‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ (#metoo) আন্দোলনের চরিত্রটি নৈতিক, আইনী নয়। পুরো বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা একটা পূর্বানুমানের ওপর দাঁড়ানো। সেটা হলো, নির্যাতিত কিংবা উত্যক্ত হওয়া নারী তার উত্যক্তকারী/নির্যাতকের পরিচয় প্রকাশ করছেন, দ্বিপাক্ষিক পরিসরে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার বিবরণ দেয়ার মাধ্যমে। এই মুখোশ উন্মোচন প্রক্রিয়া বাবদে কোনো বৈষয়িক সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছেন না তিনি। বরং নিজেকে একটা ঝুঁকির মধ্যেও ঠেলে দিচ্ছেন। এই উন্মোচন তাকে ভারমুক্ত করছে, কিন্তু তাতে তার কোনো কায়েমি স্বার্থ হাসিল হচ্ছে না।
#MeToo ম্যুভমেন্টের একটা প্যাটার্ন খেয়াল করা যায় বিশ্বব্যাপী। সেটা হলো, যিনি নিপীড়িত, তিনি তার নিপীড়ন বা হেনস্থার ঘটনাসমেত যৌন নিপীড়ক বা হেনস্থাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেন। সেই নিপীড়ক জীবিত, অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাবান, এবং সম্ভবত তখনো একইভাবে অন্য কাউকে যৌন হেনস্থা করবার সম্ভাবনা রাখেন। ফলে, তার পরিচয় প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাকে একটা গণলজ্জার (public shaming) মুখোমুখি করা এবং সামাজিকভাবে বয়কট করবার (socially ostracized) জন্য একটা নৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে এই ম্যুভমেন্ট।
ফলে, এই ম্যুভমেন্ট হলো নিপীড়িতের পাল্টা সাহসের নিশানা, যা দিয়ে তিনি তার নিপীড়ককে গণপ্রতিরোধের মধ্যে ফেলে দেন। ফলে, এটি কোনো নিপীড়িত-র ব্যক্তিগত ক্ষোভের বয়ান নয়, পরিষ্কারভাবে একটা সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ।
‘মি-টু’ যেহেতু নৈতিক-সামাজিক আন্দোলন, ফলে সে অপরপক্ষ অর্থাৎ নির্যাতকের বয়ানকেও বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে না। সে-কারণে, যখন মৃত কেউ ‘মি-টু’ ন্যারেটিভের উপলক্ষ হন, তখন তা মৃত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় না। এমনকি শুনবার সুযোগও দেয় না। ফলে, পাঠকের তরফে, মি–টুর নৈতিক অভিপ্রায়টি খর্ব হয়।
বাংলাদেশে সেলিম আল দীন বিষয়ে ‘মি-টু’ ন্যারেটিভ আমাকে এই অস্বস্তিটুকু উপহার দেয়। তার সম্পর্কিত বয়ান সম্পর্কে আমি সন্দেহ পোষণ করছি না। বরং বলতে চাইছি যে, বয়ানের আগেই মৃত থাকার কারণে সেলিম আল দীন একটা সুবিধাজনক অবস্থান প্রাপ্ত হন। নৈতিকভাবেও।
সেলিম আল দীন বিষয়ক এই বয়ানকে সন্দেহ করবার কিছু নাই। তবে তিনি এ ধরনের গণলজ্জার উর্ধ্বে উঠে গেছেন। এই বয়ানে তার শিল্পসিদ্ধিরও ক্ষতি হবে না। তিনি কালজয়ী শিল্পস্রষ্টা। কিন্তু শিক্ষক হিসাবে যৌন নিপীড়ন বা হেনস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কোনো প্যারালিগ্যাল জায়গায় নিয়ে গেছেন কি না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। কারা তাঁর নিপীড়ক সত্তার উত্তরসূরী? ছাত্রশিক্ষকের মধ্যকার সামাজিক চুক্তির মধ্যে কোথায় কোথায় এ ধরনের হেনস্থার ঘটনা ঘটছে? কারা ঘটাচ্ছে? সেখানে নজরদারি করুক এবং আঘাত হানুক #MeToo, মৃত সেলিম আল দীন বিষয়ক এই বয়ানের ধারাবাহিকতায়।
[বাই দ্য ওয়ে, সেলিম আল দীন বিষয়ে যে অভিযোগটুকু করা হয়েছে, তাতে যারা বিস্মিত হচ্ছেন, তাদের বিস্মিত হওয়া আমাকে পাল্টা-বিস্মিত করছে! আমাদের জাহাঙ্গীরনগরজীবনে এটা প্রায় ইনোসেন্ট ধরনের ওপেন সিক্রেট ছিল। এটা আমার আলাপের প্রসঙ্গ নয় বলে ব্রাকেটে বললাম।]
… …
- হালুমহুলুমভালুমবাসা, ব্রাত্য রাইসু! || সুমন রহমান - November 23, 2024
- শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান - August 23, 2024
- দেশান্তরী গরিবের কম্যুনিটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট || সুমন রহমান - July 11, 2024
COMMENTS