অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ওয়েব সিরিজ মন্দার দেখলাম। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ-র Local Adaptation নতুন ঘটনা না হলেও মন্দার-এ যেভাবে হাজির করা হয়েছে তার প্রাথমিক ধাক্কাটা বেশ মারাত্মক ছিল। সোজা কথায় চমকে গিয়েছি বলতে পারেন। নতুন প্রজন্মের অভিনেতার মধ্যে মঞ্চের শক্ত পাটাতন থেকে উঠে আসা অনির্বাণের অভিনয়ক্ষমতার সঙ্গে পরিচয় আগে থেকেই ছিল। ড্রাকুলা স্যার সহ একাধিক ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখেছি। অভিনয়নৈপুণ্যে তাঁকে মাঝেমধ্যে ঋত্বিক চক্রবর্তীর মতো লা-জবাব মনে হয়েছে। মন্দার দিয়ে পরিচালনায় পা রাখা অভিনেতা প্রথম কিস্তিতে বাজিমাত করেছেন বলতে হয়।
মন্দার দেখার পর বিশাল ভরদ্বাজের মকবুলকে নিছক পানসে মনে হচ্ছিল। ম্যাকবেথকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনির্বাণের যুক্তিটাও বেশ মনে ধরেছে। তাঁর মতে, শেক্সপিয়ারের যুগান্তকারী নাটিকাগুলোর মধ্যে ম্যাকবেথ পৃথক গন্তব্যে নিজের নিষ্ক্রমণ ঘটিয়েছে। অন্য নাটিকার তুলনায় কাহিনি সম্রাট এখানে। কবি তাঁর স্বভাবসুলভ দার্শনিক বুলি কপচানো থেকে একপ্রকার বিরত থেকেছেন এ-নাটকে। ক্ষমতার নেশা থেকে উদিত লোভ ও জিঘাংসা যদি মানবচরিত্রে সহজাত বলে মানি তাহলে এর বাড়বাড়ন্ত তাকে কোন নরক অবধি টেনে নিয়ে যেতে পারে আগাগোড়া সেই চালচিত্র দুর্দান্তভাবে ম্যাকবেথ-র কাঠামোয় কবি ধারণ করেছিলেন। উত্তম, অধম ইত্যাদির পরোয়া না করে কাহিনিকে নিজের একবগগা চালে আগানোর স্বাধীনতা দিয়েছেন পুরামাত্রায়, কোথাও আলগাভাবে নিজে ঢুকে পড়েননি।
একবগগা এই চালটাকে একালের পটপ্রবাহে ক্যামেরায় ধারণ করেছেন অনির্বাণ। প্লটিং, অ্যাক্টিং, সিনেমাটোগ্রাফির সবটাই শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টিকে ভেঙে যে-গল্প তিনি বলতে চাইছিলেন তার সঙ্গে সুসংগতি বজায় রেখে অগ্রসর হয়েছে। মন্দার (…অনেকটা শাটিকাপ-র মতো…) প্রচলিত ও দর্শকপসন্দ ওয়েব সিরিজের অংক কষে নিজেকে হইচই-এ অবমুক্ত করেনি। হিন্দি, ইংরেজি বা স্প্যানিশ Psycho Thriller ধাঁচের জমাট কাহিনি আর শেষ হইয়াও হইল না শেষ টাইপের চমক দিয়ে বাজিমাতের পথে হাঁটার চেষ্টা এখানে থোড়াই চোখে পড়েছে! মন্দার পুরোদস্তুর Dark হলেও Psycho Thriller টাইপের ডার্কবাজির ধার না ধেরেও অনির্বাণ কাণ্ডটা ঘটাতে সফলকাম হয়েছেন। কাহিনি বা নটেনটির পুরোটাই সেখানে Vulgar ও Morbid, তবু তাদেরকে অবান্তর অতিকল্পনায় বোনা বলে মনে হয় না। ঘেন্না ও বিবমিষা যেমন জাগে না আবার পছন্দ করতেও মন ওঠে না। এই দ্বিধাজড়তা মন্দারকে মাটিলগ্ন রাখে। তফাত এটুকু, — এর কাহিনি ম্যাকবেথ থেকে ধার করার নিয়তি মেনে বিরাম নেবার কোনো পরিসর পায় না। এটা একদিক থেকে ভালো হয়েছে, নতুবা মিথ্যে এক আশাবাদের নিচে মন্দার যা বলতে চাইছিল সেটা চাপা পড়ে যেত; সুতরাং পুরোদস্তুর ডার্ক কিন্তু ফ্যান্টাসি নয়…;— এই বচনটা মন্দার দেখতে বসে দর্শকের স্মরণ রাখাটা হয়তো ভালো।
