ও নদী রে || ইয়াসমীন জাহান নূপুর

ও নদী রে || ইয়াসমীন জাহান নূপুর

মন খারাপ হলেই আমি এই দিকটায় চলে আসি। মনে হয় সারা শহরে এই নদীটাকেই আমি অনেক দিন ধরে চিনি। ভিক্টোরিয়া থেকে সবুজ কিংবা হলুদ লাইনের টিউব ধরে ব্ল্যাকফ্রায়ার্স-এ আসতে বড়জোর ১৫/২০ মিনিট লাগে। আমার পিছনে টেট মডার্ন আর সামনে লন্ডন শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত টেমস নদী।

আমি বসে আছি টেট মডার্ন (Tate Modern)-এর সামনের একটি বেঞ্চে। আমার সামনে এক লোক ফুঁ দিয়ে বুদবুদ ওড়াচ্ছে আর কিছু বাচ্চা বুদবুদগুলো ধরার চেষ্টা করছে। অদ্ভুত স্বর্গীয় দৃশ্য। একদিকে নদী, আরেকদিকে বিশ্ববিখ্যাত গ্যালারি। আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ রয়েছে টেট মডার্নে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী হয় এখানে। কোনো কোনো সময় আমি একজন শিল্পীর কাজই দেখি সারাদিন ধরে।

টেট মডার্নের নতুন ভবনটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। এই ভবনটি বিখ্যাত সুইস আর্কিটেকচার ফার্ম Herzog & de Meuron-এর স্থাপত্য নকশায় নির্মিত। ৩৬০ ডিগ্রি ভিউতে লন্ডনের সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য টেট মডার্নের দশতলায় প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাপক জনসমাগম হয়। দর্শনার্থীরা নদীপাড়ের ঠান্ডা বাতাসে বুক ভরে অক্সিজেন নেয়।

আমার বন্ধুরা কমবেশি সবাই পরামর্শ দিয়েছে, আমি যেন ফেরিতে টেমস ভ্রমণ করি। আমার ইচ্ছা করেনি, খুব ট্যুরিস্টিক লাগে। বরং বেঞ্চে বসে থাকতে বা পাড় ধরে হাঁটতেই অনেক ভালো লাগে আমার। এরা নদীকে কত যত্ন করে! নদী এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত! দুই পাড় শক্ত পাথর দিয়ে নিপুণভাবে বাঁধানো। এছাড়া রয়েছে হাঁটার রাস্তা, জগিঙের ও সাইক্লিঙের প্রশস্ত পরিসর। টেমস নদীর নীচ দিয়ে চলে গেছে ৩৯৬ মিটার চওড়া এক টানেল। এটাই বিশ্বের প্রথম টানেল, নির্মিত হয়েছিল ১৮২৫ থেকে ১৮৪৩ সালের মধ্যে, অর্থাৎ প্রায় আঠারো বছর ধরে। প্রথমে এটি মূলত ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত ছিল, পরে ১৮৬৫ সালে লাইন টানা হয় এবং বর্তমানে এটি সারা লন্ডনের ওভারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের পরিবহনের অংশ হিসেবে কাজ করে।

টেমস নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নিজের ভিতর থেকে হুড়মুড় করে একটা ধাক্কা খেলাম। আরে, আমি কোথা থেকে এলাম এখানে — এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে! আমি তো বড়ই হয়েছি নদী পারাপার করে। আমি টেমসের পাড়ে এসেছি নদীমাতৃক এক দেশ থেকে।

আমার প্রিয় নদী তো কর্ণফুলী। আমি তো বড় হয়েছি কর্ণফুলীর ধারে। যে-নদীর প্রতিটি বাঁক আমার চেনা। প্রতিটি প্রবাহিত ঢেউ আমার চেনা।

আমার চিরচেনা এই স্রোতস্বিনীকে নিয়ে আছে কত গান, কত কবিতা! কর্ণফুলীর দুইপারের মানুষের জীবন নিয়ে আছে কত গল্প আর কাহিনি! অর্থনৈতিক দিক থেকে এই নদী শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় দশ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নদী কর্ণফুলী। প্রাক-ইসলামি যুগে আরব বণিকেরা ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে যে-বন্দর ব্যবহার করত, সেটি কর্ণফুলী মোহনার চট্টগ্রাম বন্দর। পর্তুগিজরা বলত — পোর্তে গ্রান্দে।

