কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব

কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব

কায়মাসুদ
পৃথিবী—গ্রহ। সূর্য—নক্ষত্র। ছায়াপথ—গ্যালাক্সি।
অঙ্কহীন গ্যালাক্সিগতির বিন্যাস।
ঘোড়ার ইলাস্টিক জিনগদির মতো এই বিশ্ব—
এই এত যে গ্রহ উপগ্রহ নীহারিকা সুপারনোভা—
মাসুদ খান সত্তা নিয়ে অন্য দ্বিতীয় কোনো কবিপ্রাণী নেই।
থাকছেন না। যদিও-বা কোথাও জায়মান হতে যায়,
অমনি শুরু হয় সংকটের। অবশেষে টিকতে পারে না।
কিন্তু আড়ালের ঘটনা এই যে,
ঋণাত্মক বিশ্বে প্রতিমাসুদ থাকেন
ফ্লেকজিবল পাইপের মতো গলা।
আমার বিপরীতে কবিতা লিখে যাচ্ছে।
স্রোত   / পাখিতীর্থদিনে

মাসুদ খানের অন্যান্য অসাধারণ কবিতাগুলো আমি অনেক পরে আবিষ্কার করতে শুরু করি। আমার পাঠস্মৃতিতে তিনি প্রবেশ করেছেন তার ‘আতাফল’ নিয়ে। অর্থাৎ দ্বিতীয় গ্রন্থ দিয়েই তাকে চিনতে শুরু করি। প্রথম গ্রন্থ তখনও আমার হাতে পৌঁছায়নি।

মনমরালের পালক গজাতে একটু সময় লেগেছে। পাথর যেভাবে সমুদ্রঢেউয়ে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়, সেইভাবে মাসুদ খানের প্রতি আমার আতাফলজ্ঞান ভাঙতে শুরু করে। নব নব উন্মোচন নিয়ে তার নানা কবিতা আমার স্মৃতি আর বিস্মৃতির ভেতরতীর্থে তাঁবু ফেলতে থাকে। নিজেকে এই আত্মভাঙনে পৌঁছে দিতে আমাকে সমুদ্রজলে নেমে অপেক্ষা করতে হয়েছে নিদারুণ নির্লিপ্ততা নিয়ে; তারপর এক ক্ষরণকাল, মুগ্ধতার অবশেষ। আমার কবিতার তরল জ্ঞানে মিশে যেতে থাকে মাসুদ খানের আরও আরও কবিতা। পুনঃপাঠে মূলত আবিষ্কৃত হয় প্রতিমাসুদ। ‘অমনি শুরু হয় সংকটের। অবশেষে টিকতে পারে না।’

০২.
বস্তুপৃথিবীকে আমরা কীভাবে আমাদের স্মৃতিতে সংরক্ষণ করি?  আমাদের যতদূর চোখ যায়, আমার ভেতরের না-ভুবন, বাইরের জগৎ, ব্যাপ্ত জমিনের বিস্তার এক নৈঃশব্দের অন্ধকার কোণে না-ঘুমিয়ে শুয়ে থাকে। আর স্মৃতি হলো ঘুমের ভান, যে-কোনো মুহূর্তে সে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে, ভেতরের জগতকে সে আছড়ে বাইরে নিয়ে আসতে পারে যে-কোনো সময়। অদৃশ্য ইথারে যে-কোনো সময় সৃষ্ট হতে পারে এক বিশাল ভূগোল; মন এভাবেই তার ভেতরের অপরিচিত কোডকে রূপান্তরিত করে ভূগোলের ভাষায়। আর এই নবসৃষ্ট ভূগোল, ঘটনাবিশ্ব পুনরায় দেহের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে। স্মৃতির পরে স্মৃতি জমে। বাইরের পৃথিবী আর ভেতরের অদেখা এক পৃথিবী নিয়ে আমরা চলতে থাকি, ফিরতে থাকি এদিক-ওদিক এথায়-সেথায়। ফলে আমাদের ‘অনুভব’ হলো বস্তুপৃথিবী আর জৈব অন্ধকারের সংঘর্ষজাত উপলব্ধি। অনুভব থেকে যখন সমস্তের অপসারণ শুরু হয়, রূপ-রস-গন্ধ-অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে থাকে নিশ্চেতনার ভেতর, তখনই জন্ম হয় বোধের। বোধের ভেতর বস্তুপৃথিবীর অন্তর্গমন একমুখী। বোধির সীমানায় আমাদের হাসিকান্নাদুঃখের গল্প নিরর্থক। দুঃখ আর সুখ, শেষ পর্যন্ত জীবনও সেখানে মাত্র ডেকোরেটিভ, আমাদের ঘরে সাজানো মুখোশের মতো। ফলে বোধের দিকে এই জীবন নামক হতাশা হেঁটে যেতে পারে না। সে এক নিশ্চল নিশ্চেতনা, আমরা সেখানে পাথরের মূর্তি। তবে বোধের থেকে বস্তুপৃথিবীর যে বহির্গমন, তা শতমুখী বিক্ষেপী। পাথরের মূর্তি এর ভেতর থেকে গুড়ো গুড়ো হয়ে বের হয়ে উড়ে যায় বাতাসে বাতাসে। এই গুড়োপাথরের ধূলোয় রচিত হয় এক মূর্ত অবয়ব। কিছুটা তাকে বোঝা যায়, কিছুটা তাকে বোঝা না-যায়।

ফলে তখন বোধকে জ্ঞান অনুভব করে এই বিধ্বংসী খেলার মাঠে। সদা রূপান্তর আর অপসৃয়মানতার খেলা চলে মনের গভীরে, মনের বাইরে। বস্তু স্থানকাল দ্বারা নির্ণীত হলেও বোধ-উদ্ভুত দৃশ্য আর বিরোধদৃশ্য নিজের ভেতর নিজেই ঘনীভূত হতে থাকে। সোজা কথা, বোধ সময়যুক্ত, তবে স্থানহীন। আর স্থানহীন এই পৃথিবীর সংকেতময়তাই এক অর্থে কবিতা।

০৩.
মাসুদ খানের কবিতা একের পর এক দৃশ্যপৃথিবীর  বস্তু অধিগ্রহণ করেছে। নানা জড় বস্তুতে তার কবিতা ভরে ওঠে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে এটা এক ভাঙাচোরা গুদাম ঘর, এর পাশেই কোনো বয়স্ক বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটারি, ল্যাবরেটারির দেয়ালে ঝোলানো আছে মৌল কথার পর্যায়সারণী, তার পাশেই লেখা আছে কণাগুলোর রং বর্ণ গন্ধ; প্রাণীবিজ্ঞানের জাদুঘর, সেখানে কাচের বোয়ামে ফর্মালিনবন্দি নানা প্রাণীর মৃতদেহ বা হাড়কঙ্কাল। এই ভূগোলের পাখি বা প্রজাপতি, নদী বা চাঁদ, বৃষ্টি বা আকাশ, ভোর বা দুপুর, মানুষ বা ক্লাউন, বাঘ বা আপেল, মৌমাছি বা আঙুর — এদের যে নিজস্ব রং আর গন্ধ তা যেন নেই। এদের দেহের আকৃতি বা এই সমস্ত বস্তুকেন্দ্রিক আমাদের চোখের পরিমিতি ঠিক রেখে এর উপর লাগানো হয়েছে অভিনব এক পালিশ। এই পালিশের রং মাসুদ খানের মগজের, এই পালিশের তারপিন তেলের গন্ধ মাসুদ খানের হৃদয়ের অভিনবত্বের। এটাই কি তার অর্জিত সাফল্য?

আমাদের কবিতা-অভ্যাসের ঝোঁক বহুদিন হলো প্রকৃতিনির্ভর। ফলে মাসুদ খানের সিনথেটিক দুনিয়া আমাদের অভ্যস্ততায় আঘাত করে। তাকে চিনে নিতে বুঝে নিতে সময় লাগে বৈকি। প্রবলভাবে উপস্থিত এই নবনির্মিত সিনথেটিক বিশ্ব আমাদের কবিতায় প্রথম বলে মনে হয়। একে বলা যেতে পারে ‘জড়সাধনা’, যা নব, এবং মাসুদ খান-নির্মিত।


রচনাটা ‘লাল জীপের ডায়েরী’ সাইট থেকে লেখকের অনুমতি নিয়াই রিপ্রিন্টেড।গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you