ফাদার অব দ্য রোডস্ || সুব্রত দেওয়ানজী

ফাদার অব দ্য রোডস্ || সুব্রত দেওয়ানজী

একমাথা ঝাঁকড়া চুল, গালে খোঁপ খোঁপ দাড়ি, ঈষৎ লাল দুটি চোখ, চেহারায় রুক্ষতার পাকাপোক্ত ছাপ। পরনে চিরাচরিত ফ্যাশনের শাদা পাঞ্জাবি, নীল জিন্স, বুট; তার সঙ্গে শাল কিংবা চাদরের আচ্ছাদন। মেকআপ কি গেটআপ সবখানেই তিনি ভাবলেশহীন কিংবা বলা যায় এখানেই তাঁর ভাবের জোয়ার। আঙুলের ফাঁকে হয়তো সিগারেট, তাতে ধুমসে মারো টান … এই তো আমাদের চিরচেনা জেমস্, বাংলার নগরবাউল।

পাঠক, পেছন থেকেই হোক শুরু। সেই কবেকার ফারুক মাহফুজ আনাম … মনে পড়ে? ২ অক্টোবর নওগাঁর প্রত্যন্ত বড়হাট্টি গ্রামে যার জন্ম। ড. মোজাম্মেল হক আর জাহানারা খাতুন কি ভেবেছিলেন তাদের কোল আলো করে জন্ম নেয়া পুত্র একদিন বাংলার ব্যান্ডমিউজিক অঙ্গন আলোকিত করবেন? বোধহয় না। বড়হাট্টির মেঠো পথ, চরজাগা নদী, পাঠশালা, রোলকলের প্রথম পিরিয়ড, কলেজ সব মাড়িয়ে একদিন আগ্রাবাদ হোটেলে উঠে এলেন তুলা রাশির এই জাতক, আশৈশব স্বপ্ন ছিল যার গায়ক হওয়ার।

সেটা ’৮৫ সাল। চাটগাঁয় এসেই নৌকা ভাসালেন তিনি, নৌকার নাম ফিলিংস্। শ্রোতারা তখন ফিলিংসকে চিনত বাংলাদেশের ডায়ার স্ট্রেটস্   হিশেবে। আর মার্ক নফ্লার বাজিয়ে তিনি তখন সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন।

’৮৯-এর কথা। মিউজিক বেঙ্গল  থেকে বেরোলো ফিলিংসের প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’। কিন্তু চলল না সেটা। তারপর ‘অনন্যা’। এবার? হিট, জব্বর হিট। আজকের জেমসের জন্ম হয়নি তখনো।

সারগাম  থেকে রিলিজ হলো দ্বিতীয় সোলো ‘পালাবে কোথায়’। নতুন পরিচয়ে জেমসকে আবিষ্কার করল শ্রোতা। খাইছে, এমনধারা গান তো আগে শুনিনি! ব্যস, রটে গেল ঢাকা নগরীতে এক ক্ষ্যাপা বাউল এসেছে। নাম তাঁর জেমস্। তারপর বেরিয়েছে আরও দুটো সোলো আর ব্যান্ড অ্যালবাম। ততদিনে তিনি ভক্তদের হৃদয়ে নির্দ্বিধায় স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। প্রথমে নগরবাউল, তারপরে গুরু, সবশেষে দেবতা — কোনদিন যে আবার ভক্তরা তাঁকে ঈশ্বরই ডেকে বসে, আল্লা মালুম!

জেমসের এহেন জনপ্রিয়তার কারণ কি? কারণ হয়তো একহাজার একটা। তবে এক্ষেত্রে শুধু একটি কথাই বলা চলে, সংগীত আর নিজের সৃষ্টিকে জেমস্ বড় যত্ন দিয়ে লালন করেন। গিটারের সঙ্গে তাঁর চিরকালের সখ্য। নিজেই তো বলে বেড়ান, ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে তাঁর ছয় রকমের কষ্ট।

জেমসের হাতে গিটার মানেই ওভারড্রিভেন ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ। তারুণ্যের না-বলা কষ্টটাকে তিনি গিটারের তারে জড়িয়ে বেড়ান। অল্টার্নেটিভ রক আর সাইক্যাডেলিক কণ্ঠ — এই দুইয়ে জেমস্ স্বতন্ত্র। আছে দুর্দান্ত সব লিরিক্স … শিবলী, দেহলভী, মারজুক, আনন্দ … শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জেমসের মতো গানের বাণীকে লাগসইভাবে ছুঁড়তে পেরেছেন কজন? ভাগ্যিস, সময়ের আবেদনটা তিনি বুঝেছেন ভালোভাবেই।

মঞ্চে জেমস্ বরাবরই বাঁধনহারা, দুর্দম। তাঁর ভেতর থেকে তখন বেরিয়ে আসে এক স্বতঃস্ফূর্ত বাউল। বাউলিয়ানা ঢঙেই জেমস্ আমাদের মনে রেখাপাত করেন। আর তখনই সিনায় সিনায় লাগে টান, যে-টান আছে তারুণ্যের শিরায় শিরায় বহমান রক্তে। সে এক মর্মভেদী মরমি টান।

ভালোবাসার সংজ্ঞা যার কাছে সুখ-দুঃখের অপূর্ব সংমিশ্রণ আর সৌন্দর্য বলতে বোঝেন মহাবিশ্বের সমস্ত সত্যকে, জেমস্ তাঁর নাম। স্বপ্ন দেখেন আজীবন গান নিয়ে থাকার। তাই তো তিনি গলা বাজান, অন্তর বাজান। গান জেমসের বড় আদরের ধন। সেই রক্তাক্ত রাজপথ, দ্বন্দ্ব, মিছিল, সুধাংশু, … যুদ্ধ, … শৈশব, মা, … হোমায়রা, সুস্মিতা, নূরজাহান, … প্রেমিকার প্রথম চুম্বন, … বাংলার লাঠিয়াল থেকে লেইস্ ফিতা … জয় গুরু সত্য।


লেখকতথ্য  : সুব্রত দেওয়ানজী / প্রযত্নে : তপন কুমার দেওয়ানজী / বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বিটিএমসি ভবন (পঞ্চম তলা), ৭-৯ কাওরান বাজার / ঢাকা ১২১৫

প্রথম-প্রকাশতথ্য  : ঈদসংখ্যা আনন্দভুবন ২০০০ / জানুয়ারি, ২০০০, ঢাকা

… …

COMMENTS

error: