VJS 50, অর্থাৎ Vijay Sethupathi-র পঞ্চাশতম film, প্রধান অভিনেতা হিসেবে। ফিল্মের টাইটেল চরিত্রটিও তার। অথচ সিনেমার সবচেয়ে বড় স্টার তাকে ছাপিয়ে অন্যকিছু, ভাবা যায়!?! সত্যি বলছি। এই ফিল্মের সবচেয়ে বড় স্টার এর চিত্রনাট্য। এত অদ্ভুত ননলিনিয়ার সহজ সরল স্টোরিটেলিং, জাস্ট ওয়াও!
একটু বিস্তারে আলাপ দরকার মনে করি।
প্লট : আমি স্পয়লার না দিয়েই বলার চেষ্টা করব। বিজয় সেত্থুপতির টাইটেল চরিত্রের নাম মহারাজা, পেশায় ক্ষৌরকার, নাপিত। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে সংসার। গল্পের শুরুতেই তার চোখের সামনে একটা দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী মারা যায়। দুর্ঘটনা থেকেই গল্প চলে যায় ১৩ বছর পরে, আমরা জানতে পারি মহারাজা তার কন্যা আর লাক্সমি এই তিনজনের পরিবার। লাক্সমি কোনো ব্যক্তি নয়, বরং লোহার তৈরি একটা ময়লা ফেলার ড্রামসদৃশ পাত্র, যেটার কারণে মহারাজার কন্যা সেই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল ১৩ বছর আগে। শুধু পরিবারের সদস্য হিসেবেই নয়, লাক্সমিকে মহারাজা এবং তার কন্যা দেবী হিসেবেই মানে, পূজার স্থানের পাশেই তাকে রাখা হয়। মহারাজার কন্যা জ্যোতি স্পোর্টসক্যাম্পে যায় এক সপ্তাহের জন্য। এবং এর পরেই আমরা দেখি মহারাজা পুলিশথানায় হাজির হয়েছে তার ঘর থেকে চুরি-যাওয়া লাক্সমিকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। তার মেয়ে এক সপ্তাহ পরে ফিরে আসার আগেই তাকে যেভাবেই হোক লাক্সমিকে খুঁজে বের করতেই হবে, এমনকি থানায় তাকে পাগল আখ্যা দিয়ে বের করে দিলে সে তার সঞ্চয় থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিতে চায় লাক্সমির সন্ধান দেওয়া পুলিশকে।
একটা ময়লার ডিব্বার খোঁজ করার মতো বিষয় নিয়ে যে-গল্প শুরু হয়, সে-গল্প শেষ হয় মৃত্যু দিয়ে। পোস্টার দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারার কথা সবার, ভীষণ ভায়োলেন্সপূর্ণ ফিল্ম। আদতে গল্পের প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতটুকু ভায়োলেন্স সিনেমায় নেই, যা আছে তা পরিমিত মাত্রায়।
চিত্রনাট্য : ‘If you show a gun, make sure it is used to fire at some point in the story’। চিত্রনাট্যকারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা, Chekhov’s Gun বলা হয় এটাকে। মহারাজার চিত্রনাট্য এই চেকভ’স গান ব্যবহারের এক দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। প্লটের বর্ণনায় যে লাক্সমির কথা বলা হয়েছে, পুরো সিনেমা জুড়ে যেমন তার ব্যবহার গল্পের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, ঠিক তেমনই নানা ছোট ছোট বস্তু দেখানো হয়েছে যার কিছুই অহেতুক দেখানো হয়নি পুরো চিত্রনাট্যের প্রায় কোথাওই। এমনকি একটা জন্মদিন অনুষ্ঠানের জন্য যে বেলুন দিয়ে ডেকোরেশন করা হচ্ছে, সেই বেলুন পর্যন্ত চিত্রনাট্যকার অহেতুক দেখাননি। সিনেমার পোস্টারে মহারাজা টাইটেল ফন্টের মাঝে একটা ক্ষুর দেখা যাচ্ছে, মহারাজা পেশায় নাপিত সেটা যেমন বোঝাতে, ঠিক একইভাবে এই ক্ষুর পর্যন্ত একটা আস্ত অ্যাকশন সিকোয়েন্সের প্রাণ হিসেবেই ধরা দেয়। এমন এত ছোট ছোট নানা Chekhov’s gun-এর দুর্দান্ত ব্যবহার চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা নিথিলান স্বোয়ামিনাথান করেছেন যা বিশাল বিশাল স্টুডিওর বিশাল বিশাল বাজেটের মুভিতেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
