স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৩ || সানজিদা শহীদ

স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৩ || সানজিদা শহীদ

উত্তরাঞ্চলের আকাশ মাটি সবসময়ই একটা রুদ্র মূর্তি ধারণ করে থাকত। গ্রীষ্মের সময় খা খা করা রোদ, ছাতিম গাছের উপর বসে কাকের তারস্বরে কা কা করা, আবার শীতে প্রচন্ড কুয়াশা, শৈত্যপ্রবাহে একহাত দূরের জিনিসও না দেখতে পাওয়া, লেপে শীত না-মানা, আমাদের বাড়ির টিনের চাল বেয়ে টুপটাপ শব্দে কুয়াশার জল গড়িয়ে পড়া। আবার বর্ষায় ভারী বর্ষনে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া, গাছপালা প্রবল বাতাসে উড়িয়ে নেয়া, কখনো শিলাবৃষ্টিতে সাদা হয়ে থাকা আমাদের উঠোন, টিনের চালে সুরের ঝঙ্কার শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া আরামে। চলে যায় বসন্তের পর বসন্ত।

খুব অল্প বয়সে মার বিয়ে হয়। বিয়ের পর উনি আবার পড়ালেখা করতে চান। বাবারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গ্রাম থেকে দাদা চিঠি পাঠান নাকি বাবাকে — “শহীদ, মেয়েমানুষ হিসেবে যথেষ্ট পড়ালেখা হয়েছে, আর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না, বাকি তোমার ইচ্ছা।”

মা-র আর পড়ালেখা এগোল না।

আমার অনেক সহজসরল মা একসময় সংসারের হাল ধরা শুরু করলেন। হয়তো বাগানে পুঁইয়ের বিচি ফেলে দিলেন কয়েকটা, তাতে কদিন পরেই লকলকিয়ে বেড়ে উঠতো পুঁইশাক, প্লাস্টার-করা উঠোনের এক জায়গায় একটু খুঁড়ে লাগিয়ে দিতেন লাউয়ের চারা, কঞ্চি দিয়ে উঠিয়ে দিতেন ছাদে, লাউ আর লাউশাকে ভরে যেত ছাদ। নয়তো বাড়ির প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে শিমের মাচা। কখনো নারকেল গাছটার গোড়ার আশেপাশে মরিচ গাছ। প্রায়ই এগুলো দিয়ে উনি খুব সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতেন, বাঁচিয়ে দিতেন বাজারখরচ। তখন হয়তো সপ্তাহে একদিন বড়জোর দুদিন মাংস রান্না হতো, বাকি দিনগুলোতে ডিম, মাছ। কী এক অসীম ক্ষমতায় মা এগুলো পারতেন, আমার এখনো বিস্ময় লাগে। দাদাবাড়িতে খরচ দেয়া, আমাদের দু-বোনের পড়ালেখার খরচ, সংসার চালানো সেইসাথে কিছু টাকা সঞ্চয় করে রাখা, সবকিছুই করতেন মা ওনার দক্ষ হাতে।

উনি নানাভাবে সংসারখরচ বাঁচাতেন। নিজের সেলাইমেশিনে সেলাই করে ফেলতেন নিজের ব্লাউজ, পেটিকোট, আমাদের দু-বোনের নানা ডিজাইনের জামা। একটু বড় হওয়ার পর আমার ফ্রকগুলোর সামনে উনি নানা ডিজাইনের বড় বড় কুচি দিয়ে দিতেন আমার বয়ঃসন্ধিকালকে রক্ষার জন্য, পুরুষের চোখ আড়াল করার জন্য। আমি বুঝতাম না তখন এগুলোর কিছুই।

আজকাল মা আগের মতো কিছুই খেতে পারেন না, খুব অসুস্থ। আমিও পেরিয়ে এসেছি অনেক অনেক বছর, অনেক অনেক পুরুষের চোখ, রাতে জেগে থাকি, ঘুম খুব কম হয়। সেলাইমেশিনটা স্মৃতি হিসেবে এখনো রয়ে গিয়েছে।

আহা মধ্যবিত্ত আর তার রোজনামচা, কত কত কথা!

আহা মধ্যবিত্ত! কে বলে স্মৃতিরা প্রতারক? পলাতক? ধূসর কিংবা সাদাকালো? আমি তো দেখি স্মৃতিরা সবসময়ই রঙিন। চোখ বন্ধ করলেই আমি স্মৃতির বায়োস্কোপ দেখতে পাই।

বগুড়ায় আসার পরেও আমি দু-জন খেলার সাথি পেয়ে গেলাম পাড়ায়, মুন্নী আর হ্যাপী। আমরা একই ক্লাসে, একই স্কুলে পড়তাম। অনেক বছর আমরা একসাথে ছিলাম। হ্যাপী একসময় ওদের দেশের বাড়ি কুমিল্লায় চলে গেল। ইন্টারের পরে বিয়েও হয়ে গেল। এখন তিন বাচ্চার মা, ভীষণ ব্যস্ত। যখনই ফোন দেই, একনাগাড়ে বলতে থাকে — “আরে আর বলিস না, তিনটা বাচ্চার একটা-না-একটার অসুখ লেগেই থাকে, এদিকে তোর ভাইয়া একটা নতুন ব্যবসা শুরু করেছে, জানিস আমরা-না ঢাকা-কুমিল্লা রোডের ওদিকে একটা জায়গা কিনে ফেলেছি।” আমি চুপচাপ শুনি আর নিঃশব্দে হাসি ফোনের এপ্রান্তে। ওর সুখী সাজানো সংসারের গল্প শুনে যাই, ভালো লাগে। আর মুন্নীটাও সংসার শুরু করেছিল কিন্তু গোছাতে পারল না, দু-বছরের মাথায়ই ছেড়ে আসতে হলো। ও আর আমি যখনই প্রতিরাতে কথা বলি, আমার প্রায়ই মনে হয় ক্ষমতা থাকলে ওর জীবন থেকে আমি পারলে এই দু-বছর মুছে ফেলতাম। মুন্নী এখন একটা সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  টিচার। হয়তো একা কিন্তু ভালোই আছে, অন্তত সেই দু-বছরের দুঃসহ স্মৃতি থেকে তো মুক্তি মিলেছে।

আমার একটা রেডিও ছিল ছোট। সম্ভবত বাবা কিনে এনেছিল। আমি প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ‘অনুরোধের আসর’ অনুষ্ঠানের গান শুনতে বসে যেতাম। রেডিও থেকে খুব সুন্দর কণ্ঠে ঘোষণা হতো একেকটা গানের, সাথে শিল্পী আর ছায়াছবির নামের, সেইসাথে যেসব শ্রোতা অনুরোধ জানিয়েছেন তাদের নাম। অধিকাংশ গানই থাকত এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী ওনাদের। আমিও গানগুলো গাওয়ার চেষ্টা করতাম।

রেডিও শুনতে শুনতে গোসল খাওয়া করতে দেরি হয়ে যেত। মা ভীষণ রাগী ছিলেন, একদিন আমার হাত থেকে রেডিওটা নিয়ে জোরে ছুঁড়ে মারলেন সিমেন্ট-বাঁধানো উঠোনে। রেডিও ভেঙে টুকরো টুকরো। মায়ের উপর ভীষণ অভিমান হয়েছিল সেদিন, জোরে জোরে কেঁদেছিলাম। মা আমাকে জোরে কান্নাকাটি করার জন্য মেরেছিলেনও খুব।

সবার অলক্ষে যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি তো সবই দেখেছিলেন। সেদিনের সেই কিশোরী বা তার মা কেউই হয়তো জানত না, বহু বছর পরে রেডিও নামক এই যন্ত্রটা থেকেই বড় হয়ে সেই কিশোরীর নারীকণ্ঠে শোনা যাবে —

আসসালামু আলাইকুম। সন্ধ্যা সাতটা। আজ মঙ্গলবার। চৌঠা আষাঢ়। ১৪-শাওয়াল। ১৮ই জুন। বাংলাদেশ বেতার। খবর পড়ছি সানজিদা শহীদ।

জীবন এক আশ্চর্য ভ্রমণ!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you