ম্যাকবেথ-র বিখ্যাত ডাইনিদের গৎবাঁধা উপস্থাপনায় অনির্বাণ স্বাধীনতা নিয়েছেন। মন্দার-এ তারা নিষ্ক্রিয় ভবিতব্যবক্তার ভূমিকায় স্থির থাকে না। ঘোষিত ভবিতব্যের শিকার নিজে হয় ও তার ফাড়া কাটাতে প্রতিশোধ নিতে পিছপা হয় না। ম্যাকবেথ-র ছক মেনে জগদ্দল এক বুড়ি সেখানে যথারীতি ডাইনির ভূমিকায় হাজির থাকে। সাগরবেষ্টিত মৎস্যপল্লী গেইলপুরের (…মেদিনীপুরের কল্পিত উপনাম বোধ করি…) অঘোষিত সম্রাট ডাবলুভাইকে হটিয়ে তার সকল আকাম সারার ডানহাত জোয়ানমদ্দ নপুংসক মন্দার ও তার বাজা বউ লাইলির রাজা-রানী হওয়ার নিদান হাঁকে বুড়ি। ডাইনির ছায়াসঙ্গী বদখত দেখতে এক পুত্রসন্তান (…যার নাম আবার পেদো...) হচ্ছে দ্বিতীয় ডাইনি। তৃতীয়জন হচ্ছেন মিশকালো রহস্যময় বিড়াল! এভাবে আদি ম্যাকবেথ-র কাহিনিছকে বিচরণের ক্ষণে তাকে সুযোগমতো গড়েভেঙে মন্দারকে ভাষা দিয়েছেন অনির্বাণ।
কাহিনির স্বকীয় গতির সঙ্গে তাল দিয়ে মূল এবং পার্শ্বচরিত্ররা পর্দায় সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিজের দায় মিটিয়েছে। ডাবলুভাই, ধ্বজভঙ্গ মন্দার ও তার বাঁজা বউ লাইলি … ত্রিভূজ এই ছক কাহিনির নিয়ন্তা হলেও পার্শ্বচরিত্ররা সেখানে ত্রিভূজটিকে সুষম ও গতিশীল হতে দারুণ সহায়তা করেছে। ডাবলুভাইয়ের হরিহর আত্মা স্থানীয় নেতা মদন, অসৎ ও নারীলোভী পুলিশ-অফিসার মোকাদ্দর, ডাবলুভাইয়ের অসুখী স্ত্রী ও বখাটে পুত্র মঙ্কা, মন্দারের মতোই ডাবলুভাইয়ের হয়ে আকাম সারার কর্মে নিয়োজিত বঙ্কা ও তার সরল-সুবোধ পুত্রধন ফন্তুস … বিচিত্র এইসব পার্শ্বচরিত্রকে পর্দায় সমান গুরুত্ব সহকারে অনির্বাণ জায়গা দিতে পেরেছেন। ওয়েব সিরিজ হওয়ার কারণে হয়তো-বা মূল ও পার্শ্বচরিত্রকে এভাবে Exploit করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছে। মন্দার যদি দুই, আড়াই ঘণ্টার চলচ্চিত্র হতো সেক্ষেত্রে ভারসাম্যটা এভাবে বজায় থাকত বলে মনে হয় না। অনেক কাটছাটের মধ্য দিয়ে হয়তো অন্য মাত্রায় মোড় নিত সেটা।
বলা প্রয়োজন, মন্দার-র কাহিনি সাগরবেষ্টিত গেইলপুর হলেও সাগর এখানে কোনো নির্ণায়ক চরিত্র নয়। সাগরে মৎস্য শিকার, বেচাকেনা ও মৎস্যশ্রমিকদের ইউনিয়নবাজি ইত্যাদি অনুষঙ্গকে ব্যাপক করার সুযোগ অনির্বাণের ছিল তবে সেক্ষেত্রে কাহিনি ঝুলে যেতেও পারত। যদিও মৎস্য-ব্যবসার কেন্দ্রস্থল রূপে সাগরতট, নৌকা, গলুই ও এইসব অনুষঙ্গ ঘিরে মূল এবং পার্শ্বচরিত্রের Interaction-র চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে। মন্দার-র ভাষা, বয়ান ও সংলাপ বলাবাহুল্য অত্যধিক কর্কশ যেমন নয় আবার পেলবও নয়। হাওয়া সিনেমায় মাঝিদের ভাষা, সংলাপ ও খিস্তি ইত্যাদি ব্যাপারে আতিশয্যের