর্জনার নিচ থেকে
তাদের টেনে আনতে।
এখনও তুমি এখানে বসে কবিতা লিখছ,
অত্যন্ত পরিশীলিত কবিতা,
উচ্চমানের সোনালি কবিতা —
নকশি কাঁথার মতো সুন্দর।
যুদ্ধ সম্পর্কিত কোনও কবিতা নেই
আছে কেবলই পচন;
শুধু অক্ষরগুলো রয়ে যায়
আর তারা সকলে একটাই শব্দ তৈরি করে — ধধধ।
পেরভোমাইস্ক পেরভো আর মাইস্কে বিভক্ত হয়ে গেছে
কণায় কণায় প্রাথমিক অস্থিরতায়
যুদ্ধ আবার শেষ হয়ে গেছে
তবুও শান্তি আসেনি।
কোথায় আমার ডেব, আল্টস, ইভো?
সেখানে কোনও কবি জন্মাবে না আর
কোনও মানুষ থাকবে না।
আমি দিগন্তে তাকাই
এটি একটি ত্রিভূজে সংকুচিত হয়ে গেছে
সূর্যমুখী ফুলগুলো মাঠে মাথা নামিয়ে দিয়েছে
কালো আর শুকিয়ে গেছে, যেমন আমি।
আমি এতটা পুরানো হয়ে গেছি
এখন আর লিউবা নই
শুধু -বা।
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন ওকসানা মাকসিমচুক এবং ম্যাক্স রোসোচিনস্কি।
লিউবা ইয়াকিমচুক ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || গদ্যভাষ্য : জয়দেব কর
ইউক্রেনীয় কবি, নাট্যকার এবং চিত্রনাট্যকার লিউবা ইয়াকিমচুক (Lyuba Yakimchuk) ১৯৮৫ সালে ইউক্রেনের লুহানস্ক অঞ্চলের পেরভোমাইস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার সাহিত্যকর্ম যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের বর্তমান সংকট, বিশেষ করে ডনবাস অঞ্চলের সংঘাত ও অভিজ্ঞতার গভীর প্রতিফলন।
ইয়াকিমচুক লুহানস্ক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কিয়েভ-মোহাইলা অ্যাকাডেমি থেকে শিক্ষালাভ করেন। ২০১৪ সালে পেরভোমাইস্ক শহরটি রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর দখলে চলে যায়। তার পরিবার এবং অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। এই অভিজ্ঞতা তাকে তার কবিতার বই ‘Apricots of Donbas’ (২০১৫) রচনায় প্রেরণা দেয়। বইটি ডনবাস অঞ্চলের সংঘাত এবং যন্ত্রণার প্রতিফলন হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বইটির ইংরেজি অনুবাদ ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়।
ইয়াকিমচুকের নাটক The Wall কিয়েভের ইভান ফ্রাঙ্কো ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক ড্রামা থিয়েটার-এ প্রযোজিত হয়, যা সমাজে যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করে। তিনি Slovo House: Unfinished Novel (২০২১) নামক একটি চিত্রনাট্যও লিখেছেন, যা নিপীড়িত ইউক্রেনীয় শিল্পীদের জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
২০২২ সালে, ইউক্রেনের ওপর রুশ আক্রমণের পর, তিনি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস-এ তার কবিতা ‘Prayer’ পরিবেশন করেন, যা ইউক্রেনীয় সংকট এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি কবিতাটি ইংরেজিতে পড়েন, যা জন লেজেন্ডের গান ‘Free’–র সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। এই পারফরম্যান্স ইউক্রেনীয় শিল্পীদের প্রতিক্রিয়া এবং সমর্থনের একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করে।
লিউবা ইয়াকিমচুক বর্তমানে উত্তর কিয়েভে তার স্বামী ইউরিয় বারাবাশ এবং ১১ বছরের ছেলে সহ বসবাস করছেন। ২০২২ সালের রুশ আক্রমণের পর তিনি ইউরোপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য প্যারিস, ওয়ারসো এবং সেন্ট অ্যান্ড্রুসে যান।
লিউবা ইয়াকিমচুকের সাহিত্যকর্ম শুধু ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে তুলে ধরে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও মানবাধিকার, যুদ্ধ, এবং শান্তির প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে। তার কবিতা এবং নাটক ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে এবং তাকে শক্তিশালী এক সাংস্কৃতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই ভাষান্তরগুচ্ছ প্রকাশের সময়, লিউবা ইয়াকিমচুকের পাঁচটি কবিতার একটি গুচ্ছ, এই কথাটা উল্লেখ করতে চাই যে, এ এক প্রকল্পিত বাংলা তর্জমাপ্রবাহ যেখানে একেক কবির পাঁচের অধিক কবিতা ভাষান্তর করা হয়েছে ‘যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা’ শীর্ষকের আওতায়, যেখানে এর আগে ও পরে আরও কবির কবিতা গৃহীত হয়েছে একটি বিশেষ সুচয়িত ও সমুচিত অবয়বের গ্রন্থ প্রকল্পনা মাথায় রেখে, এবং গ্রন্থরূপায়িত হবার আগ পর্যন্ত অনুবাদকাজগুলো খসড়া ও সম্ভাব্য গ্রন্থভুক্তির প্রক্রিয়াধীন হিসেবে গণ্য হবে।
একটি কথা আরও, উল্লেখ কর্তব্য, প্রত্যেক কবিতার মূল ইউক্রেনীয় ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদকের তথ্য স্বতন্ত্র কবিতার উপান্তে পাদটীকায়িত হয়েছে একটি পৃথক গদ্যভাষ্যের বাইরে, যেন অনুবাদপাঠকের অংশগ্রহণ সুগম ও সন্ধিৎসু হয়।
লিউবা ইয়াকিমচুক ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা
ভাষান্তর ও গদ্যভাষ্য : জয়দেব কর
গানপার প্রকাশ : মার্চ ২০২৫
জয়দেব কর রচনারাশি
যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা ১
যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা ধারাবাহিকী
- ডাক ও অন্যান্য কবিতা || নাজমুল হক নাজু - June 1, 2025
- তুমি বাংলাদেশ ও অন্যান্য কবিতা || ফজলুররহমান বাবুল - May 27, 2025
- মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার - May 17, 2025
COMMENTS