গ্রিক নাট্যের মতো destiny এই চিত্রনাট্যের শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ নেয়, প্লটেই সেটা বলা আছে। একটা পর্যায়ে গ্রিক ট্র্যাজিক প্যাটার্নে শুরু হওয়া গল্প হঠাৎ করেই মনে হতে থাকে কমেডির দিকে যাচ্ছে। এমন হয়েছে কিছু দৃশ্যে অভি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে রীতিমতো। কিন্তু চিত্রনাট্যকার নির্মাতা খুব অদ্ভুতভাবে প্রোটাগনিস্টের দৃঢ়তাসম্পন্ন চেহারা যেটা আগেই দেখিয়েছেন গল্পের শুরুতে, এই কমেডির আড়ালেও সেটার ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন করেননি। একদিকে সারফেস লেভেলে কমেডিক আবহ, অন্যদিকে এক অটল মানুষের নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে একই ঘটনার বারবার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া (মোটিফের দুর্দান্ত ব্যবহার এবং এটাও চেকভ’স গান)। অদ্ভুত! সাউথ ইন্ডিয়ান বাণিজ্যিক সিনেমার দিক থেকে চিন্তা করলে, শুরুর এই কমেডিক টোন যে-কোনো অডিয়েন্সকে আটকে ফেলবে আর অন্যদিকে একেবারেই বিপরীত মেরুর প্রোটাগনিস্ট আটকে রাখবে অজানা এক দুশ্চিন্তায়, আসলেই কি বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে? ননলিনিয়ার ওয়েতে বলা গল্প এই দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়েছে বারবার। এমন চিত্রনাট্য এর আগেও হয়তো অনেক লেখা হয়েছে, গল্পটাকে সরলরেখায় বলেছেন অনেকেই (শেষদৃশ্য নিয়ে পরে আলাপ করছি), কিন্তু সরল গল্পকে ভেঙে এই-যে টুকরো টুকরো করে বুনে দুর্দান্ত একটা থ্রিলার, রিভেঞ্জ ড্রামার পথে নিয়ে যাওয়া, এমনটা ভয়াবহ মুনশিয়ানার বিষয়। সিনেমার দ্বিতীয় অঙ্কের শেষ হবার আগেই দর্শক এক জটিল ধাঁধার সরল বয়ানে আটকা পড়ে যায়, অজানা আশঙ্কায়।
শুরুটা যেমন গ্রিক ট্র্যাজেডির আদলে, শেষটাও তা-ই। অন্যায়, পাপ কখনোই মানুষকে ছেড়ে যায় না, অন্যায়ের আকার যতটা বড় হতে থাকে, তার শাস্তি ততই ভয়ানক হয়। চিত্রনাট্যে থিমেটিক জায়গা এত দারুণভাবে ধাক্কা দেয়, পাপীর জন্য কান্না এলেও পাপের প্রতি ঘৃণা বেড়ে যায় বহুগুণে। একজন চিত্রনাট্যকারের এর থেকে বড় সাফল্য আর কি হতে পারে?
অভিনয় : বিজয় সেত্থুপতি একজন অদ্ভুত নীরব অভিনেতা। অনেক কথা না-বলেও বহু কথা বলে তার পুরো সত্তা। মহারাজা সিনেমার যে নামকরণ, সেটাকেও চুড়ান্ত রূপ দিয়েছেন তিনি। রাজার থেকেও বড় রাজা, যার হৃদয় ধারণ করে জগতের সকল করুণা কিন্তু ন্যায়ের জন্য যিনি পর্বতের মতোই অটল। সেত্থুপতি এর কিছুই বাদ রাখেননি। পুরো সিনেমা জুড়ে কোনো গান নেই, কোনো ফিমেল লিড নেই, কিন্তু সেত্থুপতির একার উপস্থিতি স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে দেয়নি। অনুরাগ কাশ্যপ সিনেমার অ্যান্টাগনিস্ট, পাল্লা দিয়ে অভিনয়ের চেষ্টা করেছেন তিনিও। উপস্থিতি কম হলেও প্রতিটি জায়গায় চেষ্টার ত্রুটি ছিল না তার, এবং শেষদৃশ্যে তার অভিনয় কী যে অসাধারণ শিহরণ দেয়, উফফ! অন্যান্য চরিত্রেরা এসেছেন গল্পের প্রয়োজনেই। সেত্থুপতির মেয়ের চরিত্র করা মেয়েটা শেষদৃশ্যে যে সংলাপ বলে, যে দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, বলিউডের বহু নামী অভিনেত্রী সেখানে মার খেয়ে যাবে।
ননলিনিয়ার গল্পের কারণে হয়তো মনে হতে পারে মাথায় কিছু আসছে না, কিন্তু এত দারুণভাবে গাঁথুনি এই সিনেমার, নির্মাতাকেই বরং ‘মহারাজা’ বলে ডাকা উচিৎ এখন থেকে।
সময় করে এই সিনেমাটা দেখুন অবশ্যই।
- তুমি বাংলাদেশ ও অন্যান্য কবিতা || ফজলুররহমান বাবুল - May 27, 2025
- মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার - May 17, 2025
- মেঠোসুর আনন্দযাত্রা : গানময় এক সংবেদনশীল বাংলাদেশ || বিমান তালুকদার - May 9, 2025
COMMENTS