অভিযোগ কিছু দর্শক তুলেছেন শুনতে পাই, মন্দার বোধ করি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। মেদিনীপুরের ভাষাকে অনির্বাণ দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সংলাপ (…মঞ্চে লম্বা সময় কাজ করার অভিজ্ঞতার ফসল হতে পারে…) নির্মেদ ও টানটান হওয়ার কারণে একে অতিশয়োক্তি ভাবার সুযোগ দর্শকের থাকে না। নতুন অভিনেতা নিয়ে কাজ করার পরিবর্তে থিয়েটারে কাজ করেছে বা অভিনয়টা জানে এ-রকম চরিত্র অনির্বাণ খুঁজে নিয়েছিলেন, যেহেতু তাঁর মনে হয়েছিল নতুন কাউকে অভিনয়বিদ্যা শিখিয়ে-পড়িয়ে ক্যামেরার সামনে নামানো তাঁর জন্য ঝক্কির। হিসাবি কদম ফেলাটা এইবেলা কাজে দিয়েছে মানতে হয়। অতি-অভিনয় নেই আবার দর্শক বিরক্ত হতে পারেন সে-রকম পেশাদারী নিরস অভিনয়ও কেউ করতে যায়নি। সোহিনী সরকার লেডি ম্যাকবেথের দায় পুরোটা মিটিয়েছেন আর ম্যাকবেথ মহাশয়ের চরিত্রে দেবাশিষ মণ্ডল ছিলেন যথার্থ নির্বাচন। বাকিরাও তথৈবচ।
তো সব মিলিয়ে মন্দার বাংলা ওয়েব সিরিজকে জমিয়ে তোলার ছকে ব্যতিক্রম ঘটনাই বটে! মন্দার ও লাইলির সন্তানের মা-বাপ হওয়ার মিথ্যে স্বপ্ন ছাড়া যার পুরোটাই অমাবস্যায় ঢাকা। ডাবুল থেকে মোকাদ্দার সকলের ভোগের শিকার লাইলি নাওয়ের গলুইয়ে ফাঁস লাগিয়ে লেডি ম্যাকবেথ হওয়ার নিয়তি পুরা করে। লাইলিকে সন্তান দিতে ব্যর্থ মন্দার নিজের অন্তিম ভবিতব্য জানতে ডাইনিপুত্র পেদোকে গাছের ফাঁসে লটকায় ও ডাইনির চোখে রাক্ষসে পরিণত হয়। ‘কাল বালের কাল, তোর কালের কুনু মূল্য নাই বুড়ি।’;— ডাইনির উদ্দেশে মন্দারের নিদান যেন-বা তার নিয়তিকে অমোঘ করে যায়। শেষ দৃশ্যে মানবশরীরী রাক্ষস মন্দারকে খতম করতে বঙ্কাপুত্র ফন্তুস ও ডাবলুভাইয়ের পুত্রধন যবে পেরে উঠছে না তখন ডাইনির ছোঁড়া বল্লম তার গলা চিরে গেঁথে যায়, ঠিক যেমন লোকে বল্লম দিয়ে মৎস্য গাঁথে…, সে-রকম। অন্তিম দৃশ্যটি মন্দার ওরফে ম্যাকবেথ-র পতন দিয়ে সমাপ্ত হলেও কাহিনি আদতে গোঁড়ায় ফিরে যায়, যেখানে ডাবলুভাইয়ের হয়ে তার গুণধর পুত্রধন ও শৃগালের মতো ধূর্ত মদনরা ফের গেইলপুরে জুত হয়ে বসে। মাঝখানে যা-কিছু ঘটে গেল তা যেন-বা দুঃস্বপ্ন! ক্ষমতার সার্বভৌম ক্ষমতায় যারা খানিক তরঙ্গ তুলে ফের ওই ক্ষমতাকে অন্তিম বলে কুর্নিশ ঠুকতে বাধ্য হয়। মনে পড়ে, টেকো মাথার ফরাসি সায়েব ফুকো কোনো-একদিন বলেছিলেন ক্ষমতা সার্বত্রিক। মন্দার-এ অভিনেতা, গায়ক, লেখক ও নির্দেশক অনির্বাণ ফুকোবচনকে কেটেছেটে এই বার্তাটি ইয়াদ রাখতে বলছেন, ‘Power corrupts.’ … ক্ষমতার রাজনীতিটা যারা বুঝতে চাইছেন তাদের জন্য মন্দার সময়ের অপচয় মনে হবে না। অন্যদিকে নিছক বিনোদন ও রোমাঞ্চ নিতে যারা অভ্যস্ত তারা একে বাদ দিলে ক্ষতির কিছু নেই।
- পড়ুন গানপারের ম্যুভিরিভিয়্যু বিভাগের লেখাগুলা
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS