কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৩ || জয়দেব কর

কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৩ || জয়দেব কর

শেয়ার করুন:


আস্তিক্য বা নাস্তিক্য তোমার লক্ষ্য হতে পারে না; তোমার লক্ষ্য একমাত্র মানুষ। মানুষের সন্ধানে যা যা ছাড়তে হয় তা ছাড়ো, আর যা যা ধরতে হয় তা ধরো। তোমার পতন ও উদ্ধারকর্তা তুমি নিজেই।


ঈশ্বরতত্ত্ব, আত্মাতত্ত্ব, পরকালতত্ত্ব, প্রাণিহত্যা, জাতিভেদ ও বর্ণভেদ স্থিরকরা গ্রন্থ অথবা রীতিনীতি পুরোটাই অপরাজনৈতিক বিষয়, কখনওই ধর্মীয় নয় এবং এগুলোই মানুষের প্রকৃত ধর্মের অন্তরায়।


শান্তি কোনও অলৌকিক বিষয় নয় যে তা আসমান থেকে ঝরে পড়বে; ব্যক্তি থেকে সমাজ-রাষ্ট্র—সকল পর্যায়ের মধ্যে তার সফল চর্চা করতে হয়। অজ্ঞানতাই অশান্তির পিতা যখন জ্ঞান শান্তির জননী।


জলেপড়া পিঁপড়েটিকে ডাঙায় তুলে দিচ্ছি আমি। এটাই আমায় উৎসব, এটাই আমার ধর্ম। ধর্মের নামে পশুহত্যা ও মানুষহত্যা এ আবার কেমন ধর্মচর্চা? প্রজ্ঞা ও প্রেমের জন্ম দেয়াই আমার ধর্মচর্চা। আর তাতে করে নিজের কাছেই শিক্ষা পেয়েছি যে, একটি গাছের পাতা ছেঁড়ারও অধিকার আমার নেই।


নিজের অন্তরের প্রদীপটি জ্বালাও। পরকাল, ঈশ্বর ও পাপ-পুণ্যের মতো অজস্র অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যাবে চিরতরে। প্রজ্ঞা ও প্রেমে পদ্মের মতো বিকশিত হবে মানবিক ইহকাল।


আমিত্ব ছেড়েই নিজস্বতার সন্ধান করতে হয়। সন্ধানী, তোমার চোখ হোক ঈগলের চেয়ে তীক্ষ্ণ।


শুদ্ধকর্ম পক্ষীস্বরূপ। করুণা ও প্রজ্ঞা নামক দুই ডানায় ভর করে উড়াল দেয় শূন্যতাসুন্দরে।


যিনি স্বর্গের লোভ, নরকের ভয় ও জীবনের মোহ থেকে মুক্ত তিনিই স্বাধীন মানুষ হতে পারেন।


পাপ এবং পুণ্য ঈশ্বরের মতোই মিথ্যা ধারণা।


বুদ্ধিবিহীন হৃদয়, হৃদয়হীন বুদ্ধি কোনওটাই মানুষের কাম্য নয়। হৃদয় ও বুদ্ধি এ-দুটোতে সমভাবে সম্বৃদ্ধি লাভের প্রচেষ্টাই মানুষের একমাত্র ধর্মকর্ম।


অনিত্যতা সর্বশক্তিমান।


একজন খাঁটি মানুষের কাছে মতবাদ একটা বাহন হতে পারে, চালক নয়।


প্রেমই তো নীড়, আর তবে সেই নীড় ছাড়া কোনও গন্তব্য বড়ই বেমানান।


শূন্য, যে-কোনওকিছুর সাপেক্ষেই শূন্য; প্রেমও তেমনই প্রেম!


শিক্ষালাভ সুসম্পন্ন হলে শিক্ষক আপনাতেই মূর্ত হয়ে ওঠেন। ছাত্রই নিরন্তর শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ছাত্র-শিক্ষক একই দেহাশ্রিত দুটি মানসিক গুণ।


‘মুক্তি’ ভিক্ষায় পাওয়া যায় না, যদিও অধিকাংশ মতবাদই মানুষকে ভিখারির ভূমিকায় দেখেছে এবং নানান আকৃতির ‘মুক্তিমূলা’ ঝুলিয়ে গাধার মতো খাটিয়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি অন্যখানে—মানুষ অর্জন করতে পারে, মানুষ মূলত অভিযাত্রী—জাগ্রত, অর্ধজাগ্রত এবং ঘুমন্ত!


অজ্ঞানতা ও দুর্দশা আরাধনা ও উপাসনার মতো অন্ধতা দিয়ে দূর হয় না, তা শুধু অন্তর্গত শুভ চেতনার দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভবপর। শ্রদ্ধা ও অনুশীলন নামক জীবনের প্রকৃত সম্পদের দিকে মনোযোগী হতে হবে শতভাগ।


আচরণে মনের ময়লা নয়তো সৌরভ যেকোনও একটি প্রকাশিত হয়।


যে-চেতনায় খ্রিস্টের জন্মের প্রায় শ-দুয়েক বছর পূর্বে মানুষ ও পশুর জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে হাসপাতাল নির্মিত হয়েছিল সেই সেবক চেতনার ধারা কি উপমহাদেশের শাসকদের মাঝে এই সময়ে আর অবশিষ্ট আছে? ক্ষমতা থাকার পরও যুদ্ধজয়ের বাজে ধারণা বাদ দিয়ে শিক্ষা দিয়ে অন্যকে জয় করার পররাষ্ট্রনীতি কাদের সক্রিয় আছে সারাবিশ্বে? মানুষ জীববৈচিত্র্যের অংশ। এখান থেকেই ঐক্যের ধারণাটা আসতে হবে।


যারা জন্মান্তর মানে তাদের জন্য জন্মান্তর দুঃখের কারণ। জন্মান্তর বা পরকাল ঈশ্বরের মতোই অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয়। অভিজ্ঞতার বাইরে যা তা নিয়ে মেতে থাকা বোকামি। বরং অভিজ্ঞতার ভিতর থাকা চঞ্চল চিত্তকে স্থির করার চেষ্টা এবং প্রজ্ঞা ও করুণার চাষ গাধার মতো বোঝা বহনের হাত থেকে রক্ষা করে।


প্রচলিত ধারণার পাপ-পুণ্য মানলে মানুষকে নিষেধের বেড়াজালে বন্দী হতে হয়। পাপ দেয় শাস্তির ভয় আর পুণ্য দেয় পুরস্কারের লোভ। প্রচলিত ধর্মগুলো বলে শাস্ত্র মানলে পুণ্য না মানলে পাপ। আমি শাস্ত্র মানি না , মানি না পাপ-পুণ্য। পাপ-পুণ্য বলে কিছুই নাই। যা আছে তা হলো শুভ ও অশুভ চেতনা। চেতনাই কর্ম । শুভ চেতনা শুভ ফল দেয়, অশুভ দেয় অশুভ ফল। কাল্পনিক শাস্তির ভয় বা পুরস্কারের লোভ নয়, প্রেম ও মনুষ্যগরজই আমার পাথেয়।


‘আরোগ্য পরম লাভ । সন্তুষ্টি পরম ধন। বিশ্বস্ত ব্যক্তি পরমাত্মীয়। চিত্তের অটল মুক্তি পরম সুখ।’ এই চার ‘পরম’ ধম্মপদের কথা হলেও তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা না। এগুলো সকল মানুষের বেলায় সমান অর্থ বহন করে বলেই মনে করি।


চূড়ান্ত সত্যটি হচ্ছে চূড়ান্ত বলে কিছুই নেই। সবই কার্যকারণের অধীন। সবকিছুই প্রশ্নসাপেক্ষ। পরিবর্তনশীলতা মানতে না পারায় নিজের মধ্যে মানুষ যে কারাগার রচনা করে তাতে সে নিজেই আসামীর মতো বন্দী হয়ে যায়। এই বন্দী মানুষগুলোই চিরতরে এই আত্মরচিত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি (পরম সুখ) খোঁজে।


কার্যকারণ দর্শনের মধ্য দিয়েই কোনও ব্যাপারে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি আসে, আসে অপ্রমত্ততা। অপ্রমত্ততা মুক্তিকামীকে আত্মমুক্তির (পরম সুখ) অটল উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। পরম সুখ এই জীবনেই; কার্যকারণ বাকিতে নয় নগদেই ফল দেয়।


নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী হয়ে উঠতে পারলে দুঃখ কী আর থাকে রে পাগল! নিজেকে ভালোবাসো, নিজেকে সঙ্গ দাও। অভ্যন্তরই বাহিরের সাথে মিলিত হয়।


আমিত্ব ছেড়েই নিজস্বতার সন্ধান করতে হয়। সন্ধানী, তোমার চোখ হোক ঈগলের চেয়ে তীক্ষ্ণ।


সংখ্যাগুরু অমানুষের পৃথিবীতে মানুষ সংখ্যালঘু।


প্রগতিবিরোধী রাষ্ট্র যখন তোমাকে পুরস্কার সনদ দিচ্ছে প্রগতির নায়ক হিসেবে আর তুমি তা নিয়ে লেপের নিচে আরামে ঘুমিয়ে আছ চোখ বন্ধ করে তখন তোমার রবীন্দ্রনাথকে তারা হিন্দু বলে তাড়িয়ে দিতে ঘুমন্ত তোমার লেজটিকে দিয়ে লিখছে নতুন প্রগতির কথা।


নেতা হয়ে ওঠা আর নেতার কোটা পূরণ করা দুইটা দুই জিনিস।


কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম পর্বগুলো
জয়দেব কর রচনারাশি
গানপার সদুক্তিনিচয়

শেয়ার করুন:
পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you