কর্ণফুলী নিয়ে দুটি গান একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তার একটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের বিখ্যাত শিল্পী প্রয়াত শেফালী ঘোষের গাওয়া : “ওরে কর্ণফুলী রে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে”। অন্য গানটিও সকলেরই পরিচিত — “ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানি / লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী”। আমরাও খুব গাইতাম ছোটবেলায়। এ গানের রচয়িতা হাটহাজারীর ফতেয়াবাদের মলয় ঘোষ দস্তিদার। এই অসাধারণ গীতিকারের নাম আজকাল বড়একটা শোনা যায় না।

চট্টগ্রামের সাম্পান গড়ন আর নির্মাণের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নানা ধরনের নৌকা থেকে কত আলাদা! প্রবল ঝড়তুফানের মধ্যেও সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ মোহনা আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দেওয়ার উপযোগী করে এই জলযানটিকে তৈরি করা হয়।

কর্ণফুলী নিয়ে এ পর্যন্ত যত গল্পগাথা শুনেছি তার প্রায় সবই আদিবাসী জীবনের সঙ্গে যুক্ত। আদিবাসী সমাজে নদী-দূষণকে পাপের সমতুল্য বলে মনে করা হয়। কথিত আছে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে। এক জ্যোৎস্না রাতে তারা দুইজন এই নদীতে নৌকাভ্রমণ করছিল। নদীর বুকে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যায়; তাকে উদ্ধার করতে রাজপুত্রও ঝাঁপ দেয়। কানফুলকে কেন্দ্র করে গড়েওঠা এই করুণ কাহিনি থেকেই এই নদীর নাম হয় কর্ণফুলী। মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটির নাম কাঁইচা খাল, আদিবাসীদের কাছে এটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে খাওৎলাং তুইপুই।

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই নদীর উৎপত্তি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে। এই পাহাড়ি নদী ভারতের লুংলেই জেলার টলাবুং (দেমাগ্রী) থানা থেকে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ঠেগামুখ এলাকায় প্রবেশ করেছে। ঠেগামুখ থেকে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত অংশটি পড়েছে ভারতে। হরিণার মুখের পর থেকে নদীটি পুরোপুরি বাংলাদেশের। ১৮০ কি.মি. পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে এটি রাঙ্গামাটিতে একটি দীর্ঘ ও সংকীর্ণ শাখা বিস্তার করে পরবর্তী সময়ে আঁকাবাঁকা গতিপথে ধুলিয়াছড়ি ও কাপ্তাইয়ে অপর দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়েছে। রাঙ্গামাটি ও ধুলিয়াছড়ির শাখানদী দুটি বর্তমানে কাপ্তাই লেকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাপ্তাই শাখা থেকে বেরিয়ে কর্ণফুলী নদী সীতাপাহাড় পর্বতমালার ভেতর দিয়ে আরেকটি আঁকাবাঁকা গতিপথ পাড়ি দিয়ে চন্দ্রঘোনার কাছে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীটি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকল, গোবামুড়া, চিলার ডাক, সীতাপাহাড় ও বোয়ালখালীর পাহাড় অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে এসে পড়েছে। সর্পিল গতির এই নদী কখনো অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে উঠেছে, আবার কখনো-বা ধনুকের মতো বাঁক নিয়েছে। নদী ভাঙনের পাশাপাশি কোথাও কোথাও ছোট-বড় চরও জেগে উঠেছে।

রাঙ্গামাটির কাপ্তাই বাঁধ আদিবাসীদের কান্না। ১৯৬২ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় এক লক্ষ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর পাহাড়ি জনপদের আবাসভূমির পাশাপাশি  চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ কৃষি-উপযোগী  ভূমিও প্লাবিত হয়।

কর্ণফুলীর কথা ভাবতে বসে আমার মনে ভেসে উঠছে সেই ছোটবেলায় ১৫ নম্বর ঘাট পারাপারের দৃশ্য। বছরে দুই-তিনবার আমরা গ্রামের বাড়িতে যেতাম। তখনো কর্ণফুলীর ওপরে ব্রিজ তৈরি হয়নি, আমাদের পারাপার করতে হতো নৌকায়, তখন পতেঙ্গা  ছিল একটা বেশ বড় মোহনা। আনোয়ারায় যেতে হলে সেই মোহনা পাড়ি দিতে হতো। বাবা সবসময় সাম্পান রিজার্ভ করত, পরিবারের সবাইকে নিয়ে এই নদীপথে ভ্রমণ দারুণ উপভোগ করত। এই নদীর বড় বড় ঢেউ আমার মাকে ছোট্ট খুকি বানিয়ে দিত। আর আমরা তিন বোনও খুব মজা করতাম। মনে হতো আমাদের সাম্পান যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ে উড়ে নদী পার হচ্ছে। আর পাশ দিয়ে কোনো ট্রলার বা জাহাজ গেলে ঢেউগুলো আরো উত্তাল হয়ে উঠত। মা-ও তখন বেশ ঘাবড়ে যেত, বাবাকে শক্ত করে ধরে থাকত। মোহনাতে পৌঁছালেই বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মুখে পড়তে হতো, কখনো কখনো আমাদের ভিজিয়ে দিত সেই ঢেউ। আমার জীবনে নদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সেই তখন থেকেই। সেই সময় নৌকা ছাড়া গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসার অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।

আমরা নানার বাড়ি, খালার বাড়ি যেতাম স্টিমারে করে। কর্ণফুলীর শাখাপ্রশাখা ধরেই স্টীমার চলত। অদ্ভুত সুন্দর — মাঝে মাঝে দিগন্তবিস্তৃত মাঠজুড়ে ধানক্ষেত, কোথাও-বা ঘন জঙ্গল, একসময় সরু খালে গিয়ে পড়ত স্টিমার। কোনো কোনো বাঁকে স্থির জলের নীরবতা খানখান করে দিত স্টিমারের ভটভট শব্দ। বর্ষায় ঘাস আর শণ নদীর পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লকলকিয়ে বাড়ত।

মনে আছে একবার দুর্গাপূজার ছুটিতে দশমীর দিনে স্টিমারে ফিরছিলাম। আমারা যখন চাক্তাই পৌঁছালাম ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। উপচে-পড়া মানুষের জন্য ঘাটে ভিড়তে পারছিল না স্টিমার। সারা ঘাট জুড়ে মানুষের হইহুল্লোড়, চারিদিকেই আলোর রোশনাই। ঢাকের বাজনার তালে তালে মানুষ নাচছে, কেউ-বা উলু দিচ্ছে; প্রতিমা বিসর্জনের ধুমধাম আয়োজন। স্টিমার থেমে আছে পানির উপরে, ঢেউয়ের দোলায় মৃদুমন্দ দুলছে। আমি মাথা বের করে একবার বাইরের দিকটা দেখলাম। সেই মুহূর্তটির কথা এখনো আমার মনে আছে — যেন সেই মুহূর্তে আমি সিনেমায় দেখা কোনো দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম হঠাৎ। কী অপূর্ব তার রূপ – একটি ঐশ্বরিক আলো এসে পড়েছিল প্রতিমার ওপর, ঝলমল করছিল চারপাশ, দেবীকে কী বিশাল লাগছিল! আলোর ঝলক ঠিকরে পড়ছিল নদীর বুকে। কী বড় বড় চোখ দুর্গার, মেঘকালো তাঁর চুল, কী তাঁর সাজসজ্জা, দশ হাতে দশটি অস্ত্র। শঙ্খ, সাপ, তীর-ধনুক, ত্রিশূলে সজ্জিত দুর্গার হাতগুলো। এই অস্ত্রগুলো দিয়েই নাকি অসুর বধ করেছিলেন মা দুর্গা। আমি অবাক হয়ে দেখলাম দুর্গা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন, মিটিমিটি হাসছেন। সেই অসাধারণ মুহূর্তটির কথা আমি আজও ভুলিনি।

এরপর থেকে কর্ণফুলীর সঙ্গে আমার সখ্য বেড়েই চলল। চারুকলায় পড়ার সুবাদে আউটডোর ড্রয়িং করতে হতো প্রায়ই। মাঝির ঘাট, চাক্তাই, অভয় মিত্র ঘাট, ফিরিঙ্গিবাজার, হালিশহর, নদীর ওপারের জেলেপাড়া — এসব এলাকাতেই আমার তখন নিত্যদিনের যাতায়াত, বিশেষ করে বন্ধের দিনগুলোয়। আশেপাশের মানুষেরা আমার খুব খেয়াল রাখত। সাতসকালেই চলে যেতাম, চারুকলার বন্ধু মঞ্জু বা হান্নানের সঙ্গে, আবার কখনো-বা একাই। অভয় মিত্র ঘাটের নিচে পিলারে বসেও ছবি আঁকতাম, আবার কোনো কোনো সময় শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, পানির শব্দ শুনতাম। কোনো কোনো দিন এমনও হয়েছে যে, আমাদের ছবি আঁকা শেষ, আর তখনই হুড়মুড় করে বৃষ্টি এসে সব রং ধুয়ে নিয়ে গেছে! আমরা এঁকেছি সাম্পান, জাহাজ, বর্ষার উত্তাল নদী, শীতের কুয়াশা-ঢাকা আবছা নদী। একের পর এক ড্রয়িঙে, জলরঙে চিররহস্যময়ী কর্ণফুলীর রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে গেছি। জেলেপাড়ার প্রতিটি ঘরের ছবি আমি এঁকেছি। চারুকলায় পড়ার সময় কর্ণফুলী নদী আমার ছবি আঁকার হাতকে পোক্ত হতে সাহায্য করেছে।

এই নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, একে জীবন্ত রাখা, নাব্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কীভাবে? নদীমাতৃক দেশের বাসিন্দা হয়েও আমরা জানি না কীভাবে এর যত্ন নিতে হয়! কর্ণফুলীর শাখা হালদা নদীর যে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য রয়েছে তা কল্পনাতীত। এই নদী দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হালদা নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ ও কার্প  জাতীয় মা-মাছ অসংখ্য ডিম ছাড়ে। মাছেরা মেঘলা দিনে দুপুরে ও বিকেলে ডিম ছেড়ে থাকে। হালদার পানির বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ অন্য অনেক নদীর পানি থেকে আলাদা। এই নদীর পানি সারা চট্টগ্রাম শহরে ওয়াসার মাধমে সরবরাহ করা হয়।

প্রতিদিন যে-হারে বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে, খালে ও নদীতে শিল্পবর্জ্য ও অপচনশীল প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে, তাতে কর্ণফুলী নদীর প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। দুই পাড়ে কলকারখানা বাড়ছে; ইটের ভাটা, জেটি সহ নানা অবৈধ স্থাপনা নদীর স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে কর্ণফুলীর এখানে-ওখানে চর জেগে উঠছে। দুইশোরও বেশি কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিকে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত করে তুলছে। নদীরে বুকে এরই মধ্যে কয়েক ফুট উঁচু প্লাস্টিকের পুরু স্তর জমেছে।

কর্ণফুলীকে যে-কোনো মূল্যে দখল ও দূষণ মুক্ত করে এর প্রবাহকে বহমান রাখতে হবে। কর্ণফুলীর স্রোত, নাব্যতা ও পানি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। এ নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, একে জীবন্ত রাখা দেশের সমৃদ্ধির জন্যই অত্যন্ত জরুরি। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে, যেটির বহির্গমন পথ আনোয়ারা।

যে-নদী আমাদের এতকিছু দিয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়তো সেই নদীটির গতিপথ এঁকে জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখব এবং বলব — এককালে এখানে একটি নদী ছিল।

আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের শহরের প্রিয় নদী কর্ণফুলীর কথা ভাবতে ভাবতে মন খারাপ হয়ে গেল। আমি বসে রয়েছি টেমস নদীর ঝকঝকে পাড়ে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। কখনযে রাত আটটা বেজে গেছে খেয়ালই করিনি। টেমসের আশেপাশে ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। আমি আমার অস্থায়ী নিবাসে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। চারিদিকে চোখ মেলে আরো একবার মনে হলো — কী সুন্দর ওদের এই ছোট্ট নদীটা! একদিকে আমার যেমন ঈর্ষা  হতে লাগল, তেমনি অন্যদিকে নিজেদের অবিমৃষ্যকারিতার কথা ভেবে রাগও হচ্ছিল কম নয়।


সহায়ক গ্রন্থ
লায়ন ডা. বরুণকুমার আচার্য রচিত ‘চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ইতিকথা